চতুর্থ বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ ।। ২২ মে ২০২৩
বাংলার অরাজকতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বহুকাল আগেই। এখন তা একেবারেই চরম। সমস্ত রকম ভাবে মানুষকে ঘিরে ধরার এই পন্থা এর আগে চোখে পড়েনি। একেবারেই নিচের সারিতে থাকা মানুষের কাজ ছিনিয়ে নেওয়ার এ এক নজিরবিহীন ঘটনা।
বলতেই পারেন, এ আবার কেমন কথা?
সোজা করে বলতে গেলে, নগদে ট্রাক্টর কেনার ক্ষমতা গ্ৰামাঞ্চলের এইসব সাধারণ মানুষগুলোর থাকে না। ঋণ ধার করে খানিকটা জোগাড় করে বাকিটা কিস্তি রেখে নিয়ে আসে গাড়ি। ভাবনা থাকে, খানিক মাটি, খানিক বালি বা ইট ফিট চালিয়ে শ্রাবণে লাঙ্গল চালাবে। পাঁচ সাত বছরে কোনোমতে কিস্তি শোধ করে নিজের হবে গাড়ি। তারপর দেখতে পাবে দু' এক টাকার মুখ। কিন্তু সেইসব কর্মকাণ্ড একেবারেই বন্ধ। অনুমতি নেই বালি তোলার। অনুমতি নেই মাটি খোঁড়ার। কি করবে গ্ৰামের মানুষ? সরকারের দেওয়া সামান্য নজরানাতেই বুঝি সাঙ্গ হয় সংসার খরচ?
বালি তোলার অনুমতি না থাকায় বন্ধ নির্মাণ কাজ। রাজমিস্ত্রি, কুলি, কামিন সকলেরই কাজ বন্ধ। নিজের বাড়ির জন্যেও নিজের ট্রাক্টরে করে বালি তুলতে গিয়ে ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ২০ - ২৫ হাজার। আর ঠিকানায় পৌঁছে গেলে মালিকের জেল হাজত। গাড়িতে বেরোতে পারে গাছও। তাহলে কিস্তি পরিশোধের উপায়? না, বাড়িতে আছে যদি কিছু। তা দিয়ে কয়েকটা মাস। তারপর টেনে নিয়ে যাবে গাড়ি। হয় পুলিশ না হয় কিস্তিওয়ালা। গাড়ি, শেষমেশ যাবেই মামাবাড়ি।
মানুষের কর্ম ছিনিয়ে নেওয়ার রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে। আর কত পিষ্ট করতে পারলে শান্তি পাবে এরা? আর কত...
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
অমিত মণ্ডল / অয়ন জোয়ারদার / পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় / দুর্গা দত্ত / সুজন পণ্ডা / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / শুভজিৎ চন্দ / ময়ূখ দত্ত
______________________________________________
একদিন, এক এক দিন, প্রতিদিন
অমিত মণ্ডল
১.
সমস্ত কিছুর জন্য প্রস্তুত হতে হয় একদিন।
দরজার বাইরে একদিন আগুনের সামনে হাত পেতে দাঁড়াতে হয়।
দাঁড়াতে হয় শূন্যতার মাঝেও।
তুমি শুধু সেই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থেকো।
এই যে আমি ছেঁড়াখোঁড়া স্বপ্ন নিয়ে বসে আছি ভাঙা দুপুরে একলা
এরকম একলা থাকতে থাকতে থাকতে থাকতে বুঝতে পারি
কত মানুষ শুধু ভালোবেসে ফুরিয়ে গেছে একদিন।
একদিন সমস্ত কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়।
২.
এক এক দিন নিজের সঙ্গে কথা বলি একান্তে
এক এক দিন পুরোনো ডায়েরির পাতা ওল্টাই
এক এক দিন প্রিয় বন্ধুদের চিঠিপত্র হাতড়াই।
আলো খুঁজি।
এক এক দিন কিছুই করি না
শুধু বেঁচে থাকা নিয়ে বসে থাকি সারাদিন
দিন চলে যায়।
৩.
যা কিছু খুঁজে পেতে চেয়েছি এতদিন
পাওয়া যায়নি কিছুই।
শুধু তাচ্ছিল্য, অপমান আর অসূয়া।
তবুও মনে হয়—
ভোরের আলো আর সরু গলির অন্ধকার ভোলেনি আমাকে।
একদিন হয়তো বন্ধুরাও বলবে—
চল, বেড়িয়ে আসি ক'দিন জয়ন্তীতে।
প্রতিদিন প্রতিটি সম্ভাবনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করি।
অয়ন জোয়ারদার
চিত্রপট পটচিত্র
আমার হাড়গোড় আর মাংস দিয়ে ফসল ফলে?
জল সমেত রক্ত ছিটিয়ে ফুল আনা যায় গাছে?
জ্যান্ত কালের ইচ্ছেগুলোকে সুস্বাদু সব ফল।
তবে আমার কোষানু দিয়ে তৈরি কর ক্ষেত, বাগান…
বাগানবাড়ি থাকবে তাতে? - রেখো।
যারা যাঁরা স্বপ্ন কখনও দেখেনি, তাদেরই কেবল থাকতে দিও।
ক্ষত দিয়ে বানিয়ে রেখো একটা সরু ডোবা -
সন্ধ্যাতারা দেখা দিলেই ডুব দেবে সব স্বপ্নহীন।
সকাল সন্ধ্যা, দুপুরবেলা, আলো কালো, হিমেল রাত সব তোমাদের।এসব ,সবই ভোগ করো তোমরা সবাই, সবাই মিলে -
আমায় দিয়ে সবুজ ফসল, সফল গাছ, একটা কেবল বাগান বাড়ি, তারই পাশে সরু এক ক্ষত ডোবা..।
তিনটি কবিতা
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
কুবলয়
প্রতিবিম্ব ও নিয়তাকার মিলে তৈরি হয় 'প্রতিনিয়ত'
প্রতিনিয়ত সৌরদিনের ধুলো
একেকদিন চান্দ্র রাতের বিদেহী জলে কুবলয়
ফুটে ওঠে শূন্য কলসের মুখে....
ধর্মাধর্ম
আজ স্বপ্নে দেখি অনেক অনেক আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে কে যেন ফেলে রেখে গেছে বাঁট-খোলা কোদাল; ঘাস থেকে উত্থিত বাষ্পে বাসমতি-সুবাস
একদিকে ওই ভুলো মন অন্যদিকে এই মহামতিত্ব
কারোরই ধর্মাধর্ম জানি না ।
বিসর্জন
ঢেউ-খেলানো জলের বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে এক আদি দেব ও এক আদ্যাশক্তি স্বরূপিণী। তবু মনে হয় এই ভাসান নাবালক ও নাবালিকা....
নানা সুতোর আঁচল
দুর্গা দত্ত
১.
ঘোমটা
কেউ কেউ বৃষ্টিগান জানে।
কেউ জানে শ্রাবণপূর্ণিমা।
কেউ কেউ জীমূতবাহন ব্রত শেষ করে
অক্লেশে ডিঙিয়ে যায় দূরের শ্মশান --
রেখে আসে হাতে গড়া শেয়াল শকুন।
কেউ কেউ উতরোল তুষুর ভাসানে।
কেউ কেউ ডুবে থাকে ভাদুর পার্বণে।
কেউ কেউ সুবচনীব্রতে, ছটে, পুণ্যিপুকুরে ...
সবারই পায়ের পাতা মায়ের মুখের মতো
দূর্বাদলে ঠাণ্ডা ভেজা ভেজা।
সারাটা জীবন ধরে শব্দহীন হেঁটে যায়
লক্ষ্মীমন্ত সুশীলা চলনে।
সবারই পায়ের নিচে সহস্র কণ্টক
শরের শয্যায় কাটে রাত …
আলতা ক্ষরণের কথা তবু
মুখ ফুটে কেউ কাউকে কখনও বলে না ...
২.
গন্ধ
রাত শেষ হলে শুধু দিনই আসে না ,
রাতও ফিরে ফিরে আসে।
দিনের ভেতরে রাত, রাতেরও ভেতরে রাত, দিন ...
ফিরে আসে বড়ো রাস্তার বাঁকে সরু সরু গলিমুখ --
বিন্দু বিন্দু দানা সহ আফগান স্নো
কাশীর সুগন্ধি জর্দা, সস্তার আতর
রাতবিরেতে ঝলমল চুমকি আঁটা লাল লাল ঠোঁট
আমার মায়ের।
ফিরে আসে সকাল হলেই
মায়ের দুচোখে ধ্যাবড়া ঘুমের কাজল—
সকাল হলেই
মায়ের আঁচল জুড়ে গন্ধময় রাত ফিরে আসে।
৩.
ধাইমা
থানের কোচড়ে ক'টি গাঁদালের পাতা
দু চারটি সুসনি শাক নিয়ে
মাথায় শননুড়ি
কোমর পড়ে যাওয়া
শ্রীমতী বাউরি
আমার থুতনি ধরে দাঁড়ায়
থুরথুরে ধাইমা আমার
কতো যুগের ওপার থেকে
মায়ের গন্ধে আকাশে রামধনু ওঠে
ঘুমিয়ে পড়ি আধময়লা থানের আড়ালে
৪.
মা : এক
ছিল না সমুদ্রকথা ঝড়ে জলে ঘরে ও সংসারে
ছিল না নদীর মুখ শীতে গ্রীষ্মে চাদরে গামছায়
বহুলচর্চিত কোনো প্রত্নলেখ সুতনুকা বিভা
ছিল না কোথাও, তবু জল ঢোকে চৌকাঠ ডিঙিয়ে
এরকমই হয় হয়তো, এ'রমই তো বলতে শুনেছি
অশ্বিনী ভরণী থেকে উত্তরভাদ্রপদ ও রেবতী
সবাইকে ডেকে তুলে একে একে সাজিয়েছে সাতাশ প্রদীপ
তবু আলো ফোটেনি আকাশে, ঘর জুড়ে ভূতচতুর্দশী
এরকমই হয় হয়তো, সবাই তা ভালমতো জানে
আমি ও তো জেনেছি সহজে শালপাতা কুড়োতে কুড়োতে
এরকমই হাতে পায়ে ধুলো ও কাদাতে
আমাদের জন্মদিন স্নেহ ও শুভেচ্ছাহীন, পায়েসবিহীন বহুকাল
মায়ের আঁচল নাকি কপর্দকহীন শুকনো হাওয়া
বাজারের পথ মা'কে মেপে নেয় নিক্তিতে নিক্তিতে
কাঁথার আড়াল থেকে আধবোজা চোখে দেখি রাত বেশি হলে
ঘরে ফেরে ধ্বস্ত আলু, ধ্বস্ততর বিলাতি বেগুন
কষ বেয়ে রক্তরেখা দুচোখে ত্রিশূল প্রতিদিন
প্রতি রাতে থই থই ভেসে যায় ঘরের চৌকাঠ
৫.
মা : দুই
দেওয়ালে খড়িমাটি , গোবর নিকানো উঠোন
বিকেলে নারকেল নাড়ু খই মুড়ির মোয়া ...
মায়ের হাতে ঘোরে ছোট মেয়ের মুখ
৬.
মা : তিন
বোধনের কাঠি
কল্কাপাড় সন্ধে মনকেমন
ছোট মেয়ে এই এলো বলে ...
আগমনী ফুরোলো না।
মা'র কানে দশমীর ঢাক
৭.
মা : চার
ঢোকরার পাই কনা
বাঁধা দিয়ে দশ আনা
আঁচলে তণ্ডুল । মা গো ! মাহ ভাদর !
শূন্য মন্দির তোর , এ ভরা বাদর…
৮.
মা : পাঁচ
মা মাড়ুলি দেয় ভোরের আভায়
সদর দরজার সামনে দোকান দাওয়ায়
জলে ও গোবরে খুব ঘন করে গোল গোল করে
মাড়ুলি দিয়েই চলে শিবথানে আটচালায়
ওলাইচণ্ডীর থানে মনসাতলায়
মায়ের কপাল থেকে সিঁদুরের টিপ
উঠে পড়ে পুবের আকাশে —
প্রতি ভোরে ঠিক ঠিক মাড়ুলি যেমন
৯.
মা : ছয়
ঘুমোনোর আগে প্রতি রাতে এখনও যে
চুপিচুপি শুনি
দীর্ঘ রাত গিলে নিয়ে
মা বাবাকে ফিস ফিস : -
শালের পাতায় নুন দিতেই হলো না
আমার চোখের জলে ভাত মেখে খেয়ে গেলে
সারাটা জীবন
১০.
মা-গো
ট-এর টিকি দিইনি, পেট কাটিনি মূর্ধন্য-ষ এর
ধ-এর শুঁড় ছিল না , র-এর ফুটকিও ...
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মায়ের দুচোখে ছিল
কোজাগরী চাঁদ --
মা আমার কিছুই বলেনি।
সারামুখে আলো নিয়ে সাতসকালে বসেছিল উনুনের ধারে।
মুড়িভাজা শেষ হলে তেলমুড়ি গরম গরম
ছেলেকে খাওয়াবে ---
ছেলে তার অ-আ-ক-খ শিখে গেছে সেলেট পাথরে।
এরপরে নাম লিখবে বাবা মা'র, ভাই ও বোনের,
চিঠিপত্র লিখে দেবে পাড়ার লোকের,
লেখাপড়া শিখে হবে বড়োলোক ,
বড় সড় লোক।
কতযুগ আগে , সেই মুড়িভাজা-খুশি-খুশি মুখে
আগুনের আলো নিয়ে ঠিক ভুল কিছুই না বুঝে
নির্বিকার চলে গেছে
আমার এই চিরকেলে নিরক্ষর মা--
বলাই হয়নি , মা গো , কারো কোনো কাজেই লাগিনি --
আলোহীন ছাইপাঁশ ঘেঁটে ঘুটে অক্ষর বুলিয়ে
কাটালাম এতটা জীবন --
বলাই হয়নি , মা গো !
আমার অক্ষর জ্ঞান এখনো হয় নি তোর
স্বপ্নদেখা কোজাগরী আলোটির মতো !
মৌন শূন্যতা
সুজন পণ্ডা
নির্বাক নিঃসঙ্গতা এক শুধু
চরের পর চর
বসতির পর বসতি
চাঁদের সুস্থীর আলোতে- অজস্র
নক্ষত্রের আগুন
যেন বা মৃত বোয়ালের চোখ।
যেন শব্দহীন ইথার সমুদ্র।
অগনন শরীর-
জোয়ান অথবা ভগ্ন দেহ শত সহস্র
তবুও মানুষ নেই
তবুও হাত নেই কোনো
যা ধরে পেরিয়ে যাওয়া যায়
শীর্ণ সাঁকো।
নির্বাক নিঃসঙ্গতা এক শুধু ।
মৃত নয়
আহত নয়
অস্বাভাবিক মৌন এক শূন্য শুধু।
স্বতন্ত্র দূরত্বে ছড়িয়ে
সম্পর্কের শীত
প্রেমিক, প্রেমিকা, বন্ধু, আরো কত....
তীর বিদ্ধ শিকারের মত সবাই
নিজের আঘাতে আঘাত রাখে
আরো হাজার বছরের দুরত্বের সংকল্প।
রোগ নয়
অসুখ নয়
নির্বাক নিঃসঙ্গতা এক শুধু
নির্বাক নিঃসঙ্গতা এক শুধু ।
তোমার চোখের সীমান্তে
উৎপল চট্টোপাধ্যায়
তোমার চোখের সীমান্তে এসে
শেষ হয়ে গেছে পথ
রাত্রিকে প্রশ্ন করি
তার বয়সের পরিসংখ্যান জানতে রোজ
নিজেকে দগ্ধ করি বিছানায়
এতো জল ! এতো নুন !
কি করে সাগর ধরেছে বুকে?
তোমার চোখে পলক পড়ে
আমিও সাগরের অতলে ঝাঁপ দিয়ে
পাগলের মতো সন্ধানে মেতে উঠি
পাগলিনী তুমিও,
আর বাকি টুকু মিথ্যাচার ধরে নিলে
এখন তোমার শয্যার বুকে প্রতিদিন
জেগে থাক আরও একটি বালিশের
নিষ্ক্রান্ত শূন্যতা
অচেনা বিষণ্ণতা
শুভজিৎ চন্দ
অচেনা এক পাখি
ঘুম ভাঙিয়ে গেল শীতের ভোরে।
হঠাৎ চেয়ে দেখি, গা ঢেকেছে
মেঘের কোলে।
২.
মেঘেই বুঝি আদর আছে চাদর আছে?
আর আমার আছে আবেগের উষ্ণতা।
নীরবতা।
থাইল্যান্ডের ডাইরী...
ময়ূখ দত্ত
(১) ভূমিকা
থাইল্যান্ড কথাটা শুনলেই আমাদের ভারতীয় চিন্তায় প্রথমেই মনে আসে থাই মাসাজ, যথেচ্চ আমোদ, ড্রাগ, রাতভোর পার্টি ইত্যাদি... কেউ থাইল্যান্ড যাচ্ছে শুনলেই সবাই একটা হাসি হাসি প্রশ্রয়ে প্রশ্ন সহ মুখ করে তাকায়...অনেকে আবার বলে "...দূর!! থাইল্যান্ডে আবার নিজের বৌ নিয়ে কেউ যায় নাকি?"।
যাই হোক, কাজের সুত্রে এখন যখন মাসের অনেকটা সময়ই ওই দেশে থাকতে হচ্ছে, বিভিন্ন ভাবে দেশটাকে দেখছি, চিনছি... যে কোনো জিনিসের মতই, ভাল, খারাপ মিশিয়ে একটা দেশ, তার সভ্যতা, সংস্কৃতি... আমাদের দেশের সাথে অনেক মিল, আবার অনেক অমিল...তারই কিছু কিছু রোজনামচা...
(২) বৌ বনাম গার্লফ্রেন্ড
এই থাইল্যান্ড দেশটা বেশ অদ্ভুত একটা দেশ!! সরকারী ভাবে স্বীকৃত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী একটা দেশ, সনাতন প্রথা, আচার আচরণ মেনে চলা একটা দেশ, এদিকে পাশ্চাত্যের প্রভাব প্রচুর। তার একটা বড় কারণ সম্ভবত আন্তর্জাতিক ট্যুরিস্টদের ভীড় সারা বছর!! থাইল্যান্ডের জিডিপি র প্রায় ২২% আসে এই ট্যুরিস্টদের থেকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সারা দুনিয়ার একটা প্রভাব বিরাটভাবে পড়ে থাই জীবন যাত্রায়.... তার একটা অংশ হল "বান্ধবী" (গার্লফ্রেন্ড)। পাশ্চাত্যের অনেক দেশের মতই বিবাহিত বা অবিবাহিত ছেলেদের এক বা একাধিক "গার্লফ্রেন্ড" থাকাটা খুব স্বাভাবিক এখানে, এবং উল্টোটাও!!
সেদিন আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কুন (মিস্টার) নোক এর সাথে কথা হচ্ছিল হোটেলে ফেরার পথে। সরল সাধাসিধে মানুষ, সারাক্ষণ হাসি মুখ... কোভিডের পরে আর্থিক অবস্থার অবনতির ফলে ওর নিজের দুটো গাড়ি বন্ধক রাখতে হয়েছে। এখন একটা car rental কোম্পানীর হয়ে আমাদের কাজ করছে। বিবাহিত, দুটো ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে। বৌ থাকে সিরাচা শহরে (আমরা যেখানে থাকি), বাড়ি ভাড়া নিয়ে, কেন না ছেলে-মেয়ে এখানেই স্কুলে পড়ে। আর তারপর আরও জিজ্ঞাসা করায় কুন নোক যা বলে, তাতে আমি অবাক!! নোক নাকি ওর বৌ-বাচ্চাদের সাথে থাকে না, ও থাকে ৩০ কিমি দূরে পাটায়াতে, ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে। ওর গার্লফ্রেন্ড নাকি পাটায়ার কোনো এক ন্যুড বারে কাজ করে। সপ্তাহে একদিন বা দু'দিন ও বৌ-বাচ্চার কাছে আসে, কিন্তু সংসারের খরচাপাতি সব বহন করে...আমি জিজ্ঞাসা করলাম " সে তো বুঝলাম, তা তুমি যে তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে থাকো, তাতে বৌ কিছু মনে করে না?"
- ও জানে সব, তবে আমাকে বলেছে বাড়িতে থাকার সময়ে ঐ গার্লফ্রেন্ড সম্বন্ধীয় কোনো কথা যেন আমি উচ্চারণ না করি... আর তাছাড়া আমি তো সব খরচা দিচ্ছি, মাসে একদিন রেস্টুরেন্টে খাওয়াতেও নিয়ে যাই গোটা ফ্যামিলিকে...
"বুঝলাম, যে, তোমার বৌ সব মেনে নিয়েছে... কিন্তু এই যে তুমি থাকো না বাড়িতে, তোমার বৌ-এর কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা, সেটা কি জানো তুমি?"
- (একটু চুপ করে থেকে, তারপর হেসে) না, না সেটা নিশ্চই নেই...থাকলে এতদিনে আমি জানতে পারতাম...
তারপরে সারা রাস্তা কুন নোক আর কোনো কথা বলল না... গম্ভীরভাবে গাড়ি চালিয়ে আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিল..
জানি না, ওর মাথায় এইসব কথা ঢুকিয়ে আমি ঠিক করলাম কিনা...কোনো সম্পর্ক যখন প্রাতিষ্ঠানিক ঘেরাটোপে থাকে তখন এই অধিকারবোধ বনাম স্বাধীনতার দ্বন্দটা হয়ত অনেক বেশী হয়ে থাকে...
(৩) হাউসকিপার
থাইল্যান্ডের এই ছোট্ট শহরে কোম্পানী আমাদের রেখেছে একটা হোটেল আপার্টমেন্টে... প্রতিদিন জিম নামে এক স্থানীয় থাই মহিলা হাউসকিপার আসে ঘর পরিষ্কার করতে, বিছানা ঠিকঠাক করে দেয়, এসবের দাম হোটেলের প্যাকেজের মধ্যেই ধরা আছে। আমরা সকাল সাতটায় বেরিয়ে রাত সাতটায় ফিরি, তাই রবিবার ছাড়া আমাদের ফ্লোরের ওই হাউসকিপারের সাথে দেখা হয় না।
এখানে সস্তার একটা লাঞ্চ বা ডিনার কিনতে ৪০ বা ৬০ থাই ভাট (৮০/১২০ টাকা) পড়ে। এক রবিবার জিমকে বকশিস হিসেবে ৬০ থাই ভাট দিলে দেখলাম খুব খুশী হয়ে বারবার মাথা ঝুঁকিয়ে "কাপুন কাপ" (ধন্যবাদ) বলতে লাগল... তারপর থেকে দেখতাম আমার ঘর /বাথরুম আরও যত্নের সঙ্গে ঝকঝকে তকতকে করে রাখছে, বিছানায় বা এদিক ওদিকে ফেলে রাখা তোয়ালে, জামা, গেঞ্জী বা পাজামা এক্কেবারে পাট পাট করে তুলে রাখছে ওয়াড্রোবের মধ্যে।
হোটেলের ঘরে মাঝেসাঝে কিছু রান্না করি, থালা বের করে কিছু হয়ত খাওয়াও হয়, সারা সপ্তাহের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে সেসব বাসন মাজা আর পোষায় না... সব পড়ে থাকে কিচেন সিংকের মধ্যে!! একদিন দেখলাম জিম কোথা থেকে একটা স্কচবাইট, সাবান নিয়ে এসে সেসবও পরিষ্কার করে রাখছে... কেমন যেন একটা আত্মগ্লানি এল, 'একটা থালা আর একটা বাটি হয়ত, সেটাও আমি ফেলে রাখছি...!!' জিমকে বারন করলাম, এসব তোমার বেঁধে দেওয়া কাজের মধ্যে পড়ে না...কেন করছ? তারপরে মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী মন আমাকে যেন বলে গেল "... প্রতি সপ্তাহে তো বকশিস দিচ্ছি, সেসব তো আর অন্য কেউ দেয় না, বাড়তি সব কাজ করছে, করুক না, আমি তো আর নিজের থেকে বলিনি এসব করতে...৬০ থাই ভাট পাচ্ছে, কম কি? মানে একবেলার বা দুবেলার খাবারের খরচ..." এভাবে চিন্তা করতেই আত্মগ্লানিটা উড়ে গেল কোথায়। পরের দিন থেকে বাসন মাজাতে আর নিজের হাত নোংরা করি না... জিমই সব বাসন মাজছে খুশী হয়ে...
কোনো কাজে খুশী হয়ে দেওয়া বকশিস আর বাড়তি কাজের মূল্য ধরে দেওয়ার চিন্তাধারা যেন কোথাও মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল... মধবিত্ত চাকুরে মনটা সেসব ভুলে চিন্তা করতে লাগল যে, সারা বছর কোম্পানীর কাজে আমি প্রচুর খেটেছি, মানে যা করার, সেসব খুব ভাল করে করেছি, কোম্পানী আমাকে বোনাস দেয় সেই হিসেবে...সেটা কি বকশিসের থেকে আলাদা? মানে বোনাসের বদলে কোম্পানীও কি চায় যে আমি নিজের কাজের বাইরেও আরো কাজ করি কোম্পানীর হয়ে? নাকি নিজের কাজটাই ভালভাবে করার জন্য কোম্পানী বোনাস দেয়?
সুবিধাবাদী মন আবার নিজেকে সান্ত্বনা দিল যে, না না, সেটা কি করে হয়? বোনাস আর বকশিসকে এক করে দেখাটা নিশ্চই ঠিক নয়...
(৪) সুন্দরের পুজারী...
এই দেশটার একটা ব্যাপার খুব ভাল লাগে - পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা... মাস্কাট বা দুবাইতে প্রথমে এসে এত পরিষ্কার দেখে চমকে গেলেও ভাবতাম 'এদের তো তেলের এত পয়সা তাই এসব লাক্সারী করতে পারে, রাস্তা ঝাঁ-চকচকে রাখার জন্যও এত খরচা করতে পারে...সেই হিসেবে থাইল্যান্ড এমন কিছু বড়লোকের দেশ নয়, কিন্তু রাস্তা ঘাট, পার্ক, ফুটপাথ মোটামুটি ভালই পরিষ্কার সবসময়ে, আর এটা শুধু টুরিস্ট প্রধান ব্যাংকক বা ফুকেতের কথা নয়, ছোটো খাটো শহর বা গ্রাম গুলোও খুব পরিষ্কার থাকে। থাইল্যান্ডের উত্তরে মায়ানমার-লাওসের সীমান্তে অবস্থিত চিয়াং মাই-এর এক পার্কে কাটাচ্ছি সেদিন, অলসমনে... কয়েকজন ছিন্ন পোষাকের মহিলা ঝাড়ুদার রাস্তার পাশে মাটিতেই বসে জল দিয়ে মুখ চোখ মুছছে, সম্ভবত ওদের বিশ্রামের সময় এখন। হঠাৎ দেখি একটি কমবয়সী ঝাড়ুদার মেয়ে কোমরের কোঁচোর থেকে একটা লিপস্টিক বের করে নিজের ঠোঁটে লাগাচ্ছে, আবার পাশের একটি মেয়ে একটা ছোট্ট আয়না বের করে তার মুখের সামনে তুলে ধরল!! তারপরে অন্য মেয়েটিও ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করল। সারা সকাল ধরে কাজ করার পরে স্বাভাবিকভাবেই তাদের অবিন্যস্ত চুল... চিরুনী দিয়ে পরিপাটি করে বাঁধতে আরম্ভ করল। কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা চলল, কিছুক্ষণ পরে আবার সবাই ঝাড়ু হাতে কাজে নেমে পড়ল, রাস্তা -ফুটপাথ ঝঁ-চকচকে করার কাজে... !!
ঠোটে লিপস্টিক লাগিয়ে আর চুল বেঁধে আরো সুন্দর হয়ে ওঠার পরে ওদের এনার্জী যেন আরও বেড়ে গেল....জঞ্জাল সাফ করার সাথে সাথে ওরা নিজেদের চেহারার আপাত মালিন্যর ওপরেও যেন একটা সুন্দরের প্রলেপ ফেলে দিল, রাস্তা সহ চারপাশটাও মনে হল যেন আরো বেশী পরিষ্কার, আরো বেশি রঙীন, আরো বেশি বর্ণময় হয়ে উঠল!!
______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া
______________________________________________
১/ পড়লাম সব... ভাল লাগল ডরোথী দাশ বিশ্বাস আর বিশ্বম্ভরনারায়ণের লেখা... ভাল থেক ভাই... ...
----------কবি অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র
২/ প্রতিটি ছবিই অসাধারণ 👌🏻👌🏼👌👌🏻👌🏼👌🌹💐
-----------আল্পি বিশ্বাস
৩/ সত্যিই রঙের চোরাগলিতে হারিয়ে যেতে হয়। অপূর্ব। শিল্পীকে জানাই শ্রদ্ধা। ভাই, তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ, এমন করে শিল্পীর শিল্পের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।
------------কবি ডরোথী দাশ বিশ্বাস
৪/ কবি নির্মল হালদারের পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ আগেই জেনেছিলাম। এবার তার পরবর্তী সাহিত্য কীর্তি দেখে বুঝলাম আদত কবি বা শিল্পীকে কোনো পুরস্কার প্রভাবিত করতে পারে না। তিনি সুস্থ থাকুন, সৃষ্টিতে থাকুন, এই প্রার্থনা করি।🙏🙏🙏
তাঁকে নিয়ে লেখা সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবন্ধটি ভীষণ ভালো লেগেছে। কবির প্রাপ্তিতে প্রকৃতিও আনন্দিত। ❤️
বরাবরের মতই সুন্দর কিছু কবিতা পাঠ করলাম। ভালো লাগলো খুব।👌👌
------------কবি সুনৃতা রায়চৌধুরী
৫/ অপূর্ব রঙের ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। শিল্পী এবং সম্পাদকের জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল।❤️❤️❤️
------------কবি সুনৃতা রায়চৌধুরী
৬/ নির্মল হালদারের এই সম্মান প্রাপ্তিতে আমার ভালোবাসা জানাই। সুমন খুব ভালো লিখেছেন। সব কবিতাই মন ভরিয়ে দিল।
-------------কবি অমিত মণ্ডল
৭/ অনেকদিন পর পড়লাম।
প্রিয় কবি নির্মল হালদারের এই স্বীকৃতি যেন আমাদের ব্যক্তিগত এক গর্বের অনুভূতি। শ্রদ্ধা জানাই কবিকে।
এই সংখ্যার অন্য কবিতাগুলিও উপযুক্ত। আর ছবিগুলি গভীর।
--------------কবি সুজন পণ্ডা
______________________________________________
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : আলোকচিত্র, বাপি কর্মকার
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন