দ্বিতীয় বর্ষ ।। প্রথম ওয়েব সংস্করণ ।। ১২ বৈশাখ ১৪২৮ ।। ২৬ এপ্রিল ২০২১
শ্রদ্ধার্ঘ্য
আমার জন্মের কোন শেষ নেই
***** ***** ***** *****
ছায়ার প্রয়োজন হলে বৃক্ষের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। সে ছায়া বটের হলে সোনায় সোহাগা। কিন্তু বিশাল এক বটবৃক্ষের পতন অনেকেরই ছায়া ছিনিয়ে নেয় অনিবার্য কারণেই।
বাংলা সাহিত্য জগতে সে রকমই এক বটবৃক্ষের পতন ঘটে গেল অভিশপ্ত করোনা কালে।
শঙ্খ ঘোষ, তিনি শুধু কবি ছিলেন না। ছিলেন অনেক অনেক শিল্প-সাহিত্যিক ও শিল্প-সাহিত্য মনা মানুষের অভিভাবক। পথ প্রদর্শক। সু-চিন্তক এবং সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন অসম্ভব ভালো মানুষ।
অতিথি বৎসল এই বটবৃক্ষ নিজের সুশীতল ছায়া থেকে কাউকেই বঞ্চিত করেনি। বরং ডাল বিস্তার করে দিয়েছে তাদের দিকে।
দু'বছর আগে আমি যখন সেই বৃক্ষের ছায়ায় গিয়ে শেষ বারের মতো দাঁড়িয়েছিলাম। অসম্ভব স্নেহের ছায়া পেয়েছিলাম আমি। কিন্তু ওনার বার্ধক্যজনিত কারণে স্পষ্ট করে কোনো কথা শুনতে পাইনি সেদিন। ফলে সেই বৃক্ষের পতনের মূলে কোভিড নাইন্টিন একথা মানতে রাজি নয় আমি। আসলে বার্ধক্যজনিত কারণেই আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হলো হয়তো।
চলে যাওয়ার কারণ যাই হোক, শঙ্খ ঘোষ বাঙালি মননে যে বীজ ছড়িয়ে গেলেন, সব সময় সেই বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকবে নীল আকাশের নিচে।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
____________________________
শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা
সন্দীপ মুখোপাধ্যায়
ঘর, বাড়ি, আঙিনা
সমস্ত সন্তর্পণে ছেড়ে দিয়ে মামিমা
ভেজা পায়ে চ'লে গেল খালের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে--
ছড়ানো পালক, কেউ জানে না!
নিহিত পাতাল ছায়া'-র এই বিষাদমন্হর কবিতার কাছে বারবার ফিরে আসি। অনপনেয় শঙ্খ ঘোষের এই চার পঙক্তির কবিতার আবেশ। সামাজিক বিস্রস্ততার প্রতিস্পর্ধী কবিতার সমান্তরালে বেদনার চাপা স্বর তাঁর কবিতা থেকে উৎসারিত। আর এই যে শূন্যতার ভাষা হিমেনেসের মতো শঙ্খ ঘোষও বারবার বলেন এই কবিতার গোপনরহস্যও তাকে ধরে রাখে।
প্রথম পঙক্তির তিনটি শব্দঃ ঘর, বাড়ি, আঙিনা থাকা আর চলে যাওয়ার মধ্যবর্তী একটা পরিসর যেন রচনা করলো। আর সেই পরিসরের উপর দিয়ে চলে যায় অরবতাময় এক শূন্যতা। দ্বিতীয় পঙক্তিতে কবি জানালেন রাঙা মামিমার প্রতিদিনজড়ানো এই প্রসার ছেড়ে তিনি ভেজা পায়ে অন্যপারের সাঁকো পার হয়ে চলে যান। সাঁকোটি খালের ওপারে, আর এই খালের সঙ্গে ভেজা পা-র এক দৃশ্যময় অনুষঙ্গ জেগে উঠলো। রাঙামামিমা-র সন্তর্পণ,সাবধানী,নিঃশব্দ এই চলে যাওয়া যেন চলচ্চিত্রের কয়েকটি দৃশ্যসাযুজ্য নিয়ে এল। ওপারে শব্দটি একটি অসীমের সঞ্চার নিয়ে এল। অনির্দেশ্যতার এক ইংগিত পাঠকের ভিতরে উঠলো জেগে। এরপর একটি বিরতি। শেষ পঙক্তির ছড়ানো পালক একই সঙ্গে উড়ে যাওয়া কবুুতর আর স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাওয়া মামিমার প্রতীক। বেদনাঘন একটি সংহত ভাষাচিত্র। আর তাঁর উদ্দেশ্য যে অজানা সেটি মৃত্যুর ইংগিতে প্রতিভাসিত।
শঙ্খ ঘোষের চিরায়মান উপস্থিতি যে কবিতাগুলির মধ্যে অপরিম্লান তারই একটির মধ্যে প্রণত।
সেইসব খেলা আর নেই
তপন পাত্র
মানব সভ্যতার সূচনালগ্নেই খেলাধুলার উৎপত্তি । যে সকল খেলা কোনও নির্দিষ্ট ভূগোল সীমায় সীমাবদ্ধ নয়, দেশ কাল নির্বিশেষে বহু বিস্তৃত এলাকায় প্রচলিত, যেগুলির সর্বজনস্বীকৃত নির্দিষ্ট লিখিত নিয়মকানুন রয়েছে সেগুলি উচ্চতর ক্রীড়া । আর যেসকল ক্রীড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বংশানুক্রমে ছেলেমেয়েদের মধ্যে চারিয়ে যায়, যেগুলির নিয়মকানুন সম্পর্কে নির্দিষ্ট লিখিত নির্দেশ নেই , মুখে মুখেই বেঁচে থাকে , যেগুলি অধিকতর চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম এবং সহজ সুন্দর; মানসিক ও শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির সহায়ক সেগুলি লোকক্রীড়া নামে পরিচিত।
লোকক্রীড়াগুলি সাধারণত লৌকিকতা বর্জিত, অনাড়ম্বর, ঘরোয়া এবং আটপৌরে । সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা আজও লোকসংস্কৃতি, লোকযানের পীঠস্থান । এখানে লোকক্রীড়ারও প্রাচুর্য ছিল একসময় । তবে ধীরে ধীরে এখন সেগুলি লুপ্ত হতে বসেছে ।
পুরুলিয়ার লোকক্রীড়াগুলির সাধারণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল ----
এগুলি গ্রামীণ পরিমণ্ডলে উদ্ভূত এবং এগুলির খেলোয়াড়েরা সাধারণ শ্রমজীবী পরিবারের সদস্য ।
দ্বিতীয়ত, লোকক্রীড়াগুলিতে নিয়মের কঠোরতা থাকে না ।
তৃতীয়ত, এই ক্রীড়া গুলিতে সুনির্দিষ্ট কোন পোশাক ব্যবহৃত হয় না ।
চতুর্থত, এইসব খেলায় সময়সীমা নির্ধারিত থাকে না ।
পঞ্চমত, লোকক্রীড়ায় ক্রীড়া সরঞ্জাম এর পরিবর্তে পেশী সঞ্চালনের ওপর জোর দেওয়া হয় বেশি ।
ষষ্ঠত, প্রায় প্রত্যেকটি লোকক্রীড়ায় অসফল খেলুড়েকে ফুড়ি, হাঁড়ি , কানি , ডোমনি, চোর ইত্যাদি বলা হয় এবং নির্দিষ্ট খেলার নিয়ম অনুসারে তাকে শাস্তি পেতে হয় ।
পুরুলিয়ার লোকক্রীড়াগুলিকে লিঙ্গ ভেদে দু'ভাগে ভাগ করা হয় --- পুরুষ এবং নারী । এছাড়া স্থান ও পরিবেশগত দিক দিয়েও দু'টি বিভাগ রয়েছে যেমন বসে খেলা বা ঘরের খেলা আর না বসে খেলা বা বাইরের খেলা ।
বসে খেলা বা ঘরের খেলা, যেগুলি সাধারণত পুরুষেরা খেলে সেগুলি হল -- বাঘচাইল, চাইতপাইত , ইকিড় মিকিড় , রাম-লক্ষণ , লাউ কাটাকাটি , পঁদ জুবাজুবি, ডাসকোষ ইত্যাদি । আর ঘরে বসে মহিলাদের খেলাগুলি হল কড়ি খেলা , পুতুল খেলা, সাতগাঁতিয়া , রসকষ, ইকিড় মিকিড়, ঘরকন্না বা রান্নাপাতি এবং রুমাল চুরি প্রভৃতি ।
অন্যদিকে না বসে খেলা বা বাইরের খেলা যেগুলি পুরুষেরা বা ছেলেরা খেলে সেগুলি হল গুটি খেলা বা মার্বেল খেলা, বুড়ি বসন্ত, টির ডাং, মশা খেদা, ভেজা বিঁধা , মোরগ লড়াই, কুমির ডাঙ্গা , গদা দিয়াদিয়ি,চোর পুলিশ, কান ঝুনঝুন, কানামাছি , মাংস চুরি , সাঁতার দেওয়া , চাখা চালানো, টোকচেরা ইত্যাদি । এই পর্যায়ের মেয়েদের খেলা গুলি হলো কিতকিত, এলাটিং বেলাটিং , সীতা হরণ,বউ ব'সাবসি ,হাড়িভাঙ্গা ,নাম পাতানো, বিড়াল-ইঁদুর , লুকলুকানি, টুনটুনি পাখি, কানামাছি ও বুড়ি ছোঁয়া ইত্যাদি ।
পুরুলিয়ার লোকক্রীড়াগুলি লোক আঙ্গিকে সংগঠিত । খেলোয়াড় নারী-পুরুষ বা বালক-বালিকারা গ্রামীণ, স্বাভাবিক কারণেই গ্রামের মাঠ অথবা ফসল ওঠা অমসৃণ জমি অথবা আটচালা, শিবথান, নদীর তীর , পুকুরের পাড়, জল শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের গাভায় খেলাগুলি অনুষ্ঠিত হয় ।
এখন কয়েকটি অধিকতর ও জনপ্রিয় খেলার ধরনধারণ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। প্রথমেই আসে গুটি খেলা বা মার্বেল খেলার প্রসঙ্গ । গুটি আঞ্চলিক ভাষায় "গুঠি" হলো কাঁচ বা শঙ্খ বা সিমেন্ট দিয়ে তৈরি গোলাকার বস্তু । এই গুটি দু' ভাবে খেলা হয় । কাঁচের মার্বেলের খেলায় হার-জিতের ব্যাপার থাকে । আর শাঁখের মার্বেল যা আকারে একটু বড় হয় তা নিয়ে খেলায় হওয়ার শাস্তি পাওয়ার ব্যাপার থাকে এর নাম টোকচেরিয়া বা টোক চে'রা । খেলোয়াড় বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল মাটিতে রেখে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীর সাহায্যে বাম হাতের তর্জনী কে কাজে লাগিয়ে নির্দিষ্ট আঘাত করে । মুখে বুলি আওড়ায় ---"টোকটি মাই চেরাটি মাই ভে'রাটি..." বেশ মজার খেলা এটি । কোন গাছের তলায়, গ্রামের পথে, মন্দির বা আটচালার পাশে ছেলেরা এই খেলা খেলে ।
"বাঘ চাইল" দু'জনের খেলা । একজন বাঘ অন্যজন ছাগলের প্রতিনিধি। স্থান ভেদে জেলার কোন জায়গায় এর নাম "বাঘ-ছাগল" কোথাও বলে "বাঘ বন্দি"। খেলাটিতে চারটে বাঘ ও কুড়িটি ছাগল থাকে। একটি নির্দিষ্ট ছক আঁকা হয়। তাতে পঁচিশটি ঘর থাকে। বাঘ হিসাবে বড় আকারের কোন কাঠ টুকরো কিংবা পাথরের টুকরো নেওয়া হয় বাঘের প্রতীক হিসাবে। তুলনামূলকভাবে ছোট কুড়িটি কাঠের টুকরো বা পাথরের টুকরো নেওয়া হয় ছাগলের প্রতিনিধি হিসাবে । খেলাটি থেকে বোঝা যায় যে আদিম যুগের বন জঙ্গল ঘেরা স্থানে কিভাবে সঙ্গবদ্ধ হয়ে হিংস্র পশুকে জব্দ করতে হয় , তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে এই খেলাটি তে।
ছাঁতপাত খেলাটিও দু'জনের খেলা । নির্দিষ্ট ছককাটা ঘরে কাগজের টুকরো ,কড়ি, ছোট পাথর, তেঁতুল বীজ খোলামকুচি , চুড়ি ভাঙ্গা প্রভৃতির সাহায্যে এই খেলাটি সম্পন্ন হয় ।
ইকিড় মিকিড় খেলাটি খেলে আট-দশজন বালক-বালিকা মিলে । তার মধ্যে একজন ছড়া বলে বা গণনা করে । অন্যজনের তাদের দুই হাতের তালু মাটির উপর রাখে । আর যে ছড়া কাটে বা গণনা করে সে এক হাত মাটিতে রাখে অন্য হাত দিয়ে প্রত্যেকের হাতে ডান দিক থেকে মৃদু চিমটি কাটে। মুখে বলে ---"ইকিড় মিকিড় চাম চিকিড় চাম কৌটা মজুমদার ..."।
এইভাবে আরও নানা বাক্য বিনিময় এবং অঙ্গভঙ্গি চলতে থাকে । প্রশ্ন-উত্তরের মধ্য দিয়ে খেলাটি এগিয়ে যায় । যতদূর জানা যায় ভারতচন্দ্রের "অন্নদামঙ্গলে"র কাহিনীতে যে ভবানন্দ মজুমদারের কথা ও কাহিনী রয়েছে তার সঙ্গে মিল রয়েছে এই খেলার। দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক এবং অত্যাচারী মানসিংহ ভবানন্দের অপকীর্তির পটভূমিতে এই ছড়াটি রচিত হয়েছে । হয়তো তার আগেও খেলাটির প্রচলন ছিল । কিন্তু এখান থেকে ছড়াটি নবতর মাত্রা পেয়ে গেছে । এটিকে বিশ্বাসঘাতকতার দলিল রূপে দেখা হয় ।
লাউ কাটাকাটি খেলাটি অনেকটাই বাঘছাগল খেলার মতো । পঁদ জুবাজুবি খেলাটি দু'জনের । দুটি করে গুটি দু'জনের হাতে থাকে । এটি নিছক বিনোদনের খেলা । এছাড়া ডাসকোষ, কড়িখেলা, সাতগাছিয়া, পোকা বাছাবাছি, রুমালচুরি, সীতা হরণ , টির-ডাং , মশা খেদা , ভেজা বিঁধা ,মোরগ লড়াই , গদা দিয়াদিয়ি সহ অসংখ্য খেলায় যেমন সমাজ ভাবনার ছবি রয়েছে তেমনি সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ মনন চিন্তন গঠনেরও সহায়ক এগুলি। এগুলিতে জমিদারি শাসন ব্যবস্থা , মধ্যস্বত্বভোগ, বিদেশি শাসকদের তাড়ানোর সংগ্রাম প্রভৃতির প্রভাব রয়েছে ।
কিন্তু দিন যতো এগোচ্ছে এই লোকক্রীড়াগুলি ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। পুরুলিয়ার গ্রামেগঞ্জে শিব মন্দিরের পাশে , তেঁতুলতলে, কুমারী-কাঁসাই-টটকো নদীর ধারে আর দেখা যায় না এই সব গ্রামীণ খেলোয়ারদের । এখন হাতে তাদের সেলফোন, মনে পাপজি'র নেশা । যাদের হাতে এখনও সেলফোন আসেনি, তাদের কাঁধে ক্রিকেটের ব্যয়বহুল সরঞ্জাম । আগামী প্রজন্মকে হাজার মনস্তাপে মাথা ঠুকেও বোঝানো যাবে না লোকক্রীড়া কী ও কেন ?
করোনা
নির্মল হালদার
যে পরিবারে করোনা এসেছে। সেই পরিবারটি সমাজের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে পড়ছে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমিত করে। চিকিৎসাবিজ্ঞান তাই বলছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দেবো?
আমরা করোনা রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করবো না?কাছে যাবো না?
নিজেদের স্বার্থে নিজেরা মগ্ন হয়ে থাকি। কোনভাবেই নিজের স্বার্থকে ক্ষুন্ন করতে চাই না। কোনভাবেই বিপদের দিকে পা বাড়াতে চাই না। একবার ভেবেও দেখি না যে আমার স্বার্থমগ্নতা একজনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
করোনা সংক্রমণ চতুর্দিকে ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে। আমরাও ভীত হয়ে করোনা রোগীর পাশে
যেতে চাইছি না। যদি আমারও হয় ?
যে পরিবারে করোনার সংক্রমণ ঘটেছে, সেই পরিবারের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে আমাদের ভয়।যদি আমার হয়?
এ থেকে যা ঘটছে তা হলো
পরিবারটি ব্রাত্য হয়ে উঠছে।
অসহায় হয়ে উঠছে। একা হয়ে উঠছে।
এখানেই ভাববার বিষয়।
আমাদের কী করনীয়?
অবশ্যই আমি সতর্কতা অবলম্বন করে রুগীর কাছে যাবো।
করোনা ভাইরাসের নামে মানবাধিকার লঙঘন হচ্ছে বারবার। আমরা কি নজর দেবো না ? খেয়াল করবো না
যে আমার প্রতিবেশী করোনা
সংক্রমণে অসহায় বোধ করছে।
তাকে দেখভাল করার কেউ নেই।
তাকে সেবা করার শুশ্রূষা করার
দায়িত্ব আমাদেরও আছে।
ভাববার সময় এসেছে।
করোনার নামে এক একটা পরিবারকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারি কি?
পুরুলিয়ার পলাশ পরব
মধূপর্ণা কর্মকার
ধর্ম নিয়ে হানাহানি আর ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বিচিত্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কূটচক্র দেখতে দেখতে যখন আমাদের মন আর মনন বিরক্ত হয়ে উঠেছে তখন ঋতুউৎসব গুলিই একমাত্র স্বস্তির আশ্বাস বয়ে আনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে ঋতুউৎসবের যে ধারা প্রচলন করেছিলেন তা আমাদের প্রকৃতি সংলগ্নতার পাঠ দেয়। ধর্মীয় মেরুকরণের এই সময়ে দাঁড়িয়ে ঋতুউৎসবে যােগ দিতে পারার মত অনাবিল আর কিছু হতে পারে না হয় তাে। পুরুলিয়ার কবি নির্মল হালদার, আমাদের নির্মলদার তত্ত্বাবধানে “অনিকেতের বন্ধুরা" বসন্তে আয়ােজন করে “পলাশ পরব”। পুরুলিয়ার প্রকৃতি, জনজীবন জন্ম দিয়েছে ও নির্মাণ করেছে যে কবিকে, তাঁর গড়ে তােলা সংস্কৃতির ধারাটিও সেই রসদে পুষ্ট। মৌলিকত্ব আর নিজস্বতা এই সাংস্কৃতিক বাতাবরণকে করেছে অনাড়ম্বর মানবিকতার কাছাকাছি, দিয়েছে স্বতন্ত্র মাত্রা।
পুরুলিয়ার সঙ্গে যােগাযােগের আসলে শুরু আছে, শেষ নেই। এই আত্মীয়তার গতি এক রৈখিক। শুরু হয় তারপর নিজস্ব চলনে বাড়তে থাকে, গভীর হয়। পরিসর বিস্তৃত হয়। রাজধানীর প্রচারসর্বস্বতা আর আত্মহারা উজ্জ্বল আলাে থেকে অনেকদূরে রুখা শুখা মাটির কাছে একান্তে বসতে পারার মত অবসর তৈরি করে এই পলাশ পরব। আনন্দ আর ফুর্তির মধ্যে পার্থক্য যখন প্রায় গুলিয়ে যাচ্ছে, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় যখন মানুষের মনকে আর থিতু হতে দিচ্ছে না, দেউলেপনার অসুখে আক্রান্ত যখন আমরা সবাই, অন্তঃসারশূন্যতার উদযাপনে মসগুল থাকাই যখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে বেঁচে থাকার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তখন পলাশ পরবের ডাক আন্তরিকতার পাঠ দেয়, নির্মলদার সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা চারা গাছ গুলাে - পুরুলিয়ার ভুমিপূত্রকন্যাদের সঙ্গে কয়েকটা দিন অদ্ভুত সুন্দর ভাবে কাটে। চেতনার ধুলােবালি সাফ হয়ে যায়। সান্নিধ্যের অকৃত্রিমতায় কয়েকদিন কেটে যায়।
ফুটিয়ারী জলাধারের পাশে অহল্যাভূমি অতিথি নিবাসে এপ্রিলের তিন চার তারিখ আয়ােজিত হয়েছিল পলাশ পরব। অনুষ্ঠানের প্রতিটি গানে পুরুলিয়ার মাটির গন্ধ। ঝুমুরের কিংবদন্তী শিল্পী কিরীটি মাহাতাের গান, সন্ধায় ছৌ নাচ ইত্যাদি আস্বাদনের অবকাশ পলাশ পরবকে করে তুলেছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ। একটি জনজীবনকে কতটা গভীর ভাবে
পর্যবেক্ষন ও উপলব্ধি করতে পারলে সেখান থেকে একটা উৎসবের জন্ম দেওয়া যায় যার প্রতিটি মুহুর্তে সেখানকার মানুষের বেঁচে থাকার, জীবনচর্যার নির্যাস মিশে থাকে। পুঁজিবাদের থাবার নীচে যখন সমস্তই নিজস্বতা হারিয়ে ক্রমে বিকট হয়ে উঠছে আমাদের উদযাপনের ইচ্ছা আর প্রক্রিয়া, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে পলাশ পরব ভিন্ন আবেদন নিয়ে একাত্মতার কাছাকাছি নিয়ে যায়।
চঞ্চল দুবের কবিতা
১.
পুনর্জন্মের আয়োজন
তোমাকে পুনর্জন্মের জন্য প্রস্তুত করতে
আমার সমস্ত আয়োজন।
সমস্ত আয়োজনের কেন্দ্রে আয়ুক্ষয় বিষয়ক
স্বগত-সংলাপে যে আলেখ্য রচিত হয়
তার উপজীব্যে কোথাও আমি নেই।
কেবল তোমার পিপাসা, পরবাসী হাওয়ার স্পর্শে
তোমার ধৈর্যহীন প্রতিক্ষা পুনর্জন্মের জন্য
তীর্থের কাক হয়ে শৃঙ্খলাবর্জিত কামনায়
অনর্গল চঞ্চু ঘষে দায়বদ্ধ বৃক্ষের শাখায়।
২.
দ্বৈত সত্তা
এক হাতে ধরেছ শান্তি, অন্য হাতে অনন্ত দহন,
যে আছে বাহিরে আর যাকে তুমি রেখেছো অন্দরে
কখনো একাত্ম হয়ে মিলে যায় সেই দুই জন।
তুমিই মিলাও আর দু'জনের মাঝখানে ওঠাও প্রাচীর,
দুইটি সত্তা নিয়ে কখনো শান্ত নদী, কখনো বা ঝড় ;
অদৃশ্য মরমি ছায়া ডেকে রাখে তাপদগ্ধ তোমার শরীর।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
চাষবাস
পরিযায়ী চাল বছরে আসে একটি বার,
সাধুবেশে দুষ্কৃতিও আসে না
ভিক্ষার অজুহাতও বুঝি বাড়ন্ত
হত্যায় নয় যদি প্রপঞ্চে ধরা দেয় মায়ামৃগ
তার আহার জোগাবো কী করে!
চাষবাসই আমার স্বামী, আমার পিতা
বৃষ্টির পিছনে ছুটছেন তিনি,
বৃষ্টির তীরে বিদ্ধ হতেই বুক পেতে দেওয়া
বরষার গলায় দূর দিগন্তে
প্রিয় কণ্ঠ শোনার উপবাসী আমি
ইদানিং আর কিছু নেই
শুধু পায়রা-গুমরানো দুপুর
আমাকেই পাতে পেড়ে চঞ্চু চালিয়ে
কানে ঢেলে দেয় সুদীর্ঘ রোদন
২.
সীমাবদ্ধ
ভালোবাসতে ময়ূর-পেখম লাগে না
গো-বন্দনায় কামধেনু হন উত্যক্ত
চন্দন-চর্চাও ছুঁতে পারে না ললাটের জ্বর -যাতনা
বাঁশবনের পা ছুঁয়ে গেল জোয়ারের জল,
এই দৃশ্যটিকে প্রণাম বলে মনে হলে
আমার চোখের প্রদোষ মাপ করে দিও
পা যে মলিন, শুকনো নদীর বালি থেকে
সমস্ত পায়ের ছাপ কুড়িয়ে রাখলেও মিলবে না আদম সুমারি
আকাশের দিকেও পা তোলা পাপ বলে
আকাশকে দেখাতে পারি না
পায়ের তলায় লেগে থাকা স্বর্ণরেণু
তিতিরদের গ্ৰাম
রামকুমার আচার্য
অবিরাম ডাকছে
নানা শব্দে, নানা ডাল থেকে
রাত যখন ফুল ফোটায়
ওরাই দেখে,
ওরাই শোনে
ফুল ফোটার শব্দ...
ওরা অবিরাম ডাকছে
আমাকে তোমাকে নয়
চড়ুই - তিতিরকে
কাক - কোকিলকে...
এমন ভোরে নুয়ে পড়তে
ইচ্ছে করে,
নির্জন ধূলোর পথে
শিশির কুড়োতে কুড়োতে
রাখাল হেঁটে যাবে একা
তোমার চোখের পাতায়
এঁকে আসবো সকাল
আড়াল
অমিত সাহা
সিদ্ধান্তে লুকোনাে আছে জিজ্ঞাসার জন্মদাগ
আর আছে বিস্ময়-সাধনা।
সিঁদুরে জড়ানাে থাকে সধবা সংগীত!
বিপন্ন হয়েছে যে আড়াল তাকে রােজ দেখি
জন্মপাপ বুকে নিয়ে ছায়ার নিকটে গিয়ে
সূর্যবমি করে...
গাছের তলায় বসে পাতার মর্মরে নিঃস্ব হয় রােদ,
নিঃস্ব হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে
নিজেকে সরিয়ে নিলে সঙ্গী হয় বিপন্ন আড়াল!
সিদ্ধান্তের কাছে গিয়ে দেখি
তর্কপ্রিয় জিজ্ঞাসাসমূহ কতগুলি সম্ভাবনা নিয়ে
সিঁদুরে সাজাচ্ছে নিজেদের..
আর শুকনাে পাতায় স্বরলিপি বাঁধছে বিধাতা-বিস্ময়!
উৎপল দাসের কবিতা
১.
ফিরে দেখা
বিচ্ছিন্নতার গ্রাসে ক্রমশ শেষ হওয়া সম্পর্ক,
ধূলোর আস্তরণের মতো
কোথাও জমে থাকে।
ভয়াবহ রূপ নিয়ে ফিরে আসা মহামারী।
নির্বাচন হারুক বা জিতুক।
বিস্তীর্ণ নীরবতা ভেঙে,
আমাদের দেখা হবে হৈ-হুল্লোড়ে...
২.
শাসন
সব লেখা ছাপা হলে,
কলমের দিকে তাকাতাম না আর।
শূন্যে দাঁড়াও শূন্যে।
হে ভাসমান --
দাউদাউ জ্বলছে আগুন।
এলোপাতাড়ি চিতায় পুড়ছে কারা!
তোমাকে বলছিলাম,
শাসন করতে এসো এই বুকে
৩.
প্রাকৃতিক
এবার কাগজ ফুলের ডালে টুনটুনিরা বাসা বেঁধে ছিল। সে দেখে বাচ্চাদের কি আনন্দ। কয়েকদিন যখন টুনটুনিরা মুখে করে খাবার এনে ছানাদের খাওয়াতে লাগলো, মেয়েটা তা দেখে আনন্দে তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো। আরো কয়েকদিন পর সকাল বেলায় ছানাগুলি বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। একটা বেশ ভালো উড়তে পারলো আর একটা এডাল সেডাল হতে থাকলো। দুপুরের পর খুব ঝড়বৃষ্টি থামলে দেখি বাসাটা ভেঙে পড়ে আছে। আমারা মেঘ দেখে বুঝতে পারি ঝড়বৃষ্টির কথা। আর পাখিরা ---
স্যানিটাইজার
সুপ্রিয় দেওঘরিয়া
শব্দ বাক্যে সামাজিক দূরত্ব
অনুভূতিতে সুক্ষ্ম মাস্ক
চিন্তাগুলো তবু ভিড় করে
যেন অবাধ্য জনতা,
লাঠি খায়,
মরার ভয় নেই, বেহায়াপ্রায়
চিন্তা-অনুভূতি- শব্দে
নিয়মবিধি -
থেমে-থেমে কথা
ভেবে-ভেবে কৃত্রিম প্রকাশ,
শুধু অগোচরে বের হয় দীর্ঘশ্বাস
তার কোনো স্যানিটাইজার নেই!
শাপলা মেয়ে
সৌরভ লায়েক
বড্ডো এখন বেখেয়ালী বুঝতে পারি বেশ
আমার তো সেই কয়েক নদী একমাত্র দেশ
একটি জীবন শিকল বাঁধা প্রলুব্ধকর হাওয়া
জড়িয়ে ছিঁড়ে সময় জুড়ে দুঃখ শুধু পাওয়া ।
কাল বোশেখের দিনটি ছিল কৃষ্ণ কালো মেঘ
আমার ঘরের চাল উড়েছে স্তব্ধ ভাবাবেগ
ভিজলো মাটি বইলো হাওয়া মাতাল করা স্বাদ
গড়তে গিয়ে জীবন দেখি তছনছে বরবাদ ।
পলাশ পাড়ার শূণ্য জীবন দীর্ণ মাটির বুক
গ্রীষ্ম দিনে শাপলা মেয়ে বৃষ্টি হয়ে নামুক
ও কবুতর শাপলা দিঘির সামনে কবে এলে
মীরা যেদিন গাইলো ভজন শান্ত ম্যায়ফিলে ।
উঠলো ফুটে মাধবীলতা কাঞ্চন আর বেলি
বললো আমায় শাপলা মেয়ে রাগ করে বেশ গেলি
আমি তখন বলবো কী আর দ্রীম্ দ্রীম্ দ্রীম্ বুক
রাধা মীরা একটি নারী শাপলা হয়ে নামুক ।
ফুরুস ফুলের মধু
সায়ন্তন ধর
সেদিনও ছিল এমন পয়লা বৈশাখ, দিগন্ত থেকে দিগন্তে কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছি বর্ষবরণের ডাক, চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী যে দেহ তাতে এক সমুদ্র আনন্দে উত্তাল এক মনের বাস। কে যেন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কেবলি বলে চলেছে, "মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা।" অথচ এ যে শনিবারের বারবেলা, মন ভাবল তাতে কি, সব দিন সব বার সমান। চলার পথেই মিলবে সব সমাধান। ডুয়ার্সের আনাচে-কানাচে পর্যটন স্থান, সেতো চিরন্তন পুস্তক আমার, যার খুব সামান্যই অপঠিত বলা যায়। মানচিত্রে চোখ বুলোই, ঈশান, অগ্নি, নৈঋত, বায়ু কোন দিক বেছে নিই- রূপকথার রাজকন্যের বিশাল কেশদামের মত রাত্রি যেখানে, মাথায় পরিহিত নক্ষত্রের মুকুট যতই শোভিত হোক শ্বাপদসংকুল অরন্যের ছমছমে পরিবেশে জানি সাথ দেবে না কেউ। অগম্য স্থানে দিনে দিনে ফিরে আসাই শ্রেয়। ভাঁট ফুল, অ্যাজারেটাম, ল্যান্টানা ক্যামারার ফুলেরা জানি আমার এই ঝটিকা সফরে বেজায় খুশি হবে, তাদের সাথে একসাথে প্রশ্বাসে ভরে নেবো গোলাপি ফুসফুস দুটি। দৃষ্টি আটকে গেল রম্ভিতে।
ডিমভাঙ্গা রোদ্দুরে নিত্য যৌবনা তিস্তার রুপোলী জলরাশির ছলাৎ ছল শব্দ যেন কর্ণকুহরে প্রবেশ করল। তিস্তা লো ড্যাম থ্রী ও তার আশেপাশের সৌন্দর্য যেন মূর্তিমান স্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে এই মুহূর্তে আমার চারপাশে। গাছেরাও যেন পাতা খসাতে ভুলে গেছে। বাতাসে ভেসে এলো আবার সেই ফিসফিসানি-সকাল সকাল জলশহর থেকে বাস ধরে শিলিগুড়ি, তেনজিং নরগে টার্মিনাস থেকে অগ্রিম টিকিট কেটে কালিম্পং গামী স্টেট বাসে একেবারে রম্ভি চলে যাও। এ পথে সেবক, কালিঝোরা আকাশ ভরা আলোয়, মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে অজস্রবার দেখা তোমার। এ ছবিতে কোনদিন ধুলো জমে না, শ্যাওলা জন্মে না। তাই বারবার দেখতে ভালো লাগে যে। এক ছবি কতোবার তুলেছ খেয়াল আছে? কন্ডাক্টরবাবুকে বলে সামনের সিটটা দখল করে নিতে, আর ছবি তোলার আনন্দে মশগুল তুমি, হাওয়ার মুখে পালের মত ভরপুর খুশিতে। চোখের সামনে থেকে পর্দা উঠে গেল। কালিঝোরা থেকে রম্ভি বারো কিমি পথ, ধীরে ধীরে শহরের জ্যামজট পেরিয়ে শালুগাড়া চেকপোস্ট, এস. এস. বি. ক্যাম্প, বেঙ্গল সাফারির শোরিয়া পার্ক … ঢং ঢং ঢং, ঘন্টা বাজে, বেলা যায়। পেটের নিচে তুলোর বালিশটা টেনে নিই ভালো করে, মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরছে ঘরংঘর, ঘরংঘর, বড় বিরক্তিকর। জানালায় ঝুলানো ম্যাজেন্টা রঙের সিল্কের পর্দাটা সরিয়ে দিতেই ঘোড়ানিমের মাথায় সদ্য গজিয়ে ওঠা ঝিরঝির পাতার সবুজ আন্দোলন স্বস্তি দিল খানিক। শোরিয়া পার্ক ছাড়িয়ে মাইলের হিসেবে গড়ে ওঠা জনপদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, যেখানে জ্যোৎস্না রাতে বৈকুণ্ঠপুরের অরণ্যে হাতির দল রাস্তা পার হয়ে যায় জল খেতে। মন যে বারে বারে ফিরে যেতে চায় সেখানে। সেই বন সেই রাত যেখানে তিস্তা তোমার ডান হাত ধরে (পাহাড়ি রাস্তায় পাকদণ্ডী ধরে) পথ হাঁটবে তোমার সাথে। ধীরে ধীরে সামনে আসবে বহুপরিচিত করোনেশন ব্রিজ, গোলাপি হলুদ রঙে রাঙা, সবুজ শাড়িতে তিস্তা তখন টুক করে লুকিয়ে পড়বে ব্রিজের নিচে। এন. এইচ. টেন - এর সমান্তরালে তিস্তার জলধারার হঠাৎ আত্মপ্রকাশ। এ যেন চঞ্চলা বালিকা। কিচ্ছুটি ভয় নেই প্রাণে। গুরুগম্ভীর পাহাড়ের সামনে সূর্যের রশ্মি রেখায় সোনালী ঢেউ তুলে এ কোন লাজহীনা? বাতাস যার বয়ে চলার ছন্দে স্বনিত হয়ে ওঠে বারবার? ছলাৎ ছল জল সোহাগী পাহাড়ের সানুদেশে সবুজ নীলে সেলাজিনেল্লার আল্পনা। গা বেয়ে উঠেছে লাইগোডিয়ামের দেহ বল্লরী। আমি তো দেখেছি শীত বসন্ত শেষে বৈশাখে পাহাড়ের রূপ হয় অন্যরকম, পর্ণমোচীরা তখনো সাজেনি সবুজে, গৈরী বাঁশেরা শুকিয়ে লাল, ধস নামা জায়গাগুলো ভীষণ ন্যাড়া। ডুয়ার্স তখন পশ্চিম হিমালয়ের রূপ ধরে। 'অনুসন্ধান' শুটিংস্পর্শে ধন্য কালিঝোরার সেই পাহাড় কেটে তৈরি করা বাংলোখানির গায়ে ম্যাকারডোনিয়া প্রোকাম্বেন্সের হলুদ ফুল লতিয়ে উঠেছে, নক্ষত্রের নিঃশ্বাস ফেলা অন্ধকারেও যা স্বপ্রভা। গোর্খা দম্পতির একখণ্ড উঠোন সে ফুলের বুনো সৌরভে মাতোয়ারা। কাঁচা সোনার কাঁকন পরা হাতের আন্দোলনে মৃদু রিন রিন শব্দে রাতের স্তব্ধতা সচকিত খানিক। অদূরে ড্যাম তৈরির কাজ চলছে জলবিদ্যুতের উৎপাদনের জন্য, পাহাড়ের ওপর বড় গাছগুলিতে বানর পরিবারের বসবাস। দিনের বেলা খাবারের আশায় রাস্তার ধারে তারা ভিড় জমায়, কেউ খেলে, কেউ উকুন বাছে আত্মীয়ার, কেউবা ব্যস্ত থাকে আহারে। বাঁ দিকের রাস্তায় ভীষণ চড়াই, সোজা উঠে গেছে লাটপাঞ্চারে। সার সার শাল সেগুন এর মেলা। সবুজ, হলুদ, লালচে, তামাটে নানা রঙে নানা বয়সী পাতায় রঙিন চারদিক। একি! লোহাপুল পেরিয়ে চলে এসেছি, রম্ভি গেল কোথায়? যাক, যা গেছে তা যাক, এগিয়ে চলো মন, রম্ভি না হলে তিস্তাবাজারই বা কম কি ? মাঝখানে আরো বারো কিমি পথ, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে গাছেরা মাথা নাড়ে, রোদ অজান্তেই পথ হারায়। আকাশটা নীল চোখে নির্বাক, খাদ জুড়ে দিনেও আগাছা অন্ধকার। ঝরা পালকের মতো আলতো টুকরো স্মৃতি ভাসমান, বড় আবছায়া। খটখটে শুকনো ঝোরার বেমানান অস্তিত্ব, লেজ ঝোলা ফার্নের রাজত্ব। এখানেও সবুজ রেশমি শাড়িতে তিস্তা। ব্রিজ পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় কালিম্পং, আরেকটি রাস্তা ধরে তাগদা-পেশক, শৈলরানী দার্জিলিং। গুনগুন করে উঠলো মন - হলুদ সবুজ হালকা লাল/পাহাড়ে ঝিঁঝিঁ ধরেছে তাল/ সবুজ শাড়ি, শান্ত নদী,/ রাগলে পরে ভীষণ অতি/ ডান দিকে পথ দার্জিলিং/ বাঁয়ে গেলেই কালিম্পং/ ব্রিজ জুড়েছে দুই পাহাড়/ এই দেখো, এটা তিস্তা বাজার। মুক্তি এখানে আকাশে বাতাসে, ব্রিজের অদূরেই পুরনো ঝুলনা সেতুর ভগ্নরূপ। এখনো দুদিকে লোহার স্ট্রাকচার বিদ্যমান। পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপ কাটা মখমলী মস ও শেওলাধরা সোপান খাঁড়া উঠে গেছে পরিত্যক্ত সাহেব কুঠিতে, সেই কুঠি ঘিরে ফলসা বনে শুকনো পাতা ছড়ানো, পাতার নিচে অজস্র লাল পিঁপড়ের বাসা। ভরদুপুরে সে এক ছমছমে পরিবেশ।
পাহাড়গুলি এক একটি গাছের লাইব্রেরি। পাতা উল্টে পড়ে ভালো লাগলে বাঁচানোর দাবী জানায় যেন। নিতে পারো, নতুবা রেখে দাও যত্নে। পছন্দ হল একটি 'ফুরুস' চারা, নিয়ে নিলাম তাকে। এরপর নেমে এলাম যেখানে পাহাড়ি তরুণী মোমো- চাওমিনের পসরা সাজিয়েছে। ঝাল ঝাল 'ডোলে খুরসানি'র চাটনি সহযোগে মোমো, মুখে লেগে রয়েছে তার স্বাদ আজও… দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে তিস্তা সবুজ শাড়ি ছেড়ে কালচে খয়েরি শাড়িটা পড়ে নেয়। সূর্য ও আকাশের সাথে এক অপূর্ব রং পরিবর্তনের খেলায় তখনো মেতে রয় পাহাড়ি কন্যা ত্রিস্রোতা। কিছুদূর নদীর ধার দিয়ে পথ চলা পাহাড়ি সহজ জীবনযাপন লক্ষ্য করতে করতে আপন মনে কিছুটা হাঁটা, এইতো ডুয়ার্স, এইতো আমার ঘর, এ আমার বাস্তুভিটে, এ নদী, আকাশ, বাতাস সব আমার, এ আলোতে আমার জীবনের স্পন্দন, এ বাতাসে আমি প্রত্যাশায় কান পাতি, সহজ নিঃশ্বাসে পাই বেঁচে থাকার আশ্বাস, এখানে আমার মুক্তি অনাবিল, অনাস্বাদিত জীবনবোধে পরিপূর্ণ হই বারে বারে…
পুনশ্চ, যাকে নিয়ে এসেছিলাম স্মৃতি হিসেবে, গত বসন্তে সে ফুল ফুটিয়েছে - মৌমাছিরা দলবেঁধে এসেছিল ফুরুস ফুলের মধু খেতে।
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহযোগিতায় : অনিকেতের বন্ধুরা
শঙ্খ ঘোষের ছবি : সন্দীপ কুমার
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনদারুণ লেখাগুলি, সুন্দর সম্পাদকীয় 💞💞
উত্তরমুছুনদারুণ লেখাগুলি, সুন্দর সম্পাদকীয় 💞💞
উত্তরমুছুনঅতি উচ্চ মানের সাহিত্য। তৃপ্তি পেলাম।
উত্তরমুছুনঅতি উচ্চ মানের সাহিত্য। তৃপ্তি পেলাম।
উত্তরমুছুনঅনবদ্য সংখ্যা। সম্পাদকীয় উচ্চারণ স্পর্শ করে। প্রত্যেকটি রচনাই স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।
উত্তরমুছুন