চতুর্থ বর্ষ ।। সপ্তদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ১৭ অগ্ৰহায়ণ ১৪৩০ ।। ৪ ডিসেম্বর ২০২৩
যখন সম্ভাবনা থাকে মাছের, কতজন জল ঘোলা করে। চারদিকের শ্যাওলা, নলখাগড়ার দলকে ওলট পালট করে এদিক থেকে সেদিকে। ভোর হতেই খবর যায় পাড়ায় পাড়ায়। ধুন্ধুমার কাণ্ড। জনে জনারণ্য পুকুর।
কিছুদিন এভাবেই চলে। কাদা ছিটিয়ে, ঘোলা জল ছিটিয়ে মাছ ধরার প্রয়াস। এর তার গায়ে কাদা লাগতে লাগতে পাতলা হয়ে এলে মাছ, ভেতর ভেতর পরিকল্পনা শুরু হয় নতুন মাছ ছাড়ার। ভালো জাতের মাছ। ভালো লভ্যাংশ দিতে পারবে এমন জাতের। তখন ডাক দেওয়া হয়। কে বেশি উচ্চবাচ্য করতে পারে, সেই আশায়।
পুকুরে মাছ ছাড়ার অনুমতি পেলে শুরু হয় নির্বাচন...
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
পঙ্কজ মান্না / সুজন পণ্ডা / রূপক চট্টোপাধ্যায় / সুশান্ত সেন / শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি / ময়ূখ দত্ত / ইন্দ্রনীল মজুমদার /
_____________________________________________
আমি থাকব না
পঙ্কজ মান্না
আমি থাকব না,
হয়তো তুমিই কালের আঁধার চিরে
পৃথিবীর বুকে হাজির করবে নতুন দিনের আলো
আর পরপার থেকে ঠিক জেনে যাবো
তোর মা-র চোখে আশা-দীপ চমকালো
আমি থাকবো না,
হয়তো তোমরা বোধের লাঙ্গল দিয়ে
পৃথিবীর বুক করে দেবে ফালাফালা
নবীন মাঘোৎসবে
সবাই বলবে..
এটাই এখন কালের কন্ঠ, সমসময়ের ভাষা
এরপর আর খিদের জ্বালায় মরবে না গেঁয়ো চাষা
সুজন পণ্ডার কবিতা
১.
পাখিরাও অভাব পোষে
পাখিরাও কি অভাব পোষে?
ডানার নীচে শূন্য ধরে?
দূরত্বের হিসেব কষে?
আমার মতো,
পাখিরাও কি অভাব পোষে?
বাসার থেকে অনেক দূরে,
যখন ওরা মেঘের দেশে...
কিংবা যখন কাঠ কুটো বা খাবার খোঁজে..
পাখিরাও তো সংসারী হয়...
তবে কি ওরাও অভাব পোষে?
ভীষন ঝড়ে ঝুপসি ভিজে,
ঘাড়ের পালক খুব ফুলিয়ে...
ওই যে পাখি দেয়াল ঘেঁষে,
ভয় পেয়ে ওই একপাশে...
হোক সে ঈগল হোক সে চড়ুই...
সব বাবারাই অভাব পোষে।
২.
তৃষ্ণা
কখনো প্রচণ্ড তৃষ্ণা পায়
বুক ফেটে যেতে চাইলে আমি
সবটুকু আবেগ দমন করি।
মুঠোফোন জানে আমার জলের ক্ষুধা নয়
গলা শুকিয়ে এলে
আরো আরো কথা বলার সাধ হয়
আমি তৃষ্ণার্ত হলে
উত্তরপুরুষের ছোঁয়া খুঁজি।
আমার কথা লিখতে লিখতে ভাবি
শিশুর যন্ত্রণা বোধ ঠিক কতটা গভীর?
বায়বীয় কষ্ট...
ঘর ভরে দেয়
আকাশ ভরে দেয়।
সেই বিষণ্ণ বাতাস ছুঁয়ে দেখার ক্ষমতা নেই,
অনেক অনেক রাত্রি দমবন্ধ হয়ে আসে।
ঘুমায় সন্তান... বহুদূরে।
তার কষ্ট কি এভাবেই চেপে ধরে?
জাগিয়ে রাখে রাত ভর?
গুচ্ছ কবিতা
রূপক চট্টোপাধ্যায়
১.
সেরম হিসেব জানলে
বিগত তিনটে শতাব্দী তোমায় ফেরত দিয়ে দিতাম।
আমার তো কোনো শতাব্দী লাগে না বেঁচে থাকার।
আঙুল গুনে দেখেছি
চাতালে শুয়ে থাকা একটি মাত্র জীবন
ভোর হলে দুঃখ কাঁধে নিয়ে
বেরিয়ে পড়ে। পরিক্রমণে। ট্রেনে ট্রেনে
গান বিক্রি করে। চাগিয়ে ওঠা খিদের ওপর
পা দিয়ে উঁচিয়ে ধরতে চায় জীবদ্দশা!
এরপর ভুল ভাঙলে আর টসে অংশ নেয় না।
খেলা ছেড়ে চলে যায় নিঝুম জলাশয়ের পাশে
যেখানে তার আদিম ছায়া স্নান করে
ভাত রাঁধে। হতভাগা মনে মনে আবার
ভালোবেসে ফেলে পরের দিনের
খেলাটাকেই!
২.
একপিঠে বসন্ত এলো
অন্য পিঠে চণ্ডালিনী মুদ্রায় দাঁড়িয়ে বর্ষাকাল!
কার জন্য অরণ্য আঁকবো?
কার গলায় গেঁথে দেবো অর্ধপাচ্য পৃথিবীর হাড়!
মুদ্রাস্ফীতির চাতালে বসে
মনোহর গোয়ালার বৌ ঘুঁটে দেয়। গোল বৃত্ত!
বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আমরা
কতবার টসে জিততে চেয়েছি,
বর্ষা বসন্ত কেউ আমাদের খেলায় প্রতিপক্ষ নয়।
তবুও জিতে যাওয়া খুব দরকার ছিলো।
ফুঁ দিয়ে দিয়ে জীবন গুলো নিভিয়ে দিচ্ছে যারা
তাদের থাবার নীচে বসেও
জিতে যাওয়াটা খুব দরকার ছিলো!
৩.
আবহাওয়া সঙ্গীত বাজছে,
কস্টিউমস নেই বলে
মঞ্চস্থ হতে পারছে না
দ্রৌপদীরে বস্ত্রহরন পালা!
কেউ কারো পাঠ মনে রাখেনি
সবাই হাতপা ছুঁড়ে
মুন্ডু হিলিয়ে, আত্মপরিচয় জানান দিচ্ছে।
যে যার মতো হ্রেষা ধ্বনি তুলে
ছুটছে মঞ্চের বৃত্তাকার পথে।
অলক্ষ্যে বেজে যাচ্ছে একঘেঁয়ে আবহাওয়া সঙ্গীত!
৪.
সবাই ফিরে গেছে একে একে,
দুটি মানুষ এখনো চাঁদ উঠবে বলে
বসে আছে চাতালে! মৃদু ফুল গুলি জ্বলে দূরে!
দাঁতে ইচ্ছে মতো রাত কাটছে ঝিঁঝি!
মানুষ দুটি ডানা ভাঙা শরীরে পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। ঠান্ডা আগুন। নীল হয়ে আসছে দুটি শরীর।
তার আলো চারপাশে ছিটকে পড়ছে
পাথুরে চাঁদ আর উঠলো না বিকল রাতের ঘাড়ে!
৫.
খুব অস্থির লাগছে।
একটা স্থিতধী জলচৌকি দাও। বসি গিয়ে!
ব্রজবুলি না জেনে
মান ভঞ্জনের শ্যাম আর ঘরে ফিরে আসেনি,
যে যার মতো শোকের পোষাক পরে
মিছিলে হাঁটে। বাসের গায়ে গন্তব্য লেখা নেই।
তবুও উঠে পড়া। ভাতের গায়ে প্রেম নেই
তবুও গিলে ফেলা গোগ্রাস! যৌনতায় পিঠে
আদর নেই তবু্ও প্রত্ন নিদর্শনের ঝাঁকুনি!
খুব অস্থির লাগছে এই হেঁটে যাওয়া
ও প্রান্তে একটা সরাইখানা রাখো, চন্দনের বনে
অঢেল মদ আর রুটি রাখো
টলমল শরীরে আছাড় খেয়ে পড়ার মতো
অবলোহিত আদিম নেফারতিতি রাখো
বেদনার চাতাল করে!
৬.
সহজ হোক
তীক্ষ্ণ নদীতীরে চিতার নিভু নিভু শোক।
থমকে থাকা শ্লোকের চরণে
হেঁটে যাক পদকর্তা স্বয়ং। নেচে উঠুক হাঁটু জলে
নদীর নিয়তি ঢলঢলে
অকূল পাথারে!
এই শোক প্রস্তাব ভুলে আকন্দের ফুলে
জ্বেলে দাও চলে যাওয়া পথের দুই পাশ।
ভালেবাসা যত্নকরে শ্বেত পাথরে
তুলে রাখো আজন্ম মানুষটাকে দোষ দেওয়ার
ছলনা সকল!
সুশান্ত সেনের কবিতা
১.
কোথায়
কোথায় যে যাচ্ছি কে জানে
একটু একটু করে
সভ্যতার বৃদ্ধি , জ্ঞান বৃদ্ধি
তার সাথে দুরন্ত গতি
অর্জিত শেষ দুই শতাব্দীতে
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের !
এ এক দুরন্ত লাফ
এই লাফের ধাক্কা সামলে উঠে
কি দিয়ে যাচ্ছি আমরা
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কে !
সেই ভেবে যেই একটু লেখার জন্য
কলম থুড়ি আঙ্গুল ছোঁয়াচ্ছি মুঠোফোনে
ওমনি বেড়াল টা বলে উঠল -- মিয়াও।
চার দিকে তাকিয়ে
কিছুই আর দেখতে পাই না,
চোখে একটু ছানি পড়েছে
মনে হয়।
২.
নদী
নদীতে অনেক জল সেই জলে তোমাকেই দেখি
তুমি সূর্যমুখী ফুল হলে বিকেলের নরম আলোয়
দাঁড়িয়ে আছ ,
আমার যৌবন চলে গেছে।
এখন গ্রীবার ভঙ্গি দেখে বড় তৃষা জাগে
সূর্যমুখী ফুল তাই হলুদ রঙের শুধু হয়।
নদী জলে ভেসে চলে যায়।
সাঁতার কাটার জোর নেই।
আমার যৌবন চলে গেছে।
সকালে প্রভাত আলো দ্যুতি ফেলে
তোমার ঠোঁটে'ই
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী হেসে ওঠে
প্রাতভ্রমণ গুলি সর্বস্বান্ত হয়,
আমার যৌবন চলে গেছে।
৩.
খোসা
পেঁয়াজের খোসা গুলি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে
ভেতরে কি আছে দেখার চেষ্টায়
বাক বিতন্ডায় রত হই।
অনেক কথাবার্তা তর্কবিতর্কের পর
যখন সবুজ সন্ধ্যা আসবো আসবো করছে
ঠিক সেই সময়ে পাড়ার ক্লাব ঘরে
কে যেন একটা বোমা টসকে দিল
আর তখন থেকেই বিস্তর ছোটাছুটি
হাসপাতাল পুলিশ এই সব
অনাসৃষ্টি কান্ড শুরু হলো।
নানা রকম সংঘাতের ভেতর
আবার চারপাশে ধ্বস নামার কথাও
শোনা যাচ্ছে।
পেঁয়াজের খোসা গুলো ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে
দেখার কি আর দরকার আছে !
টিনভার
শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি
কিরীটির কাঁধে টিনভার
করলার চারায় দিতেই হবে
একবেলা জল।
শৈশব আলোয় হাসে শিশু চারা
হাট বাজার গেলে
সিঁদরি থেকে নতুন বউয়ের জন্য
আসবে চপ ভাবরা
বউয়ের উদরে হাসে নতুন শিশু
লালন করে রাখতেই হবে
ভালোবাসার বীজ।
ডাইরীর_ছেঁড়া_পাতা - ৩
"শালিকপাখি"
ময়ূখ দত্ত
ছোটবেলায় বাড়ির উঠোনে, কার্নিশে, গাছে, রাস্তায় শালিক পাখি দেখলে একটা অদ্ভুত অনুভূতি আসত!! জোড়া চোখ খুঁজতে থাকত কতগুলো... এক শালিক দেখলে নাকি দুঃখ-কষ্ট ঘিরে থাকবে জীবনে, ভাগ্য খারাপ হবে ইত্যাদি, তাই নিঃসঙ্গ কোনো শালিক পাখি দেখতে পেলেই চারদিকে খুঁজতে থাকতাম কমপক্ষে আর একটা যেন দেখতে পাই... জোড়া শালিক নাকি আনন্দ দেয়!! সেটা কি যে কোনো সময়ে যে কারুর ক্ষেত্রেই নয়? মানুষও কি একা বাঁচতে পারে? মানুষের সাথে অন্য জন্তুদের একটা বড় পার্থক্য- আমরা নাকি 'সামাজিক জীব'!! আমরা সমাজে একসাথে, সবার সাথে মিলেমিশে থাকব, এভাবেই নাকি আমাদের ডিজাইন করা হয়েছে... তাই হয়তো এক শালিক আমাদের কাছে 'অশুভ'...
আমরা প্রায় সময়ই জোড়া জিনিসকে শুভ মানি আর বিজোড় জিনিসকে অশুভ মনে করি। তাই বাড়ির দরজায় পুজোর আগে বা কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আগে জোড়া কলা গাছ পুঁতি। ঘরে কোনো পাখির মূর্তি রাখলে সেটা জোড়াতে রাখার চেষ্টা করি। আমার এক বন্ধু এতটাই বিশ্বাস করত এই 'জোড়া শালিক' এর ব্যাপারটা, যে শেষমেষ বাড়িতে একজোড়া শালিক পাখি পুষতে আরম্ভ করেছিল!!... জোড়া শালিকের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হলে নাকি সোনায় সোহাগা...সারা দিন ভালবাসাময় হয়ে ওঠে.... এখন ভালবাসার দিন আমাদের আলাদা করে উদযাপন করতে হয় সবাইকে সাড়ম্বরে জানিয়ে, প্রিয়জনকে উপহার দিলে সেটার ব্র্যান্ডভ্যালু পরিমাপ করে সেই ভালবাসার মূল্য কতটা, তাই, আজকের দিনে যখন ভালবাসাও প্রায় পন্যে রূপান্তরিত হয়ে গেছে, দুই শালিকও তাই দুটো কালো-হলুদে মেশানো দুটো পাখিমাত্র...বাচ্চারা দুটো শালিক দেখলে আর কপালে হাত ছোঁয়ায় না....
শালিক কেন? সহজে দেখা যায় বলে? শালিক পাখিকে 'সামাজিক পাখি' ই বা বলা হয় কেন? একসাথে থাকে বা একসাথে ঝগড়া করে বলে? শালিক পাখি আবার বিভিন্ন স্বরে ডাকতে পারে, গলার স্বর বিভিন্ন সময়ে আলাদা করতে পারে!! বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের মতোই!! চড়াই বা কাক নয় কেন? ওদেরও তো বাড়ির আনাচে কানাচে দেখা যায়... শালিক পাখি আবার গানও গায়, নাকি সেই কারণেই কর্কষ স্বরে ডাকতে থাকা কাক বা কিচির মিচির করতে থাকা চড়াইয়ের থেকে শালিকের প্রতি আমাদের নজরটা বেশি?
তিন শালিক দেখলে নাকি চিঠি পাওয়া যেত.... চিঠি পাওয়ার বা তার সাথে অনেক ব্যাক্তিগত খবরাখবর আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়ে যে সামাজিকতা, মনুষ্যত্বের যে প্রবহমান ধারা বয়ে চলে, তিন শালিক তাকেই বয়ে নিয়ে আসে আমাদের জীবনে!! কিন্তু, আজকে আমরা কি কেউ চিঠি পাই বা পাওয়ার প্রত্যাশা করি?? ব্যাংক আর ক্রেডিট কার্ডে কোম্পানির নীরস এনভেলপ ছাড়া সবই তো ই-মেল বা মেসেজ বা ফোনে সারা হয়ে যায়... পোস্টবক্স থেকে ইনল্যান্ড লেটার বা মুখ বন্ধ করা খাম খোলার মধ্যে যে ব্যাকুলতা থাকত, বা পাড়ায় পোস্টম্যানের সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ শোনার মধ্যে যে আকুলতা থাকত তার সিকিমাত্র কি ইমেল খুলে পড়ার মধ্যে থাকে বা কম্পিউটার স্ক্রীনে ভেসে ওঠা "new e-mail arrived" এই মেসেজের মধ্যে থাকে? আমাদের চারপাশে ক্রমবর্ধমান অনুভূতিহীনতা, ক্রমনিম্ন ধারায় বয়ে চলা মনুষ্যত্বের মাঝে তিন শালিকও তাই হয়তো মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, কেউ তাদের নজর করে না...তিন জন হয়েও তাদের মধ্যে কোনো কথা নেই আজকাল...
চার শালিক দেখলে নাকি বন্ধু জোটে.... আজকের এই ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় বন্ধু ব্যাপারটাই অবলুপ্ত হতে বসেছে, না, একটু ভুল বললাম, অবলুপ্ত হচ্ছে না, বন্ধু কথাটার মানে পাল্টাচ্ছে খুব দ্রুত!! এখন সবাই সবার ফেসবুক ফ্রেন্ড, সবাই সবাইকে অনুসরণ (follow) করে, সবার সবকিছু নখদর্পনে, কিন্তু কোনো দরকারে কাউকে পাশে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার!! সবাই সবার ছবিতে "লাইক" দেয়, "খুব ভাল লাগছে.." বলি, আর তারপরেই একান্তে সেই ব্যাক্তি সম্পর্কে কটুক্তি করি, অন্যের ভাল কিছু দেখলে ঈর্ষায় বুক জ্বলে যায়... এসবের মাঝে কখনো কখনো একজনকে খুঁজে বেড়াই, যার সাথে মনের গহীন কোনে জমে জমে বাষ্পীভূত হতে থাকা কষ্টগুলো বা অবলা কথাগুলো শেয়ার করে মনটা একটু হাল্কা করা যায়!! "3 AM friend" কথাটা তার আক্ষরিক মানে বয়ে নিয়ে আসে, যার সন্ধানে আমরা এখন সারা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি, যাকে বিনা দ্বিধায় রাতবিরোতে জাগিয়ে তোলা যাবে যে কোনো দরকারে... খুঁজে কি পাই সেই একজনকে? চারটে শালিক একসাথে দেখলেও?
সংস্কার-কুসংস্কারের গন্ডি পেরিয়ে, সংকীর্ণতার সীমা ছাড়িয়ে, তথাকথিত গ্রাম্য কূপমন্ডুকতার বেড়া পেরিয়ে আমাদের আধুনিক বিজ্ঞানমনন যখন চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শালিকদের অস্বীকার করে জীবনকে নিয়ে এগিয়ে যায়, তাকে হাজার কুর্ণিশ সবসময়ে। শুধু একটাই কথা বারেবারে ধাক্কা দেয়... মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেই কবেই লিখে গেছেন "বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ"!! বুড়ো হয়ে গেলেও শালিক পাখি নাকি ঘাড়ের চকচকে রোঁয়া দেখিয়ে তার যৌবনকাল ধরে রাখতে চায় বা লোককে তার আপাত জৌলুশ দেখিয়ে নিজেকে খুশি দেখাতে চায়...আমরাও সম্ভবত আমাদের চারপাশের কৃত্তিমতার ছটায় ঝলসে যাওয়া জৌলুশের রোঁয়া দেখিয়ে এক ক্রমশ অথর্ব হতে থাকা সামাজিক ব্যাবস্থাকে শালিক পাখির মতোই ঢেকে রাখতে চাইছি...সঞ্জীবনী জড়িবুটি কোথায় - আমারা কি খুঁজছি?
পুরুলিয়াবাস ছিন্নস্মৃতি : মানব চক্রবর্তী
(প্রকাশক –ঋতাক্ষর )
বিশ্ববন্দিত ইরাণী চিত্রপরিচালক আব্বাস কিয়েরোস্তামি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন , “গল্প বলে কিছু হয় না। আমি সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়ি। যখন বুঝি আমার যা পাবার পেয়ে গেছি তখনই বেরিয়ে আসি। নিজে নিজেই কি কি ফিরে আসছে তা দেখার জন্যে অপেক্ষা করি”। স্মৃতি কি তাই নয় ? কত কালের ছবি সব ফিরে আসে অবান্তরভাবে–হাফউইট তেরো বছরের মেয়ে, ক্যাসেটের গান, লজঝরে ট্রেকার, কাঁসাই নদীতে সূর্য, লাল লাল মোটা চালের ভাত আর চাঁদের পিঠের মতো ডিম। পাখির খসে পড়া পালকের মতো সেগুলো দুলে দুলে নামতে থাকে হাওয়ায়। তার একপিঠ শাদা অন্যপিঠ কালো। “বুকের মধ্যে পাথর আছে পাথর খন্ডগুলি / তাকে নাড়ায় কেবল নাড়ায় পুরনো অঙ্গুলী”।
এই হলো স্মৃতি। মানবের, পুরুলিয়ার। পুরুলিয়া শহর, আহাড়রা গ্রাম, তার একাধিকারী ব্যাঙ্কের শাখা, তার সামান্য নল (লোন) প্রত্যাশী গরীব গুর্বো মানুষ। মাত্রই সাড়ে তিন বছরের মহানগরবাসীর সেই আপাত নির্বাসন। তবু তাই নির্মান করে স্মৃতি–এক প্রসন্ন কৌতুক আর ভালোবাসায় ভর করে। সেখানেই যেন জীবন পড়ে আছে। কয়েক বছরমাত্র সামনে চলে আসে। এই স্বল্পকালীন দেখাই পাল্টে দেয় অনেককিছু। দেখা গেল মানুষ হাসছে, কাঁদছেও বুঝি। সে কি আমার মতো না একটু অন্যরকম ? আমি কি তাকে ফিরিয়ে এনে পাশে বসাতে পারি .বলতে পারি কেমন আছো আজকাল ? এ যেন ঝাঁপ দিয়ে ঠান্ডা পুকুরের জলে নেমে পড়া। সেখানে গেঁড়ি-গুগলি ধরা যায়, মৃণাল অধরা। হয়তো অবান্তর, হয়তো পারম্পর্যহীন। একদম শেষ পাতায় এলো প্রথম দিন-পাচক ভীম, পকুড়ি, ক্যান্টিনের রাঁধুনি লখীরাম মাহাত। যখন যেমন উঠে আসছে–কখনো বন্যার কাদা আর কখনো শরতের দুর্বাঘাস। ব্যঙ্কে/ব্লকে বদলির সূত্রে যাঁরা অন্য জীবন জেনেছেন তাঁরা জানেন মানুষ কীভাবে ধরা দেয়। তার কি বাঁধা গৎ থাকে ? মানব লিখেছেন “বেশির ভাগটাই লিখে উঠতে পারিনি, ভালবাসার ধনকে নিয়ে কতটুকুই বা লেখা যায়”। তাই তো এই ভালবাসাই কথা বলে।
ট্রেকারের সামনে কোথা থেকে লাফিয়ে পড়ছে বড়সড়ো ময়ুর। মানব বলেছেন আত্মঘাতী হয়েছিল দুঃখিনী গৃহবধুর মতো। আগুনে পুড়ে যায় কিরণের মতো মেয়েরাও। মনসা সংক্রান্তিতে হংসহিসিতে প্যান্ট ভিজিয়ে দেয় দেবীকে উৎসর্গ করা হাঁস। বন্যা দুর্গতদের জন্য নির্বিকারে পাকা ব্যাঙ্ক-বিল্ডিং খুলে দেয় ছোট কর্মচারী মনভুল। বন্যায় ছাগল মরে যাবার পরে শাদা বাংলায় বীমার ক্ষতিপূরণের দরখাস্তে স্মার্ট পঞ্চায়েত প্রধান লিখে দেন the fact is turu ! সবে ধন নীলমনি কথক/আধিকারিকের টেবিলে দুজোড়া ছাগলের কাটা কান। সেখানে যে বীমা কোম্পানির বোতাম ট্যাগ করা আছে। ড ড মাহাত ডকুমেন্টে হয়ে যায় ৬৬ মাহাত। কুয়োর লনপ্রার্থী ফণী রাজোয়ার বলে , “ম্যান্জারবাবু মাইনসের জীবনে কুঁয়া আর বিয়া তো একবারই হয় নাকি ?" ভাষার ওই চন্দ্রবিন্দু মাধুর্য আর ঝোঁক মানব ভুলতে পারেননি। কুড়ি বছর পরে ফোন বেজে ওঠে ,” আহাড়রা লে বলছি, লখিরাম বটে। লখিরাম মহালি”। একান্ত অনির্ভরযোগ্য বাসের নাম আর্মান, রোজ পুরুলিয়া শহর থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে আহাড়রা ব্রাঞ্চে যাবার নির্ধারিত বাহন। অন্য বাসের নাম ,’কে জি এন’ ;মানে কোনও গ্যারান্টি নেই। বাবার সাথে পুরুলিয়ায় ছুটি কাটাতে আসা সাউথ পয়েন্টে পড়া ছেলে বাগদি বাউরির সঙ্গে খেলে বেড়ায়। সে দোকানদারকে লাট্টু ফেরৎ দিতে গিয়ে বলে, “আজই লাট্টুটা আপনার দোকান লে কিনলি, ইয়ার মইদ্যেই জোলুইটা খুলে গেল”। বাবা তখন ভাবছেন ছোটবেলার ভুলে যাওয়া খেলা–দাড়িয়া বান্দা, হা ডু ডু, পিট্টু, ডাংগুলি। কোন্ শিশু যে কখন জেগে ওঠে কে জানে ! কিরণকে হয়তো আমরা সবাই একবার না একবার পেয়েছি। তারা হারিয়েই যায়। হঠাৎ সকালের কাগজে আসে, ‘শ্বশুরবাড়িতে আগুনে পুড়ে মৃত্যু’। বুকটা ধক করে ওঠে আমার নিজের। গায়ত্রী কোথায়? সে কি আমার বাড়ির সরস্বতী পুজো মনে রেখেছে ? মনে রেখেছে ফ্রকের ওপর শাড়ি পরা ? ও কেমন আছে ? ও বেঁচে আছে তো ? ভাত আটকে যায় গলায়, মানবের মতোই। সেখানেই কি শেষ হলে ভালো হতো ? যা আসে আসুক, তাকে সাজাব তো আমি। সেখানে যে আমিই ঈশ্বর-আলো দিতে পারি, কেড়েও নিতে পারি। এটা যে বই, ফেসবুকের ক্রমশ নয়। শেষপাতায় খটকা লাগে। “খুচরো খাবারদাবার, নতুন ভাড়াবাসা নিয়ে আর একটা পোষ্ট না হয় লিখব”। এটি এক সময়ে ফেসবুকেই জনপ্রিয় হয়েছিল যে।
এই নিয়েই ‘গ ল্ ফ’, পুরুলিয়ার ‘গ ল্ ফ’, কিরণ দাঁড়িয়ে আছে কুণ্ঠিত হয়ে স্কুলের নতুন ড্রেস পড়ে। বোতামহীন পিঠখোলা ফ্রকপরা অপুষ্ট এক কিশোরীর কিৎকিৎ খেলা চলতেই থাকে। এই সব খেলা আবার দেখতে পারেন না চৌধুরীবাবুরা। কোন্ খেলার যে কি নিয়ম!
----------ইন্দ্রনীল মজুমদার
______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া
______________________________________________
১/ পত্রিকাটি বহু পরিশ্রম করে করেছো।
এটি তোমার একটি অসাধারণ কাজ হয়ে চলেছে
----------কবি ও প্রাবন্ধিক তপন পাত্র
২/ আশীষ দার ankoner সত্যিই কোনও তুলনা নেই. . আজ থেকে বছর কুড়ি আগে আমিও ওনার কাছে কিছু মাস শেখার সৌভাগ্যলাভ করেছি ..
-----------গল্পকার তনুশ্রী চন্দ্র
৩/ খুব সুন্দর সব কবিতা ও ছবি।
-----------কবি পার্বতী রায়
৪/ চিত্রশিল্পী আশীষ নন্দীর অসাধারণ জীবনগাথা ও শিল্পকর্মের সাথে পরিচিত হলাম। খুব ভালো লাগলো।
------------কবি ডরোথী দাশ বিশ্বাস
৫/এখনো পড়ে দেখি নি, এক ঝলকে মনে হচ্ছে যেন প্রতি সংখ্যাতেই পত্রিকার মানের উত্তরন ঘটছে!! পরে বস্তারির মতামত জানাব এই সংখ্যার..
আমি আমার মতামত জানাই চলতি সংখ্যাতেই, সেগুলো কি আলাদা করে জানালে ভাল হয়? তাহলে কি "আগের সংখ্যার মতামত" হিসেবে এক যায়গাতে থাকবে?
-----------কবি ময়ূখ দত্ত
৬/ খুব ভালো লাগলো সংখ্যাটি।
বাংলার দুই প্রান্তের উৎসব কেমন একটি সুতোয় গাঁথা রইলো। কবিতা গুলি ভালো, গদ্য চমৎকার। ছবিগুলি অসাধারণ।
------------কবি সুজন পণ্ডা
______________________________________________
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : সুনীল দাসের ঘোড়া, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com











পড়ে খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন