প্রথম বর্ষ ।। পঞ্চদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ১৬ ফাল্গুন ১৪২৭ ।। ১ মার্চ ২০২১
বসন্ত যে শুধুমাত্র ফুল নিয়ে আসে তাই নয়, নিয়ে আসে মন কেমন করা উদাসীনতা, এলোমেলো হাওয়ার ছুটোছুটি, ধুলো ওড়ার বাস্তবতা, অসীম শূন্যতা। মনের মধ্যে অপার আনন্দের সাথে সাথে এই চরম শূন্যতা মিশে গিয়ে এমন একটা ভাবের সৃষ্টি হয় যা ঘর ও বাহির কোনোখানেই থাকতে দেয় না আমাদের। কেউ বাহির থেকে ছুটে আসে ঘরের দিকে, কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বাহিরের দিকে। এই ঘর ও বাহিরের মাঝে একটা বৈরাগ্য ভাব তাড়া করে সব সময়।
ফুল ফোটে, নানা রঙের ফুল ফোটে নানা দিকে, নানা শাখায়। ঝরে পড়ে পরাগ, ঝরে পড়ে মধু বৃষ্টিহীন শুষ্ক মাটির উপর সাময়িক ঢাকিয়ে দেয় শুষ্কতাকে। সমস্ত হৈ হুল্লোড় এসে ধরা দেয় এক লহমায়। তারপর আবার শুষ্কতা, শুকিয়ে যাওয়া পাপড়ির চুরমুর শব্দে ভেঙ্গে যাওয়া, ভেসে যাওয়া জীবন নদীর নাব্যতার দিকে।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
_____________________________
দূরত্ব
কালীকৃষ্ণ গুহ
তুমি যখন কাছে ছিলে তখন কিছু
বলতে পারিনি।
এখন তুমি দূরে চলে গেছ।
এখন তোমাকে অনেক কথা বলছি।
কে শুনছে সেই সব কথা?
কেউ শুনছে না।
তুমি দূরে চলে গেছ।
দূরে একটা প্রদীপ জ্বলছে...
গল্প নয় সত্যি
""""""""""""'"''""""""""""""""
জীবন সংগ্রামের আর এক নাম ধনি টুডু
তপন পাত্র
বোধ করি বাংলা সাহিত্যের পাঠকমাত্রই গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাদম্বিনীকে চিনে থাকবেন। "জীবিত ও মৃত" গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কাদম্বিনীর একদিন হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। তাকে মৃত ভেবে তার সৎকারের আয়োজন করা হয় । শ্মশানে কাদম্বিনী জ্ঞান ফিরে পায় । প্রাথমিকভাবে সে নিজেও নিজেকে নিজের প্রেতাত্মা বলে মনে করে । গল্পের পরিণতিতে মাসাধিককাল পর কাদম্বিনী শ্বশুরালয়ে ফিরে আসে এবং "খোকা" সতীশকে দেখতে পেয়ে যখন কোলে নেয়, তখন সে বুঝতে পারে, সে মরেনি বেঁচে আছে । কিন্তু মৃত কাদম্বিনী খোকাকে কোলে নিয়ে বসে আছে দেখে বাড়িসুদ্ধ হুলস্থুল্ বেধে যায় ! কেউ মূর্ছা যায় ! কেউ ভয়ে পালায় ! কাদম্বিনীর ভাসুর শারদাশংকর করজোড়ে কাদম্বিনীকে অনুরোধ করেন , সংসারের মায়া কাটিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে । এবং প্রতিশ্রুতি দেন, কাদম্বিনীর যথোপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে আদ্যশ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করবেন ।
কাদম্বিনী পরিবারের সকলকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলো যে সে মারা যায়নি । কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করলো না । সকলেই ভাবলো, এ আসলে কাদম্বিনীর প্রেতাত্মার ছলনা । অবশেষে কাদম্বিনী যে জীবিত এই মহাসত্য প্রমাণ করার জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠলো, পুকুরের জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিল, "কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই" ।
-----এটি গল্প । গল্পের গরু কখনো কখনো গাছে উঠতেই পারে । কিন্তু বাস্তবের গরু তৃণভূমিতে মুখ রেখে চরে বেড়ায় , সে গাছে ওঠে না । আবার কখনো কখনো ওঠে বৈকি । সেবার ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে মেদিনীপুরের দাঁতনে একটি বাছুর ঝড়ে উড়ে গিয়ে লটকে গিয়েছিল কুল গাছের ডালে । সে এক দুর্ঘটনা , প্রাকৃতিক প্রতিকুলতা বা বিড়ম্বনা । প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা না হলেও সামাজিক প্রতিকূলতাতেও মানুষকে কখনো কখনো হাঁটতে হয় ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পথ ধরে । তখন জীবন হয়ে ওঠে জীবনসংগ্রাম ।
এই তো ক'দিন আগে "ধনি মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই" । গৌরচন্দ্রিকা অনেক হলো, এবার থাক । আসুন , আসল ঘটনাটি তে প্রবেশ করি ।
আমরা জানি, "যার ছেরাদ্দ খাইতে আইনু তারে দেখসি না ক্যান্" --একথা বলে শ্রাদ্ধ বাড়িতে একটু হাসি মশকরা করার লোকের খুব একটা অভাব নেই । কিন্তু তেমন লোক মেলা ভার, যিনি সত্যি সত্যিই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের শ্রাদ্ধ-শান্তি করবেন, আগাম স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ক'রে তার আবরণ উন্মোচন বা উদ্বোধন অনুষ্ঠান করবেন । খুব বেশি না হলেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছে পুরুলিয়ার মানবাজার থেকে আট মাইল দূরে বডডি নামের এক সাঁওতাল পল্লীতে ।
বীরাঙ্গণা এই নারীর নাম ধনি টুডু । বডডির প্রয়াত রূপাই টুডুর একমাত্র কন্যা । তার এমন একটা ব্যতিক্রম কর্মকাণ্ডের কথা শুনে ছুটে গেছি তার কাছে বারংবার । হাড় হিম করা জীবন কাহিনী শুনে কখনো চোখে জল এসেছে আবার কখনো তথাকথিত সামাজিক মানুষের নির্লজ্জতায় মস্তক অবনত হয়েছে ।
অতি অল্প বয়সেই ধনির বিয়ে হয়েছিল কুলটাঁ'ড় গ্রামের মকরা সরেনের সঙ্গে । "সেবার ভাদর মাসে কলেরায় মারা গেল মকরা । মানুষ ছিল সে, বেশ সোহাগ আদর করতো । কিন্তু মারাংবুরুর বিচার নাই ! কেন যে কেড়ে নিলেন তাকে ! নিজের বলতে রইলো দুই মেয়ে । একেবারে নাবালিকা ..." বলতে বলতেই দু'চোখ ভ'রে জল এলো । আবেগ সম্বরণ করে বললো ---" আমার তখন বয়স কম । দেওর মলিন্দ বললো , 'আমি তোকে সাঙ্গা করব' ।" শুনেই সে চিৎকার করে বলে উঠেছিল -- "ইঞদ্ আম্ বৌঞ সাঙ্গা মেয়া"। অর্থাৎ আমি তোকে সাঙ্গা ক'রব নাই। মলিন্দের হুংকার --"চেদাঃ বাম্ সাঙ্গা ঞা" ? মানে "কেন সাঙ্গা করবি নাই" ?
নিজেদের সামাজিক রীতি-প্রথার কারণেই পাড়া-প্রতিবেশীর সমর্থন পেয়ে যায় মলিন্দ । সকলে মিলে ভুলিয়ে ফুসলিয়ে, ভয় দেখিয়ে সদ্য বিধবা ধনিকে সাঙ্গাতে রাজি করায় ।
সাঙ্গা হয়ে যায় মলিন্দ- ধনির । অল্পদিনের মধ্যেই তাদের এক সন্তান আসে । এদিকে অকস্মাৎ মলিন্দ ঘরে তুললো অন্য এক সাঁওতাল যুবতি । শুরু হলো ধনির সঙ্গে দুর্ব্যবহার । অকথ্য মানসিক নির্যাতন । ধনি প্রথম স্বামীর অধিকারে অর্ধেক সম্পত্তি চেয়ে বসলো । এতে অত্যাচারের মাত্রা বাড়লো বই কমলো না । তখন ধনি ছুটলো পুরুলিয়া জজ্কোর্ট । কেস চললো টানা সাত বছর । বিচারে জয় হল ধনির । অর্ধেক সম্পত্তি পেয়ে তা বিক্রি করে বাপের বাড়িতে ফিরে এলো । সঙ্গে প্রথম স্বামীর দুই কন্যা এবং দ্বিতীয় পক্ষের এক পুত্র । পুত্র-কন্যারা বড় হ'তে থাকলো । কুমারী-কাঁসাই দিয়ে জল গড়িয়ে গেল অনেক ।
একসময় মারা গেল মলিন্দ । সমাজের বিধানদাতারা তাকে স্বামীর ঘরে নিয়ে যেতে চাইলো কিছু সামাজিক প্রথা পালনের জন্য । ধনির মন টললো না । বরং মলিন্দের ঔরসে তার গর্ভজাত পুত্রকে পাঠিয়ে আবার অর্ধেক ভাগ বুঝে নিল আইন বলেই ।
এখানেই শেষ নয় । সারা সমাজে ধনির এই দাপট দেখে সমাজের কিছু রক্ষণশীল মানুষ স্তব্ধ । বিস্মিত । চিরকালই দুর্জনদের দারুণ বুদ্ধি ! দুই স্বামী কেন মারা গেল (?) ---এই ছুতায় তারা তাকে "নুই কুড়ি গিঁদার দয় ডৌন্ গিয়া" বলে অর্থাৎ তাকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে শুরু করলো মারপিট । একেবারে পুড়িয়ে মারার উপক্রম । রাত্রির অন্ধকারে কোন প্রকারে ঝোপ জঙ্গল পার হয়ে ধনি চললো সোজা পুরুলিয়া । আবার কোর্ট । ধনিই বোধ হয় প্রথম সাঁওতাল মহিলা যে আইন আদালতের আশ্রয় নিয়ে ডাইনি অপবাদ ঘুচিয়ে সমাজের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোল । কিন্তু শুরু হল আর এক করুণ অধ্যায় । সামাজিক প্রবঞ্চণায় মানসিকভাবে অনেক দূরে সরে গেল পুত্র-কন্যারা । এতদিন সে চলছিল বীরাঙ্গনার মতো বীরদর্পে । এবার শুরু হল অন্তরের হাহাকার ! চাপা কান্নায় বুক ফেটে চৌচির । সাঙ্গাৎ-সমাজ-সংসার-পুত্র -কন্যা ----সব কিছুর প্রতি আস্থা হারিয়ে ধনি খুঁজতে লাগলো পরকালের পথ । তার বিশ্বাস নেই মরণের পর কেউ শ্রাদ্ধ-শান্তি করবে । তাই আত্মার শান্তির জন্য নিজেই নিজের শ্রাদ্ধের আয়োজন করলো । সাঁওতাল ও সাঁওতাল সমাজের বাইরের সহস্রাধিক লোকের জন্য ভুরিভোজনের ব্যবস্থা করলো । সঙ্গে সঙ্গে রাঙ্গামেটার কালিপদ টুডুর কাছে কেনা জমির উপর গড়ে তুললো অতিশয় সুদৃশ্য স্মৃতিসৌধ ।
তরতাজা তরুণীর মতো ধনি বৃদ্ধাবস্থাতেও অসামাজিক কু-প্রথা , অন্যায়, অপবাদ ---এ সব কিছুকেই বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে হেঁটে চললো বীরদর্পে । তার জীবনে সবচেয়ে ঘৃণার বিষয় ---"ডাইনি প্রথা" আর "পুত্র সম দেওরের সঙ্গে সাঙ্গা" ; এটি পুত্রের সঙ্গে বিবাহ ছাড়া কিছু নয় বলে তার জোরালো অভিমত ।
না । গল্প বা নাটকে নয়, আদিবাসী সাঁওতাল পল্লীর এই বৃদ্ধা মরণকে গ্রহণ করলো একেবারে জীবনের অপরিহার্য অঙ্গরূপে । অস্বীকার করলো ভন্ড স্বামীর পদবি, পরিচয় । তার স্মৃতিশৌধের গায়ে লেখা --- "ধনি সরেণ" নয়, "ধনি টুডু" ! পাশে স্বামীর নাম লেখায়নি, লিখিয়েছে --- " পিতা -রূপাই টুডু , বডডি "।
শুধু সাঁওতাল সমাজ নয়, সমগ্র মানবসমাজের ইতিহাসে এ এক নতুন নজির । সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে নিজের আত্মার প্রতি এক নতুন উপহার । নবতর সম্মাননা । নারীত্ব ও ব্যক্তিত্বের প্রতি এ এক আধুনিক উপঢৌকন, অসাধারণ সংবর্ধনা । পাশাপাশি সমাজ ব্যবস্থার প্রতি এ এক অদ্ভুত ঠাট্টা ! মৃত্যুর ক'দিন আগে ধনি ক্ষোভে দুঃখে জানালো --"এই আধুনিক যুগেও মানুষের মনের কোন উন্নতি হয়নি । প্রকৃত সৌন্দর্যবোধ গড়ে ওঠেনি । আমার স্মৃতিসৌধটি আমি বেঁচে থাকতেই মারা যাচ্ছে । এ , ও ঢিল ছুঁড়ে মূর্তি ও মন্দির ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে । আমার শরীরের অবস্থা এখন ওই শৌধটির মতো । আমি আর আমার স্মৃতিসৌধ দু'জনেই মরে যাবো একসাথে । এই সমাজে নারী আজও বড় অসহায় ! বাইরের সাজ পোশাক হয়তো কিছু বেড়েছে, অনেকটা আধুনিক হয়েছে , কিন্তু সেটা নিজেদের আরো অসহায় করার জন্যই " । হতাশার এক যুগ পার করেও ধনি যেন বলতে চাইলো "মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে , মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই " কবির বাণীই ধনির জীবন , সারা জীবন জুড়ে ধনি শুধু বলতে চাইলো --"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা..."
ন হন্যতে রিহার্সাল
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
বাংলা ভাষায় রিহার্সাল শব্দটির সঠিক অনুবাদ হয় না। কয়েকটা প্রতিশব্দ আছে বটে, কিন্তু তর্জমার তোয়াক্কা না করে, মূল ইংরেজি শব্দটিই আমরা সাধারণত বাংলায় ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু রিহার্সাল শব্দের আসল মানেটা, উৎপত্তিটা ঠিক কী? ইংরেজি অভিধান ঘাঁটলে কয়েকটি অদ্ভুত, দ্যোতক এবং দ্বর্থক অর্থ বেরিয়ে আসে যেগুলি আমরা বেশিরভাগই জানি না, বা জানলেও তা নিয়ে তেমন ভাবিত নই। অথচ বিষয়গুলি ভাববার মতই। একটু তলিয়ে দেখা যাক।
ইংরেজিতে rehearsal শব্দটির মূলে রয়েছে hearse শব্দটি। আর 're' মানে 'আবার'/'বারবার'। অর্থাৎ বারবার যদি hearse করা হয়, তাহলে re-hearsal হয়। কিন্তু hearse শব্দের অর্থ কি? অন্তর্জালে www.english-bangla.com অভিধান অনুযায়ী, hearse হলো, "শবযান" বা "শবাধার বহনের নিমিত্ত গাড়ি"। আনুমানিক ১৩০০ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে ফরাসী শব্দ 'rehercier' শব্দটি ইংরেজি ভাষায় 'rehearsal' রূপে নিজেকে নানাভাবে প্রকাশ করছে। সনাতন ফরাসীতে 'hercier' শব্দের অর্থ, "to drag, trail (on the ground)", be dragged along the ground (জমির বুকের ওপর দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া); rake, harrow (land) (জমি কর্ষণ); rip, tear, wound (কাটা, ছেঁড়া, ক্ষতবিক্ষত করা); repeat (পুনরাবৃত্তি করা)..." এই থেকে — 'rehearse'। অর্থাৎ জমি-কর্ষণের ও মাটিতে লাশ টেনে নিয়ে যাওয়া ও কবর খোঁড়ার সমস্ত অনুষঙ্গ নিয়ে উঠে আসছে 'রিহার্সাল'। খুব একটা রোচক উৎপত্তি নয়। একরকম বীভৎসই বলা যায়। কিন্তু আমরা প্রায়শই দেখি, মুখের ভাষার বহতা স্রোতে ভেসে যেতে যেতে, শব্দেরা উৎসচ্যুত হয়ে, নিজেদের অর্থসূত্র ও জন্মবৃত্তান্ত বিস্মৃত হয়। তাই, মুখেমুখে ফিরতে ফিরতে, বিবর্তনের স্মৃতিক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে, চতুর্দশ শতকে ইংরেজি ভাষায় rehearsal-এর অর্থ দাঁড়ায় — "to say over again, repeat what has already been said or written" (যা বলা বা লেখা হয়ে গিয়েছে, বারবার তার পুনরাবৃত্তি করা)। আর সেই থেকে, ক্রমে, ১৫৭০ সাল নাগাদ (অর্থাৎ শেক্সপীয়রের সময় থেকে), শব্দটির বর্তমান অর্থ — "practice a play, part, etc." — বেরিয়ে আসে। তার মানে, ইংরেজরা যতদিনে ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করলো, ততদিনে 'rehearsal' শব্দটির বর্তমান রূপ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। কলকাতার বাঙালিরা যখন ইংরেজি থিয়েটারের আদলে নিজেদের 'থেটার' বানালেন, বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও শব্দের সঙ্গে, এই rehearsal শব্দটিও অননুদিত 'রিহার্সাল' রূপেই ঢুকে পড়লো বাংলা শব্দভাণ্ডারে (ঠিক যেমন ঢুকে পড়েছে চেয়ার, টেবিল, কাপ, প্লেট, গেলাস...)। প্রতিশব্দ যে তৈরী হয়নি তা নয় — মহলা, মহড়া, চর্চা, অভ্যাস, অনুশীলন, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, এবং আজও হয়। কিন্তু বাংলা ভাষার তৎসম জাত্যাভিমানকে পরাস্ত করে মৌখিকভাষায় সর্বজনগ্রাহ্যতা পেয়ে গেছে 'রিহার্সাল'।
রিহার্সালের বর্তমান অর্থটি মেনে নেবার আগে, একবার যদি উৎসমুখের দিকে ফিরে তাকাই — শবযানে চড়ে, শবাধার তার শবদেহকে নিয়ে অন্ত্যেষ্টির দিকে যাত্রা করেছে। এই উৎপত্তির নিরিখে কি রিহার্সালের কোনো ভিন্নতর, দ্যোতক অর্থ বেরিয়ে আসে? কোনো এক দার্শনিক উৎসসন্ধানের প্রক্রিয়ায়? শব্দ তার জন্মবৃত্তান্ত ভুলে গেলেও, শব্দের শরীরে সেই কাহন বিধৃত থাকে, তার বংশ-বৃত্তান্ত আঁকা থাকে, বিস্মৃতির আড়ালে। আমাদের দায়, আড়াল সরিয়ে, সেই বৃত্তান্তকে পাঠ করে, শব্দটির নতুন অর্থায়ন করা।
রিহার্সাল কি তাহলে মৃত্যুপথে যাত্রার সামিল? কেমন করে? রিহার্সাল তো শিল্পের চর্চা, সৃষ্টির চর্চা! হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু আমরা সৃষ্টি করি কেন? এই অমীমাংসিত প্রশ্নের একটি আন্দাজি উত্তর হলো —নশ্বর শিল্পীরা তাঁদের অবিনশ্বর শিল্পসৃষ্টির মধ্যে অমরত্বের প্রত্যাশী। তাঁরা কায়মনোবাক্যে চান — শিল্প তাঁদের 'ন হন্যতে' করুক। কিন্তু নশ্বর আছে বলেই তো অবিনশ্বরের সম্ভাবনা দেখা দেয়। অসম্ভব না থাকলে কি সম্ভবের সম্ভাবনা থাকতো? রিহার্সাল তাই জীবনস্বরূপ। দিনানুদিনের ক্ষয়পথে মৃত্যুসন্ধানেই মতোই, নশ্বরের মধ্যে অবিনশ্বরের... ঈশ্বরের সন্ধান।
ফরাসী ভাষায় যৌনসঙ্গমের শীর্ষ-মুহূর্তটিকে ছোঁয়ার অনুভূতিকে বলা হয়, "La petite mort"..., "একটি ক্ষুদ্র মৃত্যু"। অপমৃত্যু নয়, "উপমৃত্যু"। কিন্তু একাধারে, সেই শীর্ষ-মুহূর্তটি তো ভ্রুন-সঞ্চারের, প্রাণ সৃষ্টির মুহূর্তও হতে পারে। সেই অর্থে শিল্প মানেই তো মৃত্যুর শীর্ষ-মুহূর্তে পৌঁছনোর এক রিহার্সাল, যা একাধারে আরও আরও প্রাণ পাবারও আকুতি। অনলস, নিরন্তর, দিন ও রাত্রির মতো পৌনঃপুনিক। একটি পারফর্মেন্স শুরু হয়ে যেমন অবধারিতভাবে শেষও হয়। ঠিক যেমন — সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশের আলম্বতে টলায়মান দাঁড়িয়ে, জীবন। মৃত্যুই যার সৃষ্টির একমাত্র যুক্তিযুক্ত কারণ।
এক আকাশ এক পৃথিবী
সুজন পণ্ডা
চারিদিকে কি একটা ভীষণ গোলযোগ চলছে বুঝতে পারি। প্রতিনিয়ত। কোথায় বা কি সেই গোলমাল ধরতে পারছি না, বুঝতে পারছি না। সকালে ব্রাশ হাতে কল তলায় যে অজানা আওয়াজ গুলো শুনতে পাই তারা অবিরাম সারা দিন আমার কানের কাছে বেজে চলে। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিনা কিসের গোলযোগ। সবাই শুনতে পাচ্ছে কিনা তাও পরিষ্কার নয়। না হলে এক যোগে সবাই এত উদাসীন কীভাবে?! একটা অদ্ভূত অস্থিরতা ঘিরে থাকে সব সময়েই। সর্বগ্রাসি সেই অস্থিরতা।
এখন মাঘ মাসের প্রায় শেষ, নাতিদীর্ঘ বিকেল জুড়ে মন খারাপ করা বাতাস বইতে শুরু করেছে, এই বাতাস বইবে সারাটি বসন্ত জুড়ে। তারপর এক সময় কালবৈশাখী। আমি আমার একটুকরো ছাদে দাঁড়িয়ে সেই ঝড়ের অপেক্ষা করি।
আজও সেইরকম ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই অস্থিরতা ঘিরে রেখেছিলো চারপাশের আকাশ। সন্ধে যখন নেমে এসেছে, নিচের ঘরে একটা আওয়াজ শুনলাম.. আওয়াজ টা পরিচিত, কাঁচ ভাঙ্গার আওয়াজ। হঠাত কারো অসাবধানতায় টেবিলে রাখা কাঁচের ফুলদান ভেঙে চৌচির।
নীচে নামতে আরো পরিষ্কার বোঝা গেলো। সারাদিনের, সর্বক্ষণের সেই আওয়াজ টা, সেই গোলযোগ টা ধরতে পেরেছি।
আমরা কাঁচের মতোই ভেঙে যাচ্ছি, ছড়িয়ে যাচ্ছি। এক মানুষ থেকে আরেক মানুষ দূরে সরে সরে যাচ্ছে। অযুত লক্ষ ক্রোশ দূরে। সম্পর্কগুলো পড়ছে বাস্তবের মাটিতে আর টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে অস্থির ভাবে। বাঁধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। সব সম্পর্ক। ভাই ভাই মা বাবা প্রীতি ভালোবাসা কেউ ধরছে না, কিচ্ছু ধরে রাখতে পারছে না। যুগের হাওয়ায় অথবা হুজুগের হাওয়ায়। চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে শব্দ করে। অহংকার করে। চিৎকার করে।
কিন্তু কিসের জন্য এই ছড়িয়ে যাওয়া? আমাদের চারদিকে ঘিরে থাকা বৃত্ত কখন এত ছোটো হতে শুরু করলো? কিসের ভিত্তিতে আমরা আলাদা হচ্ছি একজন আরেকজনের থেকে? কে দেখিয়ে দিচ্ছে এই আপাত প্রভেদ?
কেউ বলছে আমাদের গায়ের রং আলাদা, কেউ বলছে ধর্ম, কেউ শোনাচ্ছে ভাষার বুলি, কোথাও আঙুল তুলে কেউ দেখিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের সীমানা, কিছু না পেয়ে নিকট আত্মীয় দেখিয়ে যাচ্ছে অর্থ নৈতিক বিভেদ,
আর আমরা শুকনো পাতার মতো একদিক থেকে আরেক দিকে উড়ে উড়ে যাচ্ছি হাওয়ার সাথে। মিথ্যে অহং আর নিস্প্রয়োজনীয় দম্ভ বিষের মত ঢুকে পড়ছে সর্বত্র
১৯৭১, লেনন লিখলেন "ইমাজিন", তারও অনেক আগে ঊনবিংশ শতকের শেষে এল এল জ্যামেনহফ একটি ভাষা বানাচ্ছেন, যার নাম রাখলেন এসপারান্তো.. উঠে আসতে লাগলো এক নতুন আইডিয়া.। যে ভাবনায় মুছে গেল রাষ্ট্রের ধারণা। ওরা শেখাতে চাইলেন সমগ্র বিশ্ব একটাই দেশ, আর আমরা সকল বিশ্ববাসি একটিই পরিবার, একই ভাষা হবে সবার, একই ভাবে জীবন যাপন।
কাঁটা তারের সীমানায় যে দেশ গড়ে উঠেছে নিছকই শাসকের সুবিধার্থে, প্রকৃতি এই সীমানা তৈরি করেনি, প্রকৃতির অন্য কোনো জীব এই ধারণায় বিশ্বাসী নয়। প্রশ্ন ওঠে কতোটা বাস্তব এই ধারণা?
আসুন আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলে ইউটাহ্ প্রদেশের "পাণ্ডো" উদ্ভিদের কথা বলে শেষ করি। প্রায় ১০৮ একর জমিতে ৬০ লক্ষ কেজি ওজনের একটি উদ্ভিদ এই পাণ্ডো। খালি চোখে দেখলে যদিও বোঝার উপায় নেই যে গাছ একটিই। কিন্তু মাটির নীচে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এক ও অভিন্ন মূল ব্যবস্থা। তারা শুধু সংযুক্ত নয়, বাস্তবিক অর্থেই এক ও অদ্বিতীয়। আর কত বয়স এই উদ্ভিদটির? ১০ থেকে ১৪ হাজার।
এই মহাবিশ্বে কোটি কোটি নক্ষত্র আর নীহারিকার নিচে পৃথিবী এমনিতেই ভীষণ ভীষণ ছোট্ট, একে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে আরো ভাঙতে থাকলে আদপে কার কি লাভ তা বোঝা দুষ্কর, তাই আসুন আরো জুড়ে জুড়ে থাকি, হাতে ধরে ধরে থাকি। এই সীমাহীন মহাবিশ্বে হারিয়ে যাওয়ার আগে আমরা আসুন বন্ধু হই।
কৌশিক চক্রবর্তী-র কবিতা
১.
যে জন আছে মাঝখানে
যেখানে গাঢ় হলুদ থেকে উঠে আসে পায়ের ছাপ লাগা ব্যালকনি আর দাঁত চাপা নৈঃশব্দ্য আসলে
হাত পুড়িয়ে দেয় –
স্পষ্ট হয় রাতকুকুরের দূরত্ব আর অস্পষ্ট হাতগুলো অস্পষ্ট আঙুলের পাঠক্রম পড়তে পড়তে পিঁপড়ের মতন ভাসতে থাকে মৃত চামড়ায়
খুব শক্ত আর খুব বরফের মতন একজোড়া দস্তানা, যেখানে বেলুনওয়ালার মুখোশ খুলে তাকে ইউনিফর্ম পরিয়ে পাঠায় জন্মান্ধদের হাসপাতালে –
আর কাগজ সেলাই করার আছিলায় যতবার সরু সরু বৃষ্টি পড়ে শিশুপার্কের গালে
সেইখানে চোখ ধুয়ে নাও
নীলপ্রজাপতির উল্কি নিয়ে একবার চোখ সূর্যাস্ত দেখো
তারপর
বিস্ময়করভাবে প্রাণভরে মরে যাও শুধু
২.
খেলা ভাঙার খেলা
আমাদের সম্মোহিত ঘরকন্নায়
আজকাল আর নৌকো দাঁড়ায় না...
তুলোট কাগজের নীল আঁকতে আঁকতে
প্রতিদিনকার ঘুম পেরিয়ে যেতে চায়
মশলার আলপথ –
দেরাজের ডানকোণে লুকিয়ে রেখেছি কথা না বলা কুরুশ।
চাদর সরালেই
সেখান থেকে হাল্কা হাল্কা গন্ধ ওঠে
শুকনো স্মৃতিচিহ্নের।
জলের মিনার কোনো কোনো দুপুরেই কেবল –
বিবাহের জ্যামিতি দিয়ে আলো মাপে
সবুজ সেতুর আলোয় আমরা দেখতে থাকি
অনেকদিনের কুয়াশা পেরোনো দোলমঞ্চ। শুয়ে থাকা আকাশকুসুম।
তার নক্শা খুলে কবে যেন খেলা ফুরিয়েছে।
হাঁটু মুড়ে বসে আছে শুধু
অনন্ত এক শূণ্যতার হাত
পল্লব গোস্বামী-এর কবিতা
১.
ভেতরকার হাঁস
আমার ভেতরকার হাঁস ,
গোরুর বাগালটির দিকে ঝুঁকে পড়েছে |
মাঝখানে কাঁটাবন, তাঁকে কীভাবে পাঠাই !
বেনে বউ, হেঁটে যায় দরজা অবধি
বন্ধুরাও যায় আরও কয়েক কদম
মৃতদেহের মাঠে শুধু মাটি ছড়ানোর লোক
মোহনবাঁশিটি বাজলেই
দৃষ্টি পিছলে যায় |
সাবু আর শালবন ফাঁক করে রাখি
ভেতর থেকে নিলীন বর্ণের মতো ,
বেরিয়ে যায়,
দর্পণ সারথি |
২.
সুবচনী
সু - সুরেলা আভাস দিয়ে গেছে - এক সুপুরি গাছের স্বর
আমসরা রাখো , এবার
পিটুলি সংগ্রহে যাই ...
পদ্মফুল কেনো ডাকো ?
চোখের শিশির দিয়ে
শুধু নীরবতা আবাহন !
নৈঋতে পাশাপাশি একজোড়া হাঁস | খোঁড়া হাঁস , পাখি পাখি খেলা ...
ব - বহুদূর আল্পনা আঁকা পথ |
উঠোনে দুধপুকুর
প্রেয়সী এবার হাঁটো ...
চ - চতুর চাহনি
টিকালো টিউলিপ
রজনীগন্ধা তোমাদের মন |
নী - নীল নীল
প্রথম রাতের আলো |
ভেঙে যায় লাল চুড়ি , দুধের গেলাস ...
যখন আদর ঢালো , যখন নিভু নিভু শিশ্নমহল ;
আরও আরও
তাড়িয়ে মারো প্রণয়পিয়াসী |
সৌরভ লায়েকের কবিতা
১.
হৃদি ব্রহ্মকমল ফোটে
বিরহী পরবাস ফেলে মাঝপথে ফিরেছি আবার
ফেলে যাওয়া নিকোনো উঠোনে ।
অন্তরীপ খুঁজে যাওয়া নক্ষত্রের মতো
ভালবাসো এখনো ?
কথা নয় , নিরবতা লিখে যেও
লিখে যেও নিষুপ্ত যন্ত্রণার কথা
অর্থহীন এই বুকে পদ্ম ফুটলে ক্ষতি কি ?
২.
চাষি
অনুপম দিন গুলি বয়ে যায়
দুঃখ আসে , দু'দন্ড জিরোয়
ফিরে যায়
কর্মের জল খেয়ে
অনাগত সুখ আসে তারো কমে
ফসলী অঘ্রাণে
তারপর কোনো এক ঘোরতর ভাদরের দিনে
আলোর আকাশ থেকে খসে পড়ে তারা
সন্দীপ বাউরীর কবিতা
১.
অব্যক্ত
আমি তোমায় আমার হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে চাই------
কতটা জানতে চাও??
যতটা ভালোবাসলে --
আমার সব স্বপ্নগুলো তোমার হয়ে যাবে ,
আমার সব অনুভূতি গুলো মুহূর্তে তোমার মনকে ছুঁয়ে দিবে,
আর আমার প্রতিটি অশ্রুকণা তোমার চোখে ঝরে পড়বে-----
আবার আমি তোমার ঠিক ততটাই কাছে আসতে চাই ----
যতটা কাছে আসলে
আমার চোখে তোমার ছবি দেখতে পাবে ,
বুঝতে পারবে এ দুটি চোখের ভাষা---
আর ততটাই আমার হৃদয়কে তোমার হৃদয়ে মিলিয়ে দিতে চাই--------
যতটা মিশালে --
বুঝতে পারবে এই হৃদয়ে তোমার জন্য কত উন্মাদনা,
শুনতে পাবে তোমার জন্য আমার হৃদয়ের উন্মত্ত স্পন্দন--।।।
২.
ইচ্ছা
প্রিয়তমা , তোমায় নিয়ে গল্প লিখবো,
যদি আমায় ভালোবাসো।
তোমায় রূপকথার গল্প শুনিয়ে ,
দিনের ভারাক্রান্ত সময়কে হার মানাবো ,
যদি আমায় ভালোবাসো।।
আবার ---
ঐ ---যে দূরে মেঘমল্লিকা ,
যেখানে মেঘ আর রৌদ্দুর লুকোচুরি খেলতে খেলতে বিলিন হয়ে যায় ,
সেখানে তোমায় নিয়ে ভ্রমণ করবো ।
যদি আমায় ভালোবাসো।।
উজ্জ্বল গরাই-এর কবিতা
১.
নিদাঘ নির্বাসনে
কতদিন লিখিনি কিছুই ...
আঁজলা উঠোন জুড়ে শৈশবের খড়িমাটি দাগ ;
সে সব জলের পোকা জলে গেছে কবে ।
আতপের চাল ধুয়ে মা বাড়ন্ত বেলার গন্ধ নিয়ে আসে।
তোমাকে লিখিনি কতদিন
ভাবিনি শৈশবের মতো করে ।
ট্রামসিটে দুরন্ত ট্রাফিক হৃদয় চেপে ধরে !
মনে পড়ে,
তোমাকে বলে যাওয়া হল না আমার এ জীবনে,
কতমেঘ কতবার
ভেসে গেছে নিদাঘ নির্বাসনে ।
২.
পরিযায়ী
চাঁপাতলা মোড়টা পাইর্হাইঁ যেখানেল্লে
টেরেন দেখা যায় , ঠিক তার বাঁ ধারে পুঁটির ঘরটা ।
মোড়ের ঠিনে কুথাও চাঁপা গাছ ছিল কি নাই
জাইনতে চাইনাইঁখ্য কেউ ।
পুঁটি জানেছিল ।
দেখ্যেছিল চাঁপাডালে কেমন কৈরে চুপ হঁয়ে আসে পরিযায়ী বিকালের রৈদ ।
সে বছর যেদিনকে লকডাউন উইঠল্য
মোড়ে লাল সবৈজ কমলা রঙের হরেক গাড়ি ছুটত্যে লাইগল্য ফিরেল্লে ,
একদন্ডঅ ঘুইরে ভাইলবার অবসর রৈহ্ল্য নাই মানুষের ...
পুঁটি দু'হাতে কানটা চিপে চাঁপা গাছটার ফাঁকে ফাঁকে রৈদ দেইখছিল্য ।
মা তাখে ঢেরদিন বাপের কথা বলেনাই খ !
জলের ডাক
সুপ্রিয় দেওঘরিয়া
মাটি খুঁড়ে জলের সন্ধান পেয়েছি
তৃষ্ণা মেটানো দুটি ঠোঁট জানে নিদাঘ
শুকনো ডালের ছায়া মাঠের ওপর
ছায়ার শরীরে হলুদ ঘাসের রেখা
অবাঞ্ছিত বেদনার ফুটে ওঠা চিহ্নসকল
ছুঁইয়ে দাও পরশের ভার
যেমন করে মাটির ভিতর
প্রবেশের আহ্বান জানিয়েছিলে
মাটির সোঁদাগন্ধময় পাঁকে
জলের ডাক পাই
ভিজে থাকি প্রাণের সন্ধানে
ফিরে দেখা
রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
সবার মাথায় তো একটাই চিন্তা, কত বেশি ধান উৎপাদন করা যাবে। হাটে বাজারে ধান চালের চাহিদা তুঙ্গে। রাইস মিলের ওপর লেভি বসিয়েছেন সরকার। ডিস্ট্রিক্ট কর্ডেনিং, এক জেলার ধান/চাল অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা। ট্রেনে বাসে চেকিং। কারুর কাছে সামান্য চাল পেলেই পুলিশ কেড়ে নিতো। শহরের খোলাবাজারে চাল বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। পঞ্চাশের মন্বন্তর (1943), লাখ লাখ মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। তাই খাদ্য সংকটের হাত থেকে দেশের জনগণকে মুক্তি দিতে 1954 সালেই ভারত সরকার আমেরিকার সঙ্গে PL-480 চুক্তি করে বসেছিলেন। কিন্তু পঞ্চাশের মন্বন্তরের আসল কারনটা কেউ খুঁজে বের করতে চাইলেন না। যে সব নেতানেত্রীরা জানতেন তাঁরাও চুপ করে থেকে PL-480'কে স্বাগত জানালেন। কিন্তু ইতিহাস? সে তো সবটাই জানে। সবাইকে বলেও দিলো। "পঞ্চাশের মন্বন্তর সবটাই ছিল মানবসৃষ্ট গণহত্যা। মিত্রশক্তির দ্বারা সংগঠিত গণহত্যার নায়ক ছিলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল"। হাজার হাজার সুত্র থেকে উঠে এসেছে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নাম সঙ্গে তার কুকির্তির ইতিহাস। ভারতীয় লেখিকা মধুশ্রী মুখার্জী তাঁর "চার্চিল, সিক্রেট ওয়ার" বইতে আরও বলেছেন এটা জন্মেছিল চার্চিলের বর্ণবৈষম্য শিক্ষাদিক্ষা ও মানসিকতা থেকে। তাই বৃটিশ পার্লামেন্টে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলতে পেরেছিলেন "খেতে পেলেই ওরা খরগোশের মতো জন্ম দিয়ে যাবে" যেন বৃটেনের কোন কৃষি খামারের ফসল ভারতবাসীদের ভিক্ষা দিতে বলা হয়েছিল। সেদিনর এই খবর বাংলার কোন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়নি। স্বাধীনতার পরে ইতিহাস বইতে ওই তথ্যকে স্থান দেয়নি কংগ্রেস দল। বোধহয় জহরলাল নেহেরুর সঙ্গে বৃটিশ সরকারের কোন গোপন চুক্তি হয়েছিল। অন্যসুত্রে শোনা যায় আজাদ হিন্দ বাহিনীকে রুখতেই বৃটিশ সরকার জহরলাল নেহরুকে শিখন্ডি করেছিলেন। দায়িত্ব
মাউন্টব্যাটেনের ওপর। পারিবারিক সম্পর্কটা হয়তো তারজন্যই গড়ে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রীর গদি দখলের জন্য নেহরু এটাই করেছিলেন।
বামফ্রন্ট জামানায় ইতিহাস বইটা আমুল পরিবর্তন হয়ে গেল। কোন ছাত্রকে আর মোঘল সাম্রাজ্য পতনের কারণ বর্ননা করতে 10/12 পাতা লিখতে হতো না। সেই পরিবর্তিত রাজনীতি বিদেরাও নতুন ইতিহাসের পাতাতে পঞ্চাশের মন্বন্তরকে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে রাজি হননি। কোন ছাত্রছাত্রীই জানলো না পঞ্চাশের মন্বন্তরের
আসল সত্যটা। বর্তমান তৃণমূল সরকারের জামানায় পাঠ্য বইতে স্থান পেয়েছে কিনা সেটাও জানিনা। যদি সঠিক তথ্যটা স্বাধীন ভারতের ইতিহাস বইতে থাকতো, তাহলে হয়তো ভারতের সেরামিক ইন্ডাস্ট্রি উইনস্টন চার্চিলের মুখের আদলে পেচ্ছাপ পায়খানার প্যান তৈরি করতো।ভারতবাসীরা উইনস্টন চার্চিলের মুখে প্রস্রাব পায়খানা করে ঘৃণাটা মেটাতেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (1939 সাল থেকে 1945 সাল)
চলাকালীন মিত্র শক্তির সৈনিকদের খাদ্য সংগ্রহ করতে বৃটিশ সরকার কৃষকদের থেকে খাদ্যশস্য ছিনতাই করে ছিলেন। ব্লাক করার আশায় দেশিও
কিছু আরতদারও মজুত করেছিলেন। সেই বছর
খাদ্যশস্যের উৎপাদনও কমে যায়। ত্রেয়স্পর্শে পঞ্চাশের মন্বন্তর সৃষ্টি হলেও মুল কারণটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও বৃটিশ সরকারের মজুতদারি নিতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেই পচে যাওয়া মজুত খাদ্যশস্য বিশ্ব বাজারে বিক্রি করতে না পেরে, বৃটিশ ফৌজ গঙ্গার দু'পারে ফেলে দিয়েছিল। গঙ্গার ধারে যাঁদের ঘর বাড়ি ছিল, পচা দুর্গন্ধে তাঁদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। শোনা যায় গঙ্গাস্নান করতে গেলে নাকে কাপড় চাপা দিয়ে যেতে হতো। দু'একটা ডুব দিয়ে ভিজে কাপড়ে নাক চেপে বাড়ি ফিরতেন। ঘাটে কাপড় চোপড় কাচার উপায় ছিল না।
মিত্রশক্তির সৈনিকদের জন্য বছরে কতটা খাদ্যশস্য প্রয়োজন তার হিসাব না করেই ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরেই কৃষকদের থেকে ফসল কেড়ে নিয়ে গুদামজাত করেছিল বৃটিশ সরকার। হাজার হাজার বছর ধরে যে জাতি চুরি ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানি ধর্ষণ করে জীবন ধারণ করেছিল, সেই জাতির দ্বারা খাদ্যশস্যকে সঠিক গুদামজাত করা সম্ভব নয়। তাই সংগৃহীত খাদ্যশস্যের অধিকাংশটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। লাখ লাখ মানুষকে না খেতে দিয়ে গুদামে খাদ্যশস্য পচানোটা কি গণহত্যা নয়? তবে কেন এটাকে মন্বন্তর বলে চালিয়ে দিতে চাইছেন ভারতের রাজনিতিবিদরা? কেন
সেদিন কোন রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন করেননি? প্রতিবাদ করেননি আমজনতাও। কবিগুরুর কথায়
সাত কোটি সন্তানের হেমগ্ৰ জননী,
বাঙালি করেছো তবে মানুষ করোনি।
মিত্রশক্তির সৈনিকদের আয় কতো ছিল তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বগুড়া জেলার এক সবজি ব্যাপারীর মুখে শোনা "হাটে ড্যাঞ্চিবাবুরা এলেই আমরা মালের দাম দ্বিগুণ করে দিতাম"
কে এই ড্যাঞ্চিবাবু?
কেন ড্যাঞ্চিবাবু?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য নিয়োজিত মিত্রশক্তির সৈনিক। যাঁরা পণ্যের দাম শুনলে বলতেন ড্যাম্প চিপ। ড্যাম্প চিপ শব্দটাই গ্ৰামের ব্যাপারীদের কাছে ড্যাঞ্চি হয়ে গেছলো।
এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, মিত্রশক্তির সৈনিকদের বাজার বাবদ কতো টাকা দেওয়া হতো। বাজার বাবদ টাকার থেকেই অনুমান করা যায় তাঁদের বেতন কতো ছিল। সেই সব সৈনিকদের খরচ বহন করতে হতো ভারতবাসীদের। এর থেকেই অনুমান করা যায়, বৃটিশ সরকার ভারতবাসীকে কতটা শোষণ করতেন। দেশবাসীর মুখের গ্ৰাস কেড়ে নিয়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করলেন, আর বৃটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বললেন "ভারতবাসী! ওরা খরগোশের জাত, খেতে পেলেই বাচ্চা জন্ম দিয়ে যাবে"। এর বিরুদ্ধে কেউ কোন প্রতিবাদ করলো না। তাহলে কি ধরে নিতে হবে তৎকালীন সব রাজনৈতিক দলগুলোই ছিল বৃটিশের দালাল! আজও কি কেউ জানেন কমনওয়েলথ কি ও কেন? মনে হয় অপনিও নিজের কাছে নিজেও কোনদিন জানতে চান নি। তাই আপনিও উত্তর দিতে পারবেন না।
(২)
ন্যায্য মুল্যের দোকানে বার্মার আতপ চাল, আমেরিকার গম, কিউবার চিনি পাওয়া যেত। কখনো কখনো পাঞ্জাবের গম ও বাংলার (?) সেদ্ধ চালও পাওয়া যেতো। তবে রেশনে চাল-গমের পরিমাণটা এতোই কম যে দুবেলা দুমুঠো কারুরই হতনা। তাই বহু মানুষ সপ্তাহের প্রথম দিনেই রেশন সংগ্ৰহ করতে রাত 3'টের সময় লাইন দিতেন। রেশনে মাঝেমধ্যেই "মাইলো" দেওয়া হতো। মাইলোর সঙ্গে আসতো বিষাক্ত "পার্থেনিয়াম" বীজ। দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পরলো বিষাক্ত পার্থেনিয়াম আগাছ। শহর থেকে গ্ৰামে। পার্থেনিয়ামের অদৃশ্য টক্সিন বাতাসে ভেসে পৌঁছে গেল চাষের জমিতে। ভূট্টার প্রাথমিক অবস্থায় মোচার ফল ধারণ ক্ষমতা 30% কমিয়ে দিল। ধান, ছোলা, সরিষা, গম, বেগুন ইত্যাদির ক্ষেত্রে 40% বীজের অঙ্কুরোদগম ও বৃদ্ধি কমিয়ে দিল। চরম খাদ্য সংকটের মধ্যেই ফসলের উৎপাদন কমে গেল। গোবর, পুকুরের পাঁক, সবুজ সার দিয়েও টক্সিনকে আটকানো গেল না। অধিকাংশ কৃষি বিজ্ঞানীরা অনেকেই না বুঝেই রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে বললেন। বাস্তবে ফসলের উৎপাদন ধরে রাখার ক্ষমতা রাসায়নিক সারেরও ছিল না। তবে নতুন জমিতে রাসায়নিক সার কিছুটা উৎপাদন বৃদ্ধি করলো। বাস্তবে 15% থেকে 20% উৎপাদন কম হলো। ভারতীয় কৃষিতে রাসায়নিক সার যুক্ত হলো। চাষের উৎপাদন খরচটাও বেড়ে গেল। 15%-20% উৎপাদন কম হওয়ায় দেশের খাদ্য সংকটটা আরো বেড়ে গেল। PL-480 ওপর সরকার/দেশ আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লো।
শুধু খাদ্য সংকটাই বৃদ্ধি হলো তাই নয়, আগাছার প্রভাবে মানুষের অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, হাইফিভার, অ্যালার্জি, হাঁপানি, ক্ষতসহ চর্মরোগ, প্রচণ্ড ম্যথাব্যথা শুরু হলো। গবাদি পশুদের শরীর ফুলে গেল, তীব্র জ্বর, বদহজম সহ নানা রোগে আক্রন্ত হতে দেখা দিল। রোগের সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলো ওষুধ। আমেরিকা (AP) বৃটিশ (BP) ফার্মাসিটিক্যালের ওষুধ গ্ৰামে গঞ্জে পৌঁছে গেল। ভারতীয় ডাক্তার বিজ্ঞানীরা সেমিনারে গর্বের সঙ্গে বলে চললেন রোগগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। রোগ ও ওষুধ একে অপরের গলা জড়িয়ে গ্ৰামে গঞ্জে পৌঁছে গেল কি করে? শুধু তাই নয়, ওষুধগুলো কাজও করছে। তাহলে কি রোগ রপ্তানি করা হয়েছিল ওষুধগুলোর বানিজ্য করার জন্য। রোগের ওপর গবেষণা আগেই হয়ে গিয়েছিল? রপ্তানি কারক দেশ কি ইচ্ছে করেই মাইলোর সঙ্গে বিষাক্ত পার্থেনিয়াম মিশিয়ে ছিলেন? সরকার কেন এই ধরনের বিষ মিশ্রিত খাদ্য আমদানি করার অনুমতি দিলেন? ডাক্তার, বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্য দপ্তর, খাদ্য দপ্তর কেউই জানতে চাইলেন না কেন? রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে বিদেশি ওষুধ কিনতে হলো। দামটাও বিদেশের মতো।
যেহুতে আমি একজন technocrat, তাই আমি প্রতিটি ঘটনাকে আমাদের নিজস্ব নিয়মেই দেখছ থাকি। কি ঘটেছিল সেটাই শুধু নয় কেন ঘটেছিল সেটাও দেখার/খোঁজার চেষ্টা করি। ভারতের মাটিতে সবুজ বিপ্লব আনতে কে কি কাজ করেছেন সেটাই খুঁজে ছিলাম।
১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু পঞ্চাশের মন্বন্তর না করতে পারলে কি ভারতবাসী PL-480 মেনে নিতেন?
২। মাইলোর সঙ্গে বিষাক্ত পার্থেনিয়াম না মেশালে দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন (30-40%) গড়ে 35% কমানো যেতো?
উৎপাদন কমানোর ব্যবস্থা করতে না পারলে, উচ্চফলনশীল জাতের বীজ কি কৃষকরা গ্ৰহণ করতেন?
কেবলমাত্র মিথ্যা প্রচার করে কি স্বামীনাথন বা ভারত সরকার সবুজ বিপ্লব করতে পারতেন?
(৩)
শহরের খোলা বাজারে চাল পাওয়া যাচ্ছে না। চালের দোকানগুলো বন্ধ। লুকিয়ে চুরিয়ে চাল বিক্রি শুরু হলো। মাঝেমধ্যেই আনার পথে পুলিশ চাল কেড়ে নিতো। হাতেপায়ে ধরে কান্নাকাটি করেও চাল ফেরত পেতোনা। আবার পুঁজি জোগাড় করে চাল আনতো। পুঁজি উদ্ধার করতে ওজনে চুরি করতো। চাল বিক্রেতারা কেউ দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করতেন না। 250 এবং 500 গ্ৰামের নারিকেল তেলের কৌটাতে চাল মেপে দিতেন। একটু অসতর্ক হলেই কৌটোর উল্টোদিকে চাল তুলে ক্রেতার ব্যাগে ঢেলে দিতেন। এই ধরনের চুরি-চামারি করে কেউ কেউ মাস খানেকের মধ্যে পুঁজি উদ্ধার করতে পারতেন। আবার কারুর দুর্ভাগ্য হলে, আগেই পুলিশ চাল কেড়ে নিয়ে আরো বড় গর্তে ফেলে দিতো।
আমজনতার ভালো করতে (?) সরকার ডিস্ট্রিক্ট কর্ডেনিং করেছিল, সেই ডিস্ট্রিক্ট কর্ডেনিংই কিছু নিষ্পাপ মানুষকে চোরে পরিণত করলো।
গ্ৰাম থেকে চালটা শহরে পৌঁছে দিতেন কিছু যুবক-যুবতী। এর থেকে কিছু মানুষের রোজগারের পথ তৈরি হল। যদিও সেটা কালো জীবিকা। যুবক যুবতীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের চাকায় পাশে বসে চাল নিয়ে যেতো। মেল এক্সপ্রেস ট্রেনের স্টপেজ কম, তাই সেখানে পুলিশের ঝামেলা কম ছিল। কিন্তু লোকাল ট্রেনে, প্রতিটি স্টেশনেই পুলিশের চেকিং, এইসব এড়িয়ে চালটা শহরের বুকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কতো যুবক/যুবতীর জীবন চলে গেল, কতো সংসার যে তলিয়ে গিয়েছিল, সে তথ্য কোথাও কোনদিন প্রকাশিত হবে না।
সায়ন্তন ধরের গল্প
শুধু ওরা ভুলে গেছে আজ " আলিঙ্গন দিবস "
(১)
নেতাজী সুভাষচন্দ্রবোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওয়েটিং লাউঞ্জে অপেক্ষা করছে বৃষ্টি। বৃষ্টির বাড়ি গল্ফগ্রীনে। রাস্তায় জ্যাম থাকলে এয়ারপোর্ট পৌঁছতে দেরী হবে বলে একটু সময় হাতে নিয়ে রওনা দিয়েছিলো।আজ জ্যাম ছিলো না,উল্টে এখন ঘোষণা হচ্ছে সকাল ন'টায় যে প্লেনটি ল্যান্ড করার কথা ছিলো,তা আরো দু'ঘন্টা দেরীতে ল্যান্ড করবে। এখন সবে আটটা বাজে। তাই ওয়েটিং লাউঞ্জে ওয়েট করার সিদ্ধান্ত নিলো সে।
(২)
হিতরো থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনটা দুবাই এসে পৌঁছনোর পর ওখানকার এয়ার ট্র্যাফিকের গোলযোগে নির্ধারিত সময় থেকে দু'ঘন্টা দেরীতে টেক অফ করেছে। অভ্র প্রথম যেবার বিমানে চড়েছে সেবার সারাক্ষণ জানালার বাইরে তাকিয়েছিলো। লন্ডনে পি.এইচ. ডি করতে আসার জন্যই তার প্রথম বিমান সফর। এরপর আরও অনেকবার হিথরো থেকে দমদম,দমদম থেকে হিথরো আকাশে উড়তে হয়েছে তাকে। তাই এখন টেক অফের পর ও ল্যান্ডিং-এর ঠিক আগের মুহুর্ত ছাড়া বাইরে তাকিয়ে যে কোন লাভ নেই সেটা ভালো মতো বুঝে গেছে অভ্র। তাই জ্যোৎস্নালোকিত বালিয়াড়ির নীল আলো মিলিয়ে যেতেই চোখ বুজলো সে। মাদার টেরিজা অরফ্যানেজে বড় হয়েছে সে। ওর মতো আরো অনেক ফুটপাথের যীশুকে বড় করে তুলেছেন মাদার ডোরোথি উইলিয়ামস্। প্রথম প্রথম প্রতিবছর দেশে আসলেও শেষ দু'বছরে সময়াভাবে দেশে আসা হয়নি। পি.এইচ.ডি শেষ করে এবার একবারে ফিরছে সে। লন্ডনে থাকাকালীন চাকুরীর সুযোগ এলেও বিদেশী চাকুরী না নিয়ে দেশে ফিরে এলো সে। মাদারের কথা মনে পড়লো তার। মাদার না থাকলে তার অস্তিত্বই থাকতো না। দু'বছরে নিয়মিত দূরভাষে যোগাযোগ রাখলেও কাছ থেকে দেখা হয়নি। মাদারের মুখ মিলিয়ে যেতেই আরও একজনের মুখ ভেসে উঠলো।
(৩)
লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে করতে বৃষ্টির মনে পড়লো সাত বছর আগের এক অগাস্ট মাসের কথা। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তখন সে। প্রথম বর্ষের প্রথমদিনের ক্লাস ছিলো সেদিন। অমিতাভবাবু প্রথমদিনেই প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের এতো দেরী করে ছুটি দিলেন যে তখন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। সন্ধ্যা ছ'টা বাজে,বৃষ্টিদের ক্লাস নিচ্ছিলেন রজতবাবু। তিনিও প্রায় একই সময় ছুটি দিলেন। দ্বিতীয় বর্ষের সকলেই এমন দেরী করে ছুটি পেতে অভ্যস্ত ছিলো। ছাতাও সঙ্গে ছিলো। তাই সবাই বেরিয়ে পড়ে ছাতা মাথায় দিয়ে। প্রথম বর্ষের কেউ ছাতা এনেছে,আবার কারো অভিভাবকেরা ছাতা নিয়ে এসেছেন। তারাও ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো সকলে। বৃষ্টি দেখলো একমাত্র একটি ছেলে তখনও যায়নি,সঙ্গে ছাতা নেই তার,অসহায় দৃষ্টিতে আকাশের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে সে। বৃষ্টি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো তার কাছে। জিজ্ঞেস করলো, "তুমি প্রথম বর্ষের ছাত্র ? ছাতা আনোনি বলে বাড়ি যেতে পারছো না তো !ছেলেটি আমতা আমতা করে বললো, "হ্যাঁ,মানে,না। মানে,আমি প্রথম বর্ষে পড়ি,বৃষ্টি পড়বে ভাবিনি তো,তাই ছাতা আনিনি।"বৃষ্টি বললো, "কোথায় থাকো তুমি ?" ছেলেটি বললো, "বালীগঞ্জ"।বৃষ্টি বললো, "ঠিক আছে, আমার সাথে এসো,আমার ছাতা আছে, আমি গল্ফগ্রীন যাবো,ঐ একই পথে। কোন অসুবিধা হবে না। ছেলেটি লাজুক ও অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে বৃষ্টিকে অনুসরণ করলো।ওকে সহজ করার জন্য বাসে উঠে বৃষ্টি নিজের নাম বললো ও ওর নাম জানতে চাইলো। তখন বাইরে বৃষ্টি ধরেছে খানিকটা।
(৪)
অভ্র মনে মনে ভাবছিলো,সেই দিনটির কথা। প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টার হয়ে গেছে। যথাসময়ে রেজাল্টও বেরিয়েছে। প্রথম হয়েছে সেইই। তবে শুধু মার্কস নয়,সকলের কাছেই তার জ্ঞান ও জানার আগ্রহ প্রসংশিত হয়েছে।একদিন ট্যাক্সোনমির অতনুবাবু তাঁর ল্যাবে অভ্রকে ডেকে পাঠালেন। অভ্রর গাছ চেনার আগ্রহ ছিলো চোখে পড়ার মতো। অতনুবাবুর সাহচর্যে ও প্রশ্রয়ে শিখছিলোও দ্রুত। অভ্র এলে অতনুবাবু বললেন, "আমার সাথে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর খ্যাতনামা ট্যাক্সোনমিস্ট ডঃ যোসেফ ব্রাউনের সখ্যতা রয়েছে। আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যোগ্যতমকে আমি পি.এইচ. ডি-র জন্য উনার কাছে পাঠাই। প্রতি দু'বছর অন্তর দুই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে এই সুযোগটা আসে। তোমার যোগ্যতা রয়েছে,নিজেকে আরো উপযুক্ত করে তোলো,আমার ইচ্ছে তুমিই সেখানে যাবে।" অতনুবাবুর ল্যাব থেকে বেরিয়ে অভ্রর মনটা আনন্দে ময়ূরের মতো পেখম তুলে যেন নাচতে লাগলো। পরক্ষণেই মনে পড়লো বৃষ্টিদির কথা। বৃষ্টিদি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তখন। ও সম্ভবতঃ ইউনিভার্সিটির ইতিহাসে সেরা ছাত্রী। অভ্র নিজেও জানে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো। অতনুবাবুর পাশাপাশি বৃষ্টিদির থেকেও প্রতিনিয়ত শেখে ও। বৃষ্টিদি যখন বোটানিক্যাল গার্ডেনে যায়,অভ্রকে সাথে নিয়ে যায়। ওর ছোঁওয়ায় প্রতিটি গাছ যেন কথা বলে। প্রতিটি গাছের নাম জানে ও। প্রোফেসররাও বলেন, "বৃষ্টি ইউনিভার্সিটির গর্ব।" তাহলে ওকে বাদ দিয়ে অভ্র কেন অক্সফোর্ডের জন্য মনোনীত হলো! মন ভারাক্রান্ত হয় তার।ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই বৃষ্টিদি তাকে আপন করে নিয়েছে। বলেছিলো, "তুমি করে নয়,তুই করে ডাকবি আমায়। আমি তোর নিজের দিদি রে।" সিনিয়ারদের র্যাগিং বা অন্য বিপদ থেকে সবসময় আগলে রেখেছে তাকে। গল্ফগ্রীনে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওর বাবাকে অভ্রর সামনে এনে বলেছে, "আজ থেকে আমার বাবা তোরও বাবা।" ওরও মা নেই,সেই কষ্ট পুষিয়ে নিয়েছে মাদারের সান্নিধ্যে এসে। অভ্রর কাছে অতনুবাবুর সেদিনের কথা শুনে বৃষ্টিদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো। একবারের জন্যও হিংসা,কষ্ট বা বিষন্নতা চোখে পড়েনি। চতুর্থ সেমিস্টারে পড়াকালীন বৃষ্টিদি সর্বভারতীয় নেট পরীক্ষায় প্রথম হয়। মাষ্টার ডিগ্রী শেষ করে অতনুবাবুর তত্ত্বাবধানে পি.এইচ. ডি শুরু করে সে। আরো একবছর পর লন্ডন চলে যায় অভ্র। সী অফ করা ও আপ্যায়ন করা প্রতিবারই বৃষ্টিদি এয়ারপোর্টে এসেছে।
(৫)
হ্যাঁ,অভ্রের জন্যই এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে অপেক্ষা করছে বৃষ্টি।তার পরিচয় এখন অধ্যাপিকা বৃষ্টি মিত্র। আজ বৃষ্টির খুব আনন্দ। ওর ভাই আজ সাফল্যের সাথে পি.এইচ. ডি শেষ করে বিদেশ থেকে ফিরছে।অনেক ব্যস্ততা সত্বেও ছুটি নিয়েছে সে। দু'বছর পর ওকে দেখার জন্য সে উতলা হয়ে রয়েছে। অভ্রর দেওয়া সুইস ঘড়িটির ডায়ালের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে বারবার। আর মিনিট পনেরো পরেই ল্যান্ড করবে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৩৭।
(৬)
অভ্র কিছুদিন আগে সত্যিটা জানতে পারে। থিসিস পেপার জমা দিয়ে অতনুবাবুকে আই.এস.ডি করেছিলো সে। কুশল বিনিময়,অ্যাকাডেমিক আলোচনা,একথা সেকথার পর অভ্র বলেছিলো, "একটা কথা জিজ্ঞেস করি স্যার,অন্যভাবে নেবেন না।" অতনুবাবু রাশভারী অথচ মমতাভরা কন্ঠে বলেছিলেন, "এতো ইতস্ততঃ কোরো না।গুরু শিষ্যের মাঝে ভয় থাকে না,থাকে শ্রদ্ধা। বলো,কি জানতে চাও।" অভ্র বলেছিলো, "উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে বৃষ্টিদির জ্ঞান আমার থেকে অনেক বেশী স্যার। এমন কি ওর ইংরেজীতে দখলও ভীষণ ভালো। তাহলে আমি কেন সুযোগ পেলাম ইংল্যন্ডে আসার ?" কিছুক্ষণ চুপ থেকে অতনুবাবু বলেছিলেন,আমি তোমার এ প্রশ্ন শুনে বুঝলাম,তোমাকে লন্ডনে পাঠিয়ে আমি ভুল করিনি। প্রকৃত জ্ঞানীকে যে তুমি স্বীকার করেছো,এটাই তোমার যোগ্যতা। তাহলে বলি,বৃষ্টি শুধুমাত্র তোমাকে সুযোগ দেবার জন্যই সে যেতে চায়নি। আমার প্রথম পছন্দ ওইই ছিলো। কিন্তু ওকে সুযোগ দিলে তো তুমি যেতে পারতে না। তাই ও আমাকে অনুরোধ করে,যাতে তুমি এই সুযোগটা পাও। না,ও দয়া করেনি তোমাকে। তুমি লন্ডন থেকে পি.এইচ.ডি করবে এটাই ওর স্বপ্ন ছিলো। তবে আমি তোমাকে যা বললাম,ওকে সেটা বোলো না। আশা করবো,তোমার বৃষ্টিদিকে তুমি কষ্ট দেবে না।" অভ্র ফোন রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। এমনও মানুষ আছে!! একজন মেয়ে তার জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অফার হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়েছিলো একজন অনাথের জন্য! যে মাস ছয়েকের পরিচয়ে এতো বড়ো আত্মত্যাগ করতে পারে সে আর যাই হোক,সে মানুষ নয়,সে দেবী। এ জন্যই গ্রীকদের দেবী এথেনা বা হিন্দুদের দেবী সরস্বতী - দু'জনেই জ্ঞানের দেবী,দু'জনেই নারী। নিজের সহোদরাও কি এতোটা উদারতা দেখায় ? শুধু ত্যাগ নয়,অভ্রকে নিজের জ্ঞানের সমতূল্য করতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছে সে।
(৭)
এত শত ভাবতে ভাবতেই বিমানের চাকা রানওয়ে স্পর্শ করলো,লাউঞ্জে ঘোষণা হলো পৌঁছনোর সংবাদ। ফর্ম্যালিটিস মেনে বেরিয়ে এসে অভ্র দেখলো প্রতিবারের মতো এবারও বৃষ্টিদি দাঁড়িয়ে আছে। দু'জোড়া আকাশসম স্বপ্নিল চোখ থেকে অঝোরে ঝরছে জলধারা। ওরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। ভাইবোনের কাঁধ ভিজে গেলো একে অপরের চোখের জলে। শুধু ওরা ভুলে গেছে আজ "আলিঙ্গন দিবস"।
ছবি প্রদর্শ-শালা, প্রদ্যোত দাস
কবিতার সাথে পঞ্চাশ বছর, ভাষা দিবসে সম্মানিত কবি নির্মল হালদার
আমাদের কথা
যোগাযোগ করুন
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com







ধনী টুডুর জীবনসংগ্রাম শুধুমাত্র লড়াই নয় একটা একরোখা জীবনদর্শন।
উত্তরমুছুনপঞ্চাশের যে দুর্ভিক্ষ পুঁজির তৈরি, রাষ্ট্রের তৈরি সেটা 'ফিরে দেখা' আবার প্রমানিত হল। সেটা এখনও একইভাবে চলছে।
উজ্জ্বল গরাইয়ের পরিযায়ী কবিতাটি খুব ভালো লেগেছে।
সব মিলিয়ে পুরো সংখ্যাটি খুব ভালো হয়েছে।