চতুর্থ বর্ষ ।। অষ্টম ওয়েব সংস্করণ ।। ১৪ শ্রাবণ ১৪৩০ ।। ৩১ জুলাই ২০২৩



অর্ধেক শ্রাবণ অতিক্রান্ত। বৃষ্টি নেই। বৃষ্টির অভাবে পৃথুলা হতে পারেনি বামনি, কালি, ঠুড়গা ঝর্ণারা। এসে পৌঁছাতে পারেনি তাদের জল চাষির ক্ষেতে। শুকনো কাঁসাই কুমারী টটকো শুকনো করে রেখেছে চাষিদের মুখ। শুকনো করে রেখেছে ধান-চারার কোমর। ডোবা পুকুর খাল বিলের হা-হুতাশে আশ্বাস হারিয়েছে ব্যাঙ। কোথায় আনন্দ? কোথায় তাদের ডাক? চাষিদের মতোই তারাও বুঝে গেছে এবছর কাদা লাগবে না লাঙলে।


উত্তম মাহাত, সম্পাদক 



______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
পাপড়ি গুহ নিয়োগী / মৌ দাশগুপ্ত / পার্বতী রায় / মহিউদ্দিন সাইফ / নীতা চন্দ / পার্থসারথি মহাপাত্র / মনজু রহমান লেবু / অঙ্কন রায় / রূপক চট্টোপাধ্যায় / মধুপর্ণা কর্মকার / গৌতম দত্ত 
 
______________________________________________



পাপড়ি গুহ নিয়োগী

১.
লিবিডো


শহরের সার্কাস ছেড়ে
ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি তোমার আদি তোর্সায়
ভাবছি নিজেকে আর হত্যা নয়

স্তন তৃষ্ণার্ত
চায় ঠোঁট
আদুরে দাগ

অপেক্ষায় প্রহর গোনে মানচিত্র
লেহন উত্তাল হলে সমুদ্রস্রোত
উবু হয়

সুবর্ণপদ্ম ভিজে ওঠে জল উৎসবে

মৃত্যু মুখ
উঠে বসে
নরম যন্ত্রণায়

কতটা উওাল হলে প্লাবন আসে

এই মুহূর্তে
আমি জীবন
তুমি জল

 

  
২.
নদী

 
সাঁতার কাটতে গিয়ে দেখেছি
সাঁতার শুধু একার নয়, জলেরও
কেউ কাউকে বেঁধে রাখতে পারে না হয়তো
একটা শহর হয় না। ঘর হয় না

কিন্তু নদী একটাই...

 

৩.
শূন্যতার চিৎকার


দৌড়ের পর
ইজেল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্যানভাস
ঠোঁটে ঠোঁট রাখো। ভ্রমণ দীর্ঘ করো
চারপাশে বন্দুকভরা সীসার বল
মাংস উৎসব, ক্লান্ত মাইক
ভেতরে শূন্যতার চিৎকার

দেখ উপবাসী আয়না দাঁড়িয়ে  
ক্রমশ টিকিট বিক্রি করছে নরকের
চলছে গনগনে আগুনে স্বৈরাচারী মৃত্যুস্নান

দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে  রাত...











বাবাকে জন্মদিনে চিঠি

মৌ দাশগুপ্ত


বাবাকে বলি, শোন, 
জন্মদিনে কোন 
স্বপ্ন তুমি বোন? 

বাজার থেকে এসে 
একটুও না-হেসে 
বলতে, পথে যা-যা
দেখেছ দুশ' মজা

তোমার ছোট মেয়ে 
আর কিছু না চেয়ে 
শুনতে চায় বাবা, 
সে গল্পই আবার 

ওই পারেও কি দেখ 
মজার কাণ্ড একও ?
বাজারে তুমি যাও ?
মৌরলা কি পাও ?
শোল মাছ ও মুলো ?
মা কি ঝাড়ে ঝুলও...
ওই পারের ঘরে ?
এখনও রাগ করে ...
চালতা নিয়ে এলে 
কাটতে হবে বলে...?

ইতি পয়লা শ্রাবণ ১৪৩০







যেতে যেতে 

পার্বতী রায়


বুকের ভেতরে পাপ রেখে 
ঘুমিয়ে থাকা ভালো নয় 
আলো আসে 
আলো ফিরে যায় 
তাকিয়ে থাকি জানালার দিকে 

আসবাবে লেগে থাকে ধুলো 
তুমি আপন হও 
কাছে এলেই ফুল ফোটে 

একটি অজানা বৃক্ষের নাম রেখেছি আলো 
আমি কোনোও দিন বৃষ্টিপাতের দিকে যাইনি 

সবার অলক্ষ্যে অক্ষর সাজছে 
এভাবে চারদিক খুলে রেখে 
চলে যাওয়া ভালো নয় 
চলে যেতে যেতে কিছু বলে যাওয়া ভালো



 



মহিউদ্দিন সাইফের কবিতা 

১.
সকাল


সূর্য ওঠার মুহূর্তগুলোকে একেক দিন একেক রকম লাগে…
যেন প্রতিদিন একেকটি শিশুর জন্ম-উৎসব,
নভোমল্লায় তাই আনন্দের ধুম লেগেছে
আবিরে আবির মেঘগুলি…

আবার কোনো কোনো দিন প্যালিওলিথিক গুহাচিত্রের মেলা বসেছে,
আদিম মানুষগুলি শিকার শেষে এঁকে দিচ্ছে বিজিত পশুসমূহের ছবি :
ছুটন্ত হরিণ, ক্ষ্যাপা বাইসন, দাঁতাল ম্যামথ…
দুয়েক দিন মনে হয় জয়দেবের বাউল-বাউলানি ঘুরে ঘুরে নেচে চলেছে,
সারা আকাশজুড়ে ম-ম করছে,
'মিলন হবে কত দিনে…?'

একেক দিন তো স্পষ্ট দেখি
তথাগত সম্বুদ্ধ জাতক শোনাচ্ছেন,
শিষ্যেরা গোল হয়ে বসে আছে
চলছে সুম্ভমিত্র, শ্বেতমূষিকের কথা…

সকাল শেষ হয়ে গেলে ভাবি
প্রতিদিন নতুন সূর্যের
নাকি আমারই জন্ম হল বিবিধ উপায়ে…?




২. 
অনাদির কথা


কি জানি কত আলোক-কল্পের কথা!
তাঁর তেস্না চোখ অন্বিষ্ট আমার।
স্মৃতিচিহ্ন পড়ে আছে সপ্তপর্ণীতে
নিঃশব্দ, অধীর, গভীর, নিরাকার

পাই সেই অনিবার্য পথ আর
উটগ্রীবনিভ সংকেত গোপন খলিল
পরিত্যাজ্য গারে-হেরা, আন্ধিয়ার
স্বননমুগ্ধ ডানা, প্ৰিয় জীবরিল

আশ্রয়বিহীন আমি যেদিকে বাড়াই পা
অজ্ঞাতের ভাষা থেকে অর্থ ক্ষান্তি পায়
অসীম কুহক পাখি, পতঙ্গ, বনভূম
আরও বিবিধ প্রতীক, যেদিকে তাকাই
জাগে বিস্ময়, এত সহজ সরল হয় পথ
কোথা থেকে শুরু হয়, কোথায় হারায়…?









চিত্রাঙ্গদার জন্য

নীতা চন্দ
               

চিত্রাঙ্গদা দ্যাখো--
আজও কত ফুল ফুটেছে,
পাহাড়ের মাথায় মেঘ জমেছে কত !
জঙ্গলের সবুজ বৃষ্টিতে স্নান সেরেছে।
তুমি দুচোখ ভ'রে সেই জলছবি দ্যাখো।
শুধু ওই মাঠটার দিকে তাকিও না!
ওই রাস্তাটার দিকেও!
তাকালে জলছবিরা ঝাপসা হয়ে যাবে।
তুমি লজ্জা পাবে!
লজ্জা পাবে তোমার সঙ্গী জংলী হরিণীরাও!

চিত্রাঙ্গদা শোনো--
আজও কত পাখি গান গাইছে,
পাতায় পাতায় হাওয়া বইছে শিরশির।
দূরে কোথাও কি 'পেনা' বাজাচ্ছে কেউ ?
তুমি কান পেতে সেই মিঠে ধ্বনি শোনো।
শুধু ওই চিৎকার শুনো না !
ওই কান্নাও না !
শুনলে তুমি মানুষের ভাষা ভুলে যাবে!
তুমি ক্রুদ্ধ হবে !
তোমার স্বভাবসিদ্ধ হাত খুঁজে নেবে তুনীর ।।
      






দখল

পার্থসারথি মহাপাত্র 


সেদিনের সংলাপ যাপন ক্রম
নতজানু সম্পর্কের বারান্দায়

গুরু মস্তিস্কে অধঃক্ষিপ্ত কথা
আকন্দ বীজের বিস্তৃতি চায়

চলন্তিকা শিকড়েরা জলভ্রষ্ট
মরিচীকার আবহে তৃষ্ণাদাহ

দুঃখগুলো আরো বেশি দুঃখী
অকাল বর্ষণে করে অবগাহন

তোমার লাগানো গাছগাছালি
তুমি ছাড়া আজ সব অবিকল

অস্থিমজ্জায় সমাধিত তবু্ও
হৃদয় জরিপে তোমার দখল। 








মনজু রহমান লেবু-র কবিতা


অন্ধ আংটি


শুন্য চাদর থেকে যতদূর চলে যাই
বস্তুতপক্ষে কর্মক্ষম শিরাগুলি
যেন বার বার ফিরে আসে  
তবু না-দেখার নিরন্তর কাতরতা লিখে রাখি 
তোমারই চোখের ভিতর,  
যখন শাদা একটি ঘোড়া 
তাড়া করে বেড়ায় পাথরের পাহাড়ে ..
দৃশ্য থেকে বদলায় দৃশ্য

অসম্ভব আকুলতায় হাওয়ার উজানে
রুঢ় মূর্ছনায় আমরা বসি, মুখোমুখি
অন্ধ আংটির মতো তোমাকে খুলে ফেলতে পারি না 
একটি নিদ্রাহীন পৃথিবীতে আমাদের দিন ক্রমশ ধূসর হয়ে আসে,  
পরম আগ্রহে একটি শুন্য চাদর আমাদের ঢেকে ফেলে 
আমরা হারিয়ে যাই অলৌকিক অবগাহনে।




ধূলিঝড়ের দিনে


নিরাশার দোলাচলে পলঅনুপলে জেগেছে যে বরফের পাহাড়  
হিমবাহে জেগেছে যে তমসার প্রাণ
তথাপিও জানা হল না মায়াধুম্রজাল... 
কতকাল আর খুঁজিব রাধিকার মন

অর্ধেক গেছে নিদ্রাহীন, জাগরণে দেখি
আহা কোন নাগিনীর মুখ,  
দানব নয় মৃত মাকড়ের পা, আমাকে বুনে রাখে 
তাঁতশিল্পের ঘরে  
বুকের অলিন্দে ঘুমিয়ে থাকে কতযুগ  
এ কথা কাহাকে বলিব ধূলিঝড়ের দিনে!




ভাষা


ত্রিকাল চলে গেলো হাঁটতে শিখিনি  
শিখিনি বন্যদের ভাষা
আজ কি কেউ বুঝে কারো ভাষা?  
প্রাণীদের ভাষা দূর্ভেদ্য
গহীন রাতের মতো যেমতি জীনেরা দূর বললে যায় কাছে;
কাছে বললে যায় দূর...

আজ মানুষের ভাষা যেন ভূতের কোনো চিৎকার  
উড়ে আকাশে বাতাসে বনে মরু বালুকায়।




দাগ


বন্য অন্তরাল ভেঙে জেগে ওঠে সর্পিনি  
সংহিতা...

প্রতিরক্ষার অকুণ্ঠ সাধনায় নিজেকে
গোপন করে রোদ্রের ভেজষ্ক্রিয়তায়...
ভূগর্ভে
বনের দেয়ালে, তবু
আলপথে হাঁটে থর্ থর্ ফণা তুলে দাঁড়ায় 
সৰ্পিনি সংহিতা
তার চোখ দুটি চরকায় নাচিতেছে...
পাখির বাসা ছাড়াতে গিয়ে দেখি  
মন্ত্রভেদ করে ফণা তুলে সর্পিনি সংহিতা...  
তার নীলদেহে শুধু শোয়ানো টেবিলের দাগ...









মেঘের সঙ্গী 
(বৃষ্টির কবিতাগুচ্ছ)

অঙ্কন  রায়

এক 

শ্রাবণের ডাক আসে, 'আয় তোরা আয়...'
সেই ডাকে চোখ মেলে দেখি জানলায়
কালো মেঘ ছেয়ে আছে আকাশটা জুড়ে
বৃষ্টির ছবি মেঘমল্লার-পুরে...!

বিদ্যুৎ চমকায় থেকে থেকে ওই...
বারিধারা ঝ'রে পড়ে, জল থই থই
উঠোনের কোল জুড়ে ঢেউ হেসে যায়,
মেঘ ভাসে শ্রাবণের গগনের গায়!!




দুই 

রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টির সুরে
গান গেয়ে দিগবধূ ওই চলে দূরে...
কোন দেশে যায় ওগো কোন পথে যায়?
তার সুর ভেসে চলে মেঘেদের গায়।

রিমঝিম রিমঝিম ঘন ঘন জল
কোপাই নদীর বুক করে টলোমল!
কোন দেশে যায় সে যে কোন পথে যায়?
তার ঢেউ মেশে সাগরের কিনারায়! 




তিন 

মেঘের ছায়ায় সন্ধে বেয়ে বেয়ে
ঝিঁঝিঁর শব্দে নিঝুম শালের বন!
জানলা দিয়ে আনমনে রই চেয়ে...
মেঘের ডাকে চমকে ওঠে মন!!

অনেক দিনের বৃষ্টিভেজা সুখ
হঠাৎ কখন আবছা করে দিঠি!
তোর জন্যই আড়াল ক'রে মুখ
খুলতে বসি বাদলশেষের চিঠি!!




চার 

মন লাগে না আজকে বাদলবেলায়
ঘরের কোণে থাকবো নাকো বসে!
বন্ধুরা চল্ মাতবো মাঠের খেলায়
খেলার শেষে গান ধরবো ক'ষে।

সে গান হবে বৃষ্টিজলে স্নাত
ঝর ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে...
পার হয়ে ঠিক মনকেমনের রাতও
সে গান আমার তোমায় নেবে চিনে।




পাঁচ 

বাদল সাঁঝে রাত্রি নেমে আসে
ঠিক যেন কোন অবগুণ্ঠনবতী!
একটু যদি মুখটি তুলে দেখি
বলতে পারো কার কি হবে ক্ষতি?

বৃষ্টি ঝরে বিরামহারা রাতে
মন যে আমার বাঁধন মানে না।
ও মন, তোকে দিলাম ছেড়ে মেঘে,
দিকহারাপুর ঘুরতে চলে যা!




ছয় 

মনটা যখন বন্ধু হল মেঘের
মনের গতি তীব্রতর বেগে
উড়তে থাকে পেরিয়ে আকাশপাড়া
শূন্যে তখন বৃষ্টি বাঁধনহারা।

মনটা যখন বৃষ্টিজলে ধুয়ে
তীব্র বেগে আছড়ে পড়ে ভুঁয়ে
তখন আমার প্রলয় অভিযান
পাল্টে হল বর্ষামুখর গান।।




সাত 

বৃষ্টি শেষে সিক্ত ধরার বুকে
অনেক দিনের প্রাণের টানে ছুটি,
বনসবুজে মনসবুজের ঘর,
সে ঘর জুড়ে খুশির খেলায় জুটি।

মল্লারগান গাইবো আজ একসাথে
খুলবো হাওয়ায় আঁধার ঢাকা মন,
বৃষ্টিসুখে সৃষ্টিসুখের ছবি
আঁকবে এসো ধরায় আলিম্পন।।








অবন্তিকা এবং জলবৎ জীবন 

রূপক চট্টোপাধ্যায় 


১.
অসুখের খয়েরী রাস্তা দিয়ে অবন্তিকা হেঁটে যায়।
পক্ষপাত দুষ্ট শ্লোকের গায়ে
নির্মিত হয় বিন্দু বিন্দু প্রেম। দুই পাশে
নগর গড়ে ওঠে, মানুষ জ্বলে ওঠে, 
নিভে যায় স্মৃতির সরণীতে শীত কাল!
পাতা ঝরে। দুঃখজীবি জীবনের মাথায়
নেমে আসে খাদ্য বিপ্লবের কাক!
অবন্তিকা হেঁটে যায় এসবের ভেতর দিয়ে 
অনাদিকালের নারীর মতো খোলা চুলে!

ঘোড়া মুখো রাত তাকে অনুসরণ করে যায়
কৃতদাস হয়ে!



২.
অবন্তিকা মজুমদার ইতিহাসের পাতায়
নিজের মমি খুঁজে পায় রোজ।
ডাল ভাতের সরল ঢেকুর থেকে
স্কুলের ব্ল্যাক বোর্ডে নামিয়ে আনেন হিটলারের 
ইহুদী বিদ্বেষ। আর চোখের কোনে
হীরে খন্ডের মতো চিকচিক করে
প্রাচীন প্রণয়ের বিলুপ্ত হ্রদ লিপি!



৩.
অবন্তিকা ফিরে আসে সান্ধ্য আয়োজনে
ঘর মুখো ঠোঁটে করে
অতীন্দ্রিয় খড়কুটো। বিষাদ বিবরণী। 
বিলুপ্ত হাটের মুখে ক্রয় করা
পটোল, আলু, পাঁচ মেশালি আলোচনা! 
ঘরে ফিরে আসে
অবন্তিকা। দরজা খুলে ঢুকে যায় অনন্তের শূন্যস্থানে।

ঘর তখন হয়ে যায় আধপোড়া মহানভ!



৪.
অবন্তিকাকে প্রথম দেখেছিলাম 
দারিদ্র্যের সীমারেখার নীচে ঝিলমিলি আলোয়,
রেশন বন্টনের শীর্ষস্থানে দাঁড়ানো মানবী! 
কপালে প্রস্তরীভূত টিপে তখনো বেঁচে 
আছে গার্হস্থজীবন বিন্যাস। হাতে থলি।
সংসার ঠেলে ঠেলে পার করছে জলমগ্ন চড়া!


তার কেতকী জড়ানো আলতো খোঁপায়
 কবিতা গন্ধের খোঁজে, তখনও 
যুবক কবিরা মিছিল ছেড়ে বেরিয়ে এলো!



৫.
আমার মুন্ডুহীন কনিষ্ক জীবনে
অবন্তিকা ছিলো মৃদু বজ্রপাত অথবা
অলৌকিক ভুবনমোহিনী! তার জন্য 
রাস্তায় রাস্তায় জমে উঠতো
মানুষের সমাগম, চায়ের দোকানে 
বাঙালিরা খুলে ফেলতো ভাগ্যলক্ষী লটারী।
অলস দীঘির জলে ডুবে যাওয়া কিরণ বালিকা
তুলে আনতো গ্রামীণ চিত্রপট। 
অবন্তিকা বুটিকের শাড়ী পরে
উড়ে যেতো স্কুল শিক্ষিকা 
 কবিতার শুনশান ছায়াপথে হকারদের দখল
 আর কোলহল জেগে উঠত নরকের মতো!



৬.
অনেক দিন হলো
অবন্তিকাকে আর তেমনটি দেখিনি ছাতিমছায়ায়।
মৃত্যুর উৎসব শেষে ঘরে ফিরছে শশ্মাণ যাত্রীরা।
একটা মানুষ কেমন করে
জোৎস্না রাত হয়ে যায় মৌন নীলে। কে তার
খবর রাখে! 
 তবুও অবন্তিকা মজুমদার 
নিরলস বেঁচে থাকে, ঘেমে ওঠা কপাল মুছে
পৃথিবীর ঘূর্ণন দেখে!



৭.
মোবাইল স্ক্রিনে অবন্তিকার ছবি ক্রমশ
প্রাকৃতিক হয়ে আসছে। ঘন পর্ণমোচী হয়ে আসছে,
পাখিরাও উড়ে এসে বাসা বুনছে ডালে ডালে।

ডারউইন তত্ত্ব মেনেই 
হারিয়ে গেছে অভিমানের জিরাফ!
আমিও ক্রোমোজোমাল জঁট থেকে 
এক এক করে আলাদা করছি সেই সব
উপকূলীয় অঞ্চলের উড়ে যাওয়া দিন গুলো!



৮.
এভাবেই ভিজতে চাই 
যদি তুমি লাল আদাচায়ের পাশে
অবন্তিকা হয়ে দাঁড়াও। কাঁচের সার্সি দিয়ে
গড়িয়ে নামছে সময়। তুমিও আঁচল থেকে
আমায় কবিতা দিচ্ছো গুনে গুনে 
অন্নপূর্ণা প্রতিমায় অবন্তিকা ডুবে যায়। 
দ্রবীভূত হয় নিথর সম্মোহনে! 







নৈঃশব্দ এবং ‘এক ভূ-পর্যটকের দলিল’ বিষয়ে।   

মধুপর্ণা কর্মকার 


“সমস্ত জায়গায় একটা নৈঃশব্দের ভূগোলের উপস্থিতি কাজ করে। যেখানে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য ছোট-বড় উপাদান। বিশ্লেষণী চোখে বা গুরুত্বের বিচারে সেইসব উপাদানের ভূমিকাও যে অনস্বীকার্য। বাস্তবের মাটিতে অনুভূতির পরিসরটাই পারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে কোনো বিষয়টি বোঝার বা চেনার”।… মলয় মুখোপাধ্যায়। ( নৈঃশব্দের ভূগোল, পৃ – ১৪৫)
‘নৈঃশব্দের ভূগোল’ বইটি লেখক উল্লেখ করেছেন ‘এক ভূ-পর্যটকের দলিল’ হিসাবে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালের ১৫ই আগস্ট। প্রকাশক পরন্তপ চক্রবর্তী, ‘বিরুৎজাতীয় সাহিত্য সম্মিলনী’। বইটির লেখক মলয় মুখোপাধ্যায় উৎসর্গ করেছেন “যাঁরা ভূগোলকে ভালোবাসেন বা ভালোবাসতে চান” তাদের। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন দ্যুতিমান ভট্টাচার্য। সূচীপত্রে বিষয়গুলি বারোটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে । ২১৯ পৃষ্টার এই বইতে ৪৪ টি সংক্ষিপ্ত রচনা সংকলিত হয়েছে। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রাবস্থায় স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিসারর্টেশন তৈরির ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে তাঁর নিজের গবেষনা, তাঁর ছাত্রদের গবেষনার ক্ষেত্রসমীক্ষা এবং সেমিনার, সম্মেলন উপলক্ষে দেশ বিদেশে ভ্রমণকালীন অভিজ্ঞতার, উপলব্ধির কোলাজ এই বইটি। তাঁর গবেষক সত্তার এক বিস্তৃত বিচরণভূমি আজীবনের ক্ষেত্রসমীক্ষার সমান্তরালে প্রবাহিত হয়েছে । প্রতিটি অধ্যায় শেষে একদিকে যেমন ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠের স্বাদ পাওয়া যায় তেমনি অজানা চমকপ্রদ প্রচুর তথ্য অবলীলায় জানা হয়ে যায়। নদী, পাহাড়, ভূমিরূপ, জঙ্গল; সক্রিয়, জীবন্ত চরিত্রের মত পাঠকের সঙ্গে ইন্টারেকশন করতে থাকে। প্রকৃতির, সমাজের অন্দরমহল থেকে লেখক নিপূণ হাতে নৈঃশব্দের নিবিড় মণি-মাণিক্য একে একে কুড়িয়ে নিয়েছেন। এই সংগ্রহ এক দিনের নয়, দীর্ঘ বছরের, কয়েক দশকের। 
সমাজ বিজ্ঞানের শাখা গুলিতে ক্ষেত্রসমীক্ষা গবেষনার কেন্দ্রে অবস্থান করে। এই ‘ক্ষেত্র’ প্রকৃতি, সমাজ , মানুষ তাদের কার্যকারণ। ক্ষেত্রসমীক্ষা গবেষকের নির্মোহ নৈর্বক্তিকতার মধ্য থেকেও বের করে আনে ব্যক্তি মানুষটিকে, গবেষকটিকে। প্রতিটি সমাজ বিজ্ঞানের গবেষক ক্ষেত্রসমীক্ষার আগে ও পরে কি একই ব্যক্তি থাকেন ? নাকি পরিবর্তিত হতে হতে যান? আরও পড়ুন







অনিকেত ও নির্মল হালদার

গৌতম দত্ত 


সত্তর দশকের উত্তাল সময় থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত‌্যের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ একজন কবি নির্মল হালদার, যিনি চল্লিশে পৌঁছনোর আগেই 'অস্ত্রের নীরবতা', 'ধান ও জলের ধ্বনি', 'সীতা', ও 'মৃত‌্যুঞ্জয়'- এর মতো কবিতার বই বা 'নীলকমল লালকমল'-এর মতো গদ‌্যকাব‌্যের বই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন তাকে যেমন নতুন করে বাংলা সাহিত‌্যের প্রকৃত পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজন পড়ে না, একইরকমভাবে, এতদিন পরেও নির্মল হালদার নামটির সাথে 'পুরুলিয়ার কবি ' - তকমাটির ব‌্যবহারও খুবই সংকীর্ণ ঠেকে। প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিশীল রচনা বা বাংলাভাষা-সাহিত‌্যের চর্চা ও প্রসারে নির্মল হালদার-এর যে অবদান আধুনিক বাংলা-সাহিত‌্য জগতে বুদ্ধদেব বসুর পরে এতো ব‌্যাপকভাবে কেউ রেখেছেন ব'লে আমার অন্ততঃ মনে হয় না। সর্বাঙ্গে মানভূম-পুরুলিয়ার ধূলোবালি মাখা থাকলেও জীবনভর সহজিয়া সাধনা নির্মল হালদারকে অনন‌্য করেছে। মাটি- প্রকৃতি ও মানুষের সাথে মিশে তাকে আত্মস্হ করার ফলে নির্মল হালদার -এর বহু কবিতায় যে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায় জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতায় তা দুর্লভ। প্রায় পাঁচ দশক ধ'রে তরুন প্রজন্মের কাছে নির্মল হালদার আজও সমানভাবে আদরণীয় এই কারণে, তিনি যে কবিতায় বাংলা ভাষার মুক্তি ঘটিয়েছেন তাই নয়, একইসঙ্গে বাংলা ভাষা-সাহিত‌্যের রত্নরাজির সাথে পরিচয় ও তার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার সহজ পথটিরও সন্ধান দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে অনর্থক মনে হলেও, সেই পথটিই মহাজনদের পথ। কবি সুভাষ মু্খোপাধ‌্যায়ের পদ ধার করেই নির্মল হালদার আজ হয়তো বলতে চাইছেন "ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমার লাগছে "। 
            নির্মল হালদার শুধুমাত্র কবি নন, একজন প্রকৃত শিল্পী। যে কোনো লেখার ডাইনে-বাঁয়ে, ওপরে-নীচে নির্মলের যে স্কেচগুলি আমার নজর কেড়েছে, সেগুলি অনবদ‌্য। বিভিন্নভাবে তাঁর গদ‌্য বা তাঁর কবিতাকে প্রাণময় করে তুলতে ফুল-পাখি, ঘর-বাড়ি বা গাছপালার যেসব স্কেচ হাতের যাদুতে অবলীলায় নির্মল আমাদের উপহার দিয়েছেন, তা নন্দলাল বসুর মতো শিল্পীর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এজন‌্যই হয়তো দেশের বড়ো বড়ো চিত্রশিল্পীদের চোখেও নির্মল হালদার এত প্রিয়। নির্মল হালদারের আঁকা পাখির স্কেচগুলির সাথে 'অনিকেত'-এর ভাবনা ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে। মনে পড়ছে, তাঁর একটি কবিতাতেও এরকম ভাবনা ধরা প'ড়েছে যেখানে নির্মল লিখছেন ' আমার কোনো ঘর-বাড়ি নেই তাই আমি ঘর-বাড়ির ছবি আঁকি আর একসময় সেখানে ঢুকে পড়ি।' 
            এই নির্মল হালদারকেই আমি দেখেছি, চিনেছি। দীর্ঘসময় ধ'রে ছাতিমতলার আড্ডা চ'লছিল। এরই মাঝে নির্মলের উদ‌্যোগে ও উন্মাদনায় গ'ড়ে উঠলো আর একটি আড্ডা। 'অনিকেত'-এর আড্ডা। পুরুলিয়ার চকবাজারের মেছোগলির মোড়ে একটা বড়বাড়ির রোয়াকে জমতো সেই আড্ডা। 'ছাতিমতলা'-যদি আমাদের কাছে 'আখড়া' -হয়, তবে 'অনিকেত'- ক্রমে ক্রমে আমাদের কাছে 'শক্তিপীঠ' -হ'য়ে উঠলো।



______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া 
______________________________________________

১/ লেখা, ছবি দুটোই সুন্দর।
থাইল্যান্ডের ডায়েরি পড়ে মুগ্ধ হলাম। শ্রদ্ধা। ভালোবাসা।
                         -----------কবি শ্যামাপদ মাহাত 

২/সমীর দে রায়ের দুইটি কবিতার উল্লেখ করতেই হয় -

রাত-শুক্তো
বৃক্ষ স্বপ্নময়

এই কবি কখনো স্বপ্নকে সমাদর করে বসতে বলেন আমাদের চেনা জানা ধুলোবালির অনাদরের মাটিতে যেখানে প্রান্তবাসী মানুষ কায়ক্লেশে জীবনের রসদ খুঁটে খায় 

আবার কখনো
আমাদের রঙচটা জীবনের জন্যে  
আদরের আসনটি পাতেন মাটি থেকে অনেক উর্ধ্বে কবির অন্তরশায়ী স্বপ্ন চরাচরে ...

আমার যেন এ এক রসক্ষেত্র আবিস্কারের আনন্দ;

আর কিছু নয়,আর কিছু বলার নেই।

আমার হয়ে কবিকে শুভেচ্ছা জানাতে অনুরোধ করছি সম্পাদক মহাশয়কে ।
                              -----------কবি পঙ্কজ মান্না 

৩/ অভিজিৎ মাজীর ফটোগ্রাফের সঙ্গে আমি মোটামুটি পরিচিত।
ওর ছবি দেখলেই পুরুলিয়া এবং পুরুলিয়ার জনজীবন দেখতে পাই।
অরন্ধন এগিয়ে চলুক।
                              ----------কবি নির্মল হালদার 

৪/ অনেক ধন্যবাদ এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে চলার জন্য...সাথে আমার এইসব হিজিবিজি "লেখা" প্রকাশ করার জন্য...
                                    ----------ময়ূখ দত্ত

৫/ ছবিগুলো অসাধারণ হয়েছে!------কবি সোমেন মুখোপাধ্যায় 

৬/ মুহূর্তগুলিকে সুন্দরভাবে ধরে এনেছেন তিনি।------কবি মহিউদ্দিন সাইফ 

৭/ দারুন....আমার খুব ভালো লাগলো একটা ছবিতে ঘং এর ছবি আছে।এটা তো এখন দেখতেই পাওয়া যায় না।screan shot করে রাখলাম, নিদর্শন হিসেবে। অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই ফটোগ্রাফার ভাইকে।
                                    -----------সীমা মাহাত গৃহবধূ 

৮/ সুন্দর সুন্দর সাহিত্য সম্ভারে সাজানো পত্রিকাটি।
প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয়।নির্বাচন নিয়ে সত্যিই আর বলার কিছু নেই। ভোট এলেই আতঙ্ক হয়, যে আর কত প্রাণ যাবে, আর কত রক্ত ঝরবে।
খুব ভালো লেগেছে অরন্ধনের এই সংখ্যাটি।👌👌❤️
                              ---------কবি সুনৃতা রায়চৌধুরী 

৯/ শুধু নির্মল হালদারই পড়লাম।
সত্যি কত জানা গল্পের অজানা কথা জানলাম।
                                -----------কল্যাণ মাহাত 

১০/ প্রতিটি সংখ্যায় লেখা পরিমাণে/সংখ্যায় কম দেখা যায়। কবিতার বাইরে একাধিক গদ্য/আলোচনা রাখলে ভালো হতো। যা-ই হোক, শুভকামনা সতত।
                             ----------কবি ফজলুর রহমান এনার 

১১/ অসাধারণ সব ছবি।

সবার কবিতাই ভালো লাগলো। ময়ূখ দত্তের গদ্যের চলন আমাকে মুগ্ধ করে।
                             ---------কবি অমিত মণ্ডল 





______________________________________________

                                 আমাদের বই












সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ :  সুনীল দাসের পেন্টিং, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com





 

মন্তব্যসমূহ

  1. পড়ে খুব আনন্দ পেলাম

    উত্তরমুছুন
  2. কিছু কিছু লেখা মন কে ছুঁয়ে গেল। "ছাতিমতলা"র স্মৃতিতে অনেকবছর পিছিয়ে গেলাম, কেমন যেন আবার তরুন হয়ে উঠলাম!! মাহিউদ্দিন সাইফের কবিতার সুত্র ধরে নিজেকেই যেন জিজ্ঞাসা করলাম সকাল কি আদৌ কখনো শেষ হয়? ভাল থাকবেন!!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪