দ্বিতীয় বর্ষ ।। ত্রয়োদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ২৪ আশ্বিন ১৪২৮ ।। ১১ অক্টোবর ২০২১
কৃষিপ্রধান দেশ ভারতবর্ষের কৃষকের ভবিতব্য আত্মহত্যা অথবা ঝাঁ চকচকে গাড়ির চাকার নিচে জীবন দেওয়া বোঝালে বুঝতে হবে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামো তার সুনির্দিষ্ট গতিপথেই চলছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এর পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই ( বিশেষ করে রাজনৈতিক দিক থেকে)। কারণ ভোট ব্যাঙ্কের একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে কৃষিজীবী মানুষের অবস্থান। আর এদেরকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করে তোলার অর্থই হলো নিজেদের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে তোলা। তাই যেমন করেই হোক দেশের ভবিষ্যৎ, কৃষকদের দাবিয়ে রাখার একটা অপচেষ্টা সমস্ত সময় জুড়ে দেখা গিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেখা যাবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কেন্দ্র বা রাজ্যে যে রাজনৈতিক দলেরই অবস্থান থাক না কেন, এর কোনো হেলদোল চোখে পড়বে না। চোখে পড়বে না খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা পরিবর্তন করার সামান্যতম চেষ্টা।
বর্তমান সময়ে আবার বিভিন্ন ভাবে এইসব মানুষদের পর-নির্ভরশীল করে তোলার একটা অপচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একদিকে কর্মসংস্থানের বদলে দেওয়া হচ্ছে চাল-ডাল, টাকা। আর অন্যদিকে তার পরিবর্তে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নিত্য নৈমিত্তিক জিনিসপত্রের দাম। যার ফলে মাথায় হাত পড়ছে সাধারণ মানুষের।
ঘর বানানোর টাকা দেওয়ার পরিবর্তে ঘর বানানোর টাকা কিভাবে রোজগার করতে পারবে সেই কথা ভাবার মতো নেতৃত্বের অভাবের কারণে আজ আমাদের দেশের অবস্থা মাঝ দরিয়ায় হাবুডুবু খাওয়া নৌকোর মতো। কখন ডুবে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, এ দেশে ঐ যে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী! কেউ তো হাল ধরবেন। সেই ভরসাতেই ঈশ্বর ঈশ্বর আল্লা আল্লা করে চিৎকার করছি টলমল নৌকোর উপর।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
এই সংস্করণে যাঁরা লিখছেন
_______________________________________________
নির্মল হালদার / দুর্গা দত্ত / বিপুল চক্রবর্তী / গৌতম চৌধুরী / দেবাশিস সাহা / সৌম্য দাশগুপ্ত / সৌরভ লায়েক / সুজন পণ্ডা / অয়ন জোয়ারদার / শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি / উৎপল দাস / তপন পাত্র / মধুপর্ণা / দীপংকর রায়
_______________________________________________
পানকৌড়ির ডুব
নির্মল হালদার
কী চাইতে পারি আর?
বট গাছের ঝুরি ধরে দোল খায় ছোটরা
বটফলও দুলছে
গাছের মাথায় রোদ
বট পাতার চিকন
কী চাইতে পারি আর?
শিকড়ের চেয়ে থাকা
উঁচু-নিচু মাটি
পিঁপড়ের বাসা
পোকাদের ওঠানামা
কী চাইতে পারি আর?
বট গাছের ডালে ডালে কাঠবিড়ালি
বটের ছায়ায় একটা লোক
মলিন ধুলো
রাস্তা চলে যায়
কী চাইতে পারি আর?
বটের পিছনে দীঘি
পাতা ভাসে একটি দুটি
ঢেউ ওঠে ছোট ছোট
জলের ভিতরে জল
আমার মুঠিতে ধরবে না।
ভূতচতুর্দশী : ??
দুর্গা দত্ত
তোমার অস্তিত্ব এই শেষ চিহ্ন নাভিকুণ্ড
তুলে নিয়েছি আগুনের থেকে...
বুকের ভেতরে রেখে
সন্তর্পণে নিয়ে যাচ্ছি নদী তীরে
গাঁয়ের শ্মশানে...
তোমাকে ভাসাবো চেনা ঘরবাড়ি
ভিটেমাটি ছুঁয়ে।
পুকুরের ঘাটের পাথর, আর তলহীন
পদ্মবনে ডুবে ,
তুলসীতলার পাশে ঝুমকো লতার বন ঘেঁষে --
এই আমার গ্রামনদী
পাথরে পাথরে ঘেরা যেন কোনো সাসানডিরি প্রত্নপ্রস্তরের ধ্বনিমালা ।
এই সেই অনন্ত প্রবাহ, যেন
পূর্বপুরুষের দিকে বয়ে চলা কমণ্ডলুস্রোত --
কী সহজে করপুটে তুলে নিয়ে চলে যায়
তোমার অস্তিত্ব এই শেষ চিহ্ন নাভিকুণ্ড :-
উত্তরকালের অস্থিলিপি
লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি আমার অক্ষরমালা
তোমাকেই খুঁজে খুঁজে
ঘূর্ণাবর্তে ডোবে আর ওঠে --
সব ধ্বনি সব লিপিমালা ভাসিয়ে দিয়েছি এই জলে।
আর কোনো মুখ নেই বুকের ওপরে--
আর কোনো ছায়াচিহ্ন হাতে পড়ে নেই।
চরাচর জুড়ে শুধু দিনরাত ঘুরে ঘুরে যায়
ঘূর্ণিপাক --
জল আর শুকনো হাওয়ার ...
অন্য ব্রত
বিপুল চক্রবর্তী
"শকুনি যাবে ডালকে / শিয়াল যাবে খালকে"
—জিতাষ্টমীর ব্রত
ডাল নেই, গাছপালা কেটেকুটে সাফ
শকুনি উধাও সে তো কবে
খাল নেই, সেখানে এখন 'মল', 'হাব'
শেয়াল কোথায় যায় তবে
উঠোন হারায় যদি, বেল কলাগাছ
কোথায় বসাবে, চাই মাটি
জীবনদেবতা নেই, আনাচ-কানাচ
চিতাভস্মে সাজে পরিপাটি
ফেরাও সমস্ত, বন্ধু, ঘুম ভেঙে ওঠো
তুমি নিজে আজ ডালেখালে
জন্মের উঠোন জুড়ে নাও অন্য ব্রত
ফেরে যদি, যা-কিছু হারালে
গৌতম চৌধুরীর কবিতা
দুটি টুকরো
১.
তালাবন্ধ বাড়িটির গা বাহিয়া বট-অশথের শিকড়। চারিভিতে বুনো লতার ঝোপ। তালা মোচড় দিলেই ভাঙে। ভিতরে চাপ চাপ আঁধার। জমাট-বাঁধা বদ হাওয়া ছাড়া আর কোনও রহস্য নাই। যেকোনও ভৌতিক কাহিনির পৃষ্ঠায় পরবর্তী সকল বিবরণ। মায় এক ডাকাবুকোর চক্ষু-ঠিকরানো হাড়হিম দেহ। অনেক অনেক অনেক জানাশোনার ফলে এই উদাসীনতা।
মিথ্যা নানারকম। কিছু ফেনায় ফেনায় খচিত। কিছু টের না-পাওয়া। ক্ষোভ শমিত হইল। কৌতূহল নিবৃত্ত হইল। হাতের কুঠারটি মাথার নিচে রাখিয়া ঘুমাইয়া পড়িতে কোনও খেদ নাই। একটি সাপ ফণা তুলিয়া মুখমণ্ডল হইতে রৌদ্র আড়াল করিতেছে। যেন স্থিতাবস্থার জব্বর প্রতিমা। না কি স্বপ্ন, যেকোনও মুহূর্তে যাহা কিছু ঘটিয়া যাইতে পারে, তেমনই একটি বুক-ঢিপঢিপ সম্ভাবনা!
২.
কীট-পতঙ্গেরা কি নিজেদের বুদ্ধু বানায়? বানাইয়া মজা পায়? মজা পাইয়া হো হো হাসে? পোকারা হাসিতে পারে না, ইহা এক আজগুবি চিন্তা। কী আর করার! এমন সব আজগুবির উপরেই তো দাঁড়াইয়া আছে বড় বড় ইমারত। কোনও ভূমিকম্পেই তাহারা নাকি টাল খাইবে না। দুনিয়ার শেষ দিন ইস্তক তাহারা এইভাবে জায়গা জুড়িয়া থাকিয়া যাইবে, ভাবিতেও কেমন লাগে।
নদীগুলির মিঠা পানি কোনও না কোনও ভাবে শেষতক গিয়া পড়িয়াছে নোনাজলে। সেখানে বিরাট বিরাট ঢেউ কেবলই নৌকা নাচায় আকাশপাতাল। মোহানার কাছেই বন্দর। কে কাহাকে কোথায় কিনে আর কোথায় বেচে, কে জানে!
সম্রাট
দেবাশিস সাহা
বালিশে-চাদরে যে-ঘোড়াটা দৌড়োয়
তাকে স্তব্ধ করার মতো বাতাস ডানা মেলবে
হয়তো একটু পরে
ব্যাকরণ থাক আজ, আমরা বরং ---
সাদা পাতা জুড়ে আগুন লিখি
কেননা অনিচ্ছাকৃত যতগুলো ময়ূর এঁকেছি
ঠোঁটের গোধূলি বরাবর
থির থির কাঁপছে পৃষ্ঠা জুড়ে
বুঝিনি ---
শব্দ আর নৈঃশব্দের মাঝখানে যে তুমুল ঝড়
নিঃস্ব আঙুলে মুছে দিতে পারে
সে-ই তো সম্রাট
ভদ্রাসন
সৌম্য দাশগুপ্ত
লিপিকা সর্পিল, তাকে প্রতিবাদে ছোবল মেরেছে
ভাঙেনি ধানের শীষ, রূহ্ ভরে গেছে অভিমানে
এই কলাক্ষেত্রে আল ধরে যদি ত্রিসীমানা হাঁটো
চর্যার অরন্ধনে ম্লান হয়ে যায় দশ দিক
ভাবি তাকে সংবেদনে করপুটে বীমার সেবায়
সুরক্ষিত রাখি, তবু সেকথা সে শোনেনা শোনেনা
ভান যদি করো, তার বেদনাও তদূর্ধ বলয়ে
চক্রাকার ঘোরে, এই মূর্খতাকে যত্নে বেঁধে রাখা
প্রত্যয়ের দগ্ধতায়, বিকিরণে, মমতায়, ক্লেশে
অসর্পিল সরলতা শিখে নেয় এই ভদ্রাসন ॥
হে সান্নিধ্য
সৌরভ লায়েক
হে সান্নিধ্য -
সেই সন্ধে গুলির কথা নির্ভুল ভাবে ভুলে গেলে
অবিশ্বাসের আতর মেখে নির্দয় হতে পারো
কৌপিন বিহীন সাধকের প্রতি
তোমার মর্ম বেদনা লুকিয়ে দিও গুপ্ত মন্ত্র বলে
কাল যে মরে গিয়েছিল একবার
আজ সে আবার বেঁচে ফিরিয়াছে
নতুন বৃষ্টির পর নবস্নানে নবজলে মাছেরা যেমন
ছুটে যায় , উঠে যায় আধারের ধার হতে
ভালোবাসা তেমনি কুহক , নিজেকেই চেনো
এসো পাশাপাশি বসি , অনেক হয়েছে মান-অভিমান
শেষবারের মতো মরিবার আগে অন্তত একবার
অন্তত একবার বেঁচে যাই বাঁচার মতন ।
নীরবতা আর মেঘ
সুজন পণ্ডা
নীরবতায় আর মেঘে
মেঘে আর নীরবতায় আছি জেগে।
পাহাড়ের জোয়ারে ভাটায়
নেশাতুর পা... দীর্ঘ কুয়াশার গাছ
ততোধিক দীর্ঘ প্রশান্তি।
সমস্ত ইচ্ছে গুলি জড়ো হয়ে
মিশে আছে ঢালের অনিশ্চিতে...
দূর থেকে ভেসে আসে
বাঁশি... কোনো অভিযাত্রী..
ওই পথ
পাহাড়
নিখোঁজ কোনো উপত্যকা কোথাও..
আসলে কি শিরা উপশিরা?
আসলে কি রক্ত প্রবহমান?
দু চোখে তবুও তো পাইনের বন
আর রোডোডেনড্রন...
বাকি সবটুকু জুড়ে
নীরবতা আর মেঘ
মেঘ আর নীরবতা...
এই আশ্রয়।
শরতে তোর বাড়ি যাবো
অয়ন জোয়ারদার
কুয়াশাতে অংশীদারি, ভাগ বসাচ্ছে টুকরো মেঘ
এ যেন এক পাগল পাখি, ইচ্ছে হলেই ঝরে পড়ে
অর্ধেক ভেজা শাড়ির আলে লোভ, লালসা,জলের বাড়ি-
তুমি এবার তৈরি হও, এ শরতে বাড়ি যাবো,
হ্যাঁ রে বাবা, তোর বাড়ি! কাশের ঘর,ডাকের সাজ, কপালতোলা টানা সিঁদুর..
বৃষ্টি যদি হয়ও জানিস, ভিজবে না এ ধূসর পালক,
লোভে লোভে পৌঁছে যাবো, ঠিক যেখানে বিলয়া তোর;
পৌঁছে গিয়েই উপড়ে ফেলবো আমার যত শেকড় বাকড়।
তারপরেতেই পরের বছর আগমনীতে মন লাগাবো, যেভাবে রোজ মহালয়া সকালবেলা ভীষণ কাঁদায়।
দশভূজা
শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি
মঙ্গলা সহিস মুখোশ পরে নাচে
দুর্গার নাচ ছৌ নাচ।
মঙ্গলার দুহাত আসরে দশ হাত হয়।
মঙ্গলা কুমারী হয়েও জগতের মা।
তার সমরকে ভয় নেই,
সম্পর্ককেই ভয়।
ভয় বিবেককেও।
আসর থেকে বেরোলে মঙ্গলার চোখ থেকে বৃষ্টি ঝরে।
মঙ্গলা পুজো নিতে নারাজ।
সে ভাবে-
আজও কত মঙ্গলার অমঙ্গল
জগৎময় অসুরের উন্মুক্ত দরাজ।
প্রভু আরাধনা
উৎপল দাস
বাকি আছে ইন্দ্রজাল আরাধনা
প্রভু হে স্থির করো অন্তর আমার
না কাটে সুখে দিন, না ঘুমায় রাতে
বাহিরে ভিতরে আঁধার
ঝাঁপ দেব শূন্যের উপর
তোমার মনোরঞ্জনে যদি সুখ আসে
প্রভু হে, কার দুঃখে কেবা হাসে
লাচ কাঁঠি - কাঁঠি লাচ
তপন পাত্র
পুরুলিয়া তথা ভারতবর্ষের পুরাতন মানচিত্র অনুসারে সমগ্র মানভূম এলাকায় যে সকল মফস্বল গ্রামে শারদোৎসব উপলক্ষে দুর্গা পূজা হয় না , দুর্গা পূজার আনন্দ উপভোগ করার জন্য গ্রামবাসীদের পায়ে হেঁটে অন্তত পাঁচ-দশ কিলোমিটার পথ পার হয়ে যেতে হতো , একসময় সেই সমস্ত গ্রামের দুর্গাপূজার আনন্দধারা বজায় রাখতো একটি মনকে শান্ত ও উদ্বেলিত করার মতো লোকনৃত্য; যার নাম "কাঠি নাচ" , স্থানীয় উচ্চারণে "কাঁঠি লাচ বা "লাচ কাঁঠি"। মহাসপ্তমী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত, কোথাও কোথাও আবার দুর্গা ষষ্ঠী থেকে দশমী , আবার কোন এলাকায় দুর্গাপূজার সময় থেকে কালীপূজা পর্যন্ত গ্রামের কুলিতে কুলিতে , ঘরে ঘরে এই নৃত্য পরিবেশন করে বেড়াতো কাঁঠি লাচের দল । মূলত মহাসপ্তমী থেকে মহানবমী পর্যন্ত এই নাচের দল যখন এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গিয়ে প্রবেশ করতো, তখন দলের সামনে সামনে হাঁটতে হাঁটতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ফুলানো বেলুন হাতে ঘুরতো , আর মাঝে মাঝে দু একটা লঙ্কা ফটকা ফুটিয়ে সানন্দে ডিগবাজি দিত । যেই পরবর্তী ঘরে গিয়ে নাচ শুরু হতো , সেই মাত্র তারা সেই নাচের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো , নির্মল আনন্দে ভাসতো , তারাও অঙ্গ সঞ্চালনের অনুকরণ করতো । সাধারণত বিজয়া দশমীর দিন দূরবর্তী কোনো সমৃদ্ধ গ্রাম অথবা আধা শহরের পূজা মন্ডপে গিয়ে তারা নৃত্য প্রদর্শন করত । সেদিন গ্রামে আর কাঁঠ নাচ হচ্ছে না দেখে বালক-বালিকাদের মন বেদনায় টনটন করে উঠতো । এখন সেই নয়নাভিরাম , মনজুড়ানো কাঁঠি লাচ অবলুপ্তির পথে । কোথাও কোথাও দু-একটি নাচের দল মাঝে মাঝে নজরে আসে ।
সাধারণত শ্রাবণ সংক্রান্তির মনসা পূজার পর প্রতি সন্ধ্যায় গ্রামের আখড়ায় এই নৃত্যশিল্পীরা অনুশীলন বা চর্চা শুরু করে । নাচের শিল্পীরা ছোট ছোট বাগাল ছেলে বা রাখাল বালক । বালকেরাই কুমারী মেয়ে সেজে নৃত্য পরিবেশন করে । যারা মাদল, হারমোনিয়াম করতাল ঝুনঝুনি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র এবং মূল গায়েন ও দোহারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় , তারা তুলনামূলকভাবে বয়স্ক মানুষ । একেবারে শুরুর দিকে গোপ সমাজের একটি শাখা যারা জাতিতে বাগাল বলে পরিচিত , তারাই এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করত তাদেরই এই বিশেষ লোক নৃত্যটির সূচনাকার বলে মনে হয় । পরবর্তীকালে বাউরী , বাগদি ও ভূমিজ সম্প্রদায়ের মানুষ এই নৃত্য অংশগ্রহণ করে , তারা কাঁঠি নাচের দল গড়ে তোলে গ্রামে গ্রামান্তরে নৃত্যপরিবেশন করে।
মানভূম তথা পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় যতো ধরনের লোকনৃত্য রয়েছে , সেগুলির চাইতে কাঁঠি লাচের চরিত্র আলাদা । দুর্গাপূজার সময় গ্রামে গ্রামে আধা শহরে আরো দু'এক ধরনের নাচ --যেমন পাতা নাচ, ভুয়াং নাচ পরিবেশিত হয় । সেই নাচগুলির সাথে এই নাচের কোন সুগভীর সাদৃশ্য নেই । একসময় গোপবালকরাই এই নাচে অংশ নিত , পরে রাখাল বালকেরা । বালকেরা বালিকা সাজতে গিয়ে পায়ে ঘুঙ্গুর হাতের চুড়ি মাথায় বিয়ের কনের মতো বা রাধিকার মতো সোলার তৈরি চূড়া বা মুকুট পরিধান করে । কপাল থেকে কপোল পর্যন্ত
কনের সাজের মতো চন্দন এর নকশা করা টিপ । শাড়ি পরে ঘাগরার মতো করে । পায়ের গোড়ালি থেকে একটু উঁচু পর্যন্ত ঝুলতে থাকে ঘাগরা । কোমরের উপর অংশে সাদা সেন্ডো গেঞ্জির উপরে ব্লাউজ । ব্লাউজের ভিতরে প্যাড যুক্ত ব্রা । গলায় কাঁঠির মালা । মাথায় হাঁটু পর্যন্ত লম্বা পরচুলা । নিজেরাই পাট পচিয়ে তৈরি করা সনকে হরিতকী জলে মিশিয়ে কালো রংয়ের পরচুলা তৈরী করে নেয় খরচ বাঁচানোর জন্য । সিঁথিতে থাকে লটকন আর নথ , টায়রারও ব্যবহার করে তারা । সর্বাঙ্গে একটা গোপি-গোপি , সখী-সখী, রাধা-রাধা ভাব । নাচের সময় হাতে থাকে বিচিত্র বর্ণের রুমাল ।
লোকনৃত্যের আলোচকগণ লোকনৃত্যের অন্যতম অঙ্গ "কাঠি নাচ" প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে 'ডান্ডিয়া নৃত্য" বলতে যে "কাঠি নাচ"কে বোঝায় তার সঙ্গে "কাঁঠি লাচ"কে গুলিয়ে মিলিয়ে দিয়েছেন । তাঁরা উল্লেখ করেছেন, বীরভূমের রায়বেশে নাচ থেকে এই নাচের সৃষ্টি । ব্রতচারীর পুরোধা শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্ত মহাশয় ব্রতচারীর বিভিন্ন লোকনৃত্যের সঙ্গে কাঠি নাচকে গ্রহণ করেছেন । কিন্তু সেই "কাঠি নাচ" কোনমতেই "লাচ কাঁঠি" বা "কাঁঠি লাচ"নয় । কোন কোন পন্ডিত আবার এক পা এগিয়ে বলেছেন , কাঠি নাচের শিল্পীরা কখনো কাঠি নিয়ে নৃত্য করেন আবার কোথাও কোথাও নাকি দেখা যায় তারা কাঠির বদলে রুমাল নিয়ে নৃত্য করেন । আমার মনে হয়, এই দুটো নাচ যাঁরা খুব কাছের থেকে না দেখেছেন , নাচের পোশাক না লক্ষ্য করেছেন, নাচের ভঙ্গিমা, মুদ্রা এবং গান ও শিল্পীদের নৃত্যকালীন মুখাবয়ব গভীরভাবে না পরিদর্শন করেছেন , তাঁরাই এই দু'টি নৃত্যকে একই বলে এক মহা সত্যের অপলাপ করেছেন ।
এই প্রসঙ্গে কয়েকটি দিক উল্লেখ করা যাক । কাঠি নাচ এসেছে রায় বা জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর অনুসরণ করে । কাঠি নাচ বীর রসাত্মক , বিপ্লবাত্মক । গুরুসদয় দত্ত তাই সুস্থ সুন্দর সুডৌল শরীর গঠনের তাগিদে কাঠি নাচকে ব্রতচারীতে গ্রহণ করেছেন । কাঠি নাচ ধুতি ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরে, তার সঙ্গে লাল কাপড় পোশাক হিসেবে ব্যবহার করে , মাথায় পাগড়ি ও কোমর বেঁধে পুরুষেরা পরিবেশন করে । কখনো কখনো বা মেয়েরাও এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করে । কাঠি নাচের গান বীর রসাত্মক হলেও কোথাও কোথাও আবার ঝুমুর গানও ব্যবহার করা হয় । এই নাচের বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ঢোল , ধমসা , ফুলেট , কর্নেট বাঁশির ব্যবহার হয়, ড্রামও ব্যবহৃত হয় । নর্তকদের উৎসাহ বর্ধনের জন্য মাঝে মাঝে "হো- হো- হো- হো- হো-" ধ্বনি তোলা হয় । এই নৃত্যে রায় অর্থাৎ রাজা বা শ্রেষ্ঠ-শ্রেষ্ঠ, সেরা-সেরা, বীর-বীর ভাব থাকে ।
অপরদিকে "কাঁঠি লাচ" বীর রসাত্মক নয়, মৃদু এবং বিরহাচ্ছন্ন । এই নাচের স্রষ্টারা বাগাল সম্প্রদায়, যাঁরা নিজেদেরকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উত্তরসূরী বলে মনে করেন । যারা নৃত্যে অংশগ্রহণ করে সেই বালকেরা পেশাগত দিক থেকে সাধারণত বাগাল বা বাগালের সমগোত্রীয় । এই নৃত্যে বালকেরা বালিকা সেজে নাচে , তারা নিজেদের রাধা বা গোপবালিকা বলে মনে করে । হাতে তাদের লাঠি থাকে না , গলায় থাকে নানারকম কাঁঠির মালা । মাথায় পাগড়ি থাকে না , থাকে রাধিকার মাথার চূড়ার মতো চূড়া । বৈষ্ণব মতে ,পরস্পর তুলসীর মালা বদল করে বিবাহ সম্পাদিত হয় । এর নাম কণ্ঠী বদল । তুলসী কাঠের মালা বদল করে বিবাহটি হয় বলে এইরূপ নাম । কাঁঠি লাচের সময় কিশোরী বা যুবতীর সাজে সজ্জিত ছেলেরা নাচতে নাচতে অনেক সময় কণ্ঠী বদল করে । নিত্য ভঙ্গিমার সাথে রাসনৃত্যের একটি কোথায় যেন মিল রয়েছে এবং শিল্পীদের মধ্যে "রায় রায়" ভাব থাকে না , থাকে "রাই রাই" ভাব । কাঁঠি লাচে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে থাকে সুর মাদল, করতাল, হারমোনিয়াম ও আড় বাঁশি ।
তাহলে কোনোদিক থেকেই এই দু'টি নাচ একই নাচ বলে মনে হয় না । শুধুমাত্র নামের উচ্চারণগত সাদৃশ্যের কারণেই না দেখে শুনে বুঝে গবেষক সাজার তাগিদে পৃথক পৃথক ভূগোল সীমার দুটো নাচ এক বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতাটি বড়ই ভয়ংকর ।
একথা স্বীকার করতেই হবে যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন নৃত্যের কোন ধারাবাহিক সুস্পষ্ট ইতিহাস আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি , যদিও ভারতবর্ষের সংস্কৃতির এক মহা মূল্যবান ও প্রাণবন্ত শাখা বিভিন্ন নৃত্য কলা । আবার এই নৃত্য প্রসঙ্গে যখন লোক নৃত্যের কথা আসে তখন সেই আলোচনা যে আরও দুর্বল দেশে অবস্থান করছে এ কথাটিও স্পষ্ট । লোক নৃত্য এবং সাধারণ নৃত্য উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের মধ্যে যথেষ্ট কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব রয়েছে । এর প্রধান কারণ যাঁরা নৃত্য চর্চা করেন তাঁরা নিজেরা নৃত্যের ইতিহাস রচনার জন্য খুব একটা কলম ধরেননি । আর লোক নৃত্যের ক্ষেত্রে তো তা একেবারেই নয় । যারা পন্ডিত সাজার জন্য এই বিষয়কে অবলম্বন করে কলম ধরেন , তাঁরা অন্যের লেখা পড়ে অথবা অন্যের মুখে কথা শুনে গল্পের গরুকে গাছে তোলেন । রাতের পর রাত জেগে, দিনের-পর-দিন শিল্পীদের পিছনে ঘুরে ঘুরে তাঁরা নৃত্য দেখেন না, বোঝার চেষ্টাও করেন না ফলে ইতিহাস বিকৃত হয়ে যায় ।
পুরুলিয়া তথা মানভূমে যতো রকমের লোকনৃত্য রয়েছে , যেমন --ছো নাচ ( অতি পণ্ডিতদের পাল্লায় পড়ে ফেসবুকের সংস্কৃতিতে যা এখন আবার "ছো" বা "ছৌ" বা "ছ" বা "ছউ" নাচ ছেড়ে হয়ে যাচ্ছে "ছাউ"নাচ ), নাটুয়া নাচ , দাঁ'ড় নাচ, রণপা নৃত্য, ঝুমুর নাচ, নাচনি নাচ-খেমটি নাচ --- সবই বেশ শ্রমসাধ্য কিন্তু কাঁঠি লাচ ততোটা শ্রমসাধ্য নয় ।
কাঁঠি লাচের আসরে মূলত কৃষ্ণলীলা বিষয়ক গানই গীত হয়ে থাকে । ঝাড়খন্ড মানভূম এলাকা দিয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পার হয়ে গিয়েছিলেন । তাই পুরুলিয়া বাঁকুড়া মেদিনীপুর উড়িষ্যার ময়ুরভঞ্জ অঞ্চলে গ্রামে গ্রামে হরিনামের আটচালা যেমন গড়ে উঠেছে , তেমনি কীর্তন এর প্রভাবও যথেষ্ট এবং রাস উৎসব ও রাস নৃত্যেরও প্রভাব রয়েছে । তার প্রভাব পড়েছে কাঁঠি লাচের আসরে । নাচের আসরে প্রথমে মহাপ্রভুর , শ্রী শ্রী জগন্নাথের, গ্রামের গরাম হরির বন্দনা করা হয় । বেশ বুঝতে পারা যায় বৈষ্ণব ভাবনার সঙ্গে লোকায়ত ভাবনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ।
কাঁঠি লাচের আসরে নৃত্যশিল্পীরা অর্ধ-বৃত্তাকারে এক দিকে মুখ করে দাঁড়ায় । বাদ্য শিল্পীরাও প্রস্তুত । মুলগায়েন প্রথমেই , সুর বেঁধে দেবার জন্য ধীরে ধীরে উচ্চারণ করেন -----
'নারে নারে নারে নারে নারে নারে নারে গো
ও তারে নারে নারে নারে নারে নারে নারে গো ...."
শুরু হয় বন্দনা -----
" পথমে বন্দনা করি গাঁয়ের গরাম হরি
তারপরে বন্দনা করি জগন্নাথের নাম গো ..." ইত্যাদি।
এরপর যে সমস্ত গান গাওয়া হয় সেখানে মূলত নিমাই সন্ন্যাস, কৃষ্ণ লীলার পদ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রামায়ণ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাহিনী আশ্রয় করে গান গাওয়া হয় । মূল গায়েনের গান শুরুর সাথে সাথেই সুরমাদলে "তুং" ওঠে । সঙ্গে সঙ্গে দোহারেরা গান ধরে । আর নৃত্যশিল্পীরা নাচতে শুরু করে পায়ের নূপুর বেজে ওঠে ঝুম্ ঝুম্ রবে ।
একথা উল্লেখ করা ভালো যে, কাঁঠি লাচের কোনোকালেই কোন নির্দিষ্ট পেশাদার দল গড়ে ওঠেনি । মূলত প্রাক্ শারদ উৎসবের কালে দলগুলি গড়ে ওঠে , রিহার্সাল করে এবং পূজার মরসুমে নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়েই সারা বছরের নাচের পাট চুকে যায় । বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক লোকসংস্কৃতির ও লোকনৃত্যের উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য অন্যান্য সময়ে এই নৃত্য দেখা যেত এবং সেই কারণে রাধা কৃষ্ণ লীলা, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন , রামায়ণের কাহিনী বাদ দিয়ে সমসাময়িক আর্থ-সমাজ-রাজনৈতিক বিষয়ও গান হয়ে দেখা দিয়েছিল । কিন্তু কালের প্রভাবে ধীরে ধীরে কাঁঠি লাচ আজ ইতিহাস হতে চলেছে । এর কারণ স্মার্টফোন, সিডি, ডিজে , ইন্টারনেট নয় ; এর মূল কারণটি অন্যত্র । কাঁঠি লাচে যে রাখাল বালকের দল অথবা তাদের বন্ধুরা অংশগ্রহণ করত সেই রাখালদের আর গ্রামেগঞ্জে , পল্লীবাংলার কোথাও দেখা যায় না । হয়তো সকলের জন্য প্রথাবদ্ধ শিক্ষার লক্ষ্যে দলছুট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কারণেই বাগালী পেশা আজ অবলুপ্ত ; অবলুপ্তির পথে কাঁঠি লাচও ।
নীরবতার পুরুষতান্ত্রিক (কদ) অর্থ।
মধুপর্ণা
“নীরবতা সম্মতির লক্ষণ"
এই বাক্যটি একটি বিষাক্ত লিঙ্গ রাজনীতি বহন করে।
কনসেন্ট বা সম্মতির সম্বন্ধে কোনো শিক্ষা যে সমাজে নেই, সেখানে নীরবতার অর্থ বোঝার মত সংবেদনশীলতা আশা করা অলীক। এই তুমুল ক্যাকোফনির ভীড়ে কে কি বলছে, আর কে কি বলতে চাইছে অথবা কে মুখস্থ কথা অভ্যাসে বলে যাচ্ছে আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। এই অদ্ভুত একটা বিকট পারস্পরিকতার মধ্যে নীরবতা বলে একটা বিষয় কর্পূরের মত উবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অথবা যারা নীরবে, নিভৃতে বাঁচতে চায় তারা পিছোতে পিছোতে ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে। অথবা অন্যদের উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে তার স্বর। এই চাপা পড়া স্বরের একটি বড় অংশ নারী। বলা ভাল বেশ বড় অংশ। নানান নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে থাকতে থাকতে ক্রমে চাপা পড়ে যায় তার কথা, তার স্বর, তার ইচ্ছা, তার অনিচ্ছা, তার অসম্মতি।
সামাজিক ভাবে নারী এবং নীরবতার সম্বন্ধ অত্যন্ত জটিল। নীরব নারী সমাজে পরিবারে বিপুল সমাদৃত। "সাত চড়ে রা নেই" সেই মেয়ে বড়ো "ভালো"। এখানে কোনো থ্রেট নেই। বিষাক্ত পৌরুষ এবং তার অসুস্থ অহং এখানে ঝুঁকির মুখে পড়বে না। বরং ডালপালা সমেত বাড়বে দিনে দিনে। নীরব শান্ত মেয়ে, বেশী কথা না বলা মেয়ে, চিৎকার না করা মেয়ে, চুপ করে মেনে নেওয়া মেয়ে, অন্যের অসভ্যতা, সীমালঙ্ঘন মুখ নীচু করে মেনে নেওয়া মেয়ে আমাদের সমাজ লালন করে। এই গুণাবলিতে খাপ খাওয়া মেয়েরা বিবাহের উপযুক্ত, পরিবারে, সমাজে সমাদৃত। নারী যেখানে "অপর", "আংশিক মানুষ", "দ্বিতীয় লিঙ্গ" হিসাবে গণ্য সেখানে পুরুষের কথার উত্তরে নীরবতা একটি লিঙ্গ রাজনীতিকে নগ্ন করে তোলে। প্রাথমিক ভাবে ধরে নেওয়া হয় নীরবতা মানে সম্মতি। অসম্মতি হিসাবে কখনো নীরবতা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় নীরব নারীটি মূলত দূর্বল। নীরবতার পিতৃতান্ত্রিক অনুবাদ হয় সম্মতি নয় দূর্বলতা।
আবার সাহিত্যে কল্পনার খাদ্য এই নীরব নারীদের নিয়ে রোমান্টিসিজমের চাষ। তার মুখে কোন কথা নেই, নিজস্ব কোন স্বর নেই। তাই পুরুষ সাহিত্যিক নিজের ইচ্ছায় তার মুখে কথা বসাতে পারে। কল্পনা খাদ্য হিসাবে গড়ে তুলতে সুবিধা হয়, নিজেদের আজন্মলালিত বিষাক্ত পৌরুষের আরকে চুবিয়ে পরিবেশন করতে পারেন। কিম্ভুতকিমাকার সেই নারী মূর্তি যার কোন মুখ নেই, কথা নেই, স্বর নেই, ইচ্ছা নেই সেই নারীর ইমেজ কি প্রচন্ড আবেগ নিয়ে মানুষজন আস্বাদন করে থাকেন। "আদর্শ নারী” রা বেশি কথা বলে না। চুপ থাকে। তাকে প্রয়োজনে, ইচ্ছায় ব্যবহার করা যায়।
নীরবতাকে ভাবা হয় দূর্বলতা। অথবা অক্ষমতা। যে নারী ইতরামির সঙ্গে সম্মুখ সমরে না নিয়ে এড়িয়ে নিজের কাজে নিমগ্ন থাকতে চায়। সেই এড়িয়ে যাবার ভাষা অনূদিত হয় ভিন্ন ভাবে। মনে করা হয় তা দূর্বলতা। প্রতিরোধের একটি ভাষা নীরবতা। অবশ্য যদি প্রতিপক্ষের নূন্যতম শিক্ষা আর চক্ষুলজ্জা থাকে তবেই। পিতৃতন্ত্র এই নীরবতার ভাষা ভয় পায়। ক্ষমতার সূক্ষ্ম এবং নগ্ন রাজনীতি চালিয়ে যেতে অসুবিধা হয় বলে তা খানিকটা স্বেচ্ছায় এড়িয়ে চলে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের যাবতীয় কাঠামো বহির্মুখীদের জন্য তৈরি। অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের জন্য এই পরিকাঠামো অনুপযুক্ত এবং ক্ষতিকারক। বেশ 'বলিয়ে কইয়ে' হলে সব জায়গায় সাফল্য পেতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু যারা অন্তর্মুখী তাদের পড়তে হয় সমস্যায়, অথবা তাদের সমস্যা অপ্রকাশিত থেকে যায়। পরিশেষে একটি কথা বলবার, নীরবতা একটি স্বতন্ত্র স্বর। স্বরহীনতা নয়।
_______________________________________________
ঔপন্যাসিক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস--
"জলশ্যাওলার বিরহকথা" - এবার চতুর্থ পর্ব
______________________________
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
যেহেতু এই দেশ, এই মাটি পথিকের কাছে একেবারে রোজকার জল-ভাতের মতো, এর সমস্ত প্রকৃতি পাঠ যেমন তার কাছে ' জল পড়ে পাতা নড়ে '- র মতন কণ্ঠস্থ, ঠিক তেমনই এর উলটো পিঠে বাস করে জয়ের পরিবার। তবু এখন কিছুটা প্রচার ব্যবস্থার দৌলতে, তথাকথিত শিল্প সংস্কৃতির আনা নেওয়ায় সেই দুঃসময়ের গল্পগুলি কিছুটা হয়তো ফিকে হয়েছে, তবু জয়ের এদেশে আসা নিয়ে যথেষ্ট উদাসীন ছিল না তার বাবা-মা বা পরিবারের লোকজন। অনেক কষ্টে জয়ের বাবা-মাকেও বুঝিয়েছিল মুনাই। এবং নিয়ে এসেছিল তাকে। বাকি স্বপ্নের গল্পগুলো পথিকই বলেছিল জয়কে নিভৃতে তার টয়োটা গাড়িতে বসে বসে।
দু’হাজার দুই বা তিনের এরকমই একটি অঘ্রাণ-কার্তিকের দুপুরে তারা সকলে মিলে বেরিয়েছিল সাগরদাঁড়ি। গাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল এদেশের টয়োটা , এরা যাকে বলে মাইক্রো। আসন সংখ্যা সর্বমোট আট। ড্রাইভারের পাশের আসনটি বাদ দিয়ে আরো দুটি আসন থাকে ভাঁজ করা। সে, তার তিন শ্যালিকা, এক শ্যালক এবং এই গতি মাসিকে নিয়ে মোটমাট তারা তিন দল। এই মিলে কয়েক হাজারে গাড়ি ভাড়া মিটমাট করে শ্বশুর বাড়ির শালা-শালিদের নিয়ে এই এত বছরের মধ্যে এই প্রথম বেড়াতে বেরিয়েছিল সে। পথের মাঝে জয় এতটাই আন্তরিক হয়ে গেল সকলের কাছে যা দেখে কিছুটা সংশয় জেগেছিল।আরও পড়ুন
সম্পাদক:উত্তম মাহাত
সহায়তা:অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছবি:সন্দীপ কুমার
যোগাযোগ:হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com










মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন