চতুর্থ বর্ষ ।। চতুর্দশ ওয়েব সংস্করণ ।। ৫ কার্তিক ১৪৩০ ।। ২৩ অক্টোবর ২০২৩



প্রজাপতির ডানায় ভর করে উৎফুল্ল মনে উড়তে ভালোবাসি আমরা। আকাশকে নীল, হলদেটে, লাল দেখতে ভালোবাসি অহরহ। তার জন্য ছুটেও যাই যোজন যোজন দূর। কিন্তু তাকে স্থায়ী করার কথা ভাবি না। তাই সাড়ম্বরে পালিত উৎসবের পর স্পর্শ করে যায় দুঃখের রোজনামচা।
            আমরা যতটা অভাবি রাজ্য বলে মনে করি বা দেখানোর চেষ্টা করি এই রাজ্যকে তা কি স্পষ্ট হয়ে ওঠে এখানকার বড় বড় উৎসব গুলোকে দেখে? কখনোই না। কিন্তু যে কোন একটা হাসপাতালে গেলে? সেখানে সব সময় একটা সত্যিকারের অভাব পরিলক্ষিত হয়। দেখা যায়, এই রাজ্য কতটা বিবস্ত্র। দেখা যায় পরিকাঠামোর অভাবে হাজার হাজার রোগী বাধ্য হয়েই ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছেন প্রতিদিন। সেই বাহানায় ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছে এই রাজ্যের টাকাও। অথচ কত কত টাকার প্যান্ডেলে, কত কত টাকার সোনার গহনা পরে বসে আছেন মা। 
               সন্তানের এমন দুর্দশার সময় কিভাবে বসে থাকেন মা, এমন অবিচলিতভাবে?
               এই সম্পদের একাংশ দিয়ে, সে সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক না কেন, এখানকার চিকিৎসা পরিষেবার পরিকাঠামো বদলানো কি কোনভাবেই সম্ভব নয়? সম্ভব নয় ভিন রাজ্য থেকে বা ভিন দেশ থেকে আগত রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো গড়ে তোলা এই রাজ্যেই? কেবলমাত্র উৎসবে মেতে না থেকে এইসব বিষয়গুলো নিয়ে কবে ভাববে বাঙালি ও বাংলা? নাকি সরকারের উপর সমস্ত দোষ দিতে দিতে নিজেদেরও অনেক দোষ ঢাকিয়ে দেওয়ার চেষ্টাতেই এই রঙ ঝলমলে উচ্ছলতা? প্রজাপতির রঙিন ডানায় ভর করে ওড়ার চেষ্টা? 
               উৎসবে মেতে আছি দিব্যি। বুঁদ হয়ে আছি "আমরা বাঙালি," "আমাদের একটা উজ্জ্বল ইতিহাস আছে" এই গর্বে। কিন্তু সেই অহংকারে ভবিষ্যৎকে পদদলিত করে চলেছি সব সময়। তাই, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, সবকিছুর পরিকাঠামোগত এবং গুণগত মান তলানিতে ঠেকতে ঠেকতে হয়ে উঠছে বিবর্ণ।



উত্তম মাহাত, সম্পাদক 



______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
গৌতম দত্ত / সুমন মুখোপাধ্যায় / ডরোথী দাশ বিশ্বাস / অঙ্কন রায় / হাবিবুর রহমান এনার / গাফফার আনসারী / শ্যামাপদ মাহাত (বাঁশি) / সুজন পণ্ডা / রামানুজ মুখোপাধ্যায় / ময়ূখ দত্ত
_____________________________________________


প্রত্নশিলা

গৌতম দত্ত
                              

যে বৃদ্ধাটি সকালবেলায়
ঝুড়িভর্তি আতাফল
বিক্রি ক'রতো পথের মোড়ে

যে প্রৌঢ়া রমণীটি
সন্ধের ম্লান আলোয়
শহরের কানাগলির
দরজায় দাঁড়িয়ে প'ড়তো

দু'চোখে ঘোর লাগা
যে কিশোরীটি
স্কুল থেকে ফেরার পথে
কতদিন হ'ল হারিয়ে গেছে
কাশবনের ভেতরে

তাদের কারো নাম ছিল বিন্ধ‌্যবাসিনী
কারো নাম
কান্তারবাসিনী
কারো বা নাম ছিল বনদুর্গা

পরিত‌্যক্ত প্রাচীন মন্দিরগুলিতে 
তাঁরাই আজ শিলারূপে পূজিত হন







সারমর্ম

সুমন মুখোপাধ্যায়


আরও কিছু বছর পার হবে ।
সময় কঠিনতর হয়ে আসবে ।
ধারনা বদলাবে, খুশীর কারণ স্থানান্তর হবে ।
গন্তব্য বদলাবে । 
প্রেমের সারমর্ম কিছুটা ভুলে যাবো । অর্থের ওপর ঝোঁক বাড়বে ।
মানুষের সাথে কাঁটাছেঁড়া যোগাযোগ আরো বিচ্ছিন্ন হবে ।
কিন্তু ভুলে যেও না আমি কী এবং কেমন ছিলাম । 
নারকেল নাকি আসলেই পাথর নাকি বা কোমল একটা ঘাসফুল ।
খুঁড়ে খুঁটিয়ে না খুঁজলে, লুকিয়ে রাখবো নিজেকে ।

                               






খোলা জানালা---

ডরোথী দাশ বিশ্বাস


জানালা দিয়ে একটু বাইরে তাকাও, 
রাতের কালো মেঘ কেটে গেছে আজ
বেরিয়ে এসেছে যুদ্ধ জয়ের গৌরবে 
জ্বলজ্বলে এক সূর্য
রশ্মি ছড়িয়ে যেন তাড়া করেছে
কালো মেঘের দলকে,

কোথায় ছিলো ঘুঘুর 
প্রাণ হু হু করা ডাক?
ছাতারের দলের হুটোপুটি?

কতদিন চেষ্টা করেছি---
তবু সম্পূর্ণ শুনিনি---
"বাজলো তোমার আলোর বেণু"

পথ হাঁটতে কষ্ট হয় আজ---
অথচ বদ্ধ ঘরেই হেঁটে চলেছি রোজ
মাইলের পর মাইল।

আমার আকাশ জোড়া 
ঘোড়ানিম, গামারি, তুনের ক্যানোপি

তবু ভিতর আমার আলোকে দ্যুতিময়
কিভাবে কেটেছে কাল--- 
আজ শুধু দুঃস্বপ্ন মনে হয়।


         





অঙ্কন রায়ের কবিতা 

টুকরো ছেলেবেলা


গাছের ছায়া জলের পরে,
জলের ছায়া মনে।
সকালবেলার আলোর সুরে
হারাই বিজন বনে।
সে বন বুঝি তোমার আমার
বুকের ভিতর থাকে!
হারিয়ে যাবার পথ খুঁজি ওই
কিশোরবেলার ডাকে।।



হেমন্তের কবিতাগুচ্ছ

১.
হেমন্ত বড় নিঝুম, বড়ই শান্ত।
তার জন্যই আকুল এ মন প্রাণ তো।
একটুকু শীত, একটু শিশির-সন্ধে...
মন উচাটন ছাতিমফুলের গন্ধে।

হেমন্ত বড় মগ্ন, বড়ই চুপচাপ।
তাকে ঘিরে পড়ে শিশিরবিন্দু টুপটাপ।
একটুকু ভিজে স্বপ্নের মত সন্ধে...
দোলনচাঁপায় ভাসে মন মৃদুমন্দে।


২.
হেমন্তিকা করল গোপন
তোর দু'চোখের তারা।
ওই তারাতে লুকিয়েছিলাম,
হঠাৎ ছন্নছাড়া!
আসল কথা শিশির জলে
ভিজবে বলে মন...
হেমন্তিকায় ভিজিয়ে গেল
হৃদয় দেয়া ক্ষণ।


৩.
জানলায় চোখ, দূরান্তে ধানক্ষেত। 
সাঁঝের বাড়িতে আঁধার নেমেছে ধীরে।
একা নিরালায় বন্ধু জোনাক বাতি।
মনকেমনের সুর আসে ফিরে ফিরে।

চোখে কাজলের মায়াবি চাউনি আঁকা।
আবছায়া ভাসে দুই বিনুনির মেয়ে।
রিনিঝিনি পায়ে নুপূরের গুঞ্জন।
হেমন্তিকায় আজও খুঁজি চেয়ে চেয়ে।


৪.
নিঝুম সাঁঝের বিজন সে পথ
ছাতিম ফুলের গন্ধে ছাওয়া...
পড়ছে মনে যুবকবেলার
হেমন্তিকায় হারিয়ে যাওয়া।

দীপালিকার আলোকসাজে
বন সাজে না, ঝিঁঝিঁর ডাকে
ঘোর লাগানো রাতচরা মন
হেমন্তিকার সঙ্গে থাকে।

প্রিয়, বড়ই প্রিয় সে দিন,
যে দিন আমি একলা একা...
আতসবাজির অনেক দূরে
হেমন্তিকার মিলতো দেখা।

আজকে যখন বদ্ধ ঘরে
ঋতুর চাকা আলতো থামে...
চমকে দেখি প্রেম এসেছে
হেমন্তিকার হলুদ খামে।








হাবিবুর রহমান এনারের কবিতা 

১.
সংসার তাড়িত


সংসার তাড়িত...

তুমিও হয়েছ বেগানা, করেছ পর;
কোথায় যাবো?

স্টেশন, মসজিদ-মন্দির, আদালত;
এতটা বন্ধুত্বহীন দাঁড়িয়ে শহরের বুকে!

একা ভবঘুরে, ঘুরছি...ঘুরতেই আছি...

যেহেতু আপাত থাকার জায়গা নেই! 

ভাবছি—
একটু স্বাবলম্বী হলে, তোমার কবরটা
ভাড়া নেব আমি!




২. 
হককথা


কবি?
কবি রূপকের আয়নায়...কেমন?

সত্যি বলে তো—
কবি? হয় শয়তান, না হয় দেবতা!








নগ্নতা

গাফফার আনসারী 


সারাটা জীবন কেবল অন্ধকার ঘেঁটে যাওয়া
হাতের নাগালে যা কিছু এসে পড়ুক না কেন
একটু নাড়াচাড়া করে মুচকি হেসে 
নিজের ওপর অহং বশে ভাবছেন
হাতের মুঠোয় পৃথিবী ঘোরাচ্ছি...
আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত 
আপনার দেওয়ালে পিঠ।
দেওয়াল ছেড়ে উঠে পড়তে চাইছেন?
জানি, আপনি তল পাচ্ছেন না কিছুরই
পায় না, কেউই তল পায় না
কেবল 'পেয়েছি' এই ভাবনায় ডুবে থাকে মানুষ
বিশাল এই পৃথিবীতে বাথরুম আর বেডরুম ছাড়া 
নগ্ন হওয়ার জন্য সত্যিই কত কম জায়গা !








প্রসাদ

শ্যামাপদ মাহাত (বাঁশি)


কে যেন বলে গেল
দুর্গা আসবে

সিঁদরির হাট থেকে!

অপু অপেক্ষা করছে কুমারীর পাড়ে

শরতের আকাশে মেঘ নয় উড়ছে মায়ের আঁচল
 
জিলিং-এর মুদি ঘরের আঙিনায় 
আঁচলে বসে বাটিতে মুখ দেয় দুই ভাই

গণেশ কার্তিক।

পান্তার প্রসাদে পরমান্নের স্বাদ।








ফিনিক ফোটা জোছনা

যে আলো নির্জনে রাখে

সুজন পণ্ডা


যখন ঘুম ভাঙলো, রাত্রি গভীর। ভোর হতে তখনও দেরি আছে। কত দেরি আমি জানিনা। হাতের কাছে মোবাইল থাকে, সময় দেখলে বোঝা যাবে ঠিক কত দেরি, কিম্বা রাত্রি কতটা গাঢ়?
 দেখতে ইচ্ছে করলো না। ইন্দ্রিয় জানাচ্ছে এখন অসময়। অথচ ঘুম এক্কেবারে ভেঙে গেছে।
দুঃস্বপ্ন দেখলাম কিছু? ঘুম ভাঙার কারণ আমি জানিনা।

জানালার কাছে উঠে গিয়ে একটা সিগারেট খাওয়া যেতে পারে। জানলা দিয়ে বড় রাস্তা দেখা যায়। ঘুমন্ত শহর দেখা যায়। অবিরত কিছু ট্রাক ছুটছে। উন্মাদ তাদের গতি।

জানালা গলে সূক্ষ্ম ধারায় জোছনা ঢুকে আসছে। সেই আলোতে একটি অবয়ব তৈরি হতে দেখলাম, ধোঁয়ার মত, ভারী কুয়াশার মত।

যেমনটা প্রায়ই দেখি। সে এসেছে, যেমনটা প্রায়ই আসে।

বললাম, আবার এসেছো? বারবার কেন বিরক্ত করো আমাকে? আমি তো বলেছি আমি তোমাদের সাথে নেই.. আমার কোথাও যাওয়া হবে না।

ধোঁয়ার মূর্তি বললো, আমার উপায় নেই, তোমাকে নিয়ে যেতে না পারলে আমার চির নির্বাসন। আমিও আটকা পড়ে যাবো। তুমি একবার চলো, আমি আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাবো তোমাকে।

আমি কি করবো গিয়ে?

আমাদের শূন্যতার ধারণা দেবে... আমরা বিষয়টি অনুধাবন করতে চাই।

শূন্যতার ধারণা? শূন্য কি তুমি জানোনা?

  শূন্য কি অবশ্যই জানি, সংখ্যা শূন্য সম্বন্ধে আমাদের পরিষ্কার ধারণা আছে, আমরা জানতে চাই ওই আবেগের বিষয়ে। ওই যে শূন্যতার অনুভূতি ওই বিষয়ে।

আমাকে নিয়ে যেতে না পারলে তুমি আটকা পড়ে যাবে? কিভাবে?

 ব্যাপারটা জটিল, ধোঁয়া আরেকটু জড়িয়ে এসে বললো আচ্ছা চেষ্টা করছি বোঝাতে, এই যে তুমি এখানে আমাকে দেখছ, আমি নিজে এখানে আসিনি, তুমি আমার একটি মূর্তি দেখছ, আমার hologram বলতে পারো। আমরও ত্রিমাত্রিক একটি শরীর আছে, যতদিন অব্দি তুমি আমার সাথে না যাবে, আমি hologram হয়েই থেকে যাবো....

এই পৃথিবীতে এত মানুষ, তুমি আর কারো কাছে যাও... আমাকে মাফ করো।

অন্য কোথাও যেতে পারবো না, যে ওয়ার্মহোল দিয়ে আমার হোলোগ্রাম এখানে প্রতিস্থাপিত হয়, তার মুখ শুধু এখানেই এই তোমার ঘরেই খোলে, কাজেই আমার অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়....

শোনো, আর কখনো আমাকে বিরক্ত করবে না। আমি কোথাও যাবো না। যেতে পারবো না। আর তাছাড়া তোমার কথা শুনে যা বুঝতে পারছি তোমাদের বিজ্ঞান অনেক উন্নত, তো সেখানে এই আবেগের অনুভূতি নিয়ে হবেই বা কি? দিব্যি তো আছো।

আমরা জীবনের ব্যাপারে জানতে চাই। অঙ্ক বলছে জীবন অর্ধেক যুক্তি, অর্ধেক আবেগ। যুক্তির অংশ টি বিজ্ঞান দিয়ে আমরা বুঝবো। আবেগের অংশে আমাদের সাহায্য লাগবে। আমরা আবেগ বিষয়ে জানতে চাই।

এই যে বললে তোমরা শূন্যতা নিয়ে জানতে চাও....

বিজ্ঞান যেমন শূন্য থেকে শুরু, বিগ ব্যাং এর আগে তো বিরাট শূন্য ছিলো... আবেগের শুরুও ওই শূন্যতা বোধ থেকে বলে আমরা মনে করি। আমরা চাই তুমি ওই শুরুটা ধরিয়ে দাও....

আমি কোথাও যাবো না।
কিছুক্ষন ভেবে ওকে বলি, তবে এখানে আমি তোমাকে যদি ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করি? কেমন হয়?

ধোঁয়ার অবয়ব নড়েচড়ে ওঠে, শেখার জন্য আগ্রহী হয়।

ওকে জিজ্ঞেস করি, তোমার বাড়িতে কে আছে?

আমার সঙ্গীনী।আমার সন্তানের মা। 

তার জন্য, তাদের জন্য তোমার মন খারাপ করে না? এই যে আমাকে নিয়ে না ফিরলে আর ফেরা হবে না, তাহলে তো তার সাথে দেখাও হবে না কখনো। দুঃখ হয় না?

দেখো, যতক্ষণ আমি না ফিরছি, ততক্ষণ সে আছে নাকি নেই তাই তো জানতে পারছি না। সেও বুঝতে পারছে না, আমি ফিরব কি না? না ফেরা অব্দি দুটো সম্ভাবনাই স্পষ্ট। আর সর্বোপরি এসব তো আমার হাতে নেই।
কিছুক্ষণ কি একটা চিন্তা করে সে বলে, আচ্ছা তুমি কি বলতে চাইছো তার না থাকাই শূন্যতা?

আমি বলতে কিছুই চাইছি না।কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। ঘুম পাচ্ছে আমার। জানলা দিয়ে যেটুকু জ্যোৎস্না ঢোকে তাতে আলো হয় না, অন্ধকার কতটা জমাট সেই বোধ তীব্র হয়। জ্যোৎস্নার আড়ালে থাকা আঁধারকে ভয় লাগে।
আশার কথা, এই আলো ক্ষনস্থায়ী। এই ভয় খুব বেশি ক্ষণ থাকে না।

সে আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললো কিছু বললে না? কি ভাবছো?

আমি বললাম, হাত বাড়াও। মুঠো করে ধরো এই জোছনা।

সে ব্যার্থ প্রয়াসে হাত রাখে চাঁদের আলোতে। মুঠো করে, জোছনা বাঁধন মুক্ত হয়ে মুঠোর ওপরে পড়ে।
আবার চেষ্টা করে সে, আবার ব্যার্থ হয়... তারপরেও আবার....

এরপর ঠিক কতক্ষণ আমরা কথা বলিনি জানিনা।
সব কথা বলতে হয় না। সবসময় কথা বলতে হয় না।নিশ্চুপ জ্যোৎস্না অনেক ধারণা বদলে দেয়।

কোনকিছুর অনুপস্থিতিতে শূন্যতা তৈরি হয় না। উপস্থিত কোনকিছু ছুঁতে না পারার যন্ত্রনা জন্ম দেয় নিঃসঙ্গতার। মহাশূন্যের নির্জনতা মানুষকে আকুল করে,কারণ তার চোখের সামনে পৃথিবীর সবটাই অথচ ছোঁয়া যাচ্ছে না তাই।

সম্পর্কের অঙ্কেও এই হিসেব।

হঠাত আঙুলে সিগারেটের ছ্যাঁকা লাগতে হুঁশ ফিরে আসে। 
আমার চোখের সামনে তখন, বিস্তীর্ণ রাজপথ। উন্মাদ ট্রাক। কোথাও কোনো ধোঁয়ার কুণ্ডলী নেই।

কোথাও ছিলও না কখনো... না তার আগে না তার পরে।

দেখতে না পেলেও স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমার মুখে জ্যোৎস্নার আলো পড়ছে। আমার গাল ভিজে যাচ্ছে।

 






কাশ ফুলের হাওয়া 

রামানুজ মুখোপাধ্যায়

তৃতীয় পর্ব 

(উৎসর্গ: প্রিয় কথাশিল্পী রামকুমার মুখোপাধ্যায়, শ্রীচরণেষু)

প্রাচীন পারিবারিক রীতিগুলি দুর্গোৎসব থেকে এখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। রথের দিনে মাটি দেওয়া হয় কাঠামোয়। বাতাসে ভেসে আসে ভিজে মাটির সুঘ্রাণ। ছোটোবেলায় ছুতোরঘরে গিয়ে দেখতাম, চলছে নানারকম মাটির কাজ। এসেছে লাল এঁটেল মাটি। জল দিয়ে ভেজানো আছে। মাটি থেকে কাঁকরগুলি বাছা হবে। তারপর মেশানো হবে কুচিকুচি পাটের টুকরো। তাতে মাটির চিট বাড়বে। বেশ নরম করে মাখা হবে মাটি। এ-মাটি দিয়ে তৈরি হবে প্রতিমার মুখ আর আঙুল। দুর্গা, লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক এবং অসুরের মুখ তৈরি হবে ছাঁচে। পায়ের আঙুল অনেক সময় ছাঁচেই তৈরি হয়। হাতের আঙুলগুলি মুদ্রা অনুযায়ী গড়ে নেওয়া যায়। গণেশের শুঁড়সমন্বিত মুখ তো মূর্তির সঙ্গে প্রথম থেকে জোড়া লেগে থাকে। উঠোনের এক কোণে ভেজানো থাকে হলুদ রঙের গুলুনি মাটি। সে-মাটি দিয়ে প্রতিমার গায়ের পালিশ হবে। পালিশ করার জন্যে ব্যবহার করা হবে মানকচুর ডাঁটি। কোথাও নরম পলিমাটির পালিশ, কোথাও গুলুনি মাটির সঙ্গে চেটানো হবে কাপড়। থাকে সরু-মোটা চেরি, পালিশের কাজে লাগে। বাঁশের তৈরি। আমাদের মন্দিরেও এনে রাখা হয় এঁটেল মাটি, খড়, টুকরো বাঁশ-পাটা এবং দড়ি। ধানের কুড়ো মিশিয়ে মাখা হয় মাটি। তাকে বলে একমৃত্তিকা। এর একটা অদ্ভুত সুগন্ধ আছে। মূর্তি তৈরির কাজে লাগবে বলে আগের থেকেই কেচে রাখা হয় নরম কাপড়। এমনকী নারকোল কুড়ে মালাগুলিও আগে রেখে দেওয়া হত নানারকম রঙ রাখার পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে। এখন অবশ্য সে-পাট চুকেছে।

ছিল মাটির বাড়ি, গোলাভরা ধান, নিকোনো উঠোন। পাকা দেয়ালগুলিতে দেওয়া হত সাদা চুন, সঙ্গে মেশানো থাকত নীল এবং আঠা। কোনো-কোনো দেয়ালে থাকত এলামাটির হলুদ রঙ। বাড়ির দেয়ালগুলি, উঠোন এবং বারান্দাও নিকোনো হত রাঙামাটি দিয়ে। জানলা-দরজা আর দেয়ালের নীচের দিকে দেওয়া হত কালো আলকাতরার প্রলেপ। মন্দিরের ছোটো-বড়ো চৌকিগুলি, এমনকী হাড়িকাঠের নীচের অংশেও দেওয়া হত আলকাতরা। দু-তিনজন শ্রমিক পুরুষানুক্রমে এই কাজগুলি করে আসছিলেন বহু বছর ধরে। সারা পাড়ায়, একে-একে সবগুলি ঘর মাসখানেক ধরে নিকোতেন তাঁরা। এখন তো সিন্থেটিক রঙ, অনেকরকম। এসেছেন পেশাদার রঙমিস্ত্রিরা। বছর-বছর রঙ করার প্রয়োজন হয় না। 

পুজোঘরে কাজ কি অল্প! পুজোর সময়ে প্রয়োজন হয় অনেক-অনেক বাসনপত্রের। যে-সব কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র সরাসরি পুজোর কাজে লাগে, সাধারণত সেগুলি ভাড়া করা হয় না, বাড়িতেই থাকে। পারিবারিক সম্পত্তি। সারা বছর তোলা থাকে চিলেকোঠার ঘরে। সে-সব বাসন নামিয়ে চলে আমড়া এবং পাকা তেঁতুল দিয়ে ধোয়ামাজার কাজ। ষষ্ঠীর দিন থেকে একাদশীর একবেলা পর্যন্ত পরিবারের সবাই খাওয়াদাওয়া করেন একসঙ্গে এক হেঁসেলে। সপ্তমী, নবমী ও দশমীর দিনে গ্রামের এবং বাইরের নিমন্ত্রিত অতিথিরা অন্নগ্রহণ করেন। সেই বাসনগুলি কিছু বাড়িতে থাকে, কিছু ভাড়া করে আনা হয়। উঠোনে ছাউনি পড়ে বাঁশ-ত্রিপল-কাপড়ের। মাসখানেক আগে থেকে পুজো-পুজো রব পড়ে যায় চারপাশে। 

কত উপচার যে দুর্গাপুজোয় লাগে তার ইয়ত্তা নেই। চলে সে-সবের সন্ধান। কোথায় নীল পদ্ম ফুটেছে, কোথায় কাঁচা হলুদ-রক্তকম্বল-জোড়া বেল-মানকচু-রক্তকরবী পাওয়া যাবে, মন্দিরের সেবাকার্যে নিয়োজিত ভক্তরা সে-সব খুঁজেপেতে রাখেন। ছাগবলি হবে। অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় একটি শ্বেত ছাগ, একটুও অন্য রঙ থাকলে চলবে না। নবমীর দিনে চাই আরও অন্তত দু-টি ছাগ, যে-কোনো রঙের। ছাগ আগে থেকে বায়না করে রাখা হয়। তৈরি হবে নাড়ু। ভিয়েন বসবে ঘরে। দক্ষ কারিগর আসবেন। খই নাড়ু, সিড়ি ও বোঁদের নাড়ু, নারকেল নাড়ু, আড়শে এবং মণ্ডা-বাতাসা-কদমা তৈরি হবে। খইকে গুড় দিয়ে রাঙিয়ে তৈরি হবে মুড়কি। অন্নগ্রহণ না-করে স্নান সেরে শুদ্ধ কাপড়ে পরিবারের বড়োরা নাড়ু পাকাতে বসবেন। পাকাতে-পাকাতে হাত থেকে নাড়ু মাটিতে পড়ে গেলেই সেই নাড়ু দিয়ে দেওয়া হবে কচিকাঁচাদের। ছোটোবেলায় আমরা তার অপেক্ষায় থাকতাম। সম্প্রতি নাড়ু-মুড়কি বেশির ভাগটাই কেনা হচ্ছে দোকান থেকে। 

আতপ চাল ভানানো হবে। চারদিনের পুজোয় পরিমাণে অনেক আতপ চাই প্রায় সব ঘরে। পরমান্ন ও পোলাও রান্নার জন্যে তৈরি হবে গোবিন্দভোগের আতপ। আতপ সাধারণত দোকান থেকে কেনা হয় না। দেবোত্তর জমিতে চাষের চাল থেকে আতপ ভানিয়ে নেওয়া হয় মেশিনে। গ্রামের ধানভানার মেশিনটি একদিন বরাদ্দ রাখা হয় সবার আতপ ভানিয়ে দেওয়ার জন্যে। সর্বসম্মতভাবে একটি দিন স্থির করে ঘরে-ঘরে জানিয়ে দেওয়া হয়। ওইদিন শুধু পুজোর আতপ কোটানো হবে। বাড়ি-বাড়ি বস্তাবন্দী ধান আগে যেত গোরুরগাড়িতে। এখন তো গোরুরগাড়ি নেই, যায় মোটরভ্যানে, টোটোয়। আতপগুলি ধুয়ে, শুকিয়ে ভরে রাখা হয় টিনের মধ্যে, অথবা পাথরের বড়ো পাত্রে। পাথরের এই বড়ো পাত্রগুলিকে বলা হয় খুড়পি।

সারা বছর মন্দিরে পালিত হয় নানা তিথি-উৎসব।  মঙ্গলচণ্ডী, বিপদতারিণী, জন্মাষ্টমী-রাধাষ্টমী, ষষ্ঠীর ব্রত, পৌষলক্ষ্মী, চৈত্রসংক্রান্তি --- এমন অনেক ব্রতপার্বণ অনুষ্ঠিত হয় এই নাটমন্দিরে। ব্রতপার্বণগুলিতে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সবাই পুজো দিতে পারেন। গ্রামের বহু মানুষ সেইসূত্রে মন্দিরে আসেন। সরিকদের পারিবারিক অনুষ্ঠান --- বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন --- মন্দিরেই অনুষ্ঠিত হয়। একমাত্র শ্রাদ্ধ ও স্মরণানুষ্ঠান হয় বাড়িতে।

দেবোত্তর বিষয়সম্পত্তি শুধু সরিকদের মধ্যে ভাগাভগি হয়ে নেই। কাজের চুক্তিতে দেওয়া আছে কিছু মানুষকে। যেমন আড়াই বিঘে চাষযোগ্য জমি দেওয়া হয়েছিল সূত্রধরদের। পুরুষানুক্রমে তাঁরা সে-জমিতে সারা বছর চাষাবাদ করতেন। ফসল উঠত তাঁদের ঘরে। তাঁরা আমাদের দুর্গা প্রতিমাটি গড়ে দিতেন, বিনিময়ে কোনো অর্থমূল্য পেতেন না। পুজোর সময়ে নতুন জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়া, উপহার-আপ্যায়ন সাধ্যমতো তাঁদের প্রাপ্য ছিল। সূত্রধররা নিজেরা চাষের কাজ করেন না। চাষের আয়ও কমেছে। সাত-আট বছর হল তাঁরা জমিগুলি ফিরিয়ে দিয়েছেন সরিকদের হাতে। এখন বাজারদর অনুযায়ী অর্থমূল্যের বিনিময়ে তাঁরা দেবীপ্রতিমা গড়ছেন। দু-দশক আগেও আমাদের গ্রামের মন্দিরগুলিতে কর্মকার, সূত্রধর ও কাহারদের এমন নগদবিদায়ের ব্যবস্থা ছিল না। কর্মকাররা ছাগবলির সময়ে ঘাতকের দায়িত্বে থাকতেন, ডাকের সাজ তৈরি করতেন, বিসর্জনের সময়ে প্রয়োজনীয় হ্যাজাক লাইটগুলি সচল করে রাখতেন। পরিবারের নিজস্ব খড়্গ আছে, তাতেই ছাগবলি দেওয়া হয়। কর্মকাররা সেটি মেজেঘষে দিতেন। বলিপ্রদত্ত ছাগমুণ্ড, প্রসাদ, এবং দক্ষিণা বাবদ কিছু অর্থ তাঁরা পেতেন। তিন দশক আগেও সরিকদের পরিবারের কেউই মন্দিরে ছাগবলির ঘাতকের দায়িত্বে থাকতেন। এখন অর্থের বিনিময়ে কোনো পেশাদার ঘাতক সে-কাজ করেন। সরিকদের মধ্যে নানা মতান্তরের পরেও অনেক মন্দিরে বলিপ্রথা এখনও উঠে যায়নি। 

মন্দিরের কাজে একাধিক সহায়ক মানুষ থাকেন। প্রতিমার গায়ে মাটি দেওয়ার সময় থেকে প্রতিমা নিরঞ্জনের পরের দিনগুলি পর্যন্ত নানা দায়িত্ব থাকে তাঁদের। প্রতিমা তৈরির মাটি আনা। মাটিকে প্রতিমা তৈরির উপযুক্ত করে তোলা। প্রয়োজনে সূত্রধরশিল্পীর সহায়ক নানা কাজ করে দেওয়া। মন্দিরচত্বর ও তার চারপাশের অংশ পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন রাখা। পুজোর চারদিন ফুল-বেলপাতা তুলে আনা, বোধনের আগে নবপত্রিকার ফুল-ফল-শস্য জোগার করা, মন্দির ধোয়ামোছা --- তাঁদের প্রধান কাজ।

বিজয়া হয় দশমীর সন্ধ্যায়। কাহাররা প্রধানত জাতিতে বাগদি, মুচি, ডোম। অন্তত তিরিশ-চল্লিশজন কাহার থাকেন সেই দলে। তারা নেশা করে পর্যাপ্ত পরিমাণে। এখন অনেক পুজোয় এই প্রথাটির পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিমা নিরঞ্জন হচ্ছে ট্রাকটারের সাহায্যে। শুধু আমাদের পারিবারিক প্রতিমাটি নয়, গ্রামের সবগুলি প্রতিমা একইভাবে ট্রাকটারের সাহায্যে বিজয়া করা হচ্ছে। একটি বৃহৎ পুজো মনে শুধু আধ্যাত্মিক আরাধনা নয়, বহু মানুষের অন্নসংস্থানও। উৎসব আসলে মানুষে-মানুষে সংযোগের মাধ্যম। ক্রমশ পারিবারিক শারদোৎসবকে ঘিরে বহু সংখ্যক মানুষের সংযোগের ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়ে আসছে।



চতুর্থ পর্ব

পুজো মানেই বাদ্যি বাজবে। কাঠি পড়বে ঢাকে। ঢাক বাজে কয়েকটি পুজোমণ্ডপে। আমাদের এই গ্রামে পারিবারিক দুর্গোৎসবে বাজে ঢোল, সানাই আর কাঁসি। আমাদের পারিবারিক মন্দিরে একটি বাজনার দল একবার বাজাতে শুরু করলে তাঁদের সচরাচর বদল হয় না। প্রত্যেক বছর এক‌ই পুজোয় বাদ্য বাজানোকে বাদ্যকররা বলেন গাদি ধরে রাখা। গাদি ধরে রাখতে পারলে পুজোর আনন্দটুকু মাটি হয় না।

বিগত ছাব্বিশ বছর ধরে যাঁরা বাদ্য বাজাচ্ছেন তাঁরা বীরভূমের দুবরাজপুরের নিকটবর্তী কুখুটিয়া-চণ্ডীপুর গ্রামের অধিবাসী। পূর্ণচন্দ্র ও মানিক বাদ্যকর ঢোল বাজান। সানাই বাজান নিমাই বাদ্যকর। কয়েক বছর হল হাঁপানির টান কাবু করেছে তাঁকে। আসছেন অন্য কেউ। প্রত্যক বছর কাঁসি বাজানোর জন্যে কোনো এক কিশোর তাঁদের সঙ্গে আসে। এর আগে বাদ্য বাজাতেন বাদলচন্দ্র ডোমের একটি দল। তিনি যখন শারীরিকভাবে আর পেরে উঠলেন না তখন নিজেই এই বাজনদারের দলটিকে বায়না করে আনলেন। তারপরেও আমৃত্যু বাদলচন্দ্র পুজোর চারদিন আমাদের মন্দিরে আসতেন, থাকতেন, আনন্দ করতেন। অশক্ত শরীরে বাজনদারদের সঙ্গে বসে-বসে দেখতেন পুজো। 

ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। আমার‌ একটি কাঁসি ছিল। এনে দিয়েছিলেন আমার দাদু। বাজনদারদের দলে ভিড়ে সেটি বাজাতাম। আমার‌ও চাই ঢোল। বায়না করতাম বাদল জেঠুর কাছে। একটি শক্ত টিনের কৌটোর দু-দিক ছেয়ে দিতেন ব্যাঙের চামড়া দিয়ে। গড়ে দিতেন বাঁশের পোক্ত গিঁটের বাজনকাঠি। সারা বছর আমার ঢোলটি বাজত। প্রত্যেক বছর আমার নতুন ঢোল তৈরি হত বাদল জেঠুর হাতে। ছাগবলির পরে একটি অক্ষত চামড়া তাঁরা টানটান করে মিলে রাখতেন রোদে। ঢোল ছাওয়া হবে। নতুন বোল ফুটবে তাতে। চামড়া কি আর আছে, প্রায় সব ঢোল‌ই তো আজ পরে নিয়েছে প্লাসটিকের জামা!

তাঁদের থাকার জন্যে ঘরের ব্যবস্থা করা থাকে। থাকে যথাসাধ্য অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনাও। সাবান-তেল, জলের বোতল, মশা তাড়ানোর ধূপ, তালাই ইত্যাদি৷ আগে একটি লন্ঠন অথবা লম্ফ, হাতপাখাও দেওয়া হত। এখন তো সর্বত্র ইলেকট্রিসিটি আছে। প্রত্যেক দিন লাগে কয়েক তাড়া বিড়ি। বিজয়ার দিনে সিগারেট। বাদ্যকরদের খাওয়াদাওয়া হয় সরিকদের মধ্যে ভাগাভাগি করে, এক-একদিন এক-এক বাড়িতে। শরীর খারাপ হলে ওষুধ-ডাক্তার। ওটুকু তো করতেই হবে।

ভোরবেলা থেকে আগমনীর সুর ধরে সানাই। ঢোল তার লহর তোলে। আমাদের এই বাদ্যকররা সত্যিকারের শিল্পী। শব্দ যেন নান্দনিক মাধুর্যে নৃত্য করে তাঁদের কাঠিতে। পুজোর আগে, মাঠে ধান পোঁতা হয়ে গেলে একবার তাঁরা আসেন, খবরাখবর দিয়ে যান। সেই দিনের খাওয়াদাওয়া এবং যাওয়া-আসার খরচ পাওয়া যায় মন্দির-তহবিল থেকে। আসতে না-পারলে আগে তাঁরা চিঠি লেখাতেন নিজেদের গ্রামের কোনো স্বাক্ষর ব্যক্তিকে দিয়ে। দশককাল হল ফোনেই খবরাখবর দেওয়া-নেওয়া হয়। তারপর একেবারে ষষ্ঠীর দিন বিকালে তাঁরা এসে উপস্থিত হন। শুধু খাদ্য নয়, পর্যাপ্ত পরিমাণের চেয়ে বেশি মদ্যও চাই প্রায় প্রত্যেক দিন। মন্দির-তহবিল থেকে যা পারিশ্রমিক তা তো মিলবেই শেষে। মদের দোকানেও বলা থাকে। এই বাবদ প্রাপ্য অর্থকে বলা হয় মদের ইনাম। পাশাপাশি চলতে থাকে ব্যক্তিগত অনুরোধ-আবদার। সেই পয়সায় অবসর বিনোদন। মন্দিরে সন্ধ্যারতির সময়ে তাঁদের বাজনার নানারকম বৈচিত্র্য বহু মানুষের মনোরঞ্জন করে।

নবমীনিশির অবসান হলে দশমীর ব্রাহ্ম মুহূর্ত থেকে সানাই বাজাবে বিজয়ার সুর। এর মাঝে অবশ্য নানা গানের সুর তোলে সানাই। তাতে হিন্দি-বাংলা, লোকগান-শ্যামাসংগীত-কৃষ্ণকীর্তন কোনো কিছু বাদ থাকে না। প্রতিমা বিজয়ার সময়ে তো কেউ-কেউ নাচবেন। লাঠিখেলা হবে বিসর্জনের ঘাটে। সেইসময়ে উচ্চগ্রামে মনোরঞ্জনী বাজনাও বাজবে। বছর পঁচিশেক আগে বিজয়ার সন্ধ্যায় বসত মেলা। আর‌ও নানা প্রতিযোগিতার সঙ্গে ছিল সানাই এবং ঢোলের লড়াইও। ছিল পুরস্কার। পথে দু-দিক থেকে দুটি পুজোর শোভাযাত্রা মুখোমুখি হলে বাজনার লড়াই অবধারিত। এক-একটি পুজো মণ্ডপে বাজনদাররা আসেন এক-একটি দিক থেকে। বছরে এই একবার হয়তো তাঁদের‌ও দেখাসাক্ষাৎ, ভাববিনিময় হয়। সে-ছবি বড়ো মধুর। একাদশীর দিন তাঁরা যখন সদলে ঘরে ফেরেন, ঘরের মানুষজন‌ও তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করে থাকেন একরাশ প্রত্যাশার আলো নিয়ে।



পঞ্চম পর্ব

প্রাকৃতিক দুর্যোগ না-হলে দশমীর সন্ধ্যায় আমাদের প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। শূন্য মন্দিরে পড়ে থাকে একরাশ মনখারাপ। বিজয়ার প্রণাম জানানো শুরু হয়। সশরীরে এবং দূরভাষেও। মিষ্টিমুখও হয়। সারা বছর প্রত্যেক মানুষের জীবনজীবিকার ব্যস্ততা থাকে। কত নিকটজন সপরিবারে থাকেন দূরের কোনো শহরে। সারা গ্রামে এমন মানুষজনের মিলনের একটিই মরশুম। গল্প-আড্ডা-ভাব বিনিময়। সবার হাতে পুজোর চারটে দিন গ্রামে থাকার সুযোগ থাকে না। দশমীর পরে গ্রাম ধীরে-ধীরে ফিরে যায় নিজের খেয়ালে।

একাদশীর সকালে থাকে সরিকদের অন্য ব্যস্ততা। মন্দিরে সমস্ত সরিক একসঙ্গে বসেন হিসেবে। খরচ কত হল। কার কী প্রাপ্য মেটাতে হবে। আগামী বছরের জন্যে বায়না করে রাখা হবে কাদের। সেইসব সিদ্ধান্ত নিতে হয় একসঙ্গে বসে। জাবদা খাতায় বছরের-পর-বছর লেখা থাকে সেই হিসেব। প্রাচীন পারিবারিক দুর্গোৎসবের এই হিসেবের খাতাগুলির মধ্যে মুখ লুকিয়ে থাকে সামাজিক ইতিহাসের সাক্ষ্য।

পারিবারিক মন্দির-তহবিলের এজমালির হিসেবের খাতা যেমন আছে, তেমনি অনেকে ব্যক্তিগত হিসাবপত্রও সংরক্ষণ করেন। এজমালি হিসেবের খাতায় জমা-খরচের পাশাপাশি লেখা থাকে প্রত্যেক সরিককে তাঁর অংশভাগ অনুযায়ী কত অর্থ মন্দির-তহবিলে দিতে হবে সেই অঙ্কটিও। যে-যাঁর পুরোনো হিসেবের খাতা হাতে নিয়ে আসেন মন্দিরে। এমনই একটি খাতা এখন আমার হাতে, উলটেপালটে দেখছি অর্ধশতাব্দী আগের একটি দুর্গাপুজোর হিসেব। এই খাতাটি কমলাক্ষ মুখোপাধ্যায়ের। তিনি প্রয়াত হয়েছেন প্রায় তিন-দশক আগে। এ-খাতাটি তাঁর উত্তরাধিকারী শ্রদ্ধেয় শ্রীসুধীরকুমার মুখোপাধ্যায় সংরক্ষণ করেছেন, তাঁরা এখনও হিসেব লিখে রাখেন এই একই খাতায়। পদবিতে মুখোপাধ্যায় হলেও তাঁরা আসলে অযোধ্যার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা পুজোর অন্যতম সরিক। পুজোর হিসেবের খাতার দু-এক টুকরো এখানে আপনাদের জন্যে রাখি।

১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের পুজোয় প্রতিমার ডাকের সাজের জন্যে দেওয়া হয়েছিল বত্রিশ টাকা। বাদ্যকররা পেয়েছিলেন চোদ্দো টাকা সাম্মানিক। ছাগবলির ঘাতক পেয়েছিলেন এক টাকা। তন্ত্রধারকের সম্মানদক্ষিণা পাঁচ টাকা। সবমিলে মাত্র একশো উনসত্তর টাকা খরচ হয়েছিল দুর্গাপুজোয়। বেশ কয়েক পাতা উলটে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের হিসাবপত্রটি দেখি। তন্ত্রধারকের সাম্মানিক ছ-টাকা, ডাকের সাজ পঁয়তাল্লিশ টাকা, বাদ্যকর-বিদায় কুড়ি টাকা। আর সেইসঙ্গে দেখছি প্রতিমা বিসর্জনের কাহাররা পেয়েছেন দু-টাকা। যিনি পুজোর ফুল-বেলপাতা তুলেছেন তিনিও দু-টি টাকা পেয়েছেন। দোয়াতের কালির টানে আরো কত ছোটো-ছোটো হিসেব লিপিবদ্ধ হয়ে আছে এই জাবদা খাতায়। ১৯৭৩-এ পুজোর মোট খরচ হয়েছিল দু-শো ছেষট্টি টাকা। শেষে লেখা আছে সরিকদের কার কত ভাগ। এ-খাতা ধরে-ধরে পাতা উলটে এই সময় পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হিসেবগুলি দেখলে, যে-কোনো সন্ধানী চোখে ধরা পড়বে সামাজিক-অর্থনৈতিক পটপরিবর্তনের এক আশ্চর্য চলচ্ছবি। খাতায় যা লেখা থাকে না, তা হল সরিকদের মধ্যে বিবাদ ও মনোমালিন্যের গাথা। সরিকি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে, এমনকী হিসেব চলতে-চলতে সামান্য দু-চার টাকা নিয়ে প্রকাশ্যে ঝগড়া, এ তো লেগেই থাকে। মিটমাটও কি হয় না?








ডাইরির ছেঁড়া পাতা - থাইল্যান্ডের ডাইরি 

ময়ূখ দত্ত


আমাদের থাইল্যান্ডের প্রোজেক্টটা চালু হওয়ার পরে ক্লায়েন্টের লোকেরা আমাদের শারজার অফিসে এসে কাজ চালু করল - আমাদের কাজের তদারকি নিজের চোখে দেখার জন্য। এটা আমাদের প্রায় সমস্ত দেশের প্রোজেক্টেই হয়, এর আগেও বিভিন্ন দেশের ক্লায়েন্ট দেখেছি আমাদের অফিসে - ব্রিটিশ, নরয়েজিয়ান, আমেরিকান, রাশিয়ান থেকে আলজেরিয়ার ক্লায়েন্টও দেখেছি বা সরাসরি তাদের সাথে মেলামেশা হয়েছে। কিন্তু এবারে থাইল্যান্ডের ক্লায়েন্টদের সাথে মেলামেশা করতে গিয়ে দেখলাম ব্যাপারটা একটু অন্যরকম!!
এদের সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে আছে, গোটা অফিসের ফ্লোরটা এক্কেবারে শান্ত, ৩০-৩৫ টা লোক যে কাজ করে চলেছে, কথাবার্তা হচ্ছে, মিটিং হচ্ছে, লোকজন আসা-যাওয়া করছে, কোথাও কোনো শব্দ নেই, কোনো উঁচু গলায় কথা নেই, হাহা-হিহি নেই, সবই কেমন যেন নিরুত্তাপ ভাবে হয়ে যাচ্ছে হাসি মুখে। আর তার ওপরের ফ্লোরটাই (মানে যেখানে আমাদের নিজেদের লোকেরা বসে) এক্কেবারে গমগম করছে সবসময়ে!! একদিন কোনো একটা মিটিং-এর মাঝে কোনো একটা যুক্তি খাড়া করতে গিয়ে স্বভাবদোষেই হয়ত একটু বেশী জোরে কথা বলে ফেলেছিলাম। অন্যপ্রান্তে ক্লায়েন্টের থাই ভদ্রলোকটি দেখলাম এক্কেবারে যেন শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়ে গেলেন, মুখের সেই একইরকম হাসি-হাসি ভাবটা বজায় রেখে, যার কোনো পরিবর্তন নেই। কথা বা মিটিং ওখানেই প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আমি প্রথমে ভাবলাম আমার কথার যুক্তি উনি হয়ত মেনে নিয়েছেন, আমার যুক্তির বিপরীতে যুক্তি খুঁজে না পেয়ে মেনে নিয়েছেন নিশ্চই, তাই কথা বন্ধ হয়ে গেছে মিটিং-এর মাঝে। ও হরি, দুঘন্টা পরেই একটা ই-মেল এর মাধ্যমে উনি ওনার যুক্তিসহ বক্তব্য আমাকে জানিয়ে দিলেন। বুঝলাম, মানুষের শারীরিক ভাষা অনেককিছু বললেও হয়ত পুরোটা বলে না, বিশেষত সেই ভাষাটা যখন তার জীবনবোধের সাথে বা প্রাত্যহিক আচার-ব্যবহারের সাথে যেখানে সম্পৃক্ত থাকে । 

পরবর্তীতে যখন থাইল্যান্ডে এসে কাজ করছি, তখন ব্যাপারটা আরো ভালভাবে উপলব্ধি করলাম। এই দেশের মানুষেরা (জাপান ও অন্যান্য আরো কিছু দেশের মানুষেরাও প্রায় একই ধরনের) খুব বিনয়ী, প্রায় সারাক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে কথা বলেন। ভাষা কিছুই বুঝি না, কিন্তু একটা অদ্ভুত আন্তরিক টান আছে, যেটা অচেনাকেও আপন করে নেয়। মুর্শিদাবাদে মামার বাড়িতেও ছোটোবেলায় এরকম কিছুটা অনুভব করতাম। মনে আছে আমাদের সাধারণ কথা "কোথায় যাচ্ছিস রে?" এই প্রশ্নটা আসত অনেকটা এইরকম "কুন্ঠিং যাইছিস রে...", শেষে একটা বিলম্বিত টান, যেটা মানুষকে খুব কাছে টানত...মানভূমের ভাষা আয়ত্ব না করতে পারলেও সেই টানটা খুঁজে পেতাম উজ্জ্বল বা রামাশীষের কিছু কিছু কথায়... থাইল্যান্ডের ভাষায় অনেক বছর পরে আবার সেই অচেনাকে আপন করে নেওয়ার টানটা যেন খুঁজে পেলাম। 

রাগ, জোরে কথা বলা এগুলো প্রায় দেখা যায় না থাইল্যান্ডের মানুষজনের মধ্যে। একবার আমাদের প্রজেক্টের কর্মীদের motivate দেওয়ার জন্য একটা ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রায় ১০-১২ টা টিম, প্রাইজমানি আছে, তাই উৎসাহ উদ্দীপনা তুঙ্গে!! এক রবিবারে খেলা দেখতে গিয়ে আমি অবাক!! কোনো ফুটবলার 'ফাউল' করলে সে সাথে সাথে তার প্রতিপক্ষ ফুটবলারের উদ্দেশ্যে তিন-চার বার মাথা ঝুঁকিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে!!
খুব অবাক হয়ে ভাবতে বসি, এই নম্রতা, অন্যের প্রতি এই শ্রদ্ধা, এই ব্যবহার কি আমাদের সবার শেখার নয়? আমরা কেন পারি না? আগে শুনতাম যে আমরা ভারতীয়রা বা আরবরা বা আফ্রিকানরা গরম দেশের মানুষ বলেই নাকি আমাদের মাথা প্রায়শই গরম থাকে, ইউরোপীয় দেশের মানুষেরা সেজন্যই নাকি অনেক শান্ত, ধীর, স্থির আচারে ব্যবহারে... অনেকে আবার যুক্তি দেন যে প্রতিদিনের কঠোর জীবন সংঘর্ষের কারণেই নাকি আমাদের ব্যবহার অনেক সময়েই রূঢ় হয়ে যায়!! দুটো যুক্তিতেই আমি কোনো সার খুঁজে পেলাম না থাইল্যান্ডে এসে... ভারতের মত থাইল্যান্ডও 'ট্রিপিক্যাল কান্ট্রি" - গরমের দেশ, আর জীবনের সংঘর্ষে এই দেশও ভারতের থেকে আলাদা কিছু নয়, সাধারণ মানুষের সংগ্রাম চলছে প্রতিদিন একইভাবে। উঁচু আর নীচু শ্রেণীর পার্থক্যটা দুজায়গাতেই বিসদৃশভাবে বর্তমান, দুটো দেশেই সাধারণ মানুষ দুবেলা খাবার আর মাথার ওপরে ছাদের ব্যবস্থা করতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। দুটো দেশের সংস্কৃতি-সভ্যতা প্রায় একই জায়গা থেকে এসেছে (হিন্দু/বৌদ্ধ), পরিসংখ্যান হিসেবে ভারতের "cost of living" ৪৭% সস্তা থাইল্যান্ডের থেকে, মানে সাধারণ জীবন যাপনের জন্য থাইল্যান্ডে বেশী অর্থ লাগবে ভারতের তুলনায়। তাহলে আমাদের আচার-ব্যবহারের এই পার্থক্য কেন?
জানি না সমাজ-বিজ্ঞানীরা কি বলবেন এই ব্যাপারে। হয়ত বলবেন - যে জীবনে যত সুখী, তার জীবন তত সরল-সাদাসিধে হবে, শান্ত, ধীর, স্থির হবে!! World Happiness Index এর হিসেবে থাইল্যান্ড ৬০ নম্বরে আসে, আর আমাদের ভারত আসে ১২৩ নম্বরে, সুতরাং সেই হিসেবে থাইল্যান্ডের মানুষেরা আমাদের দেশের মানুষজনের থেকে অনেক সুখী!! তাই তারা অনেক শান্ত, বিনয়ী ইত্যাদি... এটা হয়ত এককথায় উত্তর হয়ে গেল, কিন্তু আসল প্রশ্নটা হচ্ছে, এরা বেশী সুখী থাকে কি হিসেবে? আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে জীবনটাকে আমরা কত সরল-সাধাসিধেভাবে দেখছি তার মধ্যেই কি উত্তরটা লুকিয়ে আছে? গ্লোবালাইজেশনের আগে আর পরে ভারতের মানুষের জীবনযাত্রার বা তাদের মানসিকতার যে পরিবর্তন হয়েছে, সেই অর্থে থাইল্যান্ডে এখনো হয়ত সেইভাবে আমূল পরিবর্তন হয়নি। ইন্টারনেটের দৌলতে পৃথিবীর কোন্ কোনায় কি হচ্ছে সেটা আর অজানা থাকে না কোনো দেশের মানুষের কাছেই, প্রলোভন চাহিদা বাড়তেই থাকে সব ক্ষেত্রেই...কনজ্যুমারিজম সামনের সারিতে চলে এসেছে, কিন্তু, তার মধ্যেই নিজের জীবনটাকে কত সহজভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই স্কিলটা হয়ত আমরা হারিয়ে ফেলছি বা সামঞ্জস্য করে মানিয়ে উঠতে পারছি না সঠিক ভাবে.... থাইল্যান্ডে এখনো সাধারণ মানুষেরা সপ্তাহান্তে পাব্লিক পার্কে বেড়াতে আসে দলবল বেঁধে, বাড়ি থেকে আনা খাবার আনন্দ করতে করতে সবার সাথে ভাগ করে খায়, গল্প করে, ছোটো ছোটো বিষয়ে খুব খুশী প্রকাশ করে, বয়স্করা নিজেদের মনেই বেসুরো ক্যারাওকে গানের সাথে গলা মেলায় বা অনেকে নাচের স্টেপও ফেলে...অনেক আধুনিক জিমনাশিয়াম দেখা গেলেও নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশকে দেখা যায় বিকেল বা সন্ধ্যেতে পার্কে হাঁটতে /দৌড়াতে, সেখানে আবার প্রচুর আউটডোর GYM equipment রাখা আছে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য...অনেক কিছু না পাওয়ার আক্ষেপ হয়ত আছে, কিন্তু সাথে নিজের স্বপ্নকে সাথে নিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাও দেখেছি আধুনিক প্রজন্মের সাথে কথা বলে... নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা রবিবারে সকালে সবাই হয়ত বৌদ্ধ মঠে গিয়ে চিরাচরিত প্রার্থনা করে না, কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রাস্তায় বেরোলে এখনো প্রচন্ড সম্মান পায় সমাজের সব স্তরের মানুষজনের থেকে, যে যার নিজের ক্ষমতামত চাল-ডাল ইত্যাদি তাদের ভিক্ষু-ঝোলায় ফেলে নিজেদের মাথা ঝুঁকিয়ে বা নিজের সাইকেলে বা অটোতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে পৌঁছে দেয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের... হয়ত ভয়ে, পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য... ছোটোবেলাতে আমরা ভারতেও গ্রামে-শহরে প্রায় একই ছবি দেখেছি, কিছু কিছু বাজারে দেখতাম পুরোহিতদের ঘন্টা নাড়িয়ে মাছ বা সবজি বিক্রেতার কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে কিছু টাকা ঝুলিতে ফেলে...কমে আসছে, এখন আর খুব একটা দেখি না। তিলককাটা বা ওই ধরনের আচার ধর্মের কথা বাদ রেখে যদি আমরা চিন্তা করি, কোথাও কি আমাদের নিজেদের মধ্যে কিছু ভাল করার, ভাল চিন্তা করার অভাব দেখা যাচ্ছে? ভাল কিছু করার চিন্তা না করতে পারলে, 'পজিটিভ এনার্জি আসবে কোথা থেকে, আমরা নিজেরাই বা ভাল থাকব কীভাবে? আর নিজে ভাল না থাকলে নিজের ওপরে, সারা দুনিয়ার ওপরে বিতৃষ্ণা হয়ত বাড়তেই থাকবে, অতৃপ্তিতে, অশান্তিতে ভরে থাকবে আমাদের মন, তার বহিঃপ্রকাশ তো অন্যরকম হবেই, জোরে কথা বলা, চেঁচামেচি, হৈ-হল্লা, মাথাগরম ইত্যাদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হিসেবে উঠে আসবে.... 

সভ্যতার বিকাশ, আধুনিকতা আমাদের মানসিক চেহারাকে পরিবর্তন করে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার ফলেই এসে যায় 'জেনারেশান গ্যাপ' এর মত কথা, আমরা ব্যালান্সের কথা বলি, মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলি...কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ তার দ্বন্দ্বে সাবধানে পা ফেলি প্রতিদিন। সেই সঠিক ব্যালান্সের যাদুকাঠির খোঁজে আমরা... থাইল্যান্ডের মানুষজনের এই 'ঠান্ডা ঠান্ডা, cool cool' মানসিকতা ভাবতে বাধ্য করছে আমাদের...।




______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া 
______________________________________________

১/ সময়াভাবের কারণে বহু দীর্ঘদিন পরে এটি দেখা হ'ল। কবিতা, অনেকেরই, ভাল লাগল। বিশেষত গৌতম দত্ত আর দেবাশিস সাহার। কিন্তু ধাক্কা খেলাম তোমার লেখা সম্পাদকীয়টিতে। মোদীকে বা বিজেপিকে সমর্থন, যেকোন যুক্তিতেই যে'ই করুক না কেন, সে দেশের শত্রু। ভারতবর্ষ নামক চিরন্তন ধারণাটি সে বোঝেনি বা অনুধাবন করেনি এখনও। এই লোকটা বা এই দলটা আমাদের এই দেশটাকে ধ্বংস ক'রে দেবে একেবারে, যদি এখনও এদের স্বরূপ আমরা না চিনতে পারি। তোমার কাছে অন্তত, আমি আশা করিনি এটা।
যেকোন বিকল্পই অন্তত এদের চেয়ে শ্রেয়, বস্তুত। সে চোরই হোক্ বা ডাকাতই হোক্। কেন, সে অনেক কথা। আর সব বাদ দিলেও জাতপাতের রাজনীতিটা ত বোঝ' তুমি! বোঝ' না? দলিতদের প্রতি এদের ঘৃণাটা? আর অত্যাচারটা? তারপরেও এমন কথা লিখলে কী ক'রে?
                             ----------কবি অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র 

২/ অরন্ধনের এ সংখ্যায় অভিজিৎ 
মাজীর ফটোগ্রাফ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মৃৎ পাত্র।

যা অভিজিতের ক্যামেরায় শিল্প হয়ে উঠেছে।

তাকে আমার অভিনন্দন।
                                  ---------কবি নির্মল হালদার 

৩/ ছবিতে মুগ্ধ, লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম দাদা।
ভালোবাসা নিও।
                        ---------কবি শ্যামাপদ মাহাত (বাঁশি)

৪/ খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটা।
                                   -----------দোলন রায় 

৫/ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কখনোই চায় না যুদ্ধ বন্ধ হোক। বর্তমান বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে উপযুক্ত সম্পাদকীয়। সব কবিতা, বিশেষ করে কবি বিপুল চক্রবর্তী কবিতা দু'টি ভীষণ ভালো লাগলো।
সুজন পণ্ডার লেখা ছোট গল্পটি একটি অপার্থিব পরিবেশ রচনা করেছে।
অভিজিৎ মাজীর আলোকচিত্রে গ্রাম্য একটি শিল্পকলার পরিচয় পেলাম। খুব ভালো লেগেছে।
                          ---------কবি সুনৃতা রায়চৌধুরী

৬/ অনেক ভালো ভালো কবিতা পেলাম।  শুভেচ্ছা সবার জন্য।
                                       ---------কবি পার্বতী রায়

৭/ খুব ভালো লাগল অরন্ধন।
আশ্চর্য সব ছবি তুলেছেন অভিজিৎ মাজী, তাঁকে অভিনন্দন...
                                      ---------কবি মৌ দাশগুপ্ত 

৮/ এককথায় চমৎকার আয়োজন। শুভ কামনা নিরন্তর।
                                      ---------কবি হাবিবুর রহমান এনার 

৯/ বিপুলদা, দূর্গা দত্তের কবিতা, সুজন পন্ডার লেখা অসম্ভব টানল... নিটোল একটা সংখ্যা...যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বন্ধ হয়ে সবার ভাত-কাপড়ের যোগাড় হোক, পুজোর আনন্দে সবাই থাকুন, শুভ শারদীয়া!!
                                      ----------কবি ময়ূখ দত্ত 


______________________________________________

                            আমাদের বই











সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ :  ভারতের গুপ্ত আমলের পেন্টিং, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com





 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪