গদ্য, তপন পাত্র
"মহালয়া" কী ও কেন ...
তপন পাত্র
_________________________________
কথা হচ্ছিল দু'চার জন গৃহবধুর সাথে । প্রসঙ্গ : "মহালয়া" । তাঁরা তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রী । মহালয়ার ভোরে প্রায় জোর করেই তাঁদের জাগিয়ে দেওয়া হতো । স্কুল মাঠের বকুলতলায় ঢুলু ঢুলু চোখে বসে পড়তেন তাঁরা । ছোট্ট আয়তাকৃতির একটা বাক্স থেকে ভেসে আসতো কী সব গান আর খুব গম্ভীর গলায় যত্তোসব মন্ত্র !
একসময় সকাল হয়ে যেত । তাঁরা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করতেন , ''তুই আকাশের দিকে তাকিয়ে মহালয়া দেখতে পেয়েছিস ? " উত্তর আসতো --"না" ।
আর তুই ?
প্রতিউত্তর --"না" ।
দীর্ঘ কয়েকটা বছর তাঁদের ধারণা ছিল মহালয়া মানে , ভোর বেলায় আকাশে হয়তো বিশেষ কিছু দেখতে পাওয়া যায় । তাঁদের দুর্ভাগ্য তাঁরা দেখতে পাননি । কড়া মেজাজের দিদিমণিদের এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করারও সাহস হয়নি ।
পরে ধীরে ধীরে বড়ো হবার সাথে সাথে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো তাঁদেরও ধারণা বদলালো । তাঁরাও ভাবলেন , মহালয়া মানে বাণীকুমার সম্পাদিত গীতি আলেখ্য "মহিষাসুরমর্দিনী" । এক ঝাঁক সংগীত তারকার ভুবনমাতানো গান এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ ।
সত্যি কথা বলতে কি , আপামর বাঙালির কাছে আজও মহালয়া মানে ওই আলেখ্য । মহালয়া মানে পুরানো রেডিও , ভাঙাচোরা রেডিও সারিয়ে সেই বিশেষ ক্ষণটির জন্য দিন গোনা , প্রহর গোনা ।
সময় বদলের সাথে সাথে দূরদর্শন মহালয়ার ভোরে কতো অনুষ্ঠানই না করলো , কতো নাচ , কতো আঙ্গিক , কতো প্রেক্ষাপট , রূপসজ্জা , দৃশ্য সজ্জা , লোকনৃত্যের আমদানি । কিন্তু একটু বয়স্ক বাঙালি "মহালয়া" বলতে ওই বিশেষ আলেখ্যটি নিয়ে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে যায় । আরো অনেকদিন হয়ে যাবে ।
কিন্তু এ তো অন্য কথা ।
আসল কথা হল "মহালয়া" টা কী এবং কেন ?
আমরা অনেকেই বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে । যদিও অনেক কথাই প্রচলিত আছে "মহালয়া"কে অবলম্বন করে ।
তিথিগত দিক থেকে "মহালয়া" হল পিতৃপক্ষ । "মহালয়া" বলতে যে দিনটিকে বুঝি , সেটি এই পক্ষের পঞ্চদশতম দিন । পিতৃপক্ষ বা মহালয়া পক্ষের ১৫ টি তিথি । এগুলি হল প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা ।
এরপরই দেবীপক্ষের সূচনা । মহালয়া পক্ষের শেষ দিনটি আমাদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে হিন্দুধর্ম বিশ্বাস করে এই শুভক্ষণে মা দুর্গা দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে অনুমতি নিয়ে কৈলাস থেকে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন ।
মহালয়ার সর্বাপেক্ষা মাধুর্যমন্ডিত মুহূর্তটি হ'ল এই বিশেষ সন্ধিক্ষণ -- 'পিতৃপক্ষের সমাপ্তি ও মাতৃ পক্ষের সূচনা' , এটি এক পক্ষ কাল ব্যাপী পিতৃতর্পণের শেষ লগ্ন ।
সকলেই অবগত আছেন , চিরন্তন ও আসল দুর্গাপূজা টি হ'ল বাসন্তী পূজা , যা অনুষ্ঠিত হয় বসন্তকালে । মহাকাব্য "রামায়ণ" অনুসারে সীতাদেবী কে উদ্ধারের জন্য শ্রী রামচন্দ্র কে অকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করতে হয়। সময়ের সাথে সাথে দেবীর অকালবোধন এই শারদীয়া দুর্গাপূজাই সর্বজনপ্রিয় হয়ে ওঠে ।
ধর্ম মতে কোন মঙ্গল কর্ম করতে গেলে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয় । তর্পণ হ'ল তিল- তুলসী- জল, ফলমূল দানের মধ্য দিয়ে তৃপ্ত করা । ভগবান রামচন্দ্র সীতালক্ষ্মীকে উদ্ধারের আগে মহালয়ার দিন এমন কাজই করেছিলেন ।
এখন প্রশ্ন হলো , এই মুহূর্তটির নাম "মহালয়া" হ'ল কীভাবে ?
সংস্কৃত "মহ" শব্দটির অর্থ "পিতৃগণ" আর "আলয়" শব্দের অর্থ "আগমনকাল" । মহ+আলয়=মহালয় । তার সাথে স্ত্রীলিঙ্গে "আ" যোগ করে "মহালয়া"।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর "বাঙ্গালা ভাষার অভিধান" এ বলেছেন : "শ্রাদ্ধকালে যে সময় পিতৃলোকেরা শ্রাদ্ধ ভোজনের জন্য আনন্দ সহকারে এসে থাকেন , সেই মুহূর্তটির নাম মহালয়া " ।
শারদীয়া পূজার অব্যবহিত পূর্বে আরম্ভ করে অমাবস্যা তিথিতে এই আগমন শেষ হয়। পিতৃ বিসর্জন মন্ত্র আছে, " যমলোকং পরিত্যাজ্য আগতা যে মহালয়ে" ।
হিন্দু পুরাণ অনুসারে মর্ত্যলোক এবং স্বর্গলোকের মাঝখানে পিতৃলোক নামে একটি স্থান আছে। মৃত্যুর পর মৃতের আত্মা পিতৃলোকে অধিষ্ঠান করেন । সেখানে যমরাজ সর্বময় কর্তা । যমরাজের অধীনে সেখানে তিন পুরুষের আত্মা বাস করেন । শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পূর্ববর্তী তিন পুরুষের তর্পণ করা হয় । পরবর্তী এক পুরুষের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের এক আত্মা স্বর্গলোক গমন করেন । অর্থাৎ পিতৃলোকে সর্বদা পিতা , পিতামহ এবং প্রপিতামহ বিরাজ করেন। তর্পণে এই তিন পুরুষের আত্মাকেই অঞ্জলি দেওয়া হয় ।
কথিত আছে , রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি এই ভব সংসারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বনে গমন করেছিলেন । গভীর অরণ্যে তাঁরা দু'জন ধ্যানমগ্ন হবার চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু ফেলে আসা জীবনের সুখ-দুঃখ এবং ঐশ্বর্যের চিন্তা ভুলতে পারছিলেন না । তাই তাঁরা মেধা ঋষির আশ্রমে যান , সেখানে শ্রীশ্রীচণ্ডী বিষয়ে আলোচনা চলছিল । সুরথ ও বৈশ্য সমাধি ঋষিকে তাঁদের সমস্যার কথা জানালেন । তখন ঋষি বললেন ,এই ভব সংসারের মোহ-বন্ধন এবং মুক্তি ---সমস্ত কিছুই মাতৃ আরাধনার মধ্যে নিবিষ্ট রয়েছে । তাঁরা পরম মাতৃদেবীকে লাভ করার জন্য মাতৃপক্ষের প্রারম্ভ কালে নদী সমীপে তর্পণ করেছিলেন এবং মায়ের দর্শন লাভও করেছিলেন । এই স্থলে আমাদের ভারতীয় সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে , মহালয়ার পুণ্য তিথিতে অশুভের বিনাশ এবং সৌভ্রাতৃত্বের ভাব বজায় রাখার জন্য বর্তমান যুগেও পিতৃ মহালয়া উপলক্ষে পিতৃতর্পণের মধ্য দিয়ে শুভ ভগবতী মা দুর্গার আরাধনা শুরু হয় । এই তিথিতে সমস্ত জ্ঞানী-গুণীজন নিজের পূর্ব তিন পুরুষ , এবং যে কোন আত্মীয় , বন্ধুবান্ধব ---সকলেরই পূর্বপুরুষের পারোলৌকিক আত্মার শান্তি কামনায় এই তর্পণ করে থাকেন ।
পুরাণ মতে , কর্ণ যখন মারা যান , তখন তাঁর আত্মা স্বর্গে গেলে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে খাদ্য রূপে স্বর্ণ ও রত্ন দান করেন । কর্ণের আত্মা বিস্ময়ের সঙ্গে ইন্দ্রের এই আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন , জীবদ্দশায় কর্ণ কখনো পূর্বপুরুষকে কোন খাদ্য বা জল তর্পণ করেননি , যা দান করেছিলেন তা শুধু সোনা । তাই কর্ণকে ১৫ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে এসে এই মহালয়ার তিথিতে পিতৃতর্পণ করতে হয় , এই হল মহালয়ার গুরুত্ব ।
এই তর্পনের প্রভাবে বিশ্বতর্পণ , রামতর্পণ , লক্ষণতর্পণ ক'রে হিন্দুগণ সমস্ত আত্মীয়বর্গের তর্পণ করেন । শুরু হয়ে যায় মাতৃপূজা । কারণ জগজ্জননী দেবী দুর্গা বলেছেন ---
"সর্ব্ববাধাবিনির্ম্মুক্তো ধনধান্যসুতাণ্বিতঃ ।
মনুষ্যো মৎপ্রসাদেন ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ ।।"
--অর্থাৎ আমার কৃপায় মানুষ সকল বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত হয় এবং ধন , ধান্য ও সন্তানাদি লাভ করে ।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন