ন্যায়বিচার

ন্যায়বিচার

বিবেক সেন

প্রায় বিশ বছর পর আমরা আবার সবাই ফিরে গেলাম আমাদের যৌবনের সেই কর্মক্ষেত্রে। সার্জেনসাহেবের বিশেষ অনুরোধে। 

পাহাড়ী ঘুমন্ত গঞ্জ।
ভোরের দিকে কুয়াশাঢাকা উপত্যকার কাঠের বাড়ি, স্কুলঘর, গুম্ফার শীর্ষ, দারচোগ আর লুংতার ওপারে শুধু মেঘ আর মেঘ। আর সে মেঘ ছাড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে এক চিলতে রোদ্দুর। নতুন কনের মত লজ্জায় মেঘের ওড়নায় মুখ ঢেকে নেবার আগে ওটুকুই দেখার, ওটুকুই লাভ। 

নব্বইয়ের দশকে এমন ব্লক সদরে চাকরি করা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার, বিডিও আর তার কয়েকজন ইন্সপেক্টর, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার, এডিও, বিএলডিও, আইডিও, বাকি সব তো পাহাড়েরই ছেলে। শিলিগুড়ি থেকে প্রতিদিন আসা যাওয়া করাও সম্ভব নয়। আর অধিকাংশের বাড়ি কলকাতা, হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা, তাই মাসে একবার ব্লক ছেড়ে যাওয়াও কঠিন ব্যাপার। দু'দিনের জন্য ঘুরতে এলে যেখানে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় সেখানে বছরের পর বছর আটকে থাকা খুবই দুর্দশার। বিএলডিও সাহেব তো আট বছর একই জায়গায় পড়ে আছেন। তিনি মজা করে বলেন তার দপ্তর শুধু নয়, স্ত্রী পুত্রও হয়ত ভুলে গেছে যে তিনি আছেন। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমরা প্রায় সকলেই অবিবাহিত তখনও। 

সে সময় এত হোটেল, হোমস্টের ব্যাপার চালু ছিল না। কাজেই ব্লক সদরে সামান্য কয়েকটি অফিস, হাসপাতাল, বাজার নিয়ে দিনের বেলাটুকু যত হৈচৈ। বিকেল হতেই পাহাড়ের দীর্ঘ ছায়া যেমন পাইনের জঙ্গলকে গ্রাস করে তেমনই নিস্তব্ধতা গ্রাস করে এই গঞ্জকে। তখন শুধু দূরে দূরে গ্রামের আলো কুয়াশার ফাঁকে মাঝেমাঝে জ্বলে ওঠে আর ভাঙ্গাভাঙ্গা গান ভেসে আসে - 
মিথো কুড়া গারা না শুনু মা কাসারি
গাহিরো কালো তি আখা মা
হেরেই ভুলু কাসারি
ওও ওও ওও ওও 
ও ওও ও ওও ও

কাজেই পুরোনো ক্লাব কালচারকে ফিরিয়ে এনে নিজেদের বাঁচানো ছাড়া জো ছিল না। এককালে ব্রিটিশ সাহেবদের ক্লাব ছিল একটা, ইউনিয়ান ক্লাব, সেনা অফিসার আর প্ল্যান্টারদের। সেটাকেই, যাকে মেদিনীপুরের ভাষায় এডিও সাহেব বলেন যেমন, বাগিয়ে নেওয়া হল। বিলিয়ার্ড রুম হল তাস দাবা খেলার ঘর, লাইব্রেরিতে খবরের কাগজ, অবশ্যই বাসি, এখানে কাগজ আসে বিকেলে, কিছু পত্রিকা, ক্যান্টিনে চা জলখাবারের ব্যবস্থা। অদূর ভবিষ্যতে ব্যাডমিন্টন কোর্ট আর টেবিল টেনিসের ব্যবস্থা করার ইচ্ছে রয়েছে। এই ক্লাব বাঙ্গালী অফিসারদেরই শুধু প্রাণকেন্দ্র নয়, ব্লকের সবাই জেনে গেছে সন্ধেবেলা বিডিওসাহেব, সার্জেনসাহেবকে ( স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারকে এ নামেই ডাকে স্থানীয় মানুষ) কোথায় পাওয়া যায়, এমনকি থানার দারোগাবাবু পাহাড়ের মানুষ হলেও সন্ধ্যায় এখানেই চলে আসেন। যদিও লোকশ্রুতি, তিনি নির্ভেজাল আড্ডার চেয়ে ফিশ খেলতেই বেশী আগ্রহী। 

এমন পাণ্ডববর্জিত দেশে নতুন কিছু ঘটলে তার ঢেউ এসে পড়ে ক্লাব ঘরের চুন করা সাদা দেয়ালে। তা নিয়েই খুব ব্যস্ত হয়ে ওঠেন সদস্যরা। তাই যখন শোনা গেল কলকাতা থেকে দু'জন অধ্যাপক এসেছেন ছোটেন লামার বাড়িতে, তাদের নিয়েই একটা গোটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দিল অফিসারকুল। দু'জন অধ্যাপক?  কোন বিষয়ের? ইকনমিক্স না অ্যান্থ্রোপলজি? তারা কি বিশেষ কোন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক গবেষণার কাজে এসেছে? এই শান্ত, আধঘুমন্ত ব্লক সদরে টুরিস্ট আসে না। চা, কাঠ, কমলালেবুর জন্য যারা আসে একবেলা থেকে ফিরে যায় দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, অন্তত মিরিক। কাজেই কলকাতার দুই অধ্যাপকের আগমনে ইউনিয়ান ক্লাবে ঘন ঘন সিগারেট পুড়তে লাগল। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল কো-অপারেটিভ ইন্সপেক্টর বাচ্চা ছেলে,  কাল সক্কাল সক্কাল সে ছোটেনের বাড়ি গিয়ে অধ্যাপক দু'জনকে নিমন্ত্রণ করে আসবে সন্ধ্যায় এই ইউনিয়ান ক্লাবে আথিতেয়তা গ্রহণ করতে। আর অধ্যাপক দু'জন যদি রাজি হয় কাল একটা পার্টি হয়ে যাবে। ভাত, ডাল, আলুস্কোয়াশ, খাসিমাংস আর অন্যান্য ব্র‍্যাণ্ডের সাথে এক বোতল শিভাস রিগাল। বিশ্বায়নের আগে তাই আমাদের কাছে অমৃতসমান। 

ড বেদপ্রকাশ উপাধ্যায়, কয়েক পুরুষ আগে উত্তর ভারত থেকে আসা তার পূর্বপুরুষ তাকে দিয়েছে তীক্ষ্ণ নাসা, প্রশস্ত কপাল, পাতলা ঠোঁট আর ফ্যাকাশে সাদা গাত্রবর্ণ। যদিও শ'খানেক বছরে বেদপ্রকাশবাবু ভাষা ব্যবহারে পুরোপুরি বাঙ্গালী। তার উচ্চারণে কলকাতার লব্জ। কলেজে পড়াচ্ছেন প্রায় বিশ বছর। বিষয় দর্শন। অবিবাহিত এবং তার আচার আচরণে একটা আভিজাত্য রয়েছে যা বংশগত বা আর্থিক নয়, শিক্ষা আর মনন কিছু মানুষকে একধরনের আত্মসচেতনতা দেয়, আমজনতা তাকে উন্নাসিকতা বলে ভুল করে যদিও। সব মিলিয়ে বেদপ্রকাশ উপাধ্যায় আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। 

সঙ্গী আবু রায়হান যুবক, আমাদেরই বয়সী,  বেদপ্রকাশবাবুর ছাত্র এবং সদ্য অধ্যাপনায় ঢুকেছে। রায়হানের উচ্চারণে বরং অনেক বেশী হুগলীর ছাপ আছে। ছোকরা খুব নিরীহ। ভিড়ের মাঝে তাকে আলাদা করে চেনার কোনো জো নেই। 

আলাপ পরিচয় হতে জানা গেল রায়হানের গবেষণার বিষয় প্রান্ত সম্প্রদায়ের নিজস্ব বিচারব্যবস্থা। বাঁকুড়া পুরুলিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করলেও পাহাড়ী গোষ্ঠীর মধ্যে নিজস্ব বিচারপদ্ধতি কিছু আছে কিনা আর কতটা সেটা জানতেই উত্তরে আসা। ছোটেনের এক দাদার কলকাতায় ব্যবসা আছে ভাড়ার গাড়ির। সেই সূত্রে এদের এই অজ গাঁয়ে আসা। 

বিএলডিও সাহেবের বড় ইচ্ছে ছিল অধ্যাপনা করার। ভেটের্নারিতে মাস্টার্স করলেও অধ্যাপনা জোটেনি তার। তাও দু'পাত্র পড়তেই তার শখ জাগে তাত্ত্বিক হয়ে ওঠার। তার ওপর এতদিন এই জঙ্গলে নির্বাসন। তার মনে হয় তার ওপর খুবই অন্যায় করা হয়েছে। কাজেই তার প্রশ্ন করার একটা অধিকারও রয়েছে। বিষয় সেই একই, আইনী কাজ, বে আইনী কাজ। 

খুব ধীরে নিজের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলেন ড বেদপ্রকাশ। রাতের খাবার আসার আগেই অনেকটা মদ গিলে বেসামাল হওয়ার লোক নন তিনি। দাঁতে চিনেবাদাম কাটতে কাটতে বললেন, 'সাহেব, কোন কিছুকে বে-আইনী বলা খুব আপেক্ষিক ব্যাপার।' প্রশাসনের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে এমন মন্তব্য!  আমাদের কালো সাহেবরা ১৯৪৭ না দেখুন, ১৯৭৭ এ যত শিশুই থাকুন না কেন, নব্বইয়ের দশকে বসেও খাবি খেতে লাগলেন। 'আজ্ঞে হ্যাঁ। কিছু কিছুকে বেআইনী বলতে গেলে প্রথমে কতটুকু আইনী সে সীমা টেনে দিতে হয়। মানে সম্ভাব্যের একটা তালিকা থেকে খানিকটা সরিয়ে সেটুকুকে আইনী বলব, বাকিটা আইনী নয়। অথচ যা বাদ দিলাম তা সম্ভব এবং অকল্পিত এবং তার সম্ভাব্যতা কিন্তু অপরিসীম।' 

-তাহলে আপনি বলছেন অপরাধ বলে কিছু নেই?

-অবশ্যই। যদিও অপরাধ এবং বে-আইনী কখনই সমার্থক নয়। কিছু কিছু বে-আইনী কাজকে অপরাধ বলা হয়। সেটা বাদ দিলেও, অপরাধ চিহ্নিত করতে গেলে আগে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করতে হয়। না করলে কিছুই অপরাধ নয়।

- কিছুই অপরাধ নয়! ধরুন চুরি করা?

- চুরির যা সংজ্ঞা  আর পরিধি তারপরও আইনে খুব ক্ষুদ্র অংশকেই চুরি ধরা হয়, বাকিগুলো তো মুনাফা করা, শিল্প পরিচালনা, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি।

-খুনও অপরাধ নয় বলছেন?

-আপনারা প্রশাসনে আছেন। আপনারা জানবেন নরহত্যা সীমিত ক্ষেত্রে অপরাধ। তার বাইরে নয়। রাষ্ট্রের ভিত্তিই নরহত্যা। তাছাড়াও সামন্ততান্ত্রিক সমাজে  ভৃত্য নরহত্যা করলে যা শাস্তি, প্রভু করলে তার এক শতাংশও হত না। ফা হিয়েনের ভারত ভ্রমণকাহিনী পড়ে দেখুন। মধ্যযুগের ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডে কী হত দেখুন। এখানেও কি সেই আপেক্ষিকতাই জয়ী নয়? হত্যা করে তার কারণ দেখাতে পারলে আমি আপনিও মুক্তি পেতে পারি বিশেষ ক্ষেত্রে। কারণটি প্রচলিত আইনসঙ্গত হতে হবে খালি। এবং সে যুক্তি হয়ত হত্যা করার মূহুর্তে জন্মই নেয়নি। মনে রাখবেন আইনের যুক্তি কতগুলো বাক্যপরম্পরা, নৃসংহার বা সম্পত্তি অপহরণ একটি কাজ, কার্য, কর্ম। 

-তার মানে খুন যদি অপরাধ না হয় খুনের কোনো শাস্তিও হবে না?

- এটা আরও জটিল সামাজিক প্রশ্ন। আমি একটু আগেই বলেছি বৈদিক ভারতে প্রভুদের নরসংহার প্রায় বৈধ ছিল। রোমে গ্রিসেও তাই ছিল। সব প্রাচীন সভ্যতাতেই তাইই ছিল। আর নরহত্যার শাস্তি কে দেয়? নিহতের পরিবার? নাহ। সমাজ? নাহ। দেয় নৈর্ব্যক্তিক একটি চরিত্রঃ রাষ্ট্র। আপনি আমি যদি হত্যার শাস্তি দিতে যাই তা প্রতিশোধ হিসেবে চিহ্নিত হবে। রাষ্ট্র যখন শাস্তি দেবে তখন রাষ্ট্র নিহতের পক্ষে, নিহতের নিকটবর্তীদের পক্ষে। অর্থাৎ হত্যাকারীর পক্ষে কেউ নেই। যদি থাকত তাহলে হত্যাকারীর কিচ্ছু হত না। অ্যামাজনের পিরাহাগোষ্ঠীর কোন দলপতি নেই, বিচার সভা নেই। তারা স্রেফ একটা কেন্দ্রহীন জনগোষ্ঠী। তারা হত্যাকারীকে এড়িয়ে চলে। হত্যাকারী নিজেও গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।

ঘরের ভেতরের সিগারেটের ধোঁয়া, মদের বাষ্প, আমাদের প্রত্যেকেরই পেটে পেগ দুয়েক চলে গেছে, সব কিছু গুলিয়ে যেতে লাগল। একমাত্র রায়হান ছেলেটি দেখলাম চুপচাপ বসে একটার পর একটা পেগ মেরে যাচ্ছে। অধ্যাপকের সাথে থেকে থেকে তার সব কিছুই জানা ছোকরার।

- আপনারা বেআইনী কাজ, অপরাধ, শাস্তি সব গুলিয়ে ফেলেছেন। এর কেন্দ্রে আছে রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সংখ্যালঘু কিছু ক্ষমতাবানকে ক্ষমতায় রেখে দেওয়া। রাষ্ট্র না থাকলে, মানে গুটিকয়েক ক্ষমতাবান না থাকলে আইন, অপরাধ, শাস্তি সবেরই চরিত্র বদলে যেত। 

- আপনি কি বলছেন ন্যায় অন্যায় বলে কিছু নেই?

- আমি ন্যায়ের প্রশ্নে যাচ্ছি না। ন্যায়কে নিক্তি নিয়ে মাপার প্রশ্নে আমাদের ভিন্ন এককের সন্ধান করতে হবে। আমি আপাতত আইনগত বিচার আর শাস্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকছি। বর্তমান বিচারব্যবস্থা কিন্তু বর্তমানের রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর সীমারেখা দিয়েই চিহ্নিত। ব্যক্তি ব্যক্তিকে হত্যা করলে অপরাধ, কিন্তু রাষ্ট্র ব্যক্তির পর ব্যক্তিকে হত্যা করে চলে, সেটা অপরাধ ভাবা হচ্ছে না। কেননা এই বিচারের উদ্দেশ্য অপরাধ নির্মূল করা নয়, অপরাধী জন্ম দেওয়া, অপরাধীর শাস্তি আর নিজের ক্ষমতা নিয়ে অন্যান্যদের ভীতি প্রদর্শন, তারা হয়ত এতটুকু অপরাধী নয়। আইনগত বৈধতা অবৈধতা অপরাধ শাস্তি একটা অন্ধ চক্রে ঘুরে বেড়ায়, কেননা বিচারকর্তা অপরাধের সমাপ্তি চায় না, অপরাধ বিচারককে বাঁচিয়ে রাখে। নয়ত সে বেকার হয়ে যেত।

আমাদের বিডিও সাহেব এতক্ষণ কিছু বলেননি। অল্প বয়েস হলেও ব্লকের প্রধান আধিকারিক হিসেবে তার একটা অহঙ্কার ছিল যে এই প্রশাসন, এই ব্যবস্থাকে তিনিই ধারণ করেন। এবার তিনি মুখ খুললেন। 

- অধ্যাপক উপাধ্যায়, আপনি কি বিপ্লবী? অ্যানার্কিস্ট? 

- নাহ, একদমই না। যদিও সম্পত্তি যে চুরির ফসল তা আমিও বিশ্বাস করি এবং আরও বিশ্বাস করি যে চুরির কারণও সম্পত্তি। যা অবাধে পাওয়া যায় তা চুরি হয় না। আমি আইনের দর্শন নিয়ে ভাবি। আমার ভাবনা আমাকে বুঝিয়েছে আইন আর ন্যায়ের ততটুকুই সম্পর্ক যতটুকু মাছ আর বাইসাইকেলের। আইন অপরাধদমনের মাধ্যম নয়, আইনই অপরাধের জন্ম দেয়। 

-আপনার যুক্তি আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছি মাস্টারমশাই। কিন্তু কিছু সমস্যা রয়ে যাচ্ছেই আপনার যুক্তিতে। চুরি বিষয়টা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু হত্যা আর ধর্ষণকে আপনি অপরাধ বলবেন না? 

- নাহ। আমি নরসংহার নিয়ে একটু আগেই বলেছি। প্রয়োজন ছাড়া হত্যাকারী হত্যা করে না। পশুদের মধ্যে হত্যা একটা স্বাভাবিক প্রয়োজন। মানবসমাজে সম্পত্তি, বর্ণ, বর্গ হত্যাকে তার স্বাভাবিক বৈধতার উর্দ্ধে এক অতিপ্রাকৃত রূপ দিয়েছে। আপনারা  ফ্রয়েডের তত্ত্ব জানেন। পিতৃহনন আর মাতৃগমনের রূপক। প্রয়োজনীয় হত্যার বাইরে যা পড়ে থাকে তা হল মস্তিস্কবিকারজনিত কারণ। কিন্তু তা তো বিকার। আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে। 

- কিন্তু ধর্ষণ? 

-আমি ধর্ষণ বলে কিছু দেখতে পাই না। যৌন মিলন তো যৌন মিলনই। ইচ্ছে আছে না ইচ্ছে নেই, মিলনেচ্ছু পুরুষটিকে নারীটির পছন্দ না অপছন্দ এগুলো খুব গৌণ বিষয় এবং অকারণে মানবসমাজে মূল্য দেওয়া হয়েছে। হয়ত কখনই নারীর মিলনেচ্ছা থাকে না। অনেক পশুর ক্ষেত্রেই  এমন হয়। সন্তানধারণ নারীর স্বাধীনতালোপ। আর তার প্রস্তাবনা যৌনমিলনে। নারীর যৌনতা নিয়ে যুগপৎ ইচ্ছে ও অনিচ্ছা থাকাই স্বাভাবিক। তাই সব রকম যৌনমিলনকেই কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না? কেন? যে কোনো রকম যৌন মিলন মাত্রেই কিছু পরিমাণ বলপ্রয়োগ। লেডা আর রাজহাঁসের রূপক ভুলে গেলেন? বিপরীত বলপ্রয়োগের উদাহরণ ওর্ফিউসের ওপর নারীবাহিনীর জোরজবরদস্তি। 

থাপা খাবার টেবিলে সব বেড়ে ফেলে খবর দিল। আমরা ক্লাবের ডায়নিং টেবিলে গিয়ে বসলাম। পুরনো ব্রিটিশ আমলের টেবিল চেয়ার। কিন্তু সেসব বাসনপত্র আর নেই। ব্লকের টাকায় যা আনা হয়েছে শিলিগুড়ি থেকে তার মান বলার মত কিছু নয়। আমাদের খাবারের মেনুও ব্রিটিশদের নাক সেঁটকানোর মতই। 

ছোকরা অধ্যাপক রায়হান চার পাঁচ পেগ  খেয়েও দেখিয়ে দিল খাওয়া কাকে বলে। কিন্তু অধ্যাপক উপাধ্যায় প্রায় যেন কাঠি দিয়ে খেলেন। নিজের এই নির্বাসন অবৈধ ও অন্যায্য প্রমাণ করতে না পেরে বিএলডিও সাহেব বোতল আর গ্লাস নিয়েই এসেছিলেন। উপাধ্যায় তার পাশে বসে আরসির আরেকটা বড় পেগ বানিয়ে নিলেন। ধীরেধীরে তার মুখে পানীয়জনিত রক্তাভা ফুটে উঠছিল। নেশা চড়ছিল অধ্যাপকের।

- ব্যক্তির আচরণ অন্য ব্যক্তির স্বার্থের বিরোধী হলে ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন আসে। কিন্তু আইনের বর্তমান কাঠামোয় সেটা কোথায়? আইনের উদ্দেশ্য তো ত্রিবিধ। গোটাটাই সামন্ততান্ত্রিক আর ধর্মীয় প্রভাবাচ্ছন্ন। 

- ধর্মীয়! বলেন কী?

-তাছাড়া কী? শাস্তির উদ্দেশ্য যদি হয় অপরাধদমন, ভবিষ্যতে যেন আর না হয়, তাহলে পুরোপুরি ব্যর্থ এই প্রয়াশ। অন্যদিকে  গোটা বিচারের প্রহসন হল অপরাধীকে নিজের কৃতকর্মের সম্মুখীন করা, তাকে দিয়ে অপরাধ স্বীকার করানো, এটা জুডিও খৃশ্চান সভ্যতার অবদান। ক্ষতিগ্রস্তের ক্ষতিপূরণ না করেই শাস্তিবিধানে তৎপর রাষ্ট্র, কেন না তা হল ওয়েজেস অফ সিন। শাস্তিবিধানও বিচারের অন্যতম উদ্দেশ্য, অন্যান্য সব কিছু বাদ দিয়ে, ক্ষতিপূরণ বা অপরাধের পুনরাবৃত্তিরোধ নিয়ে পুরোপুরি অসফল হয়েও। ওল্ড টেস্টামেন্টের যে ক্রুর ঈশ্বর তার ছায়া রয়ে গেছে আইনব্যবস্থায়। পাপ করলে সাজা পেতে হয়।  

আমাদের সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার একটু দর্শনটর্শন পড়েছিলেন। উপাধ্যায়জীর প্রবল গোলাবর্ষণের সামনে একটু প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেন, 'কিন্তু স্যার, আমরা তো শুনেছিলাম ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্য ব্যক্তির স্বাধীনতা আর সেটাই ব্যক্তির নৈতিক কাঠামোর ভিত্তি।'

- ভুল শুনেছিলেন, য়ুরোপের দর্শনের বাজারে কিছু পেটি বুর্জোয়া দোকানদারসুলভ কথাকে রংচং মাখিয়ে, জামাকাপড় পরিয়ে বেশ মহান সাজানো হয়েছে। কিন্তু মুর্খতা ঢাকা পড়েনি। দাসমালিক ও দাসের যে সম্পর্ক, প্রভুত্ব ও দাসত্ব - তার থেকে মুক্তির জন্যই নাকি আইন ও বিচার। ন্যায়ব্যবস্থা। এই ব্যক্তিস্বাধীনতাই লক্ষ্য, তা কোনো মাধ্যম নয়। সামাজিক সুফলের জন্য ন্যায়বিচার নয়। সেটা গৌণ, বাইপ্রোডাক্ট। মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যক্তির চূড়ান্ত পূর্ণতার জন্য ন্যায়ব্যবস্থা। 

ড উপাধ্যায়ের নেশা চড়ে গেছে। আমরা তাকিয়ে থাকলাম কোনো কথা না বলে। আবু রায়হান এক মনে খাচ্ছে, কিন্তু তার কানও শিক্ষকের কথার দিকে।

- ব্যক্তির চূড়ান্ত বিকাশ তার স্বাধীনতায়। স্বাধীনতাই লক্ষ্য। চূড়ান্ত বিকাশই লক্ষ্য। এই বিকাশ কখনো অন্য কোনো এজেন্সির দাসত্ব স্বীকার করে না। সমাজের না। রাষ্ট্রের না। ধর্মগুরুর না। সমুদ্যত ব্যক্তি নিজের সিদ্ধান্তে নিজেই উপনীত হয়। সেই সিদ্ধান্তকে নিজেই বাস্তবায়িত করে। কিন্তু কে সেই ব্যক্তি? রামশ্যামযদুমধু সবাই? যারা হাঁটতে শেখেনি তারাও? যাদের নাক মুছিয়ে, গলায় তোয়ালে জড়িয়ে ডুডু খাইয়ে, ঢেকুর তুলিয়ে মুখ মুছে দিতে হয় তারাও? তাদের জন্য যাবতীয় দর্শনের দোকানদার চীৎকার করবে? ব্যক্তিগত সম্পত্তি নাকি সেই কচি খোকাদের আঙ্গুলের মত, খোয়া যাওয়ার ভয়ে তাদের আইনব্যবস্থা চাই, ন্যায়ালয় চাই, চাই ন্যায়ের দর্শন। নেংটি ইঁদুরের মত তারা আঁকড়ে ধরে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি আর সেই নেংটি ইঁদুর প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নরহত্যা অপরাধ। 

গ্লাস থেকে এবারে ঢকঢক করে বাকি তরলটুকু গলায় ঢেলে নেয় উপাধ্যায়। মুখ চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরচ্ছে। 

-বলুন, উত্তর দিন। এই নেংটি ইঁদুরদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে? এই ঘেয়ো কুকুরদের জন্য আদর্শ মানুষ তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। সেটা অপরাধ নয়? প্রকৃতি অক্ষম প্রাণীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। মানবসভ্যতারও উচিত অক্ষম সদস্যদের সরিয়ে দেওয়া, পাল্প করে জৈব সার তৈরী করা। ন্যায়ের একমাত্র মানদণ্ড সভ্যতার বিকাশ। উন্নত ব্যক্তিত্বের বিকাশ। সেটাই চূড়ান্ত ন্যায়।

আমাদের সান্ধ্য আসর ভেঙ্গে গেল। আবু যখন ধরে ধরে বিডিও সাহেবের গাড়িতে তুল্ল অধ্যাপক উপাধ্যায়কে তিনি অস্ফুট বিড়বিড় করছেন, চেতনা অত্যন্ত ঝাপসা, মুখ দিয়ে ফেনা আর লালা গড়িয়ে পড়ছে। আচ্ছন্নের মত আমরাও যে যার ঘরে ফিরে এলাম। 

পরের দু'দিন আমরা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তখনও বয়েস কম। কিছু ঘটলে হেসে উড়িয়ে দিয়ে জীবনযাপন শিখিনি। আমাদের সান্ধ্য আসরও বসেনি দু'দিন। বৃষ্টি ছিল। সেই অজুহাতে যে যার খোঁদলে ফিরে গেছি। ঘরে কারোরই বউ ছিল না এসব সাংস্কৃতিক আঘাত সামলে দেওয়ার মত। শুধু বিএলডিও সাহেব এক আধবার বল্ল, 'মালটা শিওর আটার হোমো। ফ্রড একটা।' উপাধ্যায় বা রায়হানও এদিকে ঘেঁসেনি। আথিতেয়তার জন্য ধন্যবাদও পাঠায়নি। তৃতীয় দিন বিডিও সাহেব খোঁজ নিয়ে জানলেন একটা গাড়ি ভাড়া করে দুজন অধ্যাপক আশপাশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেদিন আমাদের ইউনিয়ন ক্লাবে আবার জমায়েত হল। আমরা আগের দিনের প্রসঙ্গ নিয়ে সচেতন থাকলেও সচেতন ভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। 
হঠাৎ ওসি ছিরিং শেরপা গাড়ি ছুটিয়ে এসে খবর দিল অধ্যাপকদের গাড়ি পাশের ব্লকে পাহাড় থেকে নিচে পড়ে গেছে, রেডিওগ্রামে খবর এসেছে, যেহেতু ওরা এই ব্লকেরই অতিথি ছিল ছিরিংকে ওখানে ডেকেছে ওদের ওসি। শুনে আমরা ক'জন লাফিয়ে উঠলাম। আমরাও যাব। বিডিও সাহেবও তার গাড়ি বার করলেন। অন্ধকার পাহাড়ি পথ দিয়ে যেতে যেতে এটাই ভাবছিলাম কী পরিণতি জীবনের। থানায় পৌঁছে দেখলাম আবু বসে আছে চেয়ারে দু'পায়ের ফাঁকে মাথা রেখে। পাশে গাড়ির ড্রাইভার।  সে'ই জানালো কী হয়েছিল। একটা হেয়ার পিন বাঁকে সে নেমেছিল মাইনাস করতে। গাড়ির হ্যাণ্ডব্রেক টানাই ছিল। আবু গাড়ি থেকে নেমে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। অধ্যাপক উপাধ্যায় ছিলেন একা। হঠাৎ গাড়ি গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। ড্রাইভার বা আবুর কিছুই করার ছিল না। গাড়ি এখনো নিচেই পড়ে রয়েছে। অধ্যাপক বেদপ্রকাশের থেঁতলে যাওয়া মৃতদেহ তুলে এনে পোস্টমর্টেমে পাঠানো হয়েছে শিলিগুড়িতে। আমরা আবুকে আমাদের সাথে নিয়ে এলাম। পথে কোনো কথা বলেনি ছেলেটি। রাতে কিছু খেতেও চায়নি। তদন্তের জন্য দু'দিন ছিল। তারপর কলকাতায় ফিরে যায়। উপাধ্যায়জীর লাস শিলিগুড়িতেই দাহ করা হল। ওর ভায়েরা এসেছিল। চেহারা বা স্বভাবে ড বেদপ্রকাশের সাথে তাদের কোনোই মিল নেই। 

ধীরেধীরে আমরা এক এক করে বদলি হলাম, অন্য অফিসাররা এল, আমাদের জীবন পত্রে পত্রে পুষ্পে পুষ্পে বিকশিত হল। সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা যেন এক রাতের হ্যালুসিনেশানের স্মৃতি হয়ে ঘুরে ফিরে বেরাতে বেরাতে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেল। 


আবার বছর কুড়ি পর। একদিনের জন্য আমরা সবাই ফিরে যাব সেই পাহাড়ী গ্রামে। গ্রাম নেই আর। পঞ্চায়েত সমিতির রেস্টহাউজ হয়েছে, ব্যক্তিগত বেশ কয়েকটা হোমস্টে, রিসর্ট, রেস্তোরাঁ। আমাদের যারা একই চাকরিতে আছে উন্নতি করেছে, কেউ কেউ অন্য চাকরিতে, বিডিও সাহেব এখন জয়েন্ট সেক্রেটারি, ওসি শেরপা এসডিপিও, সার্জেন সাহেব বিএমও থেকে সত্যিই সিভিল সার্জেন, সিএমওএচ, তারই উদ্যোগে আমরা সেই ইউনিয়ন ক্লাবে বসব, তাদের ব্যাঙ্কোয়েট হলঘরে। শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে পৌঁছে গেলাম ব্লক সদরে। চারিদিকের উন্নতি চোখে পড়ল, চোখে পড়ল আগের চেয়ে প্রকৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়া, আবর্জনার স্তুপ। আগের সেই পাহাড়ি গ্রামই তো ভাল ছিল।

ঝাঁ চকচকে রেস্ট হাউস থেকে হেঁটেই চলে এলাম ইউনিয়ন ক্লাবে। সেই ঘর। আমাদের আগেই চলে এসেছেন ডাক্তারবাবু। তার চেয়ারের পাশে অচেনা এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। উনি তো আমাদের সহকর্মী ছিলেন না। সার্জেন সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন। ড আবু রায়হান, দর্শনের অধ্যাপক আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের যে রিইউনিয়ন তার চরিত্র মূহুর্তে বদলে গেল। সেই ঘটনার স্মৃতি বিশ বছর পার করে ফিরে এল। আমরা চায়ের কাপ হাতে ধরে তাকিয়ে রইলাম সার্জেন সাহেবের দিকে। 

- বন্ধুরা, আপনাদের নিশ্চই ড বেদপ্রকাশ উপাধ্যায়ের ন্যায়ের দর্শন নিয়ে আলোচনা আর দুঃখজনক মৃত্যুর কথা মনে আছে। ওর দার্শনিক মত আর মৃত্যু আমাকে গভীর ভাবে আলোড়িত করেছিল। আমি গত বিশ বছর একটু একটু করে ওর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করি। আমি যা জানতে পারি তা খুবই চাঞ্চল্যকর। আমি জানি ড উপাধ্যায় যখন কলেজে পড়তেন তার একটি বান্ধবী ছিল, মেয়েটি আত্মহত্যা করে। তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তখন ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আত্মহত্যা করে। ওর গবেষণার সঙ্গীদেরও একজন আত্মহত্যা করে। ওর ঊনিশ বছরের শিক্ষকতায় ওর ঘনিষ্ঠ ছাত্র, গবেষক, সহকর্মীদের অন্তত দশ এগারোজনও আত্মহত্যা করে। আপনারা বলবেন আমাদেরও কত চেনা পরিচিত আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আমি যা আবিষ্কার করি তা হল ড উপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠদের যারাই আত্মহত্যা করেছে প্রত্যেকেরই একটা মিল আছে। এরা প্রত্যেকেই মানসিক অস্থিরতায় ভুগত, এদের নিজেদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ছিল, সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি নিয়েও সমস্যা ছিল। এটা থেকেও কোনো কিছু আলাদা করে নাই বলা যেতে পারে। ড বেদপ্রকাশ উপাধ্যায় হয়ত নিজেই সমকামী ছিলেন, তাই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও তাই ছিল, তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু ঘটনা ঠিক তা নয়। আমি ওর সম্পর্কে খোঁজ নিতে নিতে আবিষ্কার করি ওর এক ভিক্টিমের ডাইরি। তাতে দীর্ঘ সময় ধরে ওদের কথাবার্তার প্রায় পুরোটা লেখা রয়েছে। আপনারা ড উপাধ্যায়ের আলোচনার তীব্রতা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করেছেন। উনি ওর ভিক্টিমদের দিনের পর দিন গ্যাস লাইটিং করতেন। তাদের দুর্বল মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতেন। তাদের মনের শেষ জোরটুকু কেড়ে নিতেন। এইভাবে তাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতেন তিনি। আমি যা বুঝেছি বললাম। বাকিটা ড আবু রায়হান বলবেন। উনি প্রায় পাঁচ বছর খুব কাছ থেকে দেখেছেন ড বেদপ্রকাশকে। নিজেও একজন কৃতবিদ্য অধ্যাপক। উনি আরও গুছিয়ে বলতে পারবেন সব।

আবু রায়হানের কথা

ড নন্দী যখন আমার ইমেল আইডি জোগাড় করে আমাকে তার উপলব্ধির কথা বলেন আমি ঠিক করি আমি যা জানি সবই আমি বলব। 
ড নন্দী ঠিকই ধরেছেন। মাস্টারমশাই এই মৃত্যুগুলোর জন্য দায়ী। কোনো আইনে তাকে অপরাধী বলা যাবে না। উনি কাউকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেননি। কিন্তু দিনের পর দিন মানসিকভাবে অসুস্থ কমবয়েসীদের বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়গুলো কেড়ে নিয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে উনি ছিলেন অনবদ্য। তার ক্লাস আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। ক্লাসের পর তার টিচার্সরুমে তাকে ঘিরে থাকতাম আমরা। সেখান থেকে উনি ভিক্টিম বেছে নিতেন। যাদের পারিবারিক সমস্যা আছে, যাদের ভেতর যাকে বলে কাফকেস্ক সমস্যা আছে, দ্বিধাগ্রস্ত জীবন নিয়ে, বঙ্কিমচন্দ্রের সেই দ্বিধা, এই জীবন লইয়া কী করিতে হয়, যাদের যৌনতা খুব স্পষ্ট নয় নিজের কাছে তাদের থেকেই বেছে নিতেন। এটা তার একটা খেলা ছিল। মাইন্ড গেম। অন্যকে চালিত করার খেলা। আর এই ভাবে নিজেকে মহান ভাবার রোগ। এটাও রোগ। আপনারা হয়ত বলবেন যারা ওর ভিক্টিম তাদের কোনো শারীরিক অত্যাচার করা হত না, তাদের যোগ্যতা নিয়ে, সামাজিক আর্থিক অবস্থা নিয়ে কুকথা বলা হত না, তাহলে মানসিক অত্যাচার বলা যাবে কি? আমি বলব হ্যাঁ। মানুষের বেঁচে থাকা শুধু খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান আর কিছু আর্থিক যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের প্রয়োজন বিশ্বাস। কেউ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, কেউ রাজনৈতিক আদর্শে, মানবতায় কেউ, নিকট পরিবারও আমাদের বিশ্বাসের স্থান। কিন্তু যখন আমাদের সেই বিশ্বাস একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যায় স্রেফ আহার নিদ্রা মৈথুনের জন্য কেউ বাঁচতে পারে না। ড উপাধ্যায় এইটা করতেন। মানসিকভাবে দুর্বলদের সব বিশ্বাসের স্থানগুলো ভেঙ্গে দিতেন, তাদের কাছেই তারা জগতে চলার অযোগ্য এমন মনে করাতেন, তাদের যৌন নিজস্বতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতেন।।  'তুমি মরে যাও' একথা একবারও না বলেই তারা যে কীটপতঙ্গের চেয়ে এতটুকু বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয় তা বুঝিয়ে দিতেন। যত দুর্বল হয়ে পড়ত ভিক্টিম তত তাদের তার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ত, তত তিনি তাদের পায়ের নিচ থেকে মাটি কেড়ে নিতেন। তাদের কাছে তাদের অক্ষমতা, তাদের মানসিক রোগকে অনেক গুণ বড় করে দেখাতেন। তারপর একদিন ভিক্টিম আত্মহননের পথ বেছে নিত। অধ্যাপক বেদপ্রকাশ চলে যেতেন পরের শিকারে। 

আমি নিজে তাকে এই শিকার করতে দেখেছি। একবার, দু'বার, তিনবার। নাহ, আমি ওর শিকার ছিলাম না। ওর ঘনিষ্ঠ হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই উনি বুঝে গেছিলেন যে আমি অনেক শক্ত মনের লোক। পরিবারের, আদর্শের আশ্রয় আছে আমার। 

আমাদের অবাক করে দিয়ে শেরপা বলে উঠল, তাহলে আপনি ওকে যে খুন করলেন তা আত্মরক্ষার জন্য নয়? প্রতিশোধ?  আপনার কোনো বন্ধুর আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়েছিলেন উনি? 

শেরপাকে আমার যথেষ্ট ভোঁতা মনে হত অতীতে। তাসের জুয়াতেই তার সবটুকু শক্তি ঢেলে দিত। সে কী করে সন্দেহ করল আবুই বেদপ্রকাশের হত্যাকারী? 

ড রায়হান একটু হাসল। আমি আত্মরক্ষা করছিলাম না। প্রতিশোধও নয়। আমি মাস্টারমশাইকে থামাতে চেয়ে ছিলাম। আইনের কাছে প্রমাণ করা যেত না। যদি আইন অবিশ্বাসের দর্শন, আইকনোক্লজমকে নিষিদ্ধ করে, অপরাধ বলে চিহ্নিত করে তাহলে হ্যামলেটের চরিত্র নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, কামু কাফকার সাহিত্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, ডস্টয়েভস্কির উপন্যাস অবশ্য সোভিয়েত রাশিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল। আইন পারে না এত দূর যেতে। আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন আমার কি অধিকার ছিল ড উপাধ্যায়কে খুন করার? প্রতিটি মানুষেরই তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তেমনি প্রতিটি মানুষের অধিকার আছে নিজের স্বাধীনতা অর্জন ও তার জন্য সংগ্রামের। অপরাধ তাই যা অন্যের স্বাধীনতা খর্ব করে। আইন অপরাধের কিছুটা ধরতে পারে। বিচার করে। অপরাধীকে অনুতাপের সুযোগ দেয়। শাস্তি দেয়। বেশ কিছুটা নৈতিক অপরাধ আইন ধরতে পারে না। যারা মানসিকভাবে দুর্বল, তারা বুঝতে পারে না সাইকোপ্যাথ কী করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের দিয়ে অসামাজিক আচরণ করিয়ে নেয়, মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। মাস্টারমশাইয়ের ক্ষেত্রে ওর ভিক্টিমরা অদৃশ্য। ঠিক সেই সময় উনি কাদের ওপর ওর পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন আমি জানতাম না। আমি ওর থেকে দূরে চলে আসার পর উনি যাদের নিয়ে পরীক্ষা চালাতেন তাদের তো আরই চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল না। হিংস্র শ্বপদের মত ওকে খাঁচায় রাখার প্রয়োজন ছিল। সেটা তো সম্ভব ছিল না। 

ডিএসপি ছিরিং শেরপা বল্ল, আপনি ড্রাইভারের সাহায্য নিয়েছিলেন খুন করতে? 

- নাহ। ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে এগিয়ে গেল আড়াল খুঁজতে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালাম। দেশলাইকাঠি ফেলতে গিয়ে চোখে পড়ল রাস্তার ঢাল আর নিচের খাদ। ড্রাইভারের দরজা খুলে হ্যান্ড ব্রেক নামিয়ে দিলাম। গাড়ির পেছনে হাল্কা ধাক্কা দিতেই গাড়ি খাদে চলে গেল। স্যার ঘুমিয়ে ছিলেন বলে আঘাত হল অনেক বেশী। আমি অনুতপ্ত নই। আমি কোনো মানুষকে হত্যা করিনি। একজন প্রেতাত্মাকে অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছি।

- তাহলে ড্রাইভারকে নতুন গাড়ি কিনে দিলেন কেন? 

- ওহ, আপনি জানেন যে থাপার গাড়িটা আসলে আমার? দিতেই হত। ওর গাড়িটা খাদে ফেলে নষ্ট করে দিয়েছিলাম। 

এবার ড রায়হান আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা প্রশাসনের আধিকারিক। সবটা শুনলেন। আপনারা যদি বলেন আমি অপরাধী আমি আইনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে রাজি আছি। 

শেরপা আমাদের দিকে জিজ্ঞাসু মুখ করে চাইল। 

সেদিনের বিডিও সাহেব, আজকের জয়েন্ট সেক্রেটারি বললেন, আপনি এখন আমেরিকায় পড়ান? 

- হ্যাঁ স্যার, ঘটনার পর আমি নিজেও মানসিকভাবে খুব কাতর ছিলাম। কানাডায় চলে যাই। সেখানে কান্টিয়ান ফিলজফিতে পিএচডি করি। অধ্যাপনাও পাই। বিয়ে করিনি আমি। দেশের বাড়িতেও অনেকটা জমি ছিল। অনেক ভূসম্পত্তির মালিক আমাদের পরিবার। সেখানে অনাথ বাচ্চাদের একটা আশ্রম করেছি আর পথেঘাটে যে মানসিক অসুস্থ মহিলারা ঘুরে বেড়ান তাদের চিকিৎসা আর আশ্রয়। 

হাতের সিগারে একটা লম্বা টান দিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারি সাহেব, দেখুন, আজ যদি ড রায়হান স্বীকার না করতেন ডিএসপি শেরপার একটা সন্দেহ দিয়ে কখনই প্রমাণ করা যেত না যে ড বেদপ্রকাশ উপাধ্যায় খুন হয়েছিলেন। ড নন্দী দীর্ঘ দিন এই ঘটনার তদন্ত করেছেন। তাতে বেদপ্রকাশ উপাধ্যায় সম্পর্কে যা জানতে পারলাম তাতে ওকে ভয়ানক এক ক্রিমিনাল বলেই মনে হল, যার অপরাধ আদালতের বিচারগ্রাহ্য নয়। তাই আমার মত ড আবু সৈয়দ রায়হানকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া উচিত। উনি শিক্ষকতা আর সমাজসেবার মাধ্যমে নিজের অপরাধ থেকে আগেই মুক্তি পেয়ে গেছেন। 
একমত না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তাছাড়া আমাদের জন্য গ্লেনফিডিচের পেয়ালা অপেক্ষা করছিল। রায়হান রাতেই ফিরে যাবে। জয়েন্ট সাহেব বললেন, একটু চেখে দেখবেন না? 

- না স্যার, আমি কোনো নেশা করি না। পশুমাংস খাই না। আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন সুফী ও যোদ্ধা। তাদের ধর্মবোধ আর কান্টের দর্শন আমার শেষ আশ্রয়।
---------






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪