তৃতীয় বর্ষ ।। বিংশতি ওয়েব সংস্করণ ।। ১ মাঘ ১৪২৯ ।। ১৬ জানুয়ারি ২০২৩
কত মানুষের মুখোমুখি দাঁড়াতে হলো কয়েকদিনে। কত মানুষের মননের কাছে হার মানতে হলো। অস্ফুটে, নত মস্তকে স্বীকার করতে হলো আমার এই অপারগতা। চলন নিতান্তই মন্থর সে এক অন্য জিনিস, আর ঝরা পাতার সামনে দাঁড়ানো সে এক অন্য। ঝরা পাতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি যদি বলতে পারি, আরও কয়েকটা দিন বৃন্তের মধ্যে থেকে যাওয়ার কথা; অবশ্যই অক্সিজেন দেবে সেও। সেও চেষ্টা করবে সবুজ হয়ে থাকতে। বাড়াতে প্রবাহ শিরায় শিরায়।
পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখতে রাখতে এক সময় দূরেই চলে যাই আমরা। চলে যাই নাগালের বাইরে। তারপর শত চেষ্টাতেও নাগাল পাই না। এ এক দুর্ভাগ্য। কিন্তু হঠাৎ করে যখন অনেক মনের মানুষ সামনে এসে যান সেই দুর্লভ মুহূর্তটা যে কেমন বিস্ময় জাগায় তা না ঘটলে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। সেই মিলন ক্ষেত্র টুসুমেলা হতে পারে। হতে পারে লিটলম্যাগ মেলা অথবা "অনুবর্তন"-এর এক নিতান্তই ঘরোয়া আড্ডা।
ভালোবাসা মানুষকে বাঁচতে শেখায়। কিন্তু সেই ভালোবাসাকে কে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবেন তা কে কাকে শেখাবেন? সে তো নিজে নিজেই পরিচালিত হয়ে একটা গন্তব্যে পৌঁছে দেয় আমাদের। আর আমরা তা মেনেও নিই বাধ্য করে। তবে কি ভালোবাসার ডোর সত্যি সত্যিই বাঁধা আছে অন্য কোনো ঘাটের অন্য কোনো নৌকায়?
আমাদের অনিকেতের বন্ধু সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের মা স্বর্গ লোকে পাড়ি দিয়েছেন। অনিকেতের বন্ধুরা তাঁর আত্মার মঙ্গল কামনা ক'রে তার পরিবারের সবাইকে জানায় আন্তরিক সমবেদনা।
উত্তম মাহাত , সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া / ফজলুররহমান বাবুল / তপন পাত্র / সুশান্ত সেন / সঞ্চিতা পাত্র / ফণিভূষণ মণ্ডল / দেবাশিস সরখেল / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / উৎপল দাস / মধুপর্ণা
______________________________________________
নিঃসঙ্গতার ছবি
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
নিঃস্বঙ্গতার ছবি পাঠিয়েছিলে?
গত চিঠিতেই ছোট দুটি স্কেচ,
দ্রুত হাতে যা এঁকে তোলার সময়
তীক্ষ্ণ আর উঁচু হয়ে ছিটকে গেল রঙ
মায়া করতো না বলো?
স্থির মোমবাতি দেখে পড়শীরা ভয় পেতো খুব
জানতো না দেওয়ালের ওপাশেই
গোল হয়ে ঘুরছে কয়েদিরা
তারারাও ঘুরতে ঘুরতে দমচাপা মেঘ নিয়ে আসে
ঢিমে আঁচে পুড়ে পুড়ে চারকোল রাত
পাইপে ছাই হয়ে ঝুলে থাকে
তুলিরা ঘুমোয় না তবু
মোটা দাঁড়ার ব্রাশে রঙ থুপে থুপে
পুরনো চেয়ারের শুধু দুপুর হয়ে আসে
সম্পূর্ণ গমখেত জুড়ে সেই এক ফ্রেম
ক্যানভাসে গড়িয়ে পড়া নির্জন হলুদ জানে
ইজেলের মুখোমুখি হাল্কা স্ট্রোকে
শব্দের ফুলকি আঁকলে যেই
দিগন্তে ছোপ লেগে গেল!
শূন্যতার স্তুপে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালে এবার
এই তবে ছবি..?
ল্যান্ডস্কেপ জুড়ে এই ফাঁকা?
চোখ খোলো,তাকাও,সোনালি-হলুদ খড়
ভিজে যাচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা রঙের মায়ায় দ্যাখো
তোমার সূর্যমুখীরা একসাথে আলো জ্বেলে দিলো...
ফজলুররহমান বাবুলের কবিতা
১.
আক্ষেপ
রাস্তার পাশে দুটি সাদা গোলাপ
হেসে উঠলে রাস্তা শুনতে পায়—
রাস্তার কালো পিচ দেখতে পায়
গোলাপের মহিমা...
কালো পিচের বুকে শক্ত পাথর—
পাথর গোলাপ হতে পারে না!
২.
মানুষ, আকাশ
আমরা যদিও মানুষ...
আকাশ বলছে—
যেন তাকে বুকে রাখি...
মানুষ কি এতটা উদার হতে পারে?
মানুষের বুকে কত পাহাড়
মরা নদী, খানাখন্দ...
আর
আকাশ আছে
সাইবেরিয়া কিংবা কারাকোরামে
আছে আটলান্টিকের উপরে
আছে বাংলায়, বঙ্গোপসাগরে...
মানুষ কি আকাশ থেকে বড়ো?
তপন পাত্রের কবিতা
মরমে মরণ মিছে
১.
এখানে প্রেম আসে না আশেপাশে,
সবাই তবু প্রণয় পেতে চায়,
ভেবো না কেউ কাউকে ভালবাসে।
না পেলে জীবন হদ্দ, হায় হায়!
উজাড় করতে ভুলেছে মানুষ,
কৌশলে চায় নিজ ইন্দ্রিয় সুখ।
মরে গেছে প্রেম,জেগে আছে কাম,
প্রণয়পুরীতে নির্ব্যূঢ় অসুখ।
মুঠো না খুললে মুঠি ভরে কবে
সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর এবং কলি,
ভালোবাসি--এই মিথ্যে কথা-প্যাঁচে
শরীর দিয়ে ভালোবাসতে বলি।
২.
শুনেছি তোমার মাইনে অনেক,
মাস পোহালেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
ঘোড়ার মতোই বীর্যদীপ্ত তুমি,
পরিকল্পিত কায়াজালে তাই ঢাকা...
প্রেম মায়া টায়া ওসব বুঝি না
দেবো আর বুঝে নেবো নিত্য সুখ।
অনাদি কালের যুগল স্রোতে ছোঁ,
মিথ্যে ভালোবাসায় টলে না বুক।
পেয়ে গেলে ঠিক সতী ও সাবিত্রী
খামতি হলে সে-ই কুলটা নারী।
"হৃদয়" --বড়ো ব্যাকডেটেড কথা
যৌবন কি বিফলে ঘুচাতে পারি !
সকাল
সুশান্ত সেন
সকালে জেগে উঠা সকালে খেলাঘর
সকালে শোনা যায় পাতার মর্মর ,
সকাল হাসিখুশি কিছুটা ভালো লাগা
প্রেমের কুয়াশায় কিছুটা রাতজাগা ।
আমোঘ নিয়তি পরেই চলে আসে
জীবন জাতাকল নীরবে শুধু হাসে ,
বেলা টি বাড়লেই কাজের কথা গুলো
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে , উড়ায় বড় ধূলো।
তখন কবি গুলো করে না বেয়াদপি
মুখটা গোমড়া সেজেছে বহুরূপী ,
বাঁচতে গেলে যে টাকাটা দরকার
এরূপ ভাবনায় জীবন ছারকার।
ছায়রা
সঞ্চিতা পাত্র
একটি টেবিল ও চার-পাঁচজন।
একটি গম্ভীর আলোচনা। কয়েকটি অর্ধসমাপ্ত চায়ের কাপ।
এরকম বিষয়ী প্রেক্ষাপটে,
কখন টুক করে ঢুকে পড়েছে দুই পঞ্চম শ্রেণি।
'ফুটবল চাই।'
একজন বলে উঠল, 'খুব রোদ'।
আরেকজন,' সবসময় খেলা ভালো নয়...'
তৃতীয়জন বলল, 'এখনো প্রথম প্রহরের ঘণ্টা পড়েনি।'
শেষজন হাসি-হাসি মুখে তাকাল শুধু।
এগারো-বছর-বয়স করুণ মুখে বলে ফেলল, 'রোদ নেই ত, ছায়রা আছে'।
'ছায়রা!...না, ছায়ারা?...',
তুমি সংশয়াদীর্ণ হলে।
ইতিমধ্যে, মারাদোনার ড্রিবলের মত ফুটবল গেছে বেরিয়ে…
পোষা বেড়ালের মত গা ঘষছে পায়ে আর চকিতে গড়িয়ে যাচ্ছে সবুজ ঘাসে।
আকাশে টুকরো মেঘের ছায়রা সরিয়ে থেকে থেকে হেসে উঠছে হেমন্তের রোদ...
মায়াহীন মঞ্চ
(মায়া ঘোষের স্মরণে)
ফণিভূষণ মণ্ডল
তুফানীর পদধ্বনি হঠাৎই থমকে গেল ঊনআশির এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় —
বেলা অবেলার গল্পগাছা ফেলে মায়াহীন মঞ্চের নেপথ্যে !
হে আপোসহীনা — জীবনে ও নাট্যে
কোনও অভিযোগ ছিল না আপনার নির্লিপ্ত দু-চোখে,
বরং অনেক স্বপ্ন ছিল মায়াময় মুখের গভীরে —
যদিও বড়ই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন শেষ দু-তিন বছরে।
কিশোরী বয়সে নাট্যের চৌকাঠে পা রেখে
আপনি যে আর ফিরে যেতে পারেননি গড়পড়তা জীবনে !
জড়িয়ে পড়েছিলেন মঞ্চের প্রগাঢ় মায়ায় —
আর মঞ্চই হয়ে উঠেছিল আপনার জীবন।
জীবন থেকে মঞ্চে ও মঞ্চ থেকে জীবনের সহজাত দক্ষতায়
পাড়ার থিয়েটার থেকে গণনাট্যে
কিংবা গণনাট্য থেকে গ্রুপ থিয়েটারে — আপনার যাতায়াত ছিল অবাধ।
তবুও থিয়েটার-অন্ত মায়াময় প্রাণের অবিরাম চলাচলে
কখনও বাধ সাধেনি আপনার আদর্শ, বরং দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন
একুশের ঘুন-ধরা বঙ্গরঙ্গের গড্ডালিকায় গা ভাসানো নাট্যকর্মীদের কাছে
আপনার আপোসহীন থিয়েটারি যাপনে।
সংসার চালানোর দায় ছিল বটে,
তবুও মুখ ফুটে রোল চাওয়ার কোনো গরজ ছিল না আপনার — টিভি কিংবা সিরিয়ালে।
অথচ প্রতি মাসে আপনি আড়াই হাজারে চালিয়ে নিতেন কী অনায়াসে !
মায়াহীন মঞ্চে আর কোনদিন ভেসে আসবে না রাজরক্তের সেই মেয়েটির মায়াময় সংলাপ :
“অনেক দিন বাঁচবো, চেষ্টা করে সুন্দর করে বাঁচবো — এটা অনেক বড় সত্য বুঝলে ?”
অমিতাভ জানে
দেবাশিস সরখেল
রাজহংসের পাখনা সম্বল
ডিম নয়, কন্ঠের ক্রন্দন নয়।
প্রাসাদ সাজানোর তালে রাখে কেউ কেউ।
রাজহংসীরা যায় না তো আর ভোরের ইস্কুলে।
লুকোনো ঝরনায় ডানা খুলে
অমৃতসিনান সারে যারা
পরি বল তারে
রাজহংসি তো নয়।
প্রস্থানের সময় প্রকৃত বিরল দৃশ্য
সূর্য তোমায় লাফ মেরে ধরে।
তুমি তো তোমার ডানা
যত নামখানা, স্থলিতবসনা জল
উড়তে উড়তে পুড়তে পুড়তে অন্তরপ্রদেশে বাড়ে
কুশিনগরের গ্রামে প্রশান্ত নিলয়ে।
ভিক্ষুর অন্তরে প্রকৃত নির্বাণ জাগো নিরন্তর।
গতিশীল
উৎপল চট্টোপাধ্যায়
মৃত তারার কোলে পায়রার বসতি
ঝিরঝিরে হাওয়ার ভাঁজবিহীন শরীরী উত্তাপে
আমার পুরুষ হৃদয়
রক্তে শর্করা ইসনোফিল
হিমযুগে আটকে যাওয়া কিছু স্বপ্ন
এখনও ছুঁয়ে আছে খাট
শব্দহীন আস্ফালনে তার ইথার সংকেত
শীতলতা জড়িয়ে নষ্ট সময়ের কিছু
স্বগতোক্তি ঘ্রান
দিগন্তে নেমে গেছে গন্তব্যহীন শূন্য দুপুর
পথিক জানে পায়রার স্নান
পথ চেনে বেশ্যার ঘর
নড়বড়ে কার্নিসে তবুও শ্যাওলা বিষ
আর ইটের ক্ষত ভেঙে ভেঙে
কবেকার সেই লৌহযুগে তারাখসার সন্ধান
তবু আজও গতিশীল পথ
আজও পায়রার বসতি
বাহাদুর
উৎপল দাস
বাহাদুরের হুইসেল বাজছে এখন
তোমার ঘুমঘুম চোখে কবিতা।
এদিকের শুরু থেকে
ওদিকের শেষ মাথা__। সারা গ্রাম ঘুরে
পাহারা দেয় সে।
কারও একঘুম, কারও দু'ঘুম
কেউ আমার মতো জেগে আছে।
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে
গোটা গ্রাম আগলে রাখে বাহাদুর।
শ্রীসদনে দৈনন্দিন - ২
মধুপর্ণা
স্মৃতির উত্তরাধিকার এক অদ্ভুত বায়বীয় বাস্তব। শ্রীসদনে যে ছাত্রীরা থেকেছেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম বেশকিছু মাস যাবত৷ স্মৃতির সাঁকো বেয়ে একটা সামগ্রিক ধারাবাহিকতার ছবি দেখার ইচ্ছায়। রবীন্দ্রসমকালে এবং পরবর্তীতে ছাত্রীদের শান্তিনিকেতনবাস এবং আবাসজীবনের স্মৃতি বিষয়ে বইপত্র বিস্তর। যাঁরা বিগত তাঁদের কথা সেইসব বইপত্র থেকে জানা গেছে। কিন্তু যাঁরা বর্তমানে রয়েছেন এবং একটা সময় কাটিয়েছেন শান্তিনিকেতনে, শ্রীসদনে তাঁদের কাছ থেকে জীবন্ত মণিমাণিক্য মিলেছে বহু। শ্রীসদনের আাবসিকাদের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আবাসজীবনের প্রসঙ্গে একটা উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে তাঁদের মুখের মনিটরে, কথায়, স্বরে। অপরিচিত তরুনী নিমেষে চেনা হয়ে যায়, বিচিত্র গল্প বলে যান সহজেই। সেইরকম এক কথোপকথন থেকে কিছু অংশ … আরও পড়ুন
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : এ রামচন্দ্রন ও থোটা ভৈকুন্টম-এর পেন্টিং, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
কাব্য-সাহিত্যপাঠে মননে যে-বিক্রিয়া ঘটে তা' তো সামান্য মন্তব্য প্রকাশের অধীন নয়; তাৎক্ষণিক সুখবোধের উচ্ছ্বসিত ভালবাসা; স্বল্প পরিসরে তা'র রসায়ন ক্রমশ প্রকাশমান ঘটে; ভাল লাগা, এবং ভালবাসা যুগপৎ রসায়নাগারে মহাবিস্ময় ; বিমূঢ় হয়ে পুনশ্চ 'অরন্ধন'-এর অপেক্ষয় থাকা
উত্তরমুছুন