চতুর্থ বর্ষ ।। ষষ্ঠ ওয়েব সংস্করণ ।। ১৭ আষাঢ় ১৪৩০ ।। ৩ জুলাই ২০২৩
প্রকৃত রাজনীতি দেশ ও দশের উন্নয়নের কথা বলে। তাই প্রকৃত রাজনেতাও দেশ ও দশের কল্যাণে নিয়োজিত করেন নিজেকে। সেখানে তাঁর লাভ লোকসানের হিসেব থাকে না। লাভ লোকসানের যতটুকু কথা সে কেবল প্রজা কেন্দ্রিক। প্রজাদেরকে কেন্দ্র করেই উন্নয়নের বার্তা বয়ে যায় দিকে দিকে। কিন্তু সেই রাজনীতি যখন করে খাওয়ার রাজনীতিতে পা রাখে তখন দেশ ও দশের কল্যাণের পরিবর্তে কেবলমাত্র নিজেদের কল্যাণের কথায় ভেবে থাকেন রাজ নেতারা। ভাবতে থাকেন, কি করে একবার পাওয়া সুযোগে পরবর্তী চার প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা যায়। আর সেখানেই রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে তুষ্টিকরণ ও স্বেচ্ছাচারিতা। রাজ নেতারা এখানে হয়ে ওঠেন পুরোপুরি আত্মকেন্দ্রিক। আমাদের সোনার বাংলা বর্তমানে সেই দ্বিতীয় পর্যায়ের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। তাই বর্তমান সময়ে এসে রাজ নেতাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাটা সমীচীন হবে বলে মনে হয় না।
তবে ধীরে ধীরে বীজ বপন করতে শুরু করলে, আবর্তিত হতে হতে একটা সময় অবশ্যই প্রথম পর্যায়ে গিয়ে পা রাখবো আমরা। সেই আশা নিয়েই এগোতে হবে আমাদের। সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে এগোতে হবে লক্ষ্যের দিকে। লক্ষ্য একটাই, কিভাবে জং ধরা সমাজতন্ত্রকে বারবার ঝাঁকিয়ে যতটা সম্ভব জং মুক্ত করা যায়। রাজ নেতাদের বুঝিয়ে দেওয়া যায়, ভুলের সংশোধন করতেই হবে তোমাদের। নতুবা মুক্তি নেই।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
অশোক দত্ত / প্রবীর ভট্টাচার্য / সায়ন্তন ধর / রামকুমার আচার্য / অনিল মাহাত / সুজন পণ্ডা / শ্যামাপদ মাহাত ( বাঁশি )
______________________________________________
লক্ষণীয় 'লকডাউন'
অশোক দত্ত
ভালবাসা ভালবাসি ভালবাসাবাসি---
বদলে আজ দিশে দিশে
কান্নার উৎরোল আর ছিঁচকাঁদুনে হাসি;
সে কী মন্থরার কালকূট ধ্বনি ---কে দেবে উত্তর?
আর গোপন করোনা, দাসবৃত্ত থেকে ফিরে,
এখন পথে পথে চলছে রাহাজানি ----তার খবরাখবর
মৃতদেহের স্তূপে স্তূপে, উনিশ-বিশ বা একুশে ---
আমরা আ-মরা চিরুনি তল্লাশে
বোদ্ধা হব যোদ্ধা হব --- বুদ্ধ-বাণীর মর্ম কতটুকুই-বা
জানি! আপাততঃ
বন্দী জীবন, গৃহকোণে বসে থাকা অনন্যোপায়
বলেই মানি।
চৈনিকদের বাখানি, কিছুই জানি না, বুঝি না----
শুধু 'হাঁও মাঁও কাঁও' আর
রাশি রাশি তাল তাল মানুষের গন্ধ পাঁউ----
অমানব পৈশাচিক চিকের আড়ালে, যেখানে হাত
বাড়ালেই, চাঁদের পাহাড় থেকে চীনের পাঁচিল----
জন্ম-মৃত্যুর প্রারম্ভের পূর্বেই আমি যে ছিলাম, আমি
যে রয়েছি আজও মস্ত ফাজিল!
ওরা সব জানে, ওরা মানে----
ফা হিয়েন, হিউ এন সাঙ, মেগাস্থিনিস---
পরিব্রাজনের অন্তরালে চুরি যায় নোবেল প্রাইজ ----
ওরা সব জানে, মানে, চায় তারা সাঁঝতারার
উঠোনে, নিজের বাগানে -----
আমরাও জানি, কিভাবে মারতে হয়, মারি!
প্রণাম সুভাষচন্দ্র,
আজও আমি একান্ত অনুগত, তরুণের স্বপ্ন বুকে
আমি যে তোমারই। আছো তুমি লাল টুকটুকে ঐ
চাঁদমারী ডাঙার আড়ালে।
সূৰ্য্যসাক্ষী তোমাকে প্ৰণাম ৷
প্রবীর ভট্টাচার্যের কবিতা
পিকনিক, ২৩
হুল্লোরের অদূরে নিভৃত আবাস
চিত্রার্পিত বাঁশবন তোমাকেই দেখে
সাঁকো পেরোলেই তোমার ঈশ্বর
আঁধার বিলের শেষে সূর্য ওঠে।
পিকনিকের প্রান্ত রেখায় শব্দ-দূষণ
সভ্যতা অসভ্যতা পৃথিবীর প্রেক্ষিত
টাল খেয়ে এই পথ চলা
নিরালম্ব ছায়া বন্ধ তোরণ।
ব্ৰাহ্মণী
রিক্ত ব্রাহ্মণী
কালো - সবুজ প্রান্তিক
ছাগশিশু বসে থাকে স্থির
শিশু মানবিক।
ধিক্কার ধ্বনি নেই
যে আসে সে আসে
অভিবাদন আলস্যরঞ্জিত
ভালোবাসে সে
শূন্য নদীখাত জাল পেতেছে।
সায়ন্তন ধরের কবিতা
১.
মেস্তা বন্দর
চলেছি সবুজ ঘাস, সাদা বালি ও গোল গোল পাথরের ওপর দিয়ে,
সাইকেলের চাকা কখনো লাফায়
কখনো টুংটাং শব্দ তোলে
বাঁয়ে তিরতিরে তিস্তা, রুপোলি জলধারায় তৈরি করে বালির ভাস্কর্য
কিছু দূরেই তার ডানহাত ধরলো করলা
চলেছি একটা ছুটির দিন কাটাতে
তিস্তা বক্ষ লালে লাল
কিসের ক্ষেত ওগুলো? অনেকটা ঠিক চুকুই-এর মতো?
চাষীভাই জবাব দেয়, মেস্তা হে, ওগুলো মেস্তা পাট---
সময়টা শীতকাল, অথচ
ডাঁই করে রাখা পাটকাঠির স্তুপ
স্বল্প জলে পাট পচানো চলছে
হাওয়ায় ভাসছে সোঁদা গন্ধ
স্বর্ণ তন্তু শুকোচ্ছে মিঠে রোদে।
পাট নয়, তন্তু ফসল মেস্তা ওগুলো!
কিছু দূরে পাটকাঠির অসংখ্য স্তুপ করলা তীরে
কলস্বরে তন্তু ছাড়িয়ে নিচ্ছে
ডুরে শাড়ি পরা গ্রামের মেয়েরা।
ঘাটে দুটি নৌকো বাঁধা, পুরুষেরা সেজেছে নাবিক,
তৈরি হয়েছে এক অস্থায়ী বিকিকিনির হাট
মেস্তা বন্দর।
২.
কোলাজ কবিতা
বন্ধু, তোমার সামনে এখন দুটি পথ
যদি অভিকর্ষের টানে নেমে আসো
দেখবে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে
সবুজের রাশি, পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখো।
আর যদি একবার অভিকর্ষকে পরাস্ত করো
ওই যে নিঃসীম নীল আকাশে সাদা মেঘ
ওরা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য
তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বলে।
একদিকে সবুজের কাছে থেকে বাস্তব সয়ে
কবিতাকে মাটি দিয়ে গড়ার সুযোগ
আর একদিকে প্রথমে একরাশ অধ্যবসায়
তারপর মেঘের ভেলায় চড়ে কাব্যবিলাস।
তুমি যাই করো বন্ধু, আমি এখানেই বসতে চাই
চার দেওয়াল থেকে দেখবো তোমাদের পথচলা
আর এক ক্যানভাস সাজিয়ে তুলবো
বৈপরীত্য কবিতাদের কোলাজে।
লতানে অভিমান
রামকুমার আচার্য
বিষণ্ণ সকাল
জাপটে ধরল আমাকে
সারাদিন বৃষ্টি
জানলা ধরে উঠছে
লতানো অভিমানের ডালপালা
বৃষ্টি শেষে
শুভ্রতা নিয়ে ঘরে ফিরছে একঝাঁক হাঁস
আমি লাঙ্গলের পাশে
সংসার
অনিল মাহাত
গোকুলের মা পাতা ঠেলে উনুনে
কাঠের বড়ো অভাব
জনম দুখিনীর ভাতের হাঁড়িতে
চাল ফুটে
ঢাকনাটা উঠে নামে।
পাখিদের ছানা হয়
উড়তে শিখলে চলে যায়।
গোকুলের মা জড়িয়ে পড়ে মায়াডোরে।
ধান কাটা ক্ষেতে ঝরে পড়া ধান শীষ
কুড়িয়ে রাখে গোকুলের মা।
জনম দুখিনীর ঘরে রাত নামে,
কাকভোরে গোবর দেয় উঠোনে।
গোকুলের মা ঘর আর বাহির...
পুরুষ-কার
সুজন পণ্ডা
ওই যে পাখি আর ফুল
সাদা আর কালোয়
দেখেছো কিভাবে দুলে দুলে ওঠে
সাঁকো আর ঢেউ
একটি নিশান জ্বলে শুধু-
'তীব্র পুরুষ-কার'
প্রায়শই নক্ষত্রের শব
ভেঙ্গেচুরে ধুলোকণা
ধুলো ধুলো কণা
অথচ ওই পুরুষ-কার।
সাঁকো ভাঙা বাঁশ কিছু কিছু
ঢেউ নিয়ে যায়
কিছু এলোমেলো-
ছত্রাক আর কীটেদের বাসা।
বসন্ত যাপন
শ্যামাপদ মাহাত ( বাঁশি )
সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা হবে। জৈষ্ঠ্যের রোদ গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। তাপ কমেনি,বাইরে ভেতরে তাপ। ক্ষুধার্ত জঠরের মতো। রাঘবপুর থেকে গোশালা মোড়ের দিকে চলেছে একটি গাড়ি। ফুল দিয়ে সাজানো। এ কোনো বরের গাড়ি নয়, যুবরাজ আগমনের বার্তা বয়ে চলেছে সে। মাইকিং হচ্ছে - দিদি -পিসি জিন্দাবাদ, নবজোয়ার দীর্ঘজীবি হোক। বিদ্যুৎ ভবনের সামনে ভাগ্নার চা দোকানে বসে এসব শুনছে বসন্ত। বসন্ত বাউরি, ইতিহাসে এম এ, স্পনসরড থেকে বিএড। মানবাজারের এক মফঃস্বলের গাঁয়ে তার বাড়ি। মানভূম, মানবাজারের ইতিহাস সে জানে, বিতর্কসভায় এ বিষয়ে পুরস্কারও পেয়েছে। সে জানে না 'জিন্দাবাদ' এর মাইকিং ইতিহাস। চা-এর কাপে চুমুক দিয়ে ভাবছে সিগারেট...না না, তার চেয়ে কড়া বিড়িটাই ধরাবে সে। কিন্তু টাকা? না থাক, প্রেস্টিজ বলেও তো কিছু একটা জিনিষ আছে। পেচ্ছাপ করার ভঙ্গিতে পুরোনো পাঁচিলের আড়ে গিয়ে ধরায়। দু' এক টান দিতেই ফোনটা বেজে ওঠে। ঘরের ফোন, উপেক্ষা করা যায় না। 'গাঁয়ের পরবে আসবি বেটা, তর দিদি বহনই আইসবেক। জামাই বৈলতেছিল অদের পিসির বিটিটা ম্যাট্রিক দিয়েছে। ত কুটুম আইসছে নকি? জুইতেই বঠে। বাবা যদি তর... ' - মায়ের গলায় এমন স্বরের ইতিহাস তার অজ্ঞাত। 'হঁ ত যাব, তারপর দেখা যাবেক ' এই বলা ছাড়া উপায় নাই। এই উত্তর দিতে দিতেই বছর ছয় সাত হলো। বোঙ্গাবাড়ির মেসে থাকতে থাকতে আট দশ জন ছেলেমেয়ে পড়িয়ে নুন ভাত চালায়। মাদ্রাসা শিক্ষক কমিশনের গেজেট প্রকাশ শুনেছে ক'দিন আগে। এখন রিচার্জ নাই। কি করে মা-কে জানাবে, 'ইবার পরবে নাই যাত্যে পারছি মাই, এস এস সি টিউশন লিব'। আজ মে মাসের পাঁচ, কাল কিছু রিচার্জের ব্যবস্থা হতে পারে ভেবে সাইকেল ধরে। কপালে মল-মাস এলে, সব আশার বীজ বিনষ্ট হয়। রাস্তার সামনে টোটো থেকে শুনতে পায় 'আগামী কাল শাসক দলের থেকে বিরোধী দলে বোঙাবাড়ি গ্রামের দুশো পরিবারের যোগদান সভা, সপরিবারে খিঁচুড়ি প্রসাদ বিতরণের আয়োজন করা হইয়াছে'
বসন্তের মনে আছে তার বাবাকে পঞ্চায়েত থেকে একটি ত্রিপল পাওয়ার জন্য দু সপ্তাহ পিঠে ভাঙতে হয়েছে রোদ। আশ্বাস তবু পেয়েছে। অফিসার জানিয়েছে পরের সপ্তাহে আসুন। অফিসে সময় দিতে গিয়ে সরিষা ক্ষেতে বাঁধা মা ছাগলটিকে কামড় দিয়েছে কুকুর। কী হবে তার... কেজানে।
যাদের ফাটা কপাল, ভাঙার আর কী বাকি তাদের? তাদের রোদ নেই, শীত নেই, সঙ্গি কেবল ঘাম আর ঘামাছি। মাছির মতোই কাটবে কি এদের জীবন?
এদিকে আবছা আলোয় রামধনু উঠেছে।
দুর্ভাগ্য, বসন্তর বিড়িও শেষ হয়েছে।
______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া
______________________________________________
১/ অরন্ধন-এর বর্তমান সংখ্যায় আলোকচিত্রী মুকেশ কুমার মাহাত-র তোলা ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হলাম।
নানান দূরত্ব থেকে দেখা মহুয়া/ মহুল গাছের পুষ্প, পাতা, শাখাবিন্যাস এবং লঙ-শট-এ নেয়া বৃহত্তর প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট, তাদের রঙের ও রূপের খেলা, আলো-ছায়া-- সবই নিজ নিজ ব্যঞ্জনায় রসিক দর্শকদের মুগ্ধ করবে।
----------গল্পকার স্বপন চক্রবর্ত্তী
২/ ভাল লাগল অনিমেষ মণ্ডলের কবিতা!... সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের লেখাটিও!... এবং তোমার এবারের সম্পাদকীয়টি!... দলহীন রাজনীতির যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন আমাদের পূর্বপুরুষেরা, সে কি সত্য হবে
কোনদিনই?... জানি না!... "কাউয়া ধান খাইল রে, খেদানের মানুষ নাই"... ...
------------কবি অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র
৩/ খুবই ভালো লাগলো সব কটা লেখা। ছবি গুলো ও অনবদ্য।
-----------কবি বেণু মাহাত
৪/ বিশেষ করে তোমার সম্পাদকীয়টা খুব মন দিয়ে পড়ি প্রতিটা সংখ্যাতে।
লেখাগুলোও ভালো লাগে।
ছবি দিয়ে সুন্দর করে সাজানোটাও ভালো লাগে বেশ।
----------- শিল্পী চৈতালী মাহাত
৫/ সৎ সম্পাদকীয়। হায়, ওরাও যদি পড়তে ও বুঝতে পারতো!!
কবিতা গুলি চমৎকার।
-----------কবি সুজন পণ্ডা
______________________________________________
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : স্কেচ, উজ্জ্বল মাহাত
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন