প্রথম বর্ষ ।। ষষ্ঠদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ মার্চ ২০২১ / ১ চৈত্র ১৪২৭




তোমার সঙ্গে কথা নেই কোনোদিন, তোমার ঘরে যেতে হবে, অবশ্যই যাবো। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব নেই, তোমার সঙ্গে ঘুরতে হবে, অবশ্যই ঘুরবো। তোমাকে দেখতে পারি না, তুমি আমার চোখের বালি, তবু তোমার প্রশংসা করবো সাতটা মুখে একুশ জায়গায়। কয়েকদিনের এই উদারতা পাঁচ পাঁচটা বছরের সুযোগ এনে দেয়। কিভাবে আর ছাড়ি?
            এই যে গতকাল সবার সামনে পা ভেঙ্গে গেল আমার, দুর্ঘটনায়, জেড প্লাস সিকিউরিটির মাঝে, আমাকে সত্যি করে বলতেই হলো এটা বিপক্ষ শিবিরের পূর্ব পরিকল্পিত। পাঁচ বছরের ভাত জোটাতে হলে এই রকম সত্যি কথা বলতেই হয়, বড়োদের কাছে শুনেছি। 
           যাদের ঘরের বড়োরা যেমন সংস্কৃতিবান হবেন তাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা তেমনই সত্যবাদী হবে তাতে আর সন্দেহ থাকার অবকাশ কোথায়? তাছাড়া পাঁচ বছর করে খাওয়ার জন্য স্বার্থের মিলনে বা এমন সত্য কথা বলতে অসুবিধা কোথায় পিসিমণি ?


উত্তম মাহাত, সম্পাদক
_______________________________




চাষবাস বৃত্তান্ত

নির্মল হালদার


কোকিলের ডাক শুনতে পাই না।

আমরা বসন্ত ঋতুতে আছি। কোকিলের ডাক শুনতে পাই না। হয়তো বা পরে শুনতে পাবো। আপাতত চাষী ঘরের কথা হোক।

যে চাষী সাত পুরুষ ধরে ধানের চাষ করে আসছে, তার ঘরে বর্তমান সময়ে আর কোনো চাষী সৃষ্টি হয় না। চাষির ছেলে লেখাপড়া করে চাকরীর চেষ্টা করছে। সে হাল চালাতে পারে না। ধরতে পারে না গাঁইতি কোদাল।

কোনো কোনো চাষির ছেলে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে কাজ করতে। কিন্তু একবারও ঘরের জমি চাষ করে দেখছে না। চেষ্টাও করছে না। চাষী বাপ ছেলেকে চাষের দিকে টেনে আনে না। হয়তো বা চাষি জানে, চাষবাসের কিছু নেই। একবার চাষ করলে যা খরচ, ফসল উঠলে তার দাম পাওয়া যায় না।

কোনো কোনো চাষির ছেলে উচ্ছশিক্ষিত হয়ে সরকারি বেসরকারি দপ্তরে চলে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না চাষির ছেলে চাষি হয়ে উঠছে। এ এক হতাশার ছবি।

আমাদের পুরুলিয়াতে এক ফসলি জমি------- ধান হয়ে গেলে আর কিছু হয় না। চাষীও চেষ্টা করে না অন্য কোনো ফসল ফলানোর। জলের অভাব আছে বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা চাষি অন্য কিছু ভাবতেই পারে না। কম হলেও অন্য কিছু চাষ হতে পারে, ভাবতেও পারে না। সরকারি কৃষি দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া দূরের কথা, চাষিদের কাছে গিয়ে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করা যায়, সেই পরামর্শও দেয় না। ফলে, ধান উঠে গেলে জমি পড়ে থাকে অফলা। তাই চাষির ছেলে আর চাষী হয় না। হয়ে ওঠে দিনমজুর।

ভবিষ্যতে বিশেষ করে পুরুলিয়ার জমি জায়গা অফলা হয়েই পড়ে থাকবে। চাষি বাপের অবর্তমানে
ছেলে চাষের দিকে এগিয়ে যাবে না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। দু' চারজন ছেলেপুলে, লেখাপড়ার পাশাপাশি চাষের কাজ শেখে। ধান রোয়ার আগে থেকে ধান কাটা পর্যন্ত মাটি চেনার চেষ্টা করে। এতে কতটুকুই বা লাভ! বাকি অসংখ্য জমি পড়ে থাকবে। অথবা বিক্রি হয়ে যাবে টাকার কাছে। কর্পোরেটদের কাছে।

ভবিষ্যৎ কি তবে এই, পুরুলিয়ার মাটি চাষির অভাবে পড়ে থাকবে? আর চাষির ছেলে অন্য রাজ্যে কাজ করে ঘরে এসে একটা বাইক কিনে ঘুরে বেড়াবে?

এই ছেলেরা গরু গোয়াল চেনে না। এই ছেলেরা পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনের কথা শোনেনি। অন্য রাজ্যের কৃষকরা কি ভাবছে, পুরুলিয়ার বর্তমান কৃষকরা ভাবার চেষ্টা করেনি। শোনার চেষ্টা করেনি।

অভাব থেকেই যাচ্ছে।

কাজ থাকলেও কাজ করছে না কেউ। অন্তত চাষের কাজ করছে না। কেউ কেউ শহরের বড় বড় নানা গোদামে কম পয়সার বিনিময়ে কাজ করবে অথচ চাষে মন দেবে না।

ভবিষ্যতে পুরুলিয়া থেকে চাষবাস যদি উঠে যায়, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কেন না, নতুন নতুন চাষির মুখ দেখতে পাচ্ছি না।

সরকারি তরফেও অবহেলা আছে অনেক, কৃষি দপ্তর থেকে প্রতি মাসে একবার করে যদি চাষীর ঘরে যায়, নতুন নতুন বীজের কথা যদি বলে, হয়তো বা চাষীরা
উৎফুল্ল হয়ে অনুপ্রাণিত হবে। নতুন চাষিও দেখতে পাবো। ধান ছাড়াও অন্য কোনো ফসল দেখতে পাবো। কিন্তু সে আশাও দেখতে পাচ্ছি না।

পুরুলিয়া চাষবাস বিষয়ে নিরাশা ছড়া কিছুই নেই। ভবিষ্যতে খুঁজতে হবে চাষির মুখ--------কে চাষী?





"লিভ টুগেদার আমাদের সমাজে কতটা সমর্থনযোগ্য"


ডরোথী দাশ বিশ্বাস


Globalization - এর প্রভাবে Live together - এর মতো পাশ্চাত্যরীতি আজকাল আমাদের আধুনিক ভারতীয় সমাজেও অনুসৃত হচ্ছে । অত্যন্ত স্বাধীনচেতা আধুনিক প্রজন্মের মনটাও তৈরী হচ্ছে পাশ্চাত্য কায়দায় । আর্থসামাজিক অস্থিরতার কারণে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাও আজকাল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার । দেশের মাটিতে কর্মসংস্থান সংকুচিত হবার কারণে বিদেশে পাড়ি দেবার স্বপ্ন সযত্নে লালিত হবার সাথে সাথে ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনা শিখে জীবনটাকেও বাইরে থেকে দেখা ও বিদেশী কায়দায় সাজিয়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নিচ্ছে "Live together " - এর ধ্যানধারণা । দুটি স্বাধীন সত্তার প্রেমহীন স্বার্থনির্ভরতার গল্পের শুরু হয় এখান থেকেই । স্বার্থ ফুরোলে চলে যেতে পারো ক্ষণিকের খেলাঘর ভেঙে -- এমন একটি দরজা এক্ষেত্রে খোলাই থাকে । এখানে হারানোর উৎকন্ঠা নেই । এমন জীবনযাত্রায় বহু অঘটন ঘটলেও মানসিক দায় এক্ষেত্রে থাকে না বললেই চলে। তাহলে যদি বিপরীত লিঙ্গের দু'জন অবিবাহিত মানুষ একসাথে বসবাসপূর্বক শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে, অর্থাৎ সহজ ভাষায় একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারী বিবাহবহির্ভূতভাবে একত্রে বসবাস করে তাকে লিভ টুগেদার বা কোহ্যাবিটেশন বলে। লিভ টুগেদার প্রথার সৃষ্টি হয়েছে বিয়ে কিংবা পরিবারের মত সামাজিক অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধাচারণ করে। তবে কি পরিবার নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি রয়েছে, যার কারণে মানুষ পরিবার ছেড়ে লিভ টুগেদারের দিকে ধাবিত হচ্ছে ? তবে কি পরিবার নামক বন্ধনটা মানুষকে বেঁধে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়?লিভ টুগেদারের বৈশিষ্ট্য হলো যতদিন রোম্যান্স ততদিন এর স্থায়িত্ব। শুধুই বর্তমানের ভাবনা, ভবিষ্যতের ভাবনা বলে কিছু নেই। প্রয়োজন শেষ তো সম্পর্কও শেষ। দুটি স্বাধীনচেতা মনের ত্যাগ বা বিশ্বাসের ভিত্তিটুকুই থাকে না যেখানে, যেখানে শুধুই যান্ত্রিক বোঝাপড়া, সেখানে জীবন মাধুর্যমন্ডিত হতে পারে না। স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলেই সম্পর্ক তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। তারপর ? জীবনের শেষপ্রান্তে গিয়ে সকল মানুষ একটা অবলম্বন চায়, যা সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত পারিবারিক জীবনে পাওয়া সম্ভব। লিভ টুগেদারের পরবর্তী জীবন একাকীত্বে দুর্বিষহ। এর পরিণতি বিচ্ছেদ, হতাশা, আত্মহত্যা এমন কি খুনও হতে পারে।

দায়িত্ববোধহীন বল্গাহীন যৌনজীবন হলেও পুরুষের কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতার ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত হিসেবে ধরা যায় লিভ টুগেদারকে, যেখানে নারী স্বাধীনতা পেয়ে থাকে একজন পুরুষের সমানই। চারিত্রিক কারণেই মানুষ বৈচিত্র্য চায় এবং সেটা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। তাই বুঝি ধর্মীয় বা সামাজিক বিধি নিষেধের ডোরেও বাঁধা থাকে না মন। এর ফলেই বুঝি অনেকেই বিবাহিত স্ত্রী/স্বামী সন্তান পরিবার ছেড়ে পুনরায় অন্যত্র সংসার পাতেন, ঘটে বিবাহবিচ্ছেদ, ঘটে পণের জন্য নারী নির্যাতনের ঘটনা, ঘটে পরকীয়া, বহুগামিতা, গণিকাগমনের মতো ঘটনা। তবে কি বিবাহের মতো সনাতনী সংস্কৃতি আজ বিপন্ন ?

পৃথিবীর অনেক দেশেই বিশেষ করে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য ইউরোপের অনেক দেশে লিভ টুগেদার প্রথা আইনগত বৈধতা পেয়েছে। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য অনুকরণের অসম মেরুকরণে সৃষ্ট এ প্রথা গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতেও ক্রমে গ্রহনীয় হয়ে উঠছে। কারণ আমরা জানি, প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ভারতীয় রীতি অনুযায়ী বিবাহ সংক্রান্ত ঘটনার ফলস্বরূপ জন্ম নিয়েছিল বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা, বিধবাবিবাহ, সতীদাহপ্রথার মতো অশুভ ফলদায়ক প্রথা। এর পাশাপাশি রুপোলি রাঙতায় মোড়া দেশজ আচার "সেবাদাসী প্রথা"-র নামে চলত অবাধ নারী বিচরণ।পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে দীর্ঘ আন্দোলন সংঘটিত হয়ে এসব ভয়ানক প্রথার বিলোপসাধন সম্ভব হয়েছে।আমাদের দেশের আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে লিভ টুগেদার এর মতো জীবন কাঙ্ক্ষিত নয়। আসলে এই ধরণের সম্পর্কের কোন স্থায়িত্ব নেই। যাঁরা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, যাঁরা পরিবারের দায়িত্ব নিতে ভয় পান, শুধুমাত্র "Give & take policy"-তে বিশ্বাসী, তাঁরাই এই ধরণের সম্পর্কের দিকে ঝুঁকছেন। এ এক বন্ধনহীন যৌনজীবন, এখানে নেই কোন মন্ত্রপাঠ, শালগ্রাম শিলা ছুঁয়ে শপথ। নেই অগ্নিসাক্ষী করে সপ্তপদীতে সামিল হওয়া, নেই আগামী দিনের স্বপ্ন, আশা, ভরসা, সন্তান পালনের প্রতিশ্রুতি, নেই পারস্পরিক আনুগত্য, নেই আমৃত্যু সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার। তাই তো, লিভ টুগেদার ব্যবস্থাটির জন্য ব্যাপক হারে ভারতীয় মন তৈরি নয়। আর এখানেই দেখি যে পাশ্চাত্যের ভালো সব কিছু অনুকরণে বদ্ধপরিকর হলেও বৈবাহিক বন্ধনের মধ্য দিয়ে যে পবিত্র সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেখানেই ভারতীয় ঐতিহ্য বর্তমান বলেই সনাতনপন্থী আমরা বিবাহের মধ্যেই স্বর্গীয় বন্ধনকে খুঁজে পাই। যেখানে "বিবাহ"-এক পবিত্র বন্ধন, তাই বলে "স্বামী স্ত্রী-র মধ্যে জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধন" - এসব ভাবনা আজ পুরোণো কাসুন্দী। সিঙ্গল ফাদার, সিঙ্গল মাদার-এর ধারণা, সে তো চিন্তনে বিপ্লবই। বিয়ে হলো আইনী সহবাস,"পুত্রস্য ক্রিয়তে ভার্যা"- জীব প্রবৃত্তি অনুযায়ী নিজ অস্তিত্ব রক্ষার্থে নিজের মতো জীব সৃষ্টি অর্থাৎ সন্তানের জন্মদান। বৈবাহিক ব্যবস্থায় এ দুটো পাওয়ার পরও সুখ শান্তি ভালোবাসার মতো অনেক কিছু না পাওয়ার যন্ত্রণাও থেকে যায়, সেক্ষেত্রে সমাজের ভয়ে অসম্মানের ভয়ে মুখ বুজে এক ছাদের নীচে অনেক দুর্বিষহ জীবন কেটেও যায়, সেদিক থেকে লিভ টুগেদার তাৎক্ষনিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে উপহার দেয় বন্ধনহীন, দায়িত্বহীন, ঝড়ঝঞ্ঝাহীন জীবন। যেখানে একান্নবর্তী সংসার নেই, আছে এক কামরার ফ্ল্যাট। যেখানে একা থেকে একাতর হয়ে গিয়ে ভাবনার অনেকগুলি জানালা বন্ধ করে আত্মতুষ্টির একমাত্র জানালাটি খুলে রেখে শুধুমাত্র দু'টি দেহমন ভাসবে যৌবন উপভোগের তরঙ্গে। আমাদের দেশেও সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত একে বৈধতা দিয়েছেন। "Kanniammal(2010) 5SCC 600,the Supreme Court held that a living relationship comes within the ambit of right to life under Article 21of the Constitution of India. The Court further held that live in relationships are permissible and the act of two major living together cannot be considered illegal or unlawful."তাঁদের মতে লিভ টুগেদার আজকের দিনে সমাজের কাছে একটি গ্রহনযোগ্য সম্পর্ক। এই আইনের ভাষ্য ঘিরে নতুন উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে তাঁদের মধ্যেই যাঁরা এ আইন পাশ হওয়ার আগে থেকেই এধরণের সম্পর্কে রয়েছেন, বা আসতে চাইছেন। বিয়ে না করে একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে আর তাঁরা কুন্ঠা বোধ করছেন না। অপরদিকে ভারতীয় আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে স্বীকৃত সনাতনী বা ধ্রুপদী সংস্কৃতির প্রবাহধারা অনুযায়ী বিবাহ অনুষ্ঠান দুটি নারী পুরুষের মননের মিলন , সামাজিক স্বীকৃতিমূলক বন্ধন বা পরিণয়সূত্রে গাঁথা দুটি জীবন যা রচিত হয় দুটি পরিবার , আত্মীয় - পরিজন সকলের দ্বারা । এভাবে দুটি মন আপন পরিবারের দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকে আপন কৃষ্টি ও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয় । নিজস্ব পারিবারিক আচার আচরণের অনুগামী হয় । পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও প্রীতি জন্মে যা একান্ত স্বাভাবিক ও উচিত । এ বিষয়ে একটি উক্তি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । " যেনাস্যপিতরোযাতা যেন যাতাঃ পিতামহাঃ । / তেন যায়াৎ সতাং মার্গং তেন গচ্ছনৃ ন রীষ্যতে ।।" অর্থাৎ যেদিকে মানুষের পিতারা গিয়েছেন , পিতামহরা গিয়েছেন , সেদিকে সে পথে সদ্ব্যক্তিদের যেতে হবে । সে পথে গেলে বিপদ ঘটবে না । তাই বলে বিবাহের ভারতীয় রীতি সবসময় যে সফল বৈবাহিক জীবন উপহার দেবে , তা নয় । তবে আনুষ্ঠানিক বিবাহরীতিতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য মন সেখানে অনেকটাই প্রস্তুত থাকে । কখনো সেখানে পবিত্র ভালোবাসা বা প্রেম মানবিক হয়েও স্বর্গীয় , বেদনার্ত হয়েও আনন্দময় , বিচ্ছেদে মলিন হয়েও মিলনে মধুর ও প্রগাঢ় হয়ে ওঠে । সমাজ দ্বারা সমর্থিত বলে মন কখনো দ্বিধা - দ্বন্দ্বে আচ্ছন্ন হয় না । সমাজের কাছে এখনো এ বিবাহের গ্রহনযোগ্যতা অনেক বেশী । বলা ভালো , Live together - এর জন্য ভারতীয় সমাজ মন ও মানসিকতা এখনো প্রস্তুত নয়।






হুদুর দুর্গা
(আমরা যাঁকে 'মহিষাসুর' নামে চিনি)

স্বাগতা দাশগুপ্ত


মহিষাধিপতি আমি
চাইচম্পা নগরীতে আমার বাসভূমি ছিল এক অনন্ত সুখের দেশ
দিনের শেষে সবাই মিলে গোল হয়ে
যখন একসাথে তালে তালে মাতিয়ে দিতাম শরীর
কোনো অভাব থাকত না মনে---
পরদিন আবার কাঁধে কাঁধ রেখে জঙ্গলে ছুটতাম লোহা গলাতে
কত বিচিত্র পাখি দেখা দিতেন আমাদের
কত সহস্রাব্দ আগের কথা সেসব? মনে পড়ে না আর

এতগুলো বছর ধরে আলোকসভ্যতার ত্রিশূলের নীচে 
বুক পেতে আধশোয়া হয়ে থাকতে থাকতে 
সভ্য মানুষের কাব্য-ইতিহাসের পাতায় পাতায়
নিজেকে অচেনা লাগে; পরিচয়হীন---

আমরা বীর জাতি, মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার লোক
ত্রিভুবনে কেউ নেই আমাকে পরাস্ত করতে পারে
কিন্তু মহিলাদের আঘাত করা আমাদের ধর্মে নেই
এমনকী প্রত্যাঘাতও না
স্বধর্মে বিচ্যুত হয় না কখনো অসুর
তাই অসামান্যা সেই মাতৃশক্তির সাথে যুদ্ধ করিনি
এতগুলো বছর ধরে বুক পেতে আছি--- 
আলোকসভ্যতার ত্রিশূলের নীচে

সভ্য ইতিহাসের রক্তিম আলোয়
কারোর কি স্মরণে আছে আজ?
নিজেরও কি মনে পড়ে আর?
অনাদৃত আত্মপরিচয়?




এইসব

শুভাশীষ ভাদুড়ী


ছিল আকাশ রুক্ষু আর
গাছের পাতা নির্বেদ,
মলিন ছায়া মাটিতে মুখ
লোকাতে চাইছিলো

হাওয়া ছিল না কোথাও,
জল বিন্দুবত দাঁড়িয়ে,
আলো বাতাস ফুরোলো যেন
ঘেন্না ধরে গাছ

শুধু মানুষ, কিছু মানুষ
ভ্রান্তিভুল সহায়,
আদিগন্ত ধুলোর শেষে
ভেতর-ভাঙা দেহে---

দু'এক কথা, পূন্যশ্লোক
দু-চার ছিটে কান্না,
মানত করে বাঁধলো যেই
মরা গাছের ডালে

দিনের পরে দিনের শেষে
নতুন কোনো দিনে---
ওগুলো হবে মায়াবী ফল,
আতপ পাকা ঘ্রাণ

ঠুকরে খাবে পাখির দল,
পোকার সন্তান




ইশারা

স্রোতস্বিনী চট্টোপাধ্যায়
 

ফাঁকা মাঠের শেষে 
কী জানি কোন দেশে 
ছায়ার মতো, আলোর রেখা কাঁপে 

দুদিকে ঘন গাছ 
বাড়িটি যেন কার
রাস্তাটুকু ফুরোয় তার বাঁকে 

ঘন রাতের মাঝে 
কোথায় তবে বাজে 
মৃদু মন্দ গানের চেনা সুর 

ভাসিয়ে আনে হাওয়া 
কাদের আসা যাওয়া 
পথিক একা, ফিরছে বহুদূর 

শীতের এই রাতে 
অলস পাহারাতে 
কোটরে বসে গাইছে এক পাখি 

ফাঁকা মাঠের শেষে 
অন্য কোনো দেশে 
আমাকে তুমি চিনতে পারো নাকি!




থেকো

তন্ময় সরকার


থাকলেই হবে জানো তো !
তুমি শুধু থাকলেই হবে ।

পেতে চাইনা
ছুঁতে চাইনা
জানতে চাইনা
আছো তা মানতেও চাইনা ।

তবু

থাকা চাই ।

থাকতে হবে আর…থাকলেই যথেষ্ট ।

সবাই তো একা বলো !
এক বীজ থেকে ধান বেরোয় আর
অন্য বীজ থেকে বেরোয় না ।
যে সূর্যের আলো দেখলো আর 
যে দেখলো না,
যে ফুল ফোটাবে আর 
যে ফোটাবে না,
যে ফল ধরবে আর 
যে ধরবে না…

সবাই

আসলে সফল ।

সাফল্য ও ব্যর্থতা মিলে তৈরী করে যে সম্পূর্ণতা ।
তারই অক্ষর এই সব হ্যাঁ ও না !

তাই,
তুমি থেকো ।
শুধু থেকো ।

যেভাবে পারো সেভাবে 
থেকে যেয়ো এই "চাইলে না থাকতেই পারতাম" যুগে।

থেকো ।




সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা


১.
উজবুক


অনেক হলো সেন্টুমুখর দিনের কারসাজি,
অনেক দেওয়ালে মূত্রত্যাগী সোশাল মিডিয়া,
অনেক হলো গিটারে মোমবাতির মিছিলে
শিথিল পেশী ফ্ল্যাশ-মব সব মাতাল ও উজবুক।

এই না হলে সুশীল সমাজ! সুশ্লীলতার দায়ে
গন্ধ মেখে মৌলবাদের, বাঁচবার আক্কেলে,
সমবাদী এই মদ্যপায়ীর যকৃৎ ফুলে ঢোল —
ছুরি-চুম্বন পাবার আশায় ওঠাচ্ছে চিবুক!

অতীত এখন গড্ডালিকায় স্বপ্নযানে আসীন।
ভবিষ্যতের অট্টালিকায় আর দেবো না হত্যে।
বর্তমানে জমছে খবর, শিরোনাম টকঝালে। 
অশ্রুভেজা আয়না এখন সদাই হাসমুখ...।


২.
ক্লান্তি-ক্ষমা


আমার ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করে না। 
দেখি, বুঝি সবই; বিবেকে গোলাপ কাঁটা,
শরীরে গোধূলি মাখা হলে ছলেবলে চুল চিরে 
ছাই ঘাঁটি পৈটিক চুল্লির গহ্বরে। অক্ষিপল্লবে
যবনিকা নেই। ক্লান্তি নেই। অঝোর ঝরণে
মধ্যশ্রাবণের মূর্ধাজল। আর আমি ঝাপসা
দেখতে দেখতে, হাল্কা হতে হতে মিলিয়ে যাই
বিম্ববিহীন আয়নার মরীচিকায়। ঘুঁসি মারতেই ঝনঝন! ভাঙন। ম্যাকবেথের রক্তাক্ত মুষ্ঠি। 
ছুরি আছে, আসলে নেই। নিধিরামের মুঠো
আলগা হতেই বাসের টিকিট। ১৯৮৩ বা ৮৪?
ছেলেবেলার এপিটাফ। ঝিংচ্যাক ধুলোপুতুলেরা
নেচে ওঠে অশালীন বিভঙ্গে। ফাঁসির বৃক্ষমঞ্চে
ঝোলে দেশদ্রোহী চাষা। আমি ভার্চুয়াল হতে হতে
আশরীর অ-শরীর ফেড আউট ফাঁসিবুকের
দেওয়ালে। যেখানে কাবাব তান্দুরে 4K আঁচ, 
38D বুকের খাঁজ, শিশুশিল্পীর মিহি কন্ঠভাঁজ,
আর ক্রমাগত স্ক্রোল, শুধু নিচে নামতে থাকা।
অপল অতল অমৃতগরল। অ্যাটলান্টিস? নাকি
এল্ ডোরাডো? স্বর্ণদ্বীপ? সোনারপুর লোকাল?
বিপ্লবের পোস্টার সাঁটা হয় স্ট্যাটাস-দেওয়ালে। 
আবালবৃদ্ধবনিতার ফোন ভালো তো মন ভালো!
কোথাও হারিয়ে যাবার নেই মানা ফোনেফোনে। 
তৎ-ত্বম-অসি? আত্মদর্শন? না। সেল্ফি। শুধু স্ক্রিন। আয়না? না। এসো না শ্যামল-সুন্দর। শুধু স্ক্রিন। চায়ের দোকানে আড্ডা অর্থহীন। শুধু স্ক্রিন।
চোখের পাতা পড়ে না, দেশলাই কাঠি দিয়ে
পল্লব তুলে রেখেছেন ঈশ্বর স্বয়ং, মিস্টার বীন....

শুধু... আমার ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করে না।



৩.
এস্-এম্-এস্


হাতে সময় কম। বালি ঝরে যাচ্ছে। জিভের চেয়ে রক্তে চিনি বেশি। নম্বরের ফাঁকে ডট কম। অ্যাপে আর লগ আউট করতে হয় না। মন জানুক না জানুক, ফোন জানে। সব জানে। স্ক্রিন ছুঁয়ে শুধু স্ক্রোল ডাউন করো... স্ক্রোল ডাউন, নো লক ডাউন। দেখতে দেখতে নিচে নেমে যাচ্ছি। নিচে, আরও নিচে। চেতনার আকাশে মেঘগুলো টাইমল্যাপ্সে বয়ে যাচ্ছে। চেত-না। তাকাতে ভয় লাগে। ক্লাউড ভরা তথ্য, সংখ্যা, কোড। বিছানো সংসারের মাথার ওপর সংস্কারের সিলিং। তার ধূলিধূসর বুকে একটা চিড় ধরেছে মাত্র। হোয়ান মিরোর পেইন্টিং। ধোঁয়াটে ক্যানভাসের কোণে হাল্কা ফাটলের মত একটা দাগ। অনেকদিন নাকি লেগেছে আঁকতে। সে নিয়ে খিস্তিমুখর শিল্পী মহল। আমি সেটাই পড়ে চলেছি, বারংবার। দুলেদুলে মুখস্ত করছি কোরানের সুরার মত, বিতর্কিত হাদিসের মত, কাশীদাসী দ্বিপদী পয়ারের মত। অথবা কৃত্তিবাস...।

কোনো নবী বা ব্যাস বা বাল্মীকি আসে না উত্তরের ঝাঁকা মাথায়। “তিরিশ টাকা, মাত্র তিরিশ টাকায়...” সম্মান ছাড়া, আর কিছুই বিকোয় না। শুধু বজ্রবিদ্যুৎসহ এস্-এম্-এস্ পাঠায় কেউ। জানিয়ে দেয়, কমতে কমতে জমার খাতায় এখন কত অ্যাভেলেবেল বাল...। তারপরেই স্ক্রিন সাদা। গ্যাঁজলা ওঠার মত। লাইন কেটে যায়। 

“নেটওয়ার্ক উপলব্ধির বাইরে।”



সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

১.
কাঙাল


গান ফুরিয়ে পথের মাঝে 
কাঙাল বলে ডেকে উঠলে কাকে?
বিকেল তখন রঙ্গপ্রবণ
রমণীদল হারানো ঠাম ঢাকে।
তোমার কাছে শীর্ণ আভাস
হঠাৎ যেন উপচে পড়েছিল।
বিকেল তাকে স্খলিত ডৌল
ঘুমজড়ানো হাতের স্বেদে দিল।
এই কি তোমার গান হারানো পথ?
ধুলোর কাছে বিকিয়ে দেবে উপার্জিত নথ?


২.
রাতের জন্যে ভাষা


স্নায়ুর কাছে কুসুম, নাকি, ভাষা!
কোমলতাহারা বিকেল, বানানো কথা।
বাড়ির শিয়র-- প্রত্যাহারের
কীর্ণ সহজটুকু--
নামিয়ে রাখে শব্দমোছানো রাত।
নিসর্গ যাচে আঁচ?




মুখোশ

সুজন পণ্ডা


একটি গাছের আড়ালে
চাঁদ, হলুদ চাঁদ জেগে রয়,
আলো পিছলে না গেলেও
সেই গাছে জড়িয়ে যায়।
ওই যে পাহাড়
ওই যে শানিত রাত্রি,
ওইখানে কিছু মানুষ,
ভীরু কিছু মানুষ। অতন্দ্র।

মানুষের মুখ তার অন্তরকে
আড়ালে রাখে। পাহারা দেয়।




সৌরভ লায়েকের কবিতা


১.
আতস কাঁচে দেখা


এই প্রথম সুদেষ্ণা কে দেখে কোনো 
ভাবান্তর হল না 

এতো বৈভব - এতো সাজ - এত জৌলুস
সমস্ত কিছুই যেন আবেগহীন

যেন হেমন্তের পলাশ বন 
ঝরা পাতায় কঙ্কালসার দাঁড়িয়ে আছে 

তিসির ক্ষেতে নীলছে ফুলের যে সৌন্দর্য
পলাশের রক্তিমে যে ভালোবাসা
সেখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই

অনুসন্ধিৎসু যুবক তোমাকে দেখে করুণা হচ্ছে
তুমি তো খড়ের উপর সাবলীল সুদেষ্ণা কে দেখোনি 



২.
পাখি জীবন


একান্ত গোপন হলেই আমি গালিভার হয়ে উঠি ।
হারানো সমুদ্রে ভেসে যাই লিলিপুটদের দেশে যেখানে দূরন্ত এক ইউটোপিয়ান সংস্কৃতি ঘিরে থাকে 
আমার নির্বিকল্প রাতকথাদের বারান্দা, ঘর, চতুর্দিক।

ফেলে আসা অতীতে হারানো শৈশবের স্মৃতি
সম্মোহনের সুপ্রাচীন গুহার ভেতরে নিয়ে যায় ।
যেখানে‌ ফাল্গুন বলে কোনো মাস নেই , বর্ষা বলে কোনো মেয়ে নেই , তাই ফুল ফোটা ও অভিসারে কোনো মোহ নেই । হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাই নির্জনে , কেন এই নির্জন প্রিয়তা আমাকে ঘিরে ধরছে , প্রতিটি সান্নিধ্য তুচ্ছজ্ঞানে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছি , ছিঁড়ে ফেলতে চাইছি সম্পর্ক মাকড়সার অদৃশ্য জাল । আমার ইউটোপিয়ান সংস্কৃতি , আমার গালিভার হয়ে ওঠা , আমায় পাখি জীবনে মুক্তি দাও আমি বেঁচে ফিরে আসি 'শঙ্খচিল শালিখের বেশে' ।




মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়ার কবিতা

১.
নদী মাতৃক


তোমাকে ভাসায় কাচের স্রোত?
দ‍্যাখো,চেনা মানুষের ভিড়ে থমথম করে ফাঁকা
বদলায়নি তো কিছু,শুধু হাওয়ার পিছুপিছু
এসে শান্ত লেখারা থেমে আছে পড়ার টেবিলে
আলো এতো কমজোর!
মুক্তদানার মত অক্ষর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল শীতকাল..ভোর
ঘুমন্ত গাছের গায়ে নিচু হচ্ছে টাটকা গোলাপ
পাপড়ির শোক ও বিলাপ পাতলা চাদরে ঢেকে
ছোট ছেলে লাগে তোমাকে
দৌড় দেবে যেন বড়মার বারণ না মেনে ঝাঁপাই জুড়বে তাই
জলে নেমে অস্থি ভাসাই
চাঁদের ভেতরে এখন পাথরের ডানা খুব পালক ঝরায়
কাচের স্রোতের মত লম্বা কুয়াশায়
খুলে গেছে এই বাড়ি, গাছগাছালির ছায়ারথ
জুড়ে যাচ্ছে ওপারের গাঙ আর এধারের ইচ্ছামতী
চেনা জলপথ…
              

২.
মায়া            


ভাঙা মন্দির..মূর্তি নাই
তাকে চেনা আত্মীয় লাগে
যেন ছোট মাসির ঘর ফেলে বাড়ি আসছি
লজঝড় বাস পেরোচ্ছে মিলনমাঠ বান্ধবভবন
ভাঙা দেউল প্রতিমাবিহীন
পাথরের হাঁ মুখে ধু ধু করে হাওয়া
রক্ত গোটার মত ছড়ানো শিমুলে
মেটে সিঁদূরের লাল আবছা লাগে
ধূলোর বেদীতে লুপ্ত মন্ত্র ও পূজাবিধি
শুধু রেণু মেখে ওড়ে মউপোকা
গুঞ্জনে আরতি সুবাস
পাতার কুমকুম ধরে রাখি আঁজলায়
ছেড়ে আসতে মায়া করে তোমায়
জঙ্গলের অনাথ দেবতা, মৃত নর্তকীর সঙ্গে
কুয়াশায় উড়ে গেছো জেনে তেষ্টা পায়
আমি সেই পিপাসার হাতে ফোঁটা ফোঁটা জল রেখে আসি 




সারহুল : আদিবাসীদের ধর্মীয় ও বসন্ত উৎসব

                  তপন পাত্র


"শাল কাঁদে , পিয়াল কাঁদে , কাঁদে মহুল বন ;
অযোধ্যা পাহাড়ে বসে কাঁদে হামার মন গো 
 কাঁদে হামার মন ..."
            শীত পেরিয়ে বসন্তের আগমনের সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় পাতাঝরার খেলা । শুকনো পাতার নূপুর পায়ে পাহাড় জঙ্গলের গা ঘেঁষে নেচে চলে মৃদু বাতাস, কখনো উতল হাওয়া । কিছু দুষ্ট মনের অধিকারী, ধ্বংস বিলাসী মানুষ ঝরা পাতায় আগুন ধরিয়ে দেয় , এ এক অদ্ভুত পৈশাচিক উল্লাস ! দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে অযোধ্যা-বাঘমুন্ডি, শুশুনিয়া, ভান্ডারী পাহাড় ; ঝাড়বাগ্দা, ঠাকুরডুংরি, রাইডুংরির মতো ছোটখাটো ডুংরি-টিলা থেকে শুরু করে দলমা রেঞ্জ-ও বাদ যায় না । মনের দুঃখে, বেদনাবিধূর চিত্তে তরুমিত্র নিসর্গপ্রেমিক নরম হৃদয়ের মানুষ গেয়ে ওঠে ঝুমুর গানের উদ্ধৃত কলি । যদিও এই গানের মূল ভাবনাটি অন্য । শাল , পিয়াল, ক্যাঁদ , মহুয়া, কুসুম, পলাশের জঙ্গল উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে ;তার পরিবর্তে কোথাও কোথাও গজিয়ে উঠছে আকাশমণি, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাস, সুবাবুলের মতো আমদানি করা বৃক্ষরাজি । যা এই পশ্চিম-সীমান্ত-বাংলা তথা পুরুলিয়া তথা ঝাড়খন্ড তথা মানভূম, জঙ্গলমহলের মাটি -জল-হাওয়ায় নিতান্তই বেমানান । তাই কবি প্রশ্ন তুলছেন --- "তিরিং রিংগা গাছগুলা কুথা থা'কে আ'ল ?"
                 
            কখনো কৃত্রিম অগ্নিদাহন, কখনো দাবানল; আর সবচাইতে বড় কথা বন কেটে বসত, জঙ্গল সাফ করে কৃষিজমির বৃদ্ধি ঘটানো , রেলপথ নির্মাণের জন্য অরণ্য ধ্বংস, রাতের অন্ধকারে ও দিনের রহস্যময় কুয়াশায় লরি লরি গাছ পাচার ‌। নানা ভাবে ও কলায় অরণ্য নিধন চলছে তো চলছেই । চলছে উত্তরণের রাজনৈতিক মোড়ক অবলম্বন করেও ।

              তবুও এখনো যেটুকু আছে তাতেও এই এলাকা নিসর্গ শোভার স্বপ্নপুরী । বসন্তের ছোঁয়া পেলে শাল সেগুন ফুলে পল্লবে ফেঁপে ওঠে । কুসুমের সবুজ , মেরুণ, পোড়া লাল পাতায় বিরাজ করে বসন্তের লুকোচুরি । অশোক ,পলাশ, শিমুলের বর্ণময় শোভা তরতাজা হৃদপিন্ডের চেয়েও গাঢ় লাল । মহুয়া ফুলের গন্ধে ম-ম করতে থাকে বন-ডুংরি, আকাশ-বাতাস । ভোরবেলা মহুলতল থেকে ভেসে আসে যেন মৃগনাভির সুবাস । কুঞ্জবনের অঞ্জলি ছাপিয়ে পড়ে, পলাশ কানন ধৈর্য হারায় রঙের ঝড়ে । দখিন দুয়ার খুলে যায়, মন বলে --- এসো হে আমার বসন্ত, তুমি এসো, দিব হৃদয়দোলায় দোলা । কেউ ভাবে ,এতদিন তো বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে ,আজ বুঝি তার দেখা পেলাম ফাল্গুনে । তবু মনে হয় যদি তারে নাই চিনি গো, সে কি আমায় চিনে নেবে এই নব ফাল্গুনের দিনে ? সংসয়ের সাথে উচ্চারিত হয় স্বগতোক্তি ---জানি নে , জানি নে , জানি নে । সে এক অবাক উন্মাদনা বীরভূম, ধলভূম, মানভূম, সিংভূম ,সমস্ত "ভূম" এলাকাজুড়ে । যেন দখিন দুয়ার খোলা, মনের মানুষ প্রাণের মানুষ সুযোগ পেলেই হৃদয়ে দোলায় দেয় দোলা । কিছু পলাশের নেশা আর কিছুটা চাঁপায় মেশা , তাই দিয়েই সুরে সুরে রঙে রসে জাল বোনেন তামাম পশ্চিম সীমান্ত বাংলার আদিবাসী জনসমাজ ।

                 এখানে যে আদিবাসী সাঁওতালী জীবন, তার ছন্দ অপরূপ নৃত্য ভঙ্গিমায় সমৃদ্ধ । যেন উল্লম্ফন ! এমনিতেই তাঁদের হৃদয় নাচে বিনে বাজনাতেই, আর বাজনা পেলে তো কথাই নেই । অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনযাপনটাই আনন্দ উন্মত্ততায় ভরপুর আর ছুতো পেলে তো সোনায় সোহাগা । তাঁদের জীবনজিজ্ঞাসার জটিল তত্ত্বের আলো-ছায়ায় লুকিয়ে আছে আনন্দমুখর জীবন দর্শনের অমল আবেশ । একদা তাঁদের জীবন দর্শন ছিল অনেকটাই ---"নাচো ,গাও, খাও ,পিও; জিও -জিও -যুগ যুগ জিও ।" এখন সেই ছন্দে অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে, রচিত হয়েছে জীবনের নব প্রকরণ । তবু তাঁরা এখনো একথা বলে আনন্দ পান যে, আমাদের "সিনালেই সাঁকরাত আর প্যাটে পড়লেই পরব" , অর্থাৎ তাঁদের জীবনে এই পরম সত্যটি বর্ণে বর্ণে প্রতিধ্বনিত যে "আনন্দই ব্রহ্ম", তাইতো তাঁদের ভাবসত্য ---"রড়গে সেরেঞ, তাড়াম্ গে এনেচ্" অর্থাৎ " বললেই গান আর চললেই নাচ" । আদিবাসী জীবন নদীর কিণারে আজও কান পাতলে শোনা যায় ----
      " জম আবোন ঞুয় আবোন
         রৌস্কৌ'রে বোন তাঁহেনা
        জিয়ৌন খাবারে --
        দাঃ বোনঞুয়া ।"
----অর্থাৎ "খাবো দাবো মকমকাবো , জীবন নদীর জল পান করবো ।"



              ---এই যাঁদের জীবনদর্শন, তাঁদের বারো মাসে তেরো পার্বণ , তের না হলেও বারো মাসে তো বারো পার্বণ অবধরিত । মাসে মাসে গাদা বঙ্গা, গাদা বুরু । গাদা গাদা বঙ্গা-বুরু । নানান দেব-দেবীর পূজা অর্চনা । আর সেই উপলক্ষে মাংস ও হাঁড়িয়া , ভালো-মন্দের বেসাতি । ধমসা মাদলের সুরে সুরে দিনরাত "এনেচ-সিরিঞ" , নাচ-গান । সব সময় যেন আত্মহারা । হৃদয় যেন দু বাহু তুলে বলতে চায় "মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো..." ,মাসে মাসে নানান পালা-পার্বন পরব-পা'ল কে ঘিরে উন্মাদনা উন্মত্ততার অন্ত নেই । তাই পাশাপাশি প্রতিবেশী তুল্য ভিন জাতির মানুষের কথা --- "ভূমিজ ( মুন্ডা) গেল গরবে আর মাঝি ( সাঁওতাল)গেল পরবে !

       গরবে-পরবে আদিবাসী জনজীবন যে আনন্দময়, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । কিন্তু নিছক আনন্দ নয়, আনন্দটি দ্বিতীয়, বলা ভালো আনন্দটি অনুষঙ্গ । মূল বিষয়টি হল প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা । একদিন গুহা ও কোটরবাসী আদি আরণ্যক জীবনে বনজ সম্পদের ভূমিকা অতুলনীয় । বাসস্থান ও অন্নসংস্থানের সৃষ্টিকর্তা জগদীশ্বর "সিঞবঙ্গা", "মারাঙবুরু"কে জগৎ ও জীবের কল্যাণে তাঁর মহান সৃষ্টির কারণে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ফলমূল পাতা দিয়ে পূজা-অর্চনার ব্যবস্থা । তাই "বাহা" এক অর্থে দেবতার উদ্দেশ্যে ফুল উৎসর্গ করার উৎসব । এ নিছক বসন্ত উৎসব নয়, উৎসবের নানান রীতি-প্রথার তাৎপর্য বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই উৎসব মিত্র ও মৃত্তিকার মহাসংগম, এই উৎসব প্রণয়োৎসব; পরিণয়োৎসব বললেও ভুল হয় না। অরণ্যের বংশরক্ষার উৎসব । শষ্যকুলের বংশ রক্ষা ও বংশবৃদ্ধির উৎসব । এ হোল প্রকৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন,কৃতজ্ঞতা, অরণ্য প্রকৃতির প্রতি অন্তরের ভক্তিপূর্ণ পূজা নিবেদন ।

           এই ফাল্গুন-চৈত্র মাসে, বসন্তে যখন শাল-পলাশ-শিমুল-মহুলের বনরাজিতে নব পল্লব, ফল-মূল, ফুল ; তখন সেগুলি নিজেরা ব্যবহার করার আগে জগৎপিতা "সিঞবঙ্গা মারাঙবুরু" ও জাহের থানের প্রধান দেবী "জাহের এরা" কে উৎসর্গ করে প্রার্থনা জানানো হয় , সৃষ্টির সমারোহে যেন কোনদিন ছেদ না পড়ে, প্রকৃতির বনজ সম্পদ থেকে মানুষ যেন কোনদিন বঞ্চিত না হয় --এটাই বাহা পরবের মূল তত্ত্ব ।

                 সাঁওতাল সমাজে একটি কিংবদন্তির প্রচলন রয়েছে । সৃষ্টির আদিতে দু'টি হাঁসের ডিম থেকে এক মানব আর এক মানবীর জন্ম হলো । তারা যৌবন প্রাপ্ত হলে মারাঙবুরু তাদের দ্বারা বংশ বৃদ্ধি করাতে মনোস্থির করলেন। তাই যাতে তাঁদের শরীরে ও মনে মিলন বাসনা জাগে, যাতে তাদের শরীরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যৌনবাসনা জাগে সেইজন্য মারাঙবুরু স্বয়ং ঘাসের বীজ থেকে হাঁড়িয়া বা হাঁ'ড়্যা তৈরীর পদ্ধতি শিখিয়ে দিলেন । এই হাঁড়িয়া পান আলোচ্য সাঁওতাল উৎসব এর অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ।

        আলোচ্য "সারহুল" বা "সারুল" বা "বাহা" উৎসবের দু'টি সুস্পষ্ট পৃথক দিক রয়েছে । একটি হল ---প্রথাগত পূজা অনুষ্ঠান আর অপরটি হল ---আমোদ আহ্লাদ ।

            "বাহা"তে পূজা পান "বোঙ্গা"গণ , পবিত্র আত্মা বা দেবতা আর তারই সাথে দেবী "জাহের এরা"। এছাড়াও 
"মঁড়েকো-তুরুই কো" ও "দেবী গোঁসাই", সমাজের পাঁচ-ছ' জন বিশিষ্ট সম্মানীয় গুণীজন । পূজা হয় "জাহের থান" -এ । কেউ বলে "গরম থান" কেউ আবার বলে "সারনা" । "সারনা" মূলত মুন্ডারীরাই বলে থাকেন । পূজার তিথি হলো ফুল্ল-কুসুমিত ফাল্গুনী দোল পূর্ণিমা । 
               
           "জাহের থান" কী ? "জাহের থান" কোথায় ? ---সে প্রসঙ্গে আরেকটি কিংবদন্তির উল্লেখ করতে হয় । কিংবদন্তিটি হল : অত্যাচারী মাধো সিংয়ের অত্যাচারের একদা সাঁওতালরা বনে বনে টিলায় টিলায় ঘুরতে থাকে । সহসা এক দিন এক সাঁওতাল আকাশের দিকে একটি তীর ছোঁড়েন । তীরটি একটি শাল গাছের নিচে এসে পড়ে । সেখানেই হয় তাদের স্থায়ী বাসস্থান । তখনই থেকেই তাঁদের ধর্ম হয় "সারনা ধরম" শাল গাছ আশ্রয় দিয়েছিল বলে শাল গাছ কে বলা হয় "সারি সারজম" অর্থাৎ "সত্য শাল"।আবার কথিত আছে এক সময় এই শালগাছের তলাতেই ধর্মবিষয়ক মীমাংসা ও সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে শাল গাছ "সত্য ধর্মের প্রতীক" "পবিত্র বৃক্ষ"। আর ওই দিনটি ছিল ফাল্গুনী পূর্ণিমা , তাই ওই চাঁদের নাম হয় "বাহা চাঁদ" অর্থাৎ "ফুল চাঁদ", "পুষ্প সম চন্দ্র"। "বাহা" মানে "ফুল" । কেউ বলে "শাল ফুল"কেউ বলে "মহুল ফুল"। প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন অনেক আদিবাসী গুণীজন এই কিংবদন্তীর কথাটি আরোপিত বলে মন্তব্য করেন ; তাঁরা এই কিংবদন্তিকে মেনে নিতে চান না ।

        শুধু সাঁওতাল নয়; মুন্ডা, ভূমিজ, শবর, কোল, ভিল, বীরহোড় অনেক উপজাতিই সারনা ধর্মে বিশ্বাসী, প্রকৃতি পূজায় অস্থাবান । এই প্রকৃতি পূজা বা ফুলকে অবলম্বন করে উৎসব "বাহা"-র আর এক নাম "সারুল" বা "সারহুল" হল কেন ? সে প্রসঙ্গেও একটি লৌকিক ব্যাখ্যা রয়েছে । বসন্তকালে বনে বনে শুভ্র উজ্জ্বল শাল পুষ্প প্রস্ফুটিত হলে সৌরভে মাতে মৌমাছি । পরাগরেণুর মিলন ঘটে । সূচনা হয় নব সৃষ্টির । প্রকৃতির বা সৃষ্টি-সৃজনের মূল বা সার হল ফুলের পরাগরেণু । মৌমাছি তার হুল দিয়ে ফুলকে জড়িয়ে ধরে ‌ । শরীরের ডানায় লেগে থাকা রেণু এক ফুল থেকে অন্য ফুলে পরাগ মিলন ঘটায় । জগতের এই "সার" বা "মুল"কর্মে "হুলে"র ভূমিকা রয়েছে, পরাগমিলনে হুলের ভূমিকা রয়েছে, তাই এর নাম "সারহুল"। "সারুল" শব্দটি "সারহুল" থেকেই এসেছে । এই বাখ্যাটিও সম্ভবত বাংলা ভাষাতত্ত্বের ভাষাতাত্ত্বিকদের, এর সাথে সাঁওতালি ভাষার যোগ অতি ক্ষীণ । যাইহোক এ এক মহা উৎসব "নাওয়া সিরমা" বা নববর্ষের দ্বিতীয় মাস, ফাল্গুন মাসের উৎসব । এই মহা উৎসব সারা মধু মাস জুড়েই পালিত হয় । বাহা পরব উপলক্ষে যে গান গাওয়া হয়, সেই গানের সুরের নাম --বাহা সুর । বলা হয় , সুর -- বাসন্তী ।


               সারা মাস জুড়ে একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকলেও "সারহুল" বা "বাহা" মূলত ত্রিদিবসীয় উৎসব । প্রথম দিনটিকে বলা হয় "উম্ , " । যার অর্থ "অধিবাস"। এই দিনটি ভক্তদের স্নান ইত্যাদি সেরে নিজেদের শুচি ও পবিত্র করার দিন, গ্রাম সাফাই করার দিন । এদিন অর্থাৎ "উম" পর্বে পবিত্র শালবনের জাহের থানে দু'টি দেব কুটির রচনা করা হয় । একটি "গোঁসাই এরার" আর অন্যটি "মারাংবুরু ও অন্যান্য দেবতাদের" জন্য । পরবের সূচনায় দু'জন অবিবাহিত যুবক পবিত্র দেহ-মনে জঙ্গল থেকে শাল ফুল ও মাটির তৈরি ঘটে পরিষ্কার জল কাঁধে নিয়ে জাহের থানে আসেন । অন্যান্য গ্রামবাসীরাও এসে হাজির হন। গোধূলিবেলায় লায়ার বাড়িতে আতিথ্য ।নাগড়া, শিঙ্গা বাজানো হয় । নায়কের হাতে কাঁসার থালায় থাকে নব পুষ্পরাজি । তিনি যখন গ্রাম পরিক্রমণ করেন তখন বাড়ির মহিলারা ছোট বাটিতে সরষের তেল আর ঘটিতে জল নিয়ে তাঁর পা ধুয়িয়ে দেন । তিনি সকলের শান্তি কামনায় মন্ত্রোচ্চারণ করেন । শান্তিবারি ছিটিয়ে দেন ।এরপর শুরু হয় নৃত্য-গীত, বসন্ত দিনের গান ।

      দ্বিতীয় দিন "সারদি মাহা"। সমবেত ভক্তদের নিয়ে জাহের থানে আসেন নায়কে । ভক্ত সকলের সাথে থাকে ধমসা, মাদল, তীর-ধনুক, সাকামসিকড়ি, বারসি, হাপা ইত্যাদি । দেব আয়ুধ ও সপুষ্প-শাল মঞ্জুরি ; ধূপ-ধুনা-সিন্দুর-আতপ চাল, মঙ্গলঘট । থাকে দেবভোগ্য মোরগের বলিদান কর্ম । গানে গানে জাহের বন্দনা, শালবৃক্ষের বন্দনা । মহিলারা আঁচল পেতে আশীর্বাদ রূপে শাল ফুল গ্রহণ করেন । ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয় "বাহাদঃ" বা "শালফুল" । 
         এই বলি প্রসঙ্গে এখানে কিছু কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন । দোল যেমন রাধা ও কৃষ্ণের মিলন উৎসব । সারহুল তেমনি আদিবাসীদের সেরা দেব ও দেবীর মিলন উৎসব । তেমনি একদা হোলি ছিল নরবলি ও যৌন লীলাময় নৃত্য-গীত । কৃষিভিত্তিক প্রাচীন সভ্যতায় প্রচুর শস্য উৎপাদনের কামনায় এই মদনোৎসব বা কামোৎসব চলতো । তাই হোলি বা দোলের সাথে সারহুল বা বাহার সাদৃশ্য টি সহজেই অনুমেয় ।

         বাহার তৃতীয় দিনকে বলে "সেন্দরা" বা "শিকার" । এদিন যুব সম্প্রদায় লায়ার আশীর্বাদ ধন্য হয়ে শিকারে বেরিয়ে পড়েন । "সাগুন-সুপারি" ও "জলক্রীড়া'' চলে হোলির মতো । বিশেষত্ব এটাই যে, আবিরের মত কোন কৃত্রিম গুঁড়ো অথবা রং তাঁরা ব্যবহার করেন না , প্রকৃতির খাঁটি তরল জল কে নিয়েই আনন্দে মেতে ওঠেন । এই শিকার উৎসব খাদ্য সংগ্রহের উৎসব । ওরাংরা এটি বেশি বেশি সাড়ম্বরে উদযাপন করেন ।

      রীতিপ্রথার বিষয়টি এখানেই শেষ নয় । কোন কোন গ্রাম এলাকায় আরেকটি বিষয় এর সাথে যুক্ত আছে । বিষয়টি হলো মনসা পূজায় কোনো কোনো নারী পুরুষের ভরণ আসার মতো "রুম বোঁঙ্গা"র ভরণ । সাধারণত দুজন লোক নির্দিষ্ট হন "রুম বঙ্গা" হিসাবে । তাঁরা নতুন বাঁশের তৈরি কুলায় আতপ চাল ও মেথি নিয়ে হাত দিয়ে রাগড়াতে থাকে । এই অবস্থায় এক সময় দেবতার ভরণ হয় । সাধারণ গ্রামবাসী "রুম বঙ্গা"র কাছ থেকে তাঁদের ও গ্রামের ভবিষ্যতের ভালোমন্দ কী হবে সে বিষয়ে জেনে নেন । এই বঙ্গার ভরণ কাটানোর জন্য মোটা দড়ির চাবুক দিয়ে তাঁকে চাবকায় । এক সময় তাঁর ভরণ কেটে যায় । তবে এতে নাকি দেবতা তুষ্ট হন । আর বোঙ্গার যতোটা আঘাত লাগার কথা ততোটা লাগে না ।

             সারহুলের পর যেমন বনজ সম্পদ পুষ্প পল্লবের প্রকৃত ব্যবহারের সূচনা, তেমনি আবার কৃষিকাজের প্রধান অঙ্গ বীজ ব্যপনেরও সূচনা হয় এই পরবের পর । 

       উৎসবের প্রথম পর্যায় রীতি-প্রথা সাঙ্গ হলে শুরু হয় আনন্দ-বিনোদন , আমোদ-আহ্লাদের পর্ব । ততক্ষণে গ্রামের মহিলারা সেজেগুজে প্রস্তুত । পরনে তাদের লাল পেড়ে সাদা শাড়ি অথবা হলদে রং এর সুতির শাড়ি, সবুজ রঙেরও হতে পারে । আঁটো সাটো করে পরে সেই শাড়ি । ছিমছাম দু'চারটে রূপার অলংকার আর কিছু গ্রাম্য প্রশাধন ‌ । ফুলের পরবে ফুলের মত মেয়েদের অঙ্গ জুড়ে ফুলের বাহার । ঠিকরে পড়ে সারহুলের আনন্দ । সহজ সরল সাবলীল গানে আর ধামসা মাদলের টুঙ্গুল... টুঙ্গুল ...টুঙ্গুল... শব্দে তখন মনযমুনা কানায় কানায় পূর্ণ । হাঁড়িয়ার মত্ততায় মাতাল সাঁতাল যুবক-যুবতী । গানের সুরে যুবকের স্বগতোক্তি ---সুজলা সুফলা জমি নেব আর মনের মতো সঙ্গিনী বেছে নেব । সেই সঙ্গিনী যদি নিলামে ওঠে তবে জমি বিক্রি করেও তাকে নিজের করে নেব । কোন গানে দেখছি বিবাহিতা যুবতী গ্রামের যুবককে বলছে ---গাঁয়ের ছেলে মঞ্জুরী আমার বাড়ির সামনে ফাঁদ পেতেছে, কিন্তু আমি তো সিঁদুরে বাঁধা পরের বউ, আমি কী করে যে মনঝরির ফাঁদে পা বাড়াবো ?
আবার কোন গানে দেখছি একটি বালিকা ও ডবকা তরুণ বন পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে , বনপথ প্রায় শেষ , কিন্তু তরুণ তাকে কিছুই বললো না, তার হাতের দিকে একবার হাতও বাড়ালো না । তখন বালিকাটি বলছে ---
    "কত যে বন হলাম পার,
      বনের পর বনের ধার।
       বারোটি বন হলাম পার,
      মাইরি ,তুমি আমাকে তবু
     বললে না তো কিছু,
  করলে না তো কিছু !"

        তখন শাল পঙড়ার মতো সমত্ত তরুণটি বলছে ---
     "বলব কি গো; কোরবো কিগো;
    তোমার ওই শরীর কচি,
     আফুটা দু'টি বুকের কুঁড়ি আজও ।
    যদি না হতো তা ---
    তাহলে আমি প্রাণভরে সুবর্ণরেখা নদীর জলের মতো তোমার রূপ সুধা পান করতাম বনের পর বনে ।" ---এই গানটি মূলত শিকার উৎসব প্রসঙ্গে গান । বাহা মহোৎসবের তৃতীয় দিনটিও মূলত শিকার দিবস ।
 
       ---এইসব ভাবানুষঙ্গ যুক্ত প্রচুর গান গীত হয় এই উৎসবে, যা থেকে আমোদের মূল সুরটি আন্দাজ করা যায় ।



             দূর আকাশে তখন বাহা চাঁদের রূপের বাহার । শাল-পলাশ-মহুয়ার প্রাকৃতিক মনোলোভা উদ্যানে ঈষৎ শীতোষ্ণ দেহ-মন আওলানো পাগল করা বাতাস ‌। দুপুর রাতের আদিগন্ত বিস্তৃত জ্যোৎস্না রাতে তখন সবাই বনে, তখন বসন্তের মাতাল সমীরণে মন আরো আনন্দ চাইছে, অধিক কিছু চাইছে । সকলের শরীর দুলছে, দৃষ্টি বদলে যাচ্ছে দু'চোখের । চিকন কালো সুঠাম শরীর গুলি ভেসে যাচ্ছে ধবধবে জ্যোৎস্নায় ‌। তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই ভেসে যাচ্ছেন বকুল ফুলের মৃদু সুবাসে । কে যেন বলছে , "আমি সব নিতে চাই ,সব নিতে ধাইরে" । ঐতো শোনা যাচ্ছে ----
"মহুল বনে তোর সনে দেখা হ'ল ফাগুনে ।
আমি ধু'ড়সে গেলি ,
আমি পুড়ে হলি লো তোর রূপের আগুনে ।
 মহুলবনে ।" 
   ও কে ? ও কি পুরুলিয়া-বৃন্দাবনের নব অনুরাগিণী রাধা ?
 "বয়সে কিশোরী, রাজার ঝিয়ারি তাহে কুলবধু বালা" সে যেন ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলছে -"
      "ওগো মনঝরি,
        আমি যে শিশিরের জালি
        সিঁদুরের বুঁদি
        পরের রাণী গো
        কী করি ?
         কি করে আজ মনঝরি-আঁঠা পাইরাব !!!"

       ঠিক তখনই যেন দূর আকাশের চাঁদের ভেতর কদম্ব বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা ভেদ করে ভেসে আসছে কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ ---
"রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্।
 ন করু নিতম্বিনি গমনবিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম্ ।।
 ধীরে সমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী ।
পিনপয়োধরপরিসরমর্দনচঞ্চলকরযুগশালী ।।"
____________________________




              আমাদের বই







 



সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : তপন পাত্র
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ-৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল- uttamklp@gmail.com
             

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪