প্রথম বর্ষ ।। অষ্টাদশ ওয়েব সংস্করণ ।। ২৯ চৈত্র ১৪২৭ ।। ১২ এপ্রিল ২০২১




করোনা পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। থাবা বসাচ্ছে চারপাশে। প্রাণ যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের। অথচ সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার আগাম কোনো ব্যবস্হা না নিয়ে পড়ে আছে ভোটের অঙ্কে। 
            ভোট যে বড়ো বালাই। মানুষের প্রাণ ভোটের থেকে বেশি হতে যাবে কেন রাজনৈতিক দলের কাছে?
             গত বছর আগাম বৈদেশিক উড়ান বন্ধ করার ব্যবস্থা না নিয়ে যে ভুল করেছিল ভারত সরকার, এ বছরও স্থানীয়ভাবে আগাম লকডাউন ঘোষণা না করে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। যার ফল ভোগ করতে হবে আমাদের মতো অসহায় সাধারণ মানুষকে। হসপিটালের লাইনে দাঁড়াতে গেলে যাদেরকে সরিয়ে রাখা হয় নির্দিষ্ট দূরত্বে। ওষুধ দেওয়া হয় লম্বা একটা হাতাতে করে। আর অফিসিয়াল চত্বরে ঢোকার আগে বলে দেওয়া হয় মাক্স পরার কথা।
            শুধু কি তাই? কোরোনাকে ঠেকাতে বছরভর বন্ধ রাখা হয়েছে পড়াশোনার পীঠস্থানগুলি। অথচ ঢাক ঢোল বাজ বাজনা নিয়ে চলছে মিটিং মিছিল। সেক্ষেত্রে কি কোরোনা ছড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই? একেই বলে, 
    "দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি
     সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?"
              আমরা বহুকাল ধরে নীরব থেকে ধীরে ধীরে এমন সব চক্রান্তকারী রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছি যেখান থেকে বেরিয়ে আসা বর্তমান সময়ে প্রায় অসম্ভব।



উত্তম মাহাত, সম্পাদক

-----------------------------------------------




প্রয়োজন নেই শিকারের হিংস্রতা 

তপন পাত্র


কয়েকদিন আগে কথা হচ্ছিল এক পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে । তিনি সদ্য সুন্দরবন ঘুরে এসেছেন । স্বাভাবিকভাবেই অরণ্য, বন্যপ্রাণ সম্পর্কে ইদানীং কিঞ্চিৎ উৎসাহী । কথায় কথায় বললেন, "আচ্ছা , ওই দ্বীপটায় গিয়েছো কোনওদিন ? সাধারণ মানুষকে ওখানে যেতে দেয় না । তবে পয়সা দিলে কখনো-সখনো দিব্যি যাওয়া যায় ।" আমি অবাক হয়ে বললাম "সব জায়গায় যে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, এমনটাও তো নয় ! "


               সত্যিই তো নয় । আমরা কি আমাদের গৃহে আগত সকল অতিথিকেই শয়ন কক্ষে নিয়ে গিয়ে বসাই ? কই না তো । তাহলে অরণ্যের বেলায় সেই গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে না কেন ? কেন থাকবে না সেখানকার আদিম অধিবাসী বন্যপ্রাণীর নিজস্ব নিরালা নির্জন জগৎ ? 
             
                 ভেবে দেখলে মহাশূন্য ,পৃথিবী, পাতাল , বহির্বিশ্বের প্রতিটি সেন্টিমিটার জয় করার এক অদ্ভুত, উদ্ভট আকাঙ্ক্ষা রয়েছে মানুষের অন্তরের নিভৃত কোণে ; যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্যিই আশঙ্কার । আতঙ্কের । ঠিক এভাবেই অরন্যের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে প্রবেশ করতে করতে মানুষ আজ অরণ্যপ্রাণকে, নিসর্গ পরিবেশকে নিঃশেষ করে দিয়েছে । দিচ্ছে । এবং সেই ধ্বংসলীলা থামতেই চাইছে না ।

             এই ধ্বংসলীলার এক উপলক্ষ হল শিকার । মানুষের জীবনের উৎপত্তি থেকেই 'শিকার' শব্দটি জড়িয়ে রয়েছে । প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ শিকারের মাধ্যমেই জীবন যাপন করতো । কিন্তু ক্রমে তা প্রয়োজন থেকে নিছক শখে রূপান্তরিত হল । রাজরাজড়াদের আমলে , জমিদারদের কালে এমনকি এখনও এক শ্রেণীর মানুষ শিকার করে মানবাত্মার অশুভ সৌন্দর্যের তৃপ্তিতে ।


               মানুষ এই শিকারের রীতি আত্মস্থ করেছে জীবনের সূত্র থেকেই । তার প্রতিফলন ঘটেছে সাহিত্যেও । আমাদের দুই জগদ্বিখ্যাত মহাকাব্য "রামায়ণ" ও "মহাভারতে"ও দেখা যায় উল্লেখযোগ্য চরিত্রেরা প্রায়শই মৃগয়ায় বার হন । এখানে একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে যে এদের কাউকেই কিন্তু শিকার করে জীবিকা অর্জন করতে হয় নি । এখানে সাধ এবং আহ্লাদের, শখের ও পাশবিক উল্লাসের জীবন্ত রূপই হ'ল শিকার ।

              এই শিকার পশুকুল ও মানব সমাজ এককথায় সমগ্র প্রকৃতির পক্ষেই কী মর্মান্তিক তা আজ থেকে আড়াইশো বছর আগেই উপলব্ধি করেছিলেন মঙ্গলকাব্যের কবিরাও । "চন্ডীমঙ্গল কাব্যে"র 'পশুদের ক্রন্দন' শিরোনামাঙ্কিত অংশে ব্যাধ কালকেতুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ও শোকাহত পশুরা প্রাণে বাঁচার জন্য দেবী চন্ডীর শরণাপন্ন হন । সিংহ , ভল্লুক , হরিণ থেকে শুরু করে সজারু, সরব-করব, বরাহ সকলেরই অভিযোগ কালকেতুর সংসার জীবন নির্বাহের জন্য পশুর রাজ্যে দেখা দিয়েছে চরম বিপদ । অবশেষে দেবী চণ্ডীর হস্তক্ষেপে পশুকুল প্রাণে বাঁচার সুযোগ পায় । আসলে কবি এই প্রসঙ্গ অবতারণার মধ্য দিয়ে শিকার বিষয়টির বিরুদ্ধে নিজের মত প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেছিলেন বলেই মনে হয় ।


              জীবনানন্দ দাশ তাঁর "১৯৪৬-৪৭" কবিতায় লিখেছিলেন "সৃষ্টি মনের কথা মনে হয় দ্বেষ" । এই চরণটি গভীর অর্থবহ । সৃষ্টির সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে তীব্র জৈব হিংস্রতা বিরাজমান । মাতৃগর্ভ থেকেও সে ভূমিষ্ঠ হয় লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, হত্যার মধ্য দিয়ে । এই সূত্রে আমরা মানুষের প্রবৃত্তিগত শিকারি রূপকে প্রত্যক্ষ করি । এ প্রসঙ্গে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের "টোপ" গল্পটির কথা মনে পড়ে । আধুনিক সভ্য সমাজে বর্বর মানুষের নির্লজ্জ অমানবিক নিষ্ঠুর মনের জীবন্ত দলিল এই গল্পটি । এতে একটি শিকার কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে । শিকার কাহিনীর অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে মানবাত্মার সমাধির কথা । গল্পটিতে সামন্ততান্ত্রিক জমিদার রাজা বাহাদুরের নিষ্ঠুর শিকারের শখ । শিকারের প্রয়োজনে জঙ্গলের গভীরে, ভয়ঙ্কর জায়গায় বানিয়েছেন ব্যয়বহুল বাংলো বাড়ি । মজুত করেছেন দামি দামি আগ্নেয়াস্ত্র । সেই জমিদার একদিন শিকার দেখানোর জন্য লেখককে আমন্ত্রণ জানালেন । লেখক দেখলেন বাঘ শিকারে সেই জমিদার টোপ হিসাবে ব্যবহার করেছেন এক মানব শিশুকে । শিউরে ওঠার মতো সে এক বীভৎস কান্ড ! অবাক , এক বিলাসপরায়ণ সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন জমিদারের কাছে শিকারটাই বড়ো ! মানব শিশুও তার সেই হিংস্রতার শিকার হয় । তাইতো "এই পৃথিবী নিহত প্রাণীর রক্তে লাল" ।

         আমরা জানি এই গ্রহের নাম পৃথিবী । এখানে বাঘই যে হরিণকে শিকার করে তা নয়, এখানকার সবচেয়ে বড় শিকারির নাম মানুষ । যারা সরাসরি অরণ্য নিধনে অত্যন্ত সাবলীল । মজার কথা এই শিকার তাদের কাছে ছেলেখেলা, শখের বিলাসিতা, কোনো বেঁচে থাকার লড়াই নয় । গোপনে আজও রাঢ়বঙ্গে অনেকেই পশু হত্যার মধ্য দিয়ে উপভোগ করে নেয় এক "স্যাডিস্টিক প্লেজার" । আবার এই মানুষ যে শুধু শিকার করেই জীববৈচিত্র্য নষ্ট করছে, তা নয় । এর পিছনে আরও কতকগুলি পরোক্ষ উপায়ও রয়েছে । যেমন, উপযুক্ত স্থান বিচার না করে রেলপথ স্থাপন, পাহাড় জঙ্গল ধ্বংস করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা, নির্বিচারে অরণ্য নিধন, মূল্যবান বৃক্ষ নিধন করে তার পরিবর্তে তুলনামূলক কম উপকারী কিছু বৃক্ষ রোপন, রমনীয় ভ্রমণ স্থান সৃজনের তাগিদে অরন্যের নির্জনতা ভঙ্গ করা ইত্যাদি । এইসব কারণে অনেক বন্যপ্রাণী নিজেদের অভিযোজিত করতে না পেরে অবলুপ্ত হতে চলেছে । প্রতিটি প্রাণীই তো গোপনীয়তা চায় । কিন্তু মানুষ নির্দ্বিধায় বন্যপ্রাণীর শয়নকক্ষে ঢুকে পড়ছে অহরহ । যা অন্যায়, যা পাপ । এই পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীরই বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে । উত্তরাধিকার রক্ষা করার অধিকার রয়েছে । মানুষ বুঝেও তা বুঝতে চায় না । পরিবেশকে প্রভাবিত করতে চায় । ভোগ করতে চায় । ধ্বংস করতে চায় ।

           অথচ বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয়রা বন্যপ্রাণের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে । তাই আধ্যাত্মিক ধর্মবোধের সঙ্গে জীববৈচিত্র্য রক্ষার যোগসুত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছে । যেমন শ্যামার সঙ্গে জবার সম্পর্ক, শিবের সঙ্গে ধুতুরা ফুলের ও কলিকা ফুলের সম্পর্ক , দুর্গার সঙ্গে পদ্মফুল, সরস্বতীর সঙ্গে বাসক , মনসার সঙ্গে মনসা পাতা, পদ্মপাতা ও কেয়া পাতার সম্পর্ক ইত্যাদি । পুজোর প্রয়োজনে আয়োজনে আম্রপত্র , বিল্বপত্র তো আছেই । তেমনি আবার বিভিন্ন দেবদেবীর বাহন রূপে বিভিন্ন পশুর কল্পনা । যেমন দুর্গার বাহন সিংহ , কার্তিকের বাহন ময়ূর, মনসার বাহন সাপ --এসবই কিন্তু মানুষের সৃষ্টি । এগুলো পারতপক্ষে প্রাণীপ্রেমের প্রাথমিক পাঠ । প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার নিবিড় পাঠ । আজও দেখা যায় গ্রামে গ্রামে গরাম থান । গরমথানে শালবৃক্ষ আবার মাটির হাতি ঘোড়ার পূজা । এই গ্রামীণ সংস্কৃতির , সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য একদিকে বৃক্ষ রক্ষা করা অপরদিকে বন্যপ্রাণীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা জানানো ও রক্ষা করার পবিত্র বাসনা ।

           এর বিপরীতে যে রীতিনীতি রয়েছে তার কথাও এখানে বলা দরকার । এখনো শিকার অনেকের কাছেই ধর্মীয় লোকাচারের অংশ । কারও বিশ্বাসে আঘাত না করেই বলতে চাই যে সময় এই প্রথার অবতারণার প্রয়োজন হয়েছিল, তখন দিন ছিল অন্য । অরণ্যও ছিল অন্য প্রকৃতির । তখন শিকারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল । প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যই শিকারের দরকার হয়েছিল । কিন্তু আজ আমাদের প্রকৃতি বদলেছে । অরণ্য এবং অরণ্যবাসী প্রাণীসম্পদ সংকুচিত হয়েছে । এখন আর প্রাণীবৈচিত্র্য ধ্বংস করার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই । বরং প্রয়োজন রক্ষা করার । আগলে রাখার ।

            মনে রাখা দরকার সুস্থ সাবলীল জীববৈচিত্র্য থাকলেই বাস্তুতন্ত্র স্থিতিশীল হয় । প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রকৃতি নিজেই নিজেকে সুন্দর ভাবে সাজিয়েছে । আমাদের দায়িত্ব শুধু তাকে রক্ষা করা , নিঃশেষ করা নয় ।


---------------------------------------------------




নির্মল হালদার : কবির ব্যপ্তি

সন্দীপ মুখোপাধ্যায়


এসময়ের প্রধান এক কবি নির্মল হালদারের একটি কবিতায় পড়ি--
আমিও ছিলাম মাটির গভীরে
অনেকেই ছিল আরও
যে যার মত প্রাণ নিয়ে খেলা করছে
রৌদ্র ছায়ায়
আমি মনুষ্যবীজ হয়ে রক্তমাখা পুতুলি হয়ে
নিজের নাড়িনক্ষত্র চিনতে চাইছি।
কবির এই আত্মোৎসারিত ভাষায় যে শব্দটি জেগে উঠল সেটি,আত্মবীজ। তাঁর সমগ্র কবিতা ভাবনায় মৃত্তিকা,বৃক্ষ আর নিসর্গ গাহনের ভাবনা ফিরে ফিরে আসে। তিনি যেন প্রাণের এই আদিমতার সঙ্গে অনুস্যূত। তাই তাঁর অনস্ফুট উক্তি, 'আমিও ছিলাম মাটির গভীরে '। তবে 'আমিও' শব্দটি থেকে বুঝি এই মৃত্তিকা লীনতা তাঁর একক অভিজ্ঞতা নয়। সমবর্তী আরও প্রাণময় অনেকের মতো তিনি তাঁদেরই একজন হয়ে মাটির গভীরে আপন সত্তার স্পন্দন অনুভব করেছেন। তারা কি শুধু মানুষ? নিসর্গের বিভিন্ন সত্তার অংশের মতো মাটির গভীরে ঊপ্ত আপন বীজকে পরিস্ফুটিত আবেগ দান করলেন। আর গভীর থেকে উন্মলিত সত্তার আবেগ আপন ইন্দ্রিয়ে গ্রহণ করে তিনি বলেন,' যে যার মতো প্রাণ নিয়ে খেলা করছে / রৌদ্রে ছায়ায়'।
শেষ তিন পংক্তিতে মাটির গভীরে সুপ্ত- ঊপ্ত বীজের সঙ্গে কবি উপমিত করলেন মানবীগর্ভের রক্তলিপ্ত পুত্তলির মতো মনুষ্য বীজকে। নিজের সত্তার প্রসারিত একটি অংশ মৃত্তিকার গভীরে,আবার একটি গর্ভের ভিতরে প্রাণসঞ্চয় করেছিল। নির্মল তাঁর সমগ্র উন্মীলক ও সম্প্রসারময় সত্তাকে এই ভাবে মৃত্তিকায়, মৃত্তিকা থেকে মাতৃকাগর্ভে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। শেষ পংক্তিতে,তিনি মানুষের অজস্রতা, প্রাকৃতিক অপরিমেয়তায় আপনাকে ছড়িয়ে দিলেন।আত্মবীজটিকে তিনি অনুভব করলেন মৃত্তিকায়, মাতৃকায়। তাই তাঁর কবিতায় মাটির আঘ্রাণ, নিসর্গের শ্যামসৌগন্ধ আর মানুষের রক্তবাহী ধমণির সমগ্রতা উচ্চারিত হলো। তিনি নিজেকে জীবনের সামগ্র্যে ব্যাপ্ত করে অনুবাদ করেন। 
তাঁর আর একটি কবিতায় পড়ি--
ধুলো কি শুধু আমার গায়ে লাগে?
তারাদের গায়েও লাগে একটু একটু করে।
ধূসর হয়ে পড়ে আলোর কিরণ।
তরুণরা গেছে অরণ্যের আবর্জনা সাফ করতে
নক্ষত্রের দেশে যাবে না?
আমাকে সঙ্গে নিলে আমি দেবো ফুঁ
তারার মুখ থেকে উড়ে যাবে ধুলো।
এক অপার মানবিক দ্যোতনা নির্মল হালদারের কবিতাটিকে পাঠকের ভিতরে চিরলীন সুন্দরের স্পর্শ নিয়ে এল। ধুলো শব্দটি এক নিবিড় প্রাত্যহিকতা, মানুষের শ্রমিষ্ঠ চলার ভিতরে প্রত্যেক পর্বে এক নতুন অভিভব অর্জন করে। সেই অভিভবটিকেই কবি প্রথম পঙক্তিতে জাগিয়ে দিলেন।
জীবনানন্দ যাকে 'প্রতিবেশ প্রসৃতি' বলেন নির্মলের অনুভবও সেই বোধের সঙ্গে সংলগ্ন হতে চায়। তিনি আপন আত্মতাকে সম্প্রসারিত করেন। আর সেই ধুলোর স্পর্শ দূরান্বিত নক্ষত্রপুঞ্জকে, সুন্দরের অলক্ষিত আভাকেও যে আপন করে নেয় তিনি সেটি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,'ধূসর হয়ে পড়ে আলোর কিরণ'। সুন্দরের অপরিম্লানতাও যে প্রাত্যহ বেদনাকে অতিক্রম করতে পারে না, সেই সত্যটি আমাদের বিদ্ধ করে। মনে রাখবো, প্রতিদিনের বেদনা জড়ানো কবি নির্মল হালদার যখন এই কবিতার মধ্যে সুন্দরের একটি প্রতিমান স্হাপন করতে চান কীটসের সেই মৃত্যুর দুশো বছরে আমরা সত্য আর সুন্দরের অন্বিত তাৎপর্যটি অনন্বিত বিভঙ্গে দেখতে চাইছি। পরবর্তী পঙক্তিতে 'অরণ্যের আবর্জনা ' সাফ করতে যাওয়া তরুণদের 'কাছে' গেলেন। তারা সময়ের শুশ্রূষায় আত্মনিয়োজিত। কিন্তু তারাও কি প্রতিদিনের আবহকে পেরিয়ে এক অলক্ষিত সুন্দরে আপন অভিমুখ স্হাপন করবে না?' নক্ষত্রের দেশে যাবে না'? এই উচ্চারণে কি আগের ভাবনাটি লীন নয়? শেষ দুই পংক্তিতে তিনি যেন প্রতিদিনের "ধুলায় ধূলায় ধূসর হবো" গানটিকে কণ্ঠে ধারণ করেন, সুন্দরের স্বচ্ছতাকে প্রতিভাসিত করতে উৎকাঙ্ক্ষিত হন। আর,তাই ফুঁ দেওয়ার এই আবেগ, সুন্দরকে প্রকাশের এই আকুলতা তাঁর ব্যাপ্ত কবি স্বভাবে পাঠকের ভিতরে এক অনাময় স্তব্ধতায় সঞ্চারিত করে।
যেদিন প্রথম সূর্য 
সেদিন প্রাণের আকুলতায় কাঁপছিল ঘাস,ঘাসের বীজ।
অস্হিরও লাগছিল, কখন ধারণ করবে
আরো আলো।
প্রশ্ন ছিল আলোর পরে কী?
আকাশ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল এক বিন্দু শিশির। 
প্রথম পঙক্তি উপনিষদ-উদ্দীপিত রবীন্দ্র -উৎসারিত উচ্চারণের সঙ্গে যেন মিলে গেল। তিনিও যেন 'আকাশ ভরা সূর্য তারা 'কণ্ঠে নিয়ে অনুভব করেন ঘাস, ঘাসের বীজে প্রাণের আকুলতার স্পন্দন। সেই স্পন্দন সঞ্চারিত করেছিল অনির্ণীত এক আকুলতার বোধ। তাঁকে করে তুললো আলোর দীপ্রতার ধারণক্ষম। এই বোধ সমগ্র নিসর্গ, প্রাণসত্তার সঙ্গে তাঁর নিবিড়তাকে ব্যক্ত করেছে। কিন্তু এখানেই তিনি স্তব্ধ নন। তিনি জানতে চান, 'আলোর পরে কী'? এক আপূর্যমান আকাঙ্ক্ষা তাঁকে উদ্বেলিত করেছে। আর শেষ পংক্তির আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়া শিশির তাঁর ভিতর বেদনাকে ছড়িয়ে দিল এক সমগ্রতায়। আমরা সেই সমগ্রতায় পূর্ণ হয়ে উঠলাম। 



             শিল্পী : স্নেহা ঘোষ



সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা


১.
তর্পণ


বয়সদোষে যখন গোধূলির সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করি, মনে হয়... দিগন্তরেখাটা আসলে একটা ব্যস্ত নদীর ঘাট। ঘাটের গায়েই আছে আমার রক্তের অতীতের চলে যাওয়া মানুষগুলো। ওরা ঝালমুড়ি, ফুচকা, আইসক্রীম বিক্কিরি করছে। গোধূলিকে নিয়ে আমি ঘাটের সিঁড়িতে বসি। এক ঠোঙা থেকে দুজনে, চুমু সহযোগে, ঝালমুড়ি খাই। হাত ফসকে কয়েকটা মুড়ির দানা নদীর হাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়ে নদীর বুকে। আমার তর্পণ করা হয়ে যায় আকস্মিকে। সে দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ টের পাই, গোধূলি আমার গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছে লজেন্সের বয়াম। গোধূলি ছেনাল। হাসতে হাসতে উঠে চলে যায় আমায় ঘাটস্থ রেখে। তার নতুন প্রেমিককে নিয়ে আসে। আমি লজেন্সের পশরা নিয়ে এগিয়ে যাই তাদের দিকে। ও কে? ঠাহর করতে পারি না। কিন্তু চেনা লাগে। 

ঘাট, শ্রাদ্ধ, তর্পণ... মিলেমিশে যায় ঘোলা জলে। রাত হলো।


২. 
দেরি


মাফ করবেন, বন্ধুসকল। 
আমার একটু দেরি হয়ে গেছে। 
বারবার দেরি হয়ে যায়। 
বুকের ভেতর খননকার্য তো
একটু সময়সাপেক্ষ। 

আমার বাবার বাবাও 
তো খুঁড়তেন। মাটি। 
কোলিয়ারির খাদান। 

আমার বাবাও
খুঁড়তেন। পার্টি আর পুস্তকের
অতল জল। ডুবুরির মত। 

আমারও
বংশ পরম্পরায় তাই
দেরি হয়ে যায়। গেছে। 
সময়মত বেরিয়ে আসতে। 
আর ধ্বস তো হরেক রকমের। 
পিঠটা তেমন শক্ত আর
হলো কই? 

সেও এক উত্তরাধিকার।


৩.
জঠরজ্বালা


আমারই পৃষ্ঠে কেন দাগ?
কাদাছাপে কেন এই দেহ পঙ্কিল?
সৃষ্টির ভ্রূণ কোনো দোষ তো করেনি?
উদ্দাম ছুটে গেছে জঠর দুয়ার ঠেলে,
জন্মের ঘ্রাণ নেবে বলে।

আমিও মাতার মত ব্যথাতুর,
খুলেছি ‌অর্গলরূপ জঙ্ঘা।
এই মূল পাপ ছিল জন্ম দেওয়ায়। 
মাতার গরিমা যায় ম্লানিমার পথে
অসময়ে গোধূলির এনাম কুড়োতে। 

ভুল ছিল আমারই নেহাৎ —
সঞ্চার ভেবেছি শুধু,
ভাবিনি গর্ভপাত।



মাটি

দুর্গা দত্ত


আমাকে ফিরিয়ে দাও 
সেই সব বিশৃঙ্খল উতল দুপুর
বুকের পকেটে থাকা 
তোমার ওই শাদাকালো ছবির সুষমা

আমাকে ফিরিয়ে দাও 
তোমার শরীরে ভেজা ঘাসরেণু শিশিরের দানা
পাতাঝরা পথ থেকে ধুলোমাটি উড়ে যাওয়া শ্বাস

আমাকে ফিরিয়ে দাও
পালকের ভাঁজে ভাঁজে শুকনো থেকে আরও শুকনো
পুনঃ পুনঃ নুনের মহিমা
ধুম জ্বরে সুশীতল মগ্ন জলপটি

আমাকে ফিরিয়ে দাও
গ্রামদেবতার থানে ধুলোমাখা দণ্ডবৎ
অন্য কোনো অনিঃশেষ জন্মের বানান...



আরোগ্য

বিশ্বম্ভর নারায়ণ দেব

[ উৎসর্গ : সুমিতা রায় ]


অর্গল মানেনি আধসেদ্ধ বয়স।
চারুবাক্ গৃহ। অস্তিত্ব উন্মুক্ত করে
বসে রয়েছেন যিনি, ফুল্লকুসুমিতা।

নক্ষত্র খচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে
তিনি খুঁজে চলেছেন
অর্ধশতকের ফেলে আসা
রৌদ্র শিশির আর্দ্রতা
খুঁজে চলেছেন প্রণয়-শীতল
পানীয় প্রেম পরমার্থ।

পেকে ওঠে শব্দ যাপনের রাত;

তরঙ্গ বাহিত নগর কোলাহল থেকে দূরে
স্পর্শযোগ্য অভিলাষ টের পাই।

সেই কাঙ্খিত ধ্রুবের কাছে
সেই অন্তর আলোক পূর্ণতার কাছে
আমার বিশ্রাম আমার অযুত সমর্পণ।




         শিল্পী : স্নেহা ঘোষ


ডরোথী দাশ বিশ্বাসের এক গুচ্ছ কবিতা


১.
অতীত...


শান্ত দীঘির জলের মতো স্বচ্ছ মন নিয়ে বসে থাকি আজকাল,
যেখানে স্মৃতিরা উত্তাল হয় না আর,
আবেগ তৈরী করেনা কোন রঙীন বুদ্বুদ,
সে জলে শুধু দেখি এক রুক্ষ শুষ্ক বিষাদময়ীর প্রতিবিম্ব।
আঁজলা ভরা জল তুলে নিই চট্ করে,
ধুয়ে ফেলি মুখ,
কেঁপে ওঠে সে মুখচ্ছবি,
ভেজা হাতের তালুর দিকে চোখ পড়ে যায়,
রেখায় রেখায় লুকোনো কষ্টরা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

যতোই বলো,এ যে পিছু ছাড়ে না।
কষ্টগুলো যে আমার ভীষণ চেনা।

নাহ্!আর ভাববো না।



২.
বসন্তলিপি...


ভীষণ ইচ্ছে,পলাশের রঙ নিই,
বনেতে আগুন,নবপল্লব ডাকে,
দিগন্ত নীল,সেও ডাকছে আয়,
ঠোঁটের খেয়ায়,তনুমনের বাঁকে।

অঞ্জলি ভরে কাজলা নদীর জলে
ভিজিয়ে দিলাম নুড়িমালাপ্রান্তর,
ছাপোষা এই জীবনযাপন ভাবে,
জ্যোৎস্না কিভাবে ভরে দেয় অন্তর!

শিকড় ছড়ায় বন্ধুবৎসলতা,
মোহন বাঁশি বাজায় প্রাণে প্রাণে,
ছেড়ো না কখনো হাত বিশ্বস্ততার,
ভুলে যেও না,নদী সব কথা জানে।

বসন্তে ফুল ছড়িয়ে হলুদ পরাগ
কপালে আঁকে প্রেমের তিলকখানি।
অতীত যেন কখনো হয় না ধূসর,
সোনার জলে লেখা থাক সে বানী।
                                আরও কবিতা পড়ুন

                            
                 শিল্পী : স্নেহা ঘোষ                  



পরিযায়ী

উজ্জ্বল গরাই


চাঁপাতলা মোড়টা পাইর্হাইঁ যেখানেল্লে
টেরেন দেখা যায় , 
ঠিক তার বাঁ ধারে পুঁটির ঘরটা ।


মোড়ের ঠিনে কুথাও চাঁপা গাছ ছিল কি নাই 
জাইনতে চাইনাইঁখ্য কেউ ।

পুঁটি জানেছিল । 
দেখ্যেছিল চাঁপাডালে কেমন কৈরে চুপ হঁয়ে আসে পরিযায়ী বিকালের রৈদ ।


সে বছর যেদিনকে লকডাউন উ'ঠল্য
মোড়ে লাল সবৈজ কমলা রঙের হরেক গাড়ি ছুটত্যে লা'গল্য ফিরেল্লে ,
একদন্ডঅ ঘুইরে ভা'লবার অবসর রৈহ্ল্য নাই মানুষের ...

পুঁটি দু'হাতে কানটা চিপে চাঁপা গাছটার ফাঁকে ফাঁকে রৈদ দেইখছিল্য ।


মা তাখে ঢেরদিন বাপের কথা বলেনাই খ !



সমার্থক বিচ্ছেদ ও

সৌরভ লায়েক


আকন্দবাড়ি স্কুলের ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে গেলে
আমার শান্ত মেয়ে দুটি 
শংকরের মতো আকাশে তাকায় ।
উড়ে যাওয়া দুটো পায়রা বাঁশ টিয়া দেখে 
ওরাও উড়তে চায়
আমি ওদের ডানার সন্ধান জানাই 
ওড়ার গুপ্ত মন্ত্র গুলি কানে কানে বলি 
তারপর বই গুলি নিয়ে ফিরে যায় ওরা ।

জানি ওরাও একদিন উড়ে যাবে 
দূরে কোনো এক অচেনা পাড়ায়
আমি - চেয়ার - বোর্ড - ডাস্টার - চক 
সবই এক , সবই সমার্থক ।



আহুতি

সুজন পণ্ডা


এক ঝাঁক পলাশের আড়ালে, 
আমি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছি
বসন্তের দহন।
তীব্র রোদের মুখে
লাগিয়েছি লাল-হলুদ আবির।
উষ্ণতা বাড়তে বাড়তে
যখন বুক পুড়িয়ে দিতে উদ্যত...
আমি মহুল ফুল দিয়ে
নিভিয়েছি তৃষ্ণা...।

এই বসন্তেই আমি, 
মাটির সাথে ষড়যন্ত্র করে
একটি নতুন বৈশাখের জন্য
আহুতি দিয়েছি
একটা গোটা চৈত্র মাস।



প্রস্থান

রাজীব চৌধুরী


আসুন
এই ম্রিয়মান হৃদয়ের
রক্তাল্পতা দিয়ে তবে
সমাদর করি...
আপনাকেই
দিতে চাই
সযত্নে বাঁচিয়ে রাখা
যথাসাধ্য হিমোগ্লোবিন...
জঠরের খিদে নিয়ে
দুটো চোখ
না বুজুক কিছুতেই
তুলসীপত্রে...
পাঁজর-
পঞ্জর নয়
পিঞ্জর হোক গরিমায়...
খাঁচার পাখিটি এই
লালন অভ্যেস পিছু ফেলে
দাউদাউ কেঁদে নিক
কারণ
অন্তত আরো
একটা জীবন লাগত
নাছোড় প্রেমের দেহে
পচন ধরতে...




প্রাণহরিণী

কুমারেশ তেওয়ারী


আলো মাখবে বলেই নয়ন শুয়ে পড়ছে কাৎ
আলোকের গর্ভগৃহে দেখছে কীভাবে 
শিল্পীত বিন্যাস ধরে এক ভাস্কর্য গ্যালারি
গড়ে যায় লগ্ন মনে মিথুনমূরতি

এমন সময় ঠিক এমন সময়
ওহো সাঁতার দেখেছ কি ডালের হাঁড়িতে নেমে
কীভাবে সাঁতলে দেয় ডাবু 
বড় নৃত্য লাগে তখন তো বয়ে যায় প্রিয় মধুবাৎ
ফিরে আসে ছন্দও,দিগবিদিক বেজে ওঠে ছলাৎ ছলাৎ

ওইসব ময়ূরেরা মোহন রতি মাখা না হলে
খুলতেই চায় না পেখম 
ময়ূরীরা টেলিপ্যাথি গোপনে ছড়িয়ে দেয় 
জঙ্গলের পাতায় পাতায়

এখানে বরং জঙ্গলের দোষ নেই কোনো
অনন্ত আগ্রহ নিয়ে সে তো উল্লসিত 
তক্কে তক্কে অ্যাকশনে ক্যামেরাহ্যাপি থাকে
আলো ধরার তার পেশাতে কোনও
গ্রহণের ভুল পাঠ নেই, আছে শুধু বিশুদ্ধ নিয়ম

দৃশ্য ঠিকঠাক রতিজ হলেই —
                             বন্ধ করো মুদ্রার বিভ্রম

ওহো দুঃখ বিভ্রম বলেছি বলে দেখো 
ফেটে যাচ্ছে কেমন প্রাণহরিণী , ক্যামেরার শ্রম

   

আকাশবাণী

শাশ্বতী সান্যাল


শরীরে কুয়াশা ঘেরা পাকদণ্ডি, ভেজা নীরবতা-

বিস্মৃতির দিনে
ঝরনা পেরিয়ে যাওয়া, সে কি খুব চাট্টিখানি কথা? 

তবুও নীচের দিকে ঘুরে ঘুরে
ঘুরে ঘুরে ঘুরে
যেসব ভ্রমণ, তা আসলে উৎসের কাছে ফেরা

আকাশবাণী বলতে যদি রেডিও বুঝেছ পোড়া দেশ
তবে কার ডাক শুনবে বলে পথে নামে মানুষেরা?



বৃষ্টি

বিট্টু সান্যাল


পড়শি বাড়ির মেঘ,ভীষন দেমাক তার বুঝলেন,
                    সে মেঘ ভীষন অহংকারী।
চোখ পাঁকিয়ে বলে জানো?
 যখন তখন তোমায় আমি ভিজিয়ে দিতে পারি।
       আমিতো হেসেই লুটোপুটি,
ভিজবো বলেই সারাটা দিন একলা মন কেমনের ঘরে,
একবুক তৃষ্ণা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মন জানালার ধারে।
মেঘবালিকার শাড়ির আঁচল লুটায় একাকী ঐ ছাদে,
আমায় দেখে লজ্জায় রাঙা অজানা আহ্লাদে।
জাফরী দিয়ে মেঘকে খুঁজি,পিপাশায় মরি একা,
কোথায় সে মেঘ?মিথ‍্যে ও সব পুরোটাই মরীচিকা।
ইচ্ছে করে চিৎকার করি,গ্রীষ্ম তো যায় চলে,
ও দেমাকী মেয়ে, ও..ও মেঘ তুই বড় অহংকারী,
                  বর্ষাবি কোন কালে?
বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দেনা রুক্ষ জীবন আমার,
ভিজুক গ্রাম ভিজুক শহর-শরীর মন ভিজুক অধর ভিজুক চিবুক ভিজুক বারংবার।
                            



সুদীপ্ত চক্রবর্তীর কবিতা


১.
অঘোরী


অঘােরবালার সাথে আমার পরিচয় অনেককাল
তখনও এজন্ম পাইনি
সেজন্মের তেঁতুলতলায়
পুরনাে কাসুন্দি মাখা শেষ বিকেলে...

এক অবিমিশ্র মনােমালিন্যের পর
অঘােরবালার সাথে দেখা হয়েছিল
মাছ ধরতে গিয়ে। আটা-ময়দা, পিপিলিকা-ডিম
কেঁচো, শামুকের সাদা মাংস বেঁধে, বিমােহিত
বিকটদর্শন কঁকড়া শিকার

গৃহস্থের সন্ধ্যা যখন ভরপুর আমিষ; সাদা থান,
আসন্নপ্রসবা সেই দেবীর সাথে চড়কের দিনে
জিহ্বায় কাটা মেরে প্রথম কথা বলেছিলাম

অঘােরবালার সাথে হয়তবা দেখাই হয়নি
আমাদের জিহ্বাগুলি শূন্যে ঝুলে ছিল


২.
সন্তান


কাটা চাঁদের দিকে চেয়ে
গলাটি উঁচিয়ে, সে ডাকে
হারানাে সন্তান, মৃতদেহ প্রসব
এসবের মাঝখানে।
চাঁদ খুঁজে ফেরে

মধ্যরাতের সেই আচমকা
আর একটানা
ছিলা ছেড়া কান্না জুড়ে

সন্ধ্যার আগে
মুখে ধরে
তুলাের পুতুল নিয়ে আসে




সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা


আক্ষরিক

১.
লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছে অক্ষর। 

নির্জনতার ভেতর পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে অন্ধ কবি, ততোধিক অন্ধ লাঠি আর জন্মান্ধ পথ। 

শেয়াল ডাকছে দূরে। কবিতার মতো। 



২.
রোহিণী নক্ষত্রের আলোয় নিরাভরণ এসে দাঁড়াও চৈতন্যভূমিতে। ঋতুমতী হও আরো একবার। 

তুমি আক্ষরিক। 

হে সহজ, তোমাকেই লালসা করি একজীবন। 



৩.
পাথরের পাশে এসে এভাবেই ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন নামগান। একটা পুরানো সেতু আর ততোধিক পুরানো কিছু কাঠ জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে জন্মের মতো। এপারে রমণের দাগ। ওপারে হরিদ্রার ক্ষেত। 

পারাপার জুড়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিবস। 



        আমাদের বই










সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
শিকারের ছবি : তপন পাত্র
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪