তৃতীয় বর্ষ ।। ঊনবিংশতি ওয়েব সংস্করণ ।। ১৭ পৌষ ১৪২৯ ।। ২ জানুয়ারি ২০২৩
অতিক্রান্ত সময়কে ফিরে পাই না। তবু বার বার ফিরে তাকাই। বুঝে ওঠার চেষ্টা করি, তার কোন অংশটা বাদ গেলে বা পরিবর্তিত হলে আরো সুন্দর হতে পারতো জীবনটা। অথচ প্রতি ক্ষেত্রেই সেভাবেই এগিয়ে চলি। নড়বড়ে করে তুলি জীবনকে।
চলে যায় পুরনো দিন, পুরনো বছর। নতুন বছর এসে কড়া নাড়ে। ছুঁয়ে যায় প্রকৃত জীবন। কল্পনার কলকাঠি জড়ো হয় কল্পনার ঘরে।
কে তুমি, বদলানোর চেষ্টা করে সময়ের নিরেট প্রবাহ, বার বার ভেসে যাও, যেদিকে ভাসতে থাকে প্রবাহিত অজশ্র খড়, শুকনো গুঁড়ি শত শত গাছের?
পাখিরও সকাল হয়। দিন বদলায় আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি পাল্টে দেয় ঋতু তাদেরও। আমাদের মতো শুধু নতুন বছর নেই, নেই হুল্লোড়ের আলাদা কোনো দিন। সূর্য ওঠার আগে আলোর আভাসে শুরু হয় কর্মদিবস। শেষ হয় সূর্য ডোবার পর আলোর আভাসে। কর্মদিবস শেষে উল্লাস, কিচিরমিচির, খোঁজ নেওয়া, ফিরেছে সবাই?
সেখানেই রূপায়িত হয় রাত পেরোনোর পর সূর্য ওঠার আগে শুরু হওয়া কর্মদিবসের যত পরিকল্পনা। প্রতিটা দিবস যেন নতুন বছর। প্রতিটা দিবস তাই মহা উল্লাসের।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
কমলেন্দু সরকার / বিপুল চক্রবর্তী
/ পৌষালী চক্রবর্তী / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / রহিত ঘোষাল / সুজন পণ্ডা / সুবোধ পরামানিক / তৈমুর খান /
______________________________________________
দরজা
কমলেন্দু সরকার
আজ দরজা খুলে রাখব অরণ্যের দিকের
যখন সে আসবে তখন ওদিক দিয়েই আসবে
আমি গেলে ওদিক দিয়েই যাব
তবে যাওয়ার আগে আর একটু দেখে নিতে চাই
নাকি বেঁচে নিতে!
অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে পুরোটা দেখা হয়নি কখনো
তার পোশাকে লেগে থাকা ধূলিকণা উড়ে আসেনি, লাগেনিও।
স্বপ্নের ভিতর জীবন শেষ হয়েছে বুঝি
তেমনই জানান দেয় ইদানীং, সর্ষেখেতের হলুদ...
স্মার্ট ওয়াচ এবং
বিপুল চক্রবর্তী
পাড়ার 'মা দূর্গা স্টোর্স' কিংবা 'আদি গণেশ' পেরিয়ে
হেঁটে যাই যদি নীল-পুকুরের দিকে
গুগুল সে সব কথা, দেখো, ব'লে দিচ্ছে
এমনকী ক-পা হাঁটছি, বা, হাঁটার সময়ে হার্ট-বিট
কখন কেমন
সে কথাও ব'লে দিচ্ছে আমার হাতের স্মার্ট ওয়াচ
যে কোন অচেনা গাছ ফুল পাখি, তাদের নামধাম
যে কোন অচেনা সাইনবোর্ড
সব সব সবকিছু প'ড়ে ফেলছে গুগুল ক্যামেরা
তথাপি দুঃখের কথা এই যে, কোথাও কোনওভাবে
ধর্ষণকারীরা কেউ-ই ধরা পড়ছে না
বরং গ্রেফতার হন অসুস্থ অশীতিপর একজন কবি
পৌষালী চক্রবর্তীর কবিতা
স্বপ্নদোষ
১.
স্বপ্নস্বভাবী সে...
নীড়কাতরতা ফেলে পুরুষ পাখিটি খোঁজে
ময়ূর পাহাড়চূড়া
অলিগলি, ভাঁজ....
কোমর সমান বয়সী শ্রাবণ বিকেলে
শঙ্খচূড় , জলঢোঁড়া সাপের আবাসভূমি যত
হড়পা বানের দেশে পর্যটনপ্রিয়...
জলের অনেক নীচে তবু কার শব? কার শব?
পাতাগুল্ম, জলঝাঁঝি সংকীর্তণ ঠেলে
দগ্ধজিভ ভেসে গেলে চন্দ্রভাগা জলে
বাক্ অবরোধ...
তুমি সে আহত পেশী
ভাঁজে ভাঁজে জমিয়েছ হৃদপিণ্ডে
সহস্রদলসম...
মোহমুগ্ধ তছনছ যত...
২.
জলের স্বভাব ঠেলে ব্রাত্য বিধবা
রাঙনী ফুলের কাছে বন্ধক রাখে
সম্বৎসরের মধুর আকাল...
নিমগাছে লটকেছে অষ্টমীর চাঁদ এক
ডুমুরপাতার মত শীতনিশি
কুয়াশাতাড়ানি গান
সকলেই সঙ্গীনি তার
মাধুর্যরহিত সব পদ্মাকাণী'র চোখ..
অথচ, ভাসানমঙ্গল ছিল, ছিল সব নাগজন্ম
সর্পগন্ধাবনে ধীবররমণী
ছাইয়ের পোশাক ফেলে পাড়ি দিত আদিগঙ্গা
চতুর ডিম্বাশয় ভরে আঘ্রাণের কথকতা
কোথায় শ্মশানঘাট? তিল- তুলসী-মধুবাতা?
হরিণস্পর্শ ভুলে উত্তরীয়খানি
তারকব্রহ্ম জপ
আদিগঙ্গার দিকে আজ লকগেট খোলা
মেঘজন্মে ঢেকে যায় অষ্টমীর চাঁদ, কালপুরুষ
আদিম তিমির ফেটে শুধু গান
ঘেউ,
ঘেউ,
ঘেউ
লুব্ধকের ঘেউ...
পুরুষত্ব
উৎপল চট্টোপাধ্যায়
তুমি ঝিনুক খুলে দেখো
পুরুষত্বের গন্ধ পাবে মাংসে খোলোশে
সুপ্রাচীন লতা গুল্মের ভেতর
দু একটা ম্যাগপাই
তুমি ঝিনুক খুলে দেখো
পুরোনো রাস্তাটির সমস্ত শোকের উপর
প্রতিশ্রুতির আঙুল চড়িয়ে জমছে পারদ
কঠিন বার্ধক্যের কুয়াশায় ছায়া
মিশে আছে বঙ্কিম আলো আর ভাঙা চাঁদ
শিশমহলের চৌকাঠ পেরিয়ে
এমন গর্তের মুখে এখন একটিই পর্দা
ছিটকিনি খুলে
আঃ ! কি মুক্তি
ছত্রিশ ব্যঞ্জনের স্বাদ
তুমি ঝিনুক খুলে দেখো
পুরাতত্ত্বের গন্ধ তোমার
হৃদয়ে জঠোরে
রহিত ঘোষালের কবিতা
১.
নিকোলাই গোগল ও সমগ্র জাতি
তেঁতুল পাতায় সমগ্র জাতি,
ক্রমশ ছুঁড়ে দিচ্ছি জোনাক যাপন।
আমি বেঁচে ছিলাম জাদু সাম্রাজ্যে
অস্তিত্বহীন হয়েছি ফসকানো সুখের
স্মৃতি শহরে।
কাল নয়তো পরশু ছেঁড়া জুতো দিয়ে হবে
মধ্যাহ্নভোজন।
জলখাবার হবে জটপাকানো মুখ থুবড়ে পড়া
ইট-পাথর-ধুলো দিয়ে।
এখানে আয়োজন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনা,
মেয়াদকাল উঁচু-নিচু তবু হয় ছন্দপতন,
মাঝেমধ্যে অবাধ্য নিকোলাই গোগল।।
২.
গাভিন মহজিজ্ঞাসা
পাড়াগাঁয়ের পথে নেমেছে রাত
অথবা ক্ষয়।
লবণের গুহা থেকে শুটকির মাচায় উঁচু নারিকেল বীথিকা,
নরসুন্দর চেয়ে থাকে খুরের দিকে,
জালকে যুদ্ধাস্ত্র ও দীর্ঘশ্বাসের কাদায় মাখা
উৎখনন থেকে বিস্ময় ঘেরা পান্ডুলিপি।
এই প্রাচীন দৈব গ্রাম পদ্মাগর্ভে বিলীন
হয়েছে,ভাটফুলের ঘুঙুর আবিষ্কার করে
গোরস্থান,গাভিন সূর্যলোক,
মহাজিজ্ঞাসা।।
৩.
আরম্ভ
অজানা সময় ধরে এই পথেই যারা হেটেছে,
যাদের থাবার ছাপ পাহাড়ের টিলায়,ভূমিরূপে জেগে আছে। জীবাশ্মে যাদের অভিপ্রায় ক্ষোদিত থাকবে।
মৃগয়া ভূমে তাদের দামামা, ধামাসা-মাদল এখন ক্ষীণ।
উপবাসে থাকা সব নক্ষত্রপুঞ্জ, ক্ষীণালোক, নিরালোক তাদের আকাঙ্খা আখরে ভবিষ্যত প্রসব করে।
প্রত্যেক লাফে লাফে, ছেটে ফেলা লেজে লেজে আমাদের উপজনন ।।
অর্ধেক অর্ধেক
সুজন পণ্ডা
অর্ধেক পৃথিবীতে নামলো আঁধার।
পৃথিবীর অর্ধেক পাখী, উদ্ভিদ,
অর্ধেক আকাশ, ঘুমিয়ে যেতে যেতে
তুলে ধরলো আধখানা চাঁদের নিশান
এবং অসংখ্য জোনাকি ফুল।
শাপমুক্তির অঙ্গীকার।
বাকী অর্ধেক পৃথিবী
আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে
নেমে এলো আলোর উঠোনে।
আলো আর আঁধারের এই
অসমবন্ট
অর্ধেক পৃথিবীর জন্য
আরেক অর্ধেকের উপহার
অজুহাত
সুবোধ পরামানিক
তোমার অজুহাত এবং জুজুহাত জড়ো ক'রে দেখা
সর্বত্রই কেবল আমিষ আমিষ গন্ধ বেরুচ্ছে
তা তুমি যতই হাত ধুয়ে ফেল না কেন
গন্ধ কিছুতেই যেতে চায় না আর।
পদ্ম পাতার টলমল জলে ধুতে চাইলেও
তোমার চার হাত জুড়ে লেপ্টে থাকে
নিশিপদ্মের আঠা, আমিষ গন্ধ।
এবার তোমার দুটো হাতে
দুটো মেরু চেপ্টে যেতে যেতে
রসাতলে ঢুকে পড়তে চাইছে।
সামাজিক ও মানবিক প্রেক্ষাপটে কবির দায়বদ্ধতা
তৈমুর খান
সামাজিক ও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকেই প্রতিটি কবির উত্থান সূচিত হয়। যদিও কবির ব্যক্তিজীবনের শূন্যতা বড় হয়ে ওঠে কবিতায়, যদিও ব্যক্তিজীবনের অবদমনের ভাষাকেই তিনি রহস্যময় কবিতায় ছায়াপাত ঘটান, তবুও সেই ব্যক্তিজীবনই নৈব্যক্তিক সমষ্টি চেতনায় যূথবদ্ধতার পরিচয় দেয়। কেননা ব্যক্তিজীবনের সমষ্টিই সমাজজীবনের আধার। আবার সমাজজীবনই আবহমান মানবজীবনের তথা মানবসভ্যতার পরিচয় বহন করে। একজন কবি কখনোই তাঁর সময়কালকে উপেক্ষা করতে পারেন না। তাঁর সমাজজীবনের অবনমন অথবা উৎকর্ষ তাঁকেও স্পর্শ করে। সমাজের অবক্ষয়, অথবা সংঘাত যে মানবজীবনেরও অন্তরায় এবং সংকট ডেকে আনে তা বলাই বাহুল্য। ১৯৪২ সালের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। নিরাপত্তাহীন জীবনে স্বপ্নভঙ্গের অভিশাপ নিয়ে তিল তিল করে তারা মৃত্যুকে উপলব্ধি করছিল। সেই অন্তহীন অনিবার্য উদাসীনতাকে 'সাতটি তারার তিমির' কাব্যের 'বিভিন্ন কোরাস' কবিতায় জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন:
"নিকটে মরুর মতো মহাদেশ ছড়ায়ে রয়েছে :
যতদূর চোখ যায়— অনুভব করি;
তবু তাকে সমুদ্রের তিতীর্ষু আলোর মতো মনে ক’রে নিয়ে
আমাদের জানালায় অনেক মানুষ,
চেয়ে আছে দিনমান হেঁয়ালির দিকে।
তাদের মুখের পানে চেয়ে মনে হয়
হয়তো বা সমুদ্রের সুর শোনে তারা,
ভীত মুখশ্রীর সাথে এ-রকম অনন্য বিস্ময়
মিশে আছে ;—তাহারা অনেক কাল আমাদের দেশে
ঘুরে–ফিরে বেড়িয়েছে শারীরিক জিনিসের মতো;"
মরুর মতো মহাদেশকে সমুদ্রের তিতীর্ষু আলোর মতো মনে করে নিয়ে আসন্ন ধ্বংসময় জীবনবোধকে যারা স্বপ্নের জানালায় দেখতে চেয়েছে, জীবনানন্দ সেইসব মানুষদেরই উপলব্ধি করেছেন। তাদের চেয়ে থাকা হেঁয়ালির মতো মনে হলেও হয়তো সময় পরিবর্তনের অপেক্ষায় রয়েছে তারা। ভীত সন্ত্রস্ত মুখের সঙ্গে তাদের আশ্চর্য হওয়ার রূপটিও ফুটে উঠেছে। মানবশরীর ধারণ করলেও অর্থাৎ তারা জীবন্ত হলেও 'শারীরিক জিনিস' অর্থাৎ আবেগ ও স্বপ্নশূন্য অনুভূতিহীন বস্তুর মতো। আরও পড়ুন
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পেন্টিং, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
ভাল লাগল। বেশকিছু কবিতা বেশ ভাল লাগল। শ্যামলবরণের ছবি মুগ্ধ করে
উত্তরমুছুন