চতুর্থ বর্ষ ।। পঞ্চদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ১৯ কার্তিক ১৪৩০ ।। ৬ নভেম্বর ২০২৩
আমাদের দেশ নির্মাণের আসল কারিগররা খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন হেমন্তের এই সময়ে। একদিকে বর্ষা পরবর্তি সময়, অন্যদিকে উৎসবের মুহূর্ত, বর্ষার জলে ধুয়ে যাওয়া বাড়িঘরকে নতুন রূপে সাজানোর পালা। নতুন জীবনদান করার পালা। যৌবনবতী করে তোলার পালা। যাতে করে আরও এক বছর সুন্দরভাবে সেবা দিতে পারে আমাদের। অন্যদিকে মাঠে মাঠে পরিপক্ক হয়ে ওঠা সোনালী ফসলকে ঘরে তোলার তোড়জোড়। চাষিদের সামান্য বিশ্রামের উপায় থাকে না এই সময়। রাতে সামান্য নিদ্রা গেলেও বিভোরে বলতে থাকেন, "কাল কানালীর কচা ক্ষেতটা শেষ করে লম্বা ক্ষেতটায় হাত দিতে হবে গো। কামিন বাড়াতে হবে দু'চারজন। অনেক বড় ক্ষেত। পাঁচজন কামিন দিয়ে হবে না। মুনিষও বাড়াতে হবে। লট আঁটি বেঁধে তুলতে হবে আলে। ভরাট করে রাখতে হবে। ক্ষেতে তো জল। এ বছর কষ্ট একটু হবে।"
কবে আর সুখ। চাষিঘরে সুখ বলতে একটাই, চাল কেনার ঝামেলা নেই। ধান পাকার পর কোনোমতে একবার ঘরে তুলতে পারলে সারাবছর ভিজা সিঝা করে খেলেই হলো। বাড়ির লতাপাতাতে ঝিঙে কাল্লা কুঁদরি সিম কোন না কোনটা হচ্ছেই। অভাব নেই। ধোয়া-মাজার জলটা লতাপাতার মূলে দিলেই হলো। আলাদা কিছু লাগে না।
দেশের জিডিপির বৃদ্ধি ঘটায় এরাও। কিন্তু এদের জিডিপি খুব একটা বাড়ে না। সরকারের শিল্পপতি ঘেঁষা নিয়মকানুন প্রবর্তনের প্রবণতা শেষ পর্যন্ত মাটি করে দেয় এদের সমস্ত পরিশ্রমকে। সম্ভবত এই কারণেই চাষবাসকে অনেকেই টা টা করে রাস্তার ধারে বা কোনো মোড়ে গিয়ে চা টা করার দিকে ঝুঁকছে। যা একদিকে যেমন দেশের জন্য বিপদ সংকেত, তেমনই সভ্যতার জন্যও।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
অরণি বসু / সুশান্ত সেন / সৃশর্মিষ্ঠা / বেণু মাহাত / অয়ন জোয়ারদার / তৈমুর খান / দেবযানী ঘোষাল / হিরণ্ময় সরকার / ময়ূখ দত্ত / বিবেক সেন / নিতা রায় /
_____________________________________________
রোদ্দুর
অরণি বসু
আলো পড়ুক শিশুর মুখে
আলো পড়ুক তোমার মুখে
জেগে উঠুক সংসার
শুধু ভালোটুকু সঙ্গে নিয়ে যেন
পার হয়ে যেতে পারি নদী
অনেক না বলা কথা থেকে যাবে
একই কথা ঘুরে ফিরে অনেকবার বলা হবে
তবুও তো তোমার হাসি, চোখের জল মিথ্যে নয়
ঠোঁটে লেগে থাকে জয়-পরাজয়-জয়
আলো পড়েছে শিশুর মুখে
আলো পড়েছে সংসারে
পুরোনো পৃথিবী রোজ নতুন লাগে।
সুশান্ত সেনের কবিতা
১.
কবিতা
কবিতা মনের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে
দম হারিয়ে যখন খাবি খাচ্ছে
ঠিক সেই সময়ে একটা প্রজাপতি এসে
নানা রকম রং ছড়াতে থাকলো
আর তার পাখার ঝাপটানো ও নানা
অপূর্ব রং দেখতে দেখতে বেভুল হয়ে
কবিতা কি করবে বুঝতে পারলো না।
তাই প্রজাপতি রং আর পাখা ঝাপটানোর
কারসাজি গোস্বামীর কলম থেকে বেরিয়ে
পি সি সরকারের সম্মোহনের ধাক্কায়
মেয়েটিকে কেটে দু টুকরো করে দিয়ে
জনাকীর্ণ রাস্তায় সাইকেল চালাতে থাকল।
কবিতা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো, দেখতেই থাকলো,
তার আর প্রকাশিত হওয়া হলো না ।
২.
সংশয়
নস্কর বাবু এক পা এগোলে সাত পা পিছিয়ে আসেন।
বিজন বাবু পাড়ার মোড়ে শুনে এলেন -
হরি বাবুর ভুল চিকিৎসা হয়েছে।
পূপে জানলো কারা কারা রাস্তায় শুয়ে পড়েছিল বলে স্কুলের বাস ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেনি।
রক্ত পরীক্ষায় কোন সংখ্যা এলে মধুমেহ
আর কখন কোন সংখ্যা এলে মধুমেহ হয়নি বলে ধরতে হবে --
এই নিয়ে বেজায় তর্কাতর্কি পন্ডিত সমাজে।
পরেশ বাবু তাঁর মেয়েকে গলি পথ ধরতে বারণ করেন, বিপদ আছে মনে করে, যদিও রাস্তাটা অনেক সহজ পথ।
এই সব সংশয়ে দিনগুলো সব কেটে যাচ্ছে।
দাঁড়িয়ে ওঠা আর হয়ে উঠলো না।
সৃশর্মিষ্ঠার কবিতা
১.
হেমন্তের ডাকটিকিটে
আলোর জমা আছে কুকুরের ঘুমে
রঙিন ফুলের জন্ম, সে আমার নয়
ফুরিয়ে এসেছে প্রকাশ
ঘুম পেলে কেউ ডেকে নেয়
হেমন্তের হলুদ ডাকটিকিটে
নিজের স্বর খুঁজি, মধ্যরাতে
জল জমে গাঢ় মর্গের কফিনে
ভোর হলে দেখো
গতরাতে আমিও বেঁচে ছিলাম
তোমাদের মতো...
২.
সুউচ্চতায়
পাহাড় আর কুয়াশার গাঢ় অস্বস্তির ভেতর
খালি পায়ে হেঁটে যাই
ক্রমশ পাইনের বন
নিঃশব্দে বাজে আকাশের নীল ডাক
শিশিরের কুম্ভে
এখানে প্রেমিকাকে ভেবো না
সুউচ্চতায় সমুদ্রের যৌনতা মানায় না...
৩.
নিভৃতে
অবসরের
সহজ শব্দে স্তব্ধতা ভাঙে
যখন তুমি ক্ষণিক বিশ্রামের টোপে
টিপটিপ আদরে
দেহ এলিয়েছ দুপুরের গায়ে
আর তাকিয়েছ
সেই অচেনা পাখিটির দিকে
যে বাতাসের কোমলতা পেরিয়ে
দূরত্বকে বশে এনেছে অনায়াসে
অনেক বছর হলো
আমরা কাছে আসিনি...
চক্ষুদান
বেণু মাহাত
অলি গলি ঈশ্বরের কৃপাদৃষ্টি।
অথচ
নিত্য দিনের পরিপাটিতে
শুকনো পেটের ভেতর ক্ষুধা জট পাকাতে পাকাতে গলায় আটকায়।
ক্ষয়িষ্ণু চাঁদে ফুটে ওঠে কত মানুষের হা-হুতাশ ,
ঢোক গিলে...
দুবেলা মাড় ভাতে ডুব দিতে দিতে দেখে মায়ের চক্ষুদান ।
অয়ন জোয়ারদারের কবিতা
১.
একটা সহজ ইস্তেহার
তুমি সূর্য দেখেছো?
তাকানো যায় নাকি ওদিকে? এই যে আলো আছে,
তাই তুমি দেখতে পাচ্ছ।
আর চাঁদ ? রাতে দেখা যায়। তাকানো যায় সরাসরি।
গায়ে পড়লে সারা গা সাদা হয়ে যায়।
-নদী দেখেছো কখনো ?
দেহে থাকে নদী, মাথায় তার গতিপথ
এই তো নদী। নদীতে মাছ থাকে। দেখতে পাচ্ছ মাছ?
নীল আলো পড়ে কেমন চকচক করছে!
নৌকোও থাকে। নৌকো চালালে বুকে গান আঁকা যায়।
আমাদের গ্রামে নদীর পাশে গাছ।
গাছে পাতা, ফুল, ফল।
তুমি নাম দেশ ফুল ফল জান?
ওই দেখো সূর্য উঠলো, ওই দেখো চাঁদও আছে-
সূর্য, চাঁদ, আলো, অন্ধকার , গাছ , ফুল, নদী, নৌকো, এসব আমরা জানি?
এতে হবে না তোমাদের ?
তোমরা আর কি জানো, তোমরা আর কি জানো,
তোমরা আর কি জানো? জেনে কি হয়?
২.
কোনো সর্বনাম নেই
একটা ফুলের নাম মনে পরছে না ঘুম থেকে উঠে..
একটা নদীর নাম ভুলেই গেছি..কতদিন হলো..
পরশু থেকে ধারাবাহিক সপ্ন দেখছি রাত জুড়ে..
শাড়ির পাড় বাঁধা এক শীর্ণ লতানে গাছ আমার মাথা জুড়ে জড়িয়ে থাকে..
শীতের হালকা আমেজ আমার মাথার উপরের পাখার আঘাতে টুকরো হয়,
আমি আসতে আসতে অনুভুতির বাক্য হয়ে উঠি..
কোনো সর্বনাম নেই..শুধু অনুভুতির বিশেষণ।
আহা! তুমি কখনও বিশেষণকে গুরুত্ব দিয়েছো??
বয়ঃসন্ধিগুচ্ছ
তৈমুর খান
১.
পর্যবেক্ষণ
পড়া মুখস্থ হয়নি
ইক্ষুক্ষেতের পাশে বসে
দেখি ঘাসেদের কানাকানি
একটি হলুদপাখি বাসা বাঁধে
ওকে আমি চিনি
ওর নাম টুনটুনি
২.
হাওয়ায়
তেঁতুলগাছের নিচে একাই বসেছি
স্মৃতিরা একে একে আসে
আমার বাল্যকাল ন্যাংটো চেয়ে আছে
ফ্যাল্-ফ্যাল্ …
গাছের কোটরে লুকায় বেড়াল
বয়ঃসন্ধির হাওয়ায়
ভিজে যায় স্বমেহনকাল!
৩.
ক্লাসে
দু একটি নতুন দিদিমণি
আমার নিভৃত ক্লাসে আসে
আমি শুধু ব্ল্যাকবোর্ড দেখি মনে মনে
জবা গাছে ফুল ফোটে
রুই মাছেরা ঘাই কাটে
দিদিমণির বুকের আঁচল ওড়ে
৪.
কুয়ো
একুয়োর নিচে জল, বহুদূর নিচে
আমি শুধু দড়ি ছাড়তে থাকি
বিস্তর পিপাসা পেলে বেড়ে যায়
স্বপ্নের দড়ি
আকাঙ্ক্ষারা হাত পেতে বসে থাকে
জল খাবে বলে
৫.
পথে
কাঁপতে কাঁপতে চলে যাচ্ছি
ভীরু রাস্তায় কাদের পাহারা?
সন্দেহ আমাকে তাড়া করে
খোলা জানালায় দেখি আধখানা নাভি
খোলা চুল
হাত-পা নড়ে…
৬.
লজ্জা
তাকানো যাচ্ছে না ওর দিকে
সোনালি উন্মুখ ঘাস
জ্যোৎস্নার ফসলে মাঠ ভরে আছে।
এলোমেলো চুলের ঘ্রাণ যদিও ডাকে
সঙ্গে তবু রেখে দিই সরল লজ্জাকে
৭.
রাত্রি
ঘুম হয়নি, তা তোমাকে বলিনি
সারারাত জোনাকি উড়েছে
বিছানা বালিশে অস্বস্তি লেগে আছে
ইন্দ্রিয়বাগানে ডেকে গেছে সংকেতের পাখি
৮.
গোপন
লেখা ও না-লেখা চিঠি শুধু ভিড় করে
আয়নায় নিজেকে দেখি
দেখা ও না-দেখাগুলি শুধু কেঁদে মরে
বলা হয় না, বলা হয় না কিছু
সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাই
মাথা হয় নিচু
মাটির মানুষ
দেবযানী ঘোষাল
ওগো !!
তোমার শরৎবাবুর চন্দ্রমুখীর ঘরের সামনে থেকে একটু মাটি খুঁড়ে নিয়ে যেও গোওওওও!
তা না হলে তোমার বাড়ির সামনে বারোয়ারীর বাঁশের প্যান্ডেলের উমার পূজা
সুসম্পন্ন হবে না গো!
নিও যেও গো !
ভুলো না আ আ আ।
চন্দ্রমুখীকে ভোলো ক্ষতি নেই।
ক'জনা আর মনে রাখে চন্দ্রমুখীদের!?
ক'জনা আর ভাবে তাদের মন।
কারুর একদিন বারবাড়ন্ত।
কারুর বা হাঁড়ি চড়ে না।
পাক ধরেছে চুলে।
সময় তো কম গেল না।
কালের সময় পেরোলে
দুটো মুখ ঝামটা না হয় খেলে!!
মানাতো পারো না তুমি?
এ কেমন পুরুষ গো তুমি?
ভুল করেও না হয় ঘুরে যেও এক মুঠো রোদ পোড়া শিউলি সুবাসি শরৎ মাটির জন্যে।
তোমার বারোয়ারী পূজোর ঢাকের আওয়াজে ভুলেই যাবে সেদিনের আলোময় স্তুতিগানের মেলা।
তবু তো দাঁড়ের পাশ থেকে লুকিয়ে দেখতে পাবে তার পরানটা!
বোধনের দিন ঐ মাটি হাতে উমার দিকে এক মনচিত্তে চেয়ো তোমার আগামীর বাসনা।
হবেই হবে পূরণ।
শুভকামনায় এ মনটা।
হিরণ্ময় সরকারের কবিতা
১.
চরিত্রহীন
সারাদিন ভাটিখানায় বসে---
চরম উত্তেজনা নিয়ে,
টলতে টলতে বাসায় ফেরে
একরাশ আবেগ নিয়ে।
তারপর পুরুষ সিংহের অত্যাচার!
নিরীহ বধূ তবু সহ্য করে,
বুক বাঁধে রাতের আশায়---
প্রতিদিনের মত আজও
ঠাণ্ডা বিছানায় প্রহর গোনে
বিপরীত আসনে
ভিজে যায় মাথার বালিশ
ভোরের অপেক্ষায়---।
তারপর একদিন বাঁধ ভাঙে
চুরমার হয়ে যায়
নিয়ম নীতির বাঁধন---
বৃষ্টি ভেজা এক শরৎ সন্ধ্যায়
আলাপী ছেলেটা এসে
মেলে ধরে নীল ছাতা
মাথার উপর---।
দিন, মাস, বছর শেষে
চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে
সমতলে এসে যেদিন স্বপ্ন দেখে
হাত ধরে একে অপরের,
হাঁটতে শুরু করে নতুন পৃথিবীর দিকে।
পুরুষ সিংহ গর্জে ওঠে---
বেশ্যা, চরিত্রহীনা বলে।
নিরীহ বধূ শুধু মুচকি হেসে
একরাশ ঘৃণা ভরে
মেলে ধরে অভিধানের পাতা।
২.
তুমি প্রকৃতির মত
আমি এক ফোঁটা জল চেয়েছিলাম---
তুমি পাহাড়ী নদীর মত
আছড়ে পড়লে আমার পাথুরে,
পাষাণ বুকে।
আমি এক টুকরো আকাশ চেয়েছিলাম
তুমি দিলে উদারতার মহাশূন্য---
অগনিত তারার ভীড়।
আমি একটা ঝরা পাতা চেয়েছিলাম
তুমি দিলে এক বিশাল অরন্য
তোমার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার
এক অচেনা ঈশারার প্রলোভন।
তোমাকে চেয়েছিলাম একবিন্দু নোনা জল
তুমি দিলে বিশাল জলরাশি---
আর অবিরাম ঢেউয়ের গভীরে,
থরে, থরে সাজানো রত্নের আকর।
তোমার কাছে এক টুকরো মাটি চেয়েছিলাম
তুমি দিলে রূপে, রসে, গন্ধে ভরা---
এক বিরাট পৃথিবী।
তোমার কাছে একটা মুহূর্ত চেয়েছিলাম
তুমি অবলীলায় দিয়ে দিলে তোমার
সারাটা জীবন।
পরিপূর্ণ নারী তুমি, প্রকৃতির মত
প্রতিদান গ্রহণে বিরত, উদার, উদাসীন।
আরবদেশের দুর্গাপুজো
ময়ূখ দত্ত
অনেক আত্মীয়-স্বজনের কাছেই আমার পরিচয় - আমি নাকি আরবদেশে থাকি এখন!! এই 'আরবদেশ' কথাটা শুনলেই ছোটোবেলার সেই নিষিদ্ধ "সহস্র এক আরব্য রজনী" র কথা মনে পড়ে যায় আর তার সাথে আমার বাবার কথা... ২০১০ সালে বাবা প্রথমবার ছেলের কাছে আসার আনন্দে পাড়ার রিটায়ার্ড মর্নিং ওয়াক গ্রুপে জিজ্ঞাসা করেছিল,"ছেলের কাছে আরবদেশে যাচ্ছি, বলুন কি আনব আপনাদের জন্য?" চোখে মুখে খুশীর ঝিলিকে ভরা বাবার মুখের ওপরে নাকি কয়েকজন উত্তর দিয়েছিলেন "... ঐ মরুভূমির দেশে ঊট, খেজুর ছাড়া আর কি পাবেন? জিজ্ঞাসা করলেনই যখন, দুটো খেজুরই না হয় নিয়ে আসবেন!!" বাবা নাকি খুব মুষড়ে পেড়েছিল!! পরে ঝাঁ-চকচকে দুবাই-শারজা-আবুধাবি ঘুরে গিয়ে বাবা নাকি ঐ প্রৌঢ় বন্ধুদের 'মুখের ওপরে জবাব' দিয়েছিল...সে আর এক গল্প!!
যাই হোক যেটা বলছিলাম - এই আরবদেশ বা মুসলমান শাসিত দেশ নিয়ে প্রচুর ঠিক ও বেঠিক ধ্যানধারনা আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে। সবকটা দেশের ব্যাপারে বলাটা ঠিক হবে না, কেননা আমি ওমান আর সংযুক্ত আরব আমীরশাহী (দুবাই /শারজা / আবুধাবি ইত্যাদি) তেই থেকেছি, তাই আমার যাবতীয় গল্প এই দুই দেশকে নিয়েই। আজকালকার গ্লোবাল দিনযাপনে অভ্যস্ত, ইন্টারনেট স্যাভী সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে প্রতিদিন, তাও প্রায়শই প্রশ্ন শুনি যে "...তোদের /তোমাদের ওখানে পুজো হয়?" খুব মুশকিলে পড়ি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে...কি করে সবাইকে বোঝাই যে এইসব দেশেও অনেক পুজো হয়, সবাই খুব আনন্দ করে, তবে তার মাধুর্য এক্কেবারে অন্যরকম, কলকাতা বা বাংলার থীম পুজো বা প্যান্ডেল হপিং হয়তো এখানে নেই, নেই স্পন্সরদের বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাওয়া অলি-গলি বা হাজারটা "পাড়ার সেরা পুজো" / "বনেদী বাড়ির সেরা পুজো"-র মত প্রতিযোগিতা, কিন্তু বাঙালি উন্মাদনা আছে পুরোমাত্রায়, ফেসবুক জুড়ে পুজোর আগে "দুবাইতে কোথায় পুজো হচ্ছে, কেউ জানাবেন?" টাইপের অহরহ পোস্ট, সবই আছে, হয়তো একটু অন্যরকম স্বাদের...
মাস্কাটে থাকার সময়ে দেখেছি, শিবমন্দিরে আমাদের বঙ্গীয় পরিষদের পুজো হত যাবতীয় নিয়ম-কানুন, দিন-ক্ষণ মেনে। আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে অনেক জায়গাতেই শনি-রবি এই দুদিনেই চারদিনের পুজো করা হয় যাতে সপ্তাহের কাজের দিন সবাই কাজে যেতে পারে, কাজের /ব্যাবসার ক্ষতি কেউ চায় না। পাঁজি-পুঁথি সব ওলট-পালট হয়ে যায় মানুষের পেটের ভাত যোগাড়ের প্রাধান্যে...মাস্কাটের দিন-ক্ষণ মেনে পুজোর কথাটা এখানে এই কারণেই হয়তো উল্লেখ্য!! সন্ধ্যারতি থেকে শুরু করে, ফলকাটা, ছোট্ট মন্দির হলটা সাজানো সবেতেই আমরা নিজেরা, নিজের বাড়ির কোনো অনুষ্ঠান যেন। কার শাড়িটা লেটেস্ট ডিজাইনের, কার সাজটা সামঞ্জস্যহীন এসব পিএনপিসি চলতেই থাকে, সাথে সন্ধ্যের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- বাংলার যে কোনো পুজোর সাথে মিলে যায়!! মন্দিরটা এক্কেবারে ওমানী পাড়ার মধ্যে অবস্থিত (মানে যে ঘিঞ্জী জায়গাতে, ছোট্ট গলির মাঝে আমাদের মতো বাইরের দেশ থেকে কাজের জন্য আসা expat রা সাধারণত থাকে না)। নতুন শাড়ি-জামা পরে কলরব করতে থাকা বাঙালিরা ওই কদিন যেন ওই পাড়াটা দখল নিয়ে নিত!! কোনোদিন দেখিনি কোনো ঝামেলা হতে। সাধারণ ওমানী বাসিন্দাদের সাথে। সরকারীভাবে স্বীকৃত মুসলিম একটা দেশে স্বাভাবিকভাবেই কিছু ভিন্ন নিয়মকানুন থাকে। আমরা রমজানের সময়ে দিনের বেলা প্রকাশ্যে জল বা খাবার না খাওয়ার চেষ্টা করি, অনেকবছর বসবাসের পরে ভিন্নধর্মী হিসেবে এটা বুঝেছি যে এটা যতটা না সংখ্যাগরিষ্ঠের ধার্মিক নিয়মকে মেনে চলার একটা অনুশাসন, তার থেকে বেশি সারাদিন নির্জলা উপোস করে থাকা অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি সহমর্মিতার প্রকাশ, তাদের ধার্মিক আচারকে সম্মান জানানো !! আমাদের মন্দিরের গার্ড ছিলেন এক মুসলিম ওমানী। কোনো একবছর রমজানের সময়ে দুর্গাপূজা পড়েছিল, তাই ঠিক করা হল যে সেই বছরে অষ্টমীতে পাত পেড়ে বসে খিচুড়িভোগ খাওয়ানো হবে না, তার বদলে সবাইকে প্যাকেট ভোগ দিয়ে দেওয়া হবে, যে যার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভোগ খাবে। সেই হিসেবে আমরা, ভলেন্টিয়াররা প্যাকেট ভোগ বিলি করছিলাম, একসময়ে দেখি রমজান মাসে সেই উপোসী মুসলিম ওমানী গার্ড এসে আমাদের সাথে হাত লাগিয়েছেন, ভোগ বিলি করতে!! মনে হল ধর্মের বাঁধন ছেড়ে আমাদের পুজো আক্ষরিক অর্থেই সার্বজনীন হয়ে উঠল!!
অনেকের কাছে ব্যাপারটা একটু আশ্চর্যের হলেও এটা হয়তো জানানো দরকার যে এই ধরনের মুসলিম শাসিত দেশগুলোতে অন্য ধর্মের মানুষজনের নিজস্ব ধর্মাচরণ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধানিষেধ নেই, আমরা দৈনন্দিন জীবনে খুব একটা কিছু পার্থক্য বুঝি না। মন্দির, গীর্জা সবই আছে, তবে হুট করে কারুর খেয়াল হল আর একটা গাছের তলায় পাথর রেখে তাতে সিঁদুর পরিয়ে, একটা প্রণামীর বাক্স রেখে পুজো চালু করলাম এক শনিবারে - এটা হবে না। সরকারের থেকে প্রসাশনিক অনুমোদন দরকার!! বহুবছরের পুরোনো দুবাই মন্দিরের দূর্গাপুজোতে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই কোনোদিনই, যথাযত সরকারী অনুমোদনের সাথেই পুজো হত, এখনো হয়, কিছু কিছু ক্লাব বা সংস্থা ওই সব প্রসাশনিক ঝুট-ঝামেলা এড়িয়ে পুজোর আয়োজন করে সাধারণ "শারদ উৎসব" ("autumn festival") হিসেবে... সেসব ক্ষেত্রে প্রশাসন হয়তো কিছুটা চোখ বন্ধ করে থাকে!! ঢাক বাজিয়ে, কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে পুজো অনেক সময়েই হয়তো একটু রেখে-ঢেকে হয়, যাতে কারুর কাছে সেই শব্দ ইত্যাদি কোনো প্রকার "দূষণ" হিসেবে বার্তা বয়ে না নিয়ে আসে। কেউ যেন কোনো অভিযোগ না করে। কিছু কিছু সময়ে পুজো কতৃপক্ষের তরফে অনুরোধ থাকে যে পুজো চলাকালীন ফেসবুক লাইভ করা যাবে না বা পুজোর ছবি দশমীর আগে ফেসবুক/ইন্সটাতে দেওয়া যাবে না ইত্যাদি!! চারদিন এই বিদেশে বসে পুজোর অনাবিল আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা, ছবি তোলা ইত্যাদি সব বন্ধুবান্ধব, চেনা-পরিচিতদের সাথে শেয়ার করার আনন্দে মত্ত সাধারণ বাঙালিদের কাছে ওইসব ছোটোখাটো জিনিষ!! সন্ধ্যেতে পুজো দেখে, রাত জেগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে বা তাতে অংশ নিয়ে আবার পরের দিনে সবাই অফিসে বা কাজের জায়গাতে (এই দেশে তো দুর্গাপুজোতে কোনো ছুটি নেই!!), কেউ কেউ অবশ্য তাদের মহার্ঘ বাৎসরিক ৩০ দিনের পাওনা ছুটির কয়েকটা এই সময়েই নিয়ে নেয় এই কদিন সপরিবারে আনন্দঘন কয়েকটা দিন একসাথে কাটাবে বলে। আজ এত বছর পরে জানতে পারছি যে এই দেশে সব মিলিয়ে নাকি ২৯ টা পুজো হচ্ছে, বেশ কিছু তো রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে, ঢাকঢোল পিটিয়ে, ঢ্যাং কুড়কুড় বাদ্যি বাজিয়ে...বারোয়ারি পুজোও চালু হয়ে গেছে...এখন লোকে কিছুটা হলেও "প্যান্ডেল হপিং" এর আনন্দ নিতে শুরু করেছে!! সকাল বেলা বাস ভাড়া করে সবাই মিলে ২০০ কিমি দূরত্ব পার করে শারজা থেকে আবুধাবি গিয়ে লোকে ঠাকুর দেখে আবার রাতে ফিরে এসে শারজার পুজোতে আনন্দ করছে!! সুতরাং এটা বুঝছি যে গ্লোবালাইজেশনের যুগে এই ধরনের মুসলিমপ্রধান দেশও তার ধ্যানধারণা, তার চিরাচরিত প্রসাশনিক ব্যাপারস্যাপার অনেক পাল্টে নিয়েছে, মানুষের উৎসব জিতে যাচ্ছে...
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলোতে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ফিলিপাইন এর মত দেশ গুলো থেকেই বেশীরভাগ শ্রমিকশ্রেণী আসে "blue collar" কাজ করার ক্ষেত্রে। তার সাথে সাথে আমাদের মত "white collar" বাবুশ্রেণীও আসে পয়সা কামানোর জন্য। এই দেশগুলোতে বাংলাদেশের বাঙালীরা সাধারণত "blue collar" কাজে যুক্ত আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা বেশীরভাগই "white collar" কাজের সাথে যুক্ত!! এই কারণেই কিনা জানি না আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, তারা বাংলাদেশের বাঙালিদের থেকে নিজেদের একটু উঁচু স্তরের মনে করি!! এই ব্যাপারটা প্রচণ্ডভাবে চোখে পড়েছিল প্রথমে মাস্কটে এবং তারপরে দুবাই আসার পরেও....। এদিকে দুর্গাপুজো তো সার্বজনীন, সেখানে ধর্ম, রাজনৈতিক কারণে ভূখন্ডের ওপরে তারকাঁটার বেড়া, এসবে কি এই জীবনের উৎসবকে আটকে রাখা যায়? তাই সব গোষ্ঠীর মানুষই সব পুজোতে যাতায়াত করে। এখানেই একটা অদ্ভুত অনুভুতি এসেছিল মাস্কটে ২০০৭ সালে এবং এখনো দেখি...পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি আয়োজিত দুর্গাপুজোতে কোনো বাংলাদেশের মানুষ আসলে কেউ বারন করে না বা আটকায় না, কিন্তু সেভাবে আমরা ওদের আপন করেও নিই না...। অন্যদিকে আমরা মানে পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা যখন বাংলাদেশীদের পুজোতে যাই, ওরা এত আপ্যায়ন করে, বারবার ভোগ খেয়ে যেতে বলেন, অনেক জায়গাতেই বাকি সবাইকে হঠিয়ে আমাদের আদর করে বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়ানোর ব্যাবস্থা করেন যে - খুব লজ্জা পেয়ে যাই, প্রতিবারই, আমাদের নিজেদের মনের সংকীর্ণতার পরিচয় পাই প্রতিবারে!! একটা কাঁটাতারের বেড়া কীভাবে আমাদের মনকে দূষিত করে দেয়, অর্থনৈতিক স্তরের বিষমতা কতভাবে আমাদের সামাজিকভাবে আলাদা করে দেয় তার পরিচয় পাই এই মানুষের উৎসবের মাঝেও..তাই প্রতিটা পুজো আমার কাছে যেন সবদিক দিয়ে উত্তরণের এক একটা অধ্যায়...
আজকাল দেখি ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ, সহনশীল দেশেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতবাদই নাকি সবসময়ে ঠিক নীতি - এই ভ্রান্ত মতের একটা বিজ্ঞাপন চালানো হয় প্রতিদিন!! সেখানে মতের অমিল হলেই "... এখানে না পোষালে পাকিস্থান চলে যান..." টাইপের মন্তব্য ভেসে আসে। এই পরিস্থিতিতে এইবার দেখলাম এখানকার একটা দুর্গাপুজোর ভেন্যু হচ্ছে "পাকিস্থান রিক্রিয়েশান সেন্টার"। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যাওয়া দুটো দেশ, তিনটে যুদ্ধ, সর্বদা ছায়াযুদ্ধ খেলতে থাকা দুই দেশের রাজনৈতিক কূটনৈতিক আওতার বাইরে দুদেশকে মেলানোর অনেক চেষ্টা চলে - ক্রিকেট, লতা মঙ্গেশকার, মেহেদী হাসান সব চেষ্টাই বিফলে যায়...শারজাতে পাকিস্থান সেন্টারে আয়োজিত বাংলাদেশি হিন্দুদের দুর্গাপুজো দেখে একটাই জিনিষ মনে হলো - মানুষ আগে, ধর্ম পরে, যেখানে মানুষের উৎসব, সেখানে কাঁটাতারের বেড়াতেও হয়তৈ কোনো একদিন গোলাপ ফুটবে, এই আশাতেই তো আমরা বাঁচি!!
একটা সময় পর্যন্ত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ভোর চারটের সময়ে নাকি গঙ্গাস্নান করে শুদ্ধ হয়ে আকাশবানী ভবনে ঢুকে " মহিসাসুরমর্দিনী লাইভ" করতে বসতেন বাকি সবাইকে নিয়ে, যা আমরা বছরের পর বছর ধরে শুনে আসছি... সেই প্রোগ্রাম আর দেবীপক্ষের সুচনা যেন সমার্থক আমাদের সবার কাছে!! আমার জানা নেই, আর কোথাও এই "লাইভ মহিসাসুরমর্দিনী" দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছে নাকি বা হয় নাকি...এই আরবদেশে আমরা দেখি নিজেদের চেনাপরিচিত মানুষজন একজোট হয়ে বিশুদ্ধ সংস্কৃত স্তোত্রপাঠে, গানে এই "লাইভ মহিসাসুরমর্দিনী" প্রায় প্রত্যেক বছর... কোনো কোনো বছর সন্ধ্যেবেলা, স্টেজে আবার সেই প্রোগ্রাম পরিবেশনা করা হয়, যারা লাইভ দেখতে পারেননি তাদের জন্য!! শুধু এটুকু বললেই হয়তো এই আরবদেশের দুর্গাপূজার গল্প অনেকটাই বলা হয়ে যায়, অনেক ভ্রান্ত ধারণাই হয়তো দূর হয়ে যায়...।
আর একটা কথা না বললে হয়তো এই আরবদেশের দুর্গাপুজোর কথা অসমাপ্ত থেকে যায়। বাচ্চারা যারা বাংলার বাইরে, দেশের বাইরে জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে - স্বাভাবিকভাবেই তাদের বাংলায় কথা বলা বা বাংলা পড়া/লেখার মধ্যে একটা আড়ষ্টতা থাকে, তার মাত্রাটা কম-বেশী হয়, যেটা তাদের বাবা-মায়ের প্রচেষ্টার ওপরে অনেকটাই হয়তো নির্ভর করে...সব কিছু ছাপিয়ে পুজোর এই চারদিনে নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি, শাড়ি-চুড়িদারে বাচ্চাগুলো যখন অনেক রিহার্সালের পরে স্টেজে নাচে-গানে-কবিতায় সুকুমার রায়, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মেতে থাকে, চারদিকে ওদের উৎসাহিত করতে থাকা হাততালির স্রোতে ওদের নিষ্পাপ হাসিতে মন ভরে ওঠে... এসি ব্যাঙ্কোয়েট হলের কোনায় বা দেওয়ালে হাওড়া ব্রীজ, উত্তম-সুচিত্রা বা বেলুড় মঠের ছবিতে আমরা খুঁজে পেতে চাই ফেলে আসা স্মৃতিকথা, পুরোনো প্রেম বা বিরহব্যাথা....অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও এই দূরদেশে, এই 'বিধর্মী"দেশে সমস্ত প্রতিকুলতার মধ্যেও কোথাও যেন আমাদের বাঙালি মননে একটা সোনালী রেখা দেখতে পাই!!
এবারে পুজোর মধ্যেই আমার এক বন্ধু আমাকে বলল যে দুর্গাপুজোর নাকি আলাদা করে কোনো মন্ত্র হয় না, অনেক মন্ত্রের সমন্বয় ঘটে এই পুজোতে বা আমরা যখন পুষ্পাঞ্জলি দিই। একইভাবে হয়তো সেই কারণেই এই "পুজো" আসলে আমাদের সবার কাছে সারা বছরের সব ক্লান্তি, গ্লানিকে জয় করে, সবকিছুর সমন্বয়ে নিজেদের পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিকে কয়েকটা দিনমাত্র... প্যান্ডাল, মূর্তি, আলোকসজ্জা এসব তো শুধুমাত্র তার বাহ্যিক ব্যাবসায়িক আবরণ মাত্র, এই "আরবদেশ" এর পুজো তার বাইরে বেরিয়ে এসে যেন এক আত্মীয়তার মেলবন্ধন ক্ষেত্র - জীবনের সব কষ্ট, সব টেনশান ভুলে কয়েকটা দিনের আনন্দঘন মুহূর্তসৃষ্টি, আমাদের বিশল্যকরণী!!
(এই লেখার ছবি লেখকের নিজস্ব)
ন্যায়বিচার
বিবেক সেন
প্রায় বিশ বছর পর আমরা আবার সবাই ফিরে গেলাম আমাদের যৌবনের সেই কর্মক্ষেত্রে। সার্জেনসাহেবের বিশেষ অনুরোধে।
পাহাড়ী ঘুমন্ত গঞ্জ।
ভোরের দিকে কুয়াশাঢাকা উপত্যকার কাঠের বাড়ি, স্কুলঘর, গুম্ফার শীর্ষ, দারচোগ আর লুংতার ওপারে শুধু মেঘ আর মেঘ। আর সে মেঘ ছাড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে এক চিলতে রোদ্দুর। নতুন কনের মত লজ্জায় মেঘের ওড়নায় মুখ ঢেকে নেবার আগে ওটুকুই দেখার, ওটুকুই লাভ।
নব্বইয়ের দশকে এমন ব্লক সদরে চাকরি করা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার, বিডিও আর তার কয়েকজন ইন্সপেক্টর, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার, এডিও, বিএলডিও, আইডিও, বাকি সব তো পাহাড়েরই ছেলে। শিলিগুড়ি থেকে প্রতিদিন আসা যাওয়া করাও সম্ভব নয়। আর অধিকাংশের বাড়ি কলকাতা, হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা, তাই মাসে একবার ব্লক ছেড়ে যাওয়াও কঠিন ব্যাপার। দু'দিনের জন্য ঘুরতে এলে যেখানে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় সেখানে বছরের পর বছর আটকে থাকা খুবই দুর্দশার। বিএলডিও সাহেব তো আট বছর একই জায়গায় পড়ে আছেন। তিনি মজা করে বলেন তার দপ্তর শুধু নয়, স্ত্রী পুত্রও হয়ত ভুলে গেছে যে তিনি আছেন। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমরা প্রায় সকলেই অবিবাহিত তখনও।
সে সময় এত হোটেল, হোমস্টের ব্যাপার চালু ছিল না। কাজেই ব্লক সদরে সামান্য কয়েকটি অফিস, হাসপাতাল, বাজার নিয়ে দিনের বেলাটুকু যত হৈচৈ। বিকেল হতেই পাহাড়ের দীর্ঘ ছায়া যেমন পাইনের জঙ্গলকে গ্রাস করে তেমনই নিস্তব্ধতা গ্রাস করে এই গঞ্জকে। তখন শুধু দূরে দূরে গ্রামের আলো কুয়াশার ফাঁকে মাঝেমাঝে জ্বলে ওঠে আর ভাঙ্গাভাঙ্গা গান ভেসে আসে - আরও পড়ুন
সহজ সুরে 'চারাবেলা'র সহজপাঠ
নিতা রায়
মানুষ যখন মনে মনে কোথাও যেতে চায় তখন তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো তার শৈশব। খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনমিত্র তাঁর মানসভ্রমণের জন্য নিজের চারাবেলাটিকেই বেছে নিয়েছেন। শতাংশের বিচারে শৈশব-কথার প্রাধান্য থাকলেও কৈশোর ও বড়বেলার কথাও অল্পবিস্তর এসেছে স্বতঃস্ফূর্ত সহজ গতিতে লেখকের স্বচ্ছন্দ অক্ষরপাতে। সেই সহজপাঠের সহজিয়া ভাবের ভালো-মন্দ বিচারে এগোনো যাক অনমিত্রর চিনিয়ে দেওয়া পথ ধরে। মায়ের একটি মন্তব্যকে উদ্ধৃত করে অনমিত্র লিখেছেন, জীবনের যে কোনো ঘটনার — তা হতে পারে লেখালেখি বা অন্য কিছু, তার তিনটি অংশ থাকে — মাথা, শরীর এবং লেজ। তাঁর মতটিকে শিরোধার্য করে তাঁর লেখা বইটির আলোচনাও আমি তিনটি স্তরে করবো।
আক্ষরিক অর্থেই মাথা দিয়ে শুরু করি। কঠিন কোনো অসুখের কারণে অনমিত্রর মাথার গঠন বড়, যা নিয়ে ছোটো থেকেই তাঁকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর সেই সংযত কিন্তু কষ্টছোঁয়া অনুভূতির কথা পড়লে লজ্জায় পাঠকের মাথা হেঁট হবে নিশ্চয়ই। কারণ, বুঝে না বুঝে মানুষের অক্ষমতা বা শারীরিক ত্রুটি নিয়ে আমরা এমনই আচরণ করে থাকি — এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। অনমিত্র কিন্তু আমাদের সহানুভূতি চাননি, নিজস্ব মেধাদীপ্ত স্মার্টনেস নিয়ে তিনি তুড়ি দিয়ে সব উড়িয়ে দিতে পারেন। কারণ তাঁর দুঃখবোধ রঙ পাল্টেছে, ধূসর থেকে হয়ে উঠেছে গোলাপী।
দক্ষিণের বারান্দা না থাক, উত্তরের জানলা প্রভাত বেলায় তাঁকে শিখিয়েছে সাহিত্য, সঙ্গীত, প্রকৃতির মর্মকথা। ৩১ এবং ৭৩ নং বাড়ি তাঁকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। অনমিত্র বুঝেছেন সময় যেমন জুড়ে দেয় তেমন আলাদাও করে, ফোটা ফুলের চেয়ে ঝরা ফুলের প্রতি তার টান বেশি — এভাবেই শিশুমনে জেগেছে মৃত্যুচেতনা।
জেঠু ও বড়মার দাম্পত্য কলহ থেকে তিনি প্রেমের সুরটি বুঝেছেন, জুতো হারাবার ভয় তাঁর শিশুমনে জন্ম দিয়েছে আতঙ্কবোধ। শৈশবেরও শৈশবে তিনি লিখেছেন প্রথম কবিতা — "দিন চলে যায়/ নষ্ট সময়/ মানুষ দাঁড়ায়/ সময় দাঁড়াতে জানে না। " এভাবেও ভাবা যায় — একথা ভেবে পাঠককে স্তব্ধ হতেই হয়। তাঁর স্বপ্নের দোকানে জমা — ১০০, খরচ — ১২০, সঞ্চয় — ১০।
জীবনের প্রেমে ডুবে থাকে যে রসিকজন — তার হিসেব তো আমাদের সঙ্গে মেলে না। তার উপলব্ধিতে কিছুটা অশেষ বোধহয় থেকেই যায় জীবনে। এইসব মণিমুক্তো দিয়েই সাজালাম এই আলোচনার মস্তক।
এবার শরীরের কথা। নানা দুষ্টুমি, নানারকম হাসি-কান্নায় ভরা ঘটনায় তৈরি অনমিত্রর শৈশব- শরীর। তার খানিকটা নিঃসঙ্গ শিশুবেলায় বাস্তব আর কল্পনার মেশামেশি। দেখে শেখা আর ঠেকে শেখার মধ্যে যে দুস্তর ফারাক, তা তাঁকে বুঝতে হয়েছিল প্রিয় ব্যাটের ধড় ও মুন্ড আলাদা হওয়ার মূল্যে। যে ফুটবল শহীদ হতে হতে বেঁচে গিয়েছিল, সেই ফুটবলে শেষবারের মতো মারাদোনা হওয়ার গল্প বহুবার পড়লেও পুরোনো হয় না। কান পাতলেই যেন শোনা যায় দুই বন্ধুর ডাকাডাকি —' ধওলা, কওলা… . ' কিম্বা দুপুরের নিস্তব্ধতা চিরে — ' ওলে ওলে আইসক্রিম… '। ছাদ ক্রিকেট, গলি ক্রিকেট, ঐকিক নিয়মের ছেলেমানুষি হিসেব — এসব নিয়েই অনমিত্রের সোনালী শৈশব। শৈশব তাঁকে শেখায় — 'জামাপ্যান্ট ছোটো হয় না, মানুষ বড় হয়' বা 'নামাটা খুব সহজ, ওঠাটাই কষ্টকর'। মামা জ্যোতিপ্রকাশের 'প্রকাশ'কে অপ্রকাশিত রেখে নিজের পরিচয় দেওয়া অথবা ভিড়ের মাঝে ডারউইন তত্ত্বের প্রয়োগ — এসব টুকরো টুকরো ঘটনায় তাঁর দুষ্টুমির ছবি বর্ণনার গুণে অসামান্য হয়ে ওঠে। কলকাতায় কাঞ্চনজঙ্ঘা বা মিস মার্জারের কথা তো শুধু শব্দের সম্মেলন নয়, ক্যানভাসে শব্দের তুলিতে আঁকা কোনো ক্লাসিক চিত্রকর্ম। অপটু দু-একটি কথা দিয়ে কতটুকুই বা বর্ণনা করা যায় অনমিত্রর ভূবন। সেই জাদু জগতের আস্বাদ পেতে হলে বইটি পড়তে হবে বহুবার।
এবার আসি আমার আলোচনার লেজের অংশে। "আমার সহজপাঠ"-এ সহজ আখরে লেখা হতে থাকে গভীর এবং সুন্দর কত শব্দছবি। জীবনকে ভালোবেসে, সজীব তারুণ্যের রঙে শব্দের তুলি রাঙিয়ে অনমিত্র এঁকেছেন কত ছবি — বিঠুনদের বাড়ি আড্ডা মারা, প্রুফ দেখা, অফিস ফেরত ফুচকা খাওয়া, বইয়ের জগতে হারিয়ে যাওয়া — আরও কত কী! তিনি উপলব্ধি করেছেন বইপাড়া জুড়ে শুধু বই আর মন, একেক মনের একেক রঙ। গরমের দুপুর, সন্ধের কালবৈশাখী, অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখে ফেরা, রবিবারের ছুটির জমজমাট আড্ডা — সব ভেসে চলে সহজপাঠের সহজ স্রোতে। যখন অনমিত্র লেখেন 'নতুন বউ দুঃখের চৌকাঠ পেরোয়, এক সংসার আরেক সংসারের দিকে পা বাড়ায়' — তখন মনে হয় সবাই যদি এভাবে ভাবতে পারতো! কমলদাদার মনের আকাশে যে তারারা ঝিকমিক করে, তাদের আলোয় পাঠকও নিজের ঘরে ফেরার পথটি খুঁজে পায়।
বইশালের বই, হারুর গান গাওয়া, মেঘেদের কথা, গলির ছবি সহজপাঠের সহজ সুরে ভরপুর। হারুর রচনা খাতার বাইরে যে খেলা সবসময় জেগে থাকে — অনমিত্রর চোখ দিয়ে আমরা তাকে চিনতে শিখি। 'নীল মুরগির কারিগর' যাঁর কলম চুঁইয়ে বেরিয়ে আসে —সেই লেখককে কুর্নিশ।
আমাদের মনের মধ্যে যে সহজপাঠের বাস — " আমার সহজপাঠ " তাকে অনুকরণ করেনি, অনুসরণ করেনি, তাকে আত্তীকরণ করে সেই সুরটি বজায় রেখে আমাদের উপহার দিয়েছে এক নতুন সহজপাঠ। সেখানে — 'নদীটির নাম তিরতির / আর ঢেউগুলি তার গয়না……', সেখানে 'তোমরা সবাই মেঘের দলে / আমরা ক'জন বৃষ্টির… '.। " আমার সহজপাঠ " আমাদের খেলনাবাটির জীবনের সময়কে দেখায়। আমরা বুঝতে শিখি — ফিরে যাব, ফেলে যাব অনেক কিছু, হয়তো নিয়ে যাব তার চেয়ে অনেক বেশি। অনমিত্রর লেখায় কান পাতলে শোনা যায় সেই আশার বাণী। তাই এই বই একবার নয়, বারবার পড়ার দাবি জানায় পাঠকের দরবারে।
একেবারে শেষে আসি বইটির প্রচ্ছদ ও ছবির কথায়। শুধু চন্দন বৈতালিকের প্রচ্ছদটি দেখেই চোখ বুজে এই বইয়ের প্রেমে পড়া যায়। ' শিশুমন অঙ্কন শিক্ষা কেন্দ্র'- র ছয় থেকে পনের বছরের শিশু শিল্পীদের আঁকা চৌত্রিশটি ছবি এ বইয়ের দু-কুল ছাপানো শৈশবের সুরটির সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে গেছে। সহজপাঠের স্রষ্টা বহুপূর্বে যে কথা বলে গেছেন — " সহজকথা লিখতে আমায় কহ যে / সহজকথা যায় না লেখা সহজে। " আমাদের এই নতুন সহজপাঠের ক্ষেত্রেও কথাটি সর্বতোভাবে প্রযোজ্য।
__________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া
______________________________________________
১/ যথাযথ সম্পাদকীয়। দুর্দান্ত কবিতা। করোনা কালের পুরুলিয়া বইটি যেমন অনবদ্য তেমনি চমৎকার পাঠ প্রতিক্রিয়া।
খুব সুন্দর হয়েছে সংখ্যাটি।
----------কবি সুজন পণ্ডা
২/ অসাধারণ সম্পাদকীয়। নৈতিকতার নাগপাশে বেঁধে একেবারে চাবুক।
অবাক করে দিলে তো, আমার কবিতা!!!
খুউব খুশি।
পুজোর আবহে অপূর্ব অরন্ধন।
---------কবি ডরোথী দাশ বিশ্বাস
৩/ সম্পাদকীয়তে বরাবরের মতো সত্য প্রশ্ন উঠে এসেছে। ভাববার বিষয়।
গ্রামীণ জীবনের ছবিগুলো উজ্জ্বল, নান্দনিক।
লেখা গুলোতে নতুন ভাবনায় ঋদ্ধ করেছে।
তোমাকে ভালোবাসা দাদা। অরন্ধন বেঁচে থাকুক।
-----------কবি শ্যামাপদ মাহাত (বাঁশি)
৪/ অনেক অনেক অজানা ছবি ও ছবি ওয়ালার ব্যাপারে জানতে পেরে খুব ভালো লাগছে..
-----------দেবমাল্য মাহাত
______________________________________________
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছবি : বাপি কর্মকার
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
নির্মলদার অনুরোধে লিখে ফেলা আরবদেশের দূর্গাপুজো নিয়ে আমার অকিঞ্চিতকর লেখাটাকে একটা সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হতে দেখে একটু হলেও কুন্ঠা লাগল। বরাবরের মত খুব সুন্দর কিছু কবিতা পড়ার সুযোগ পেলাম, ন্যায়-অন্যায়, আইনী-বেআইনী ইত্যাদি বেশ কিছু গম্ভীর বিষয় নিয়ে লেখা বিবেক সেনের গল্পটি ভাবাবে...ভাল থাকবেন সবাই।
উত্তরমুছুন