দ্বিতীয় বর্ষ ।। পঞ্চম ওয়েব সংস্করণ ।। ৬ আষাঢ় ১৪২৮ ।। ২১ জুন ২০২১






_____________________________________________




কবি গৌতম বসুর প্রয়াণে আমরা মর্মাহত। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
_______________________________________________




বানরের এ ডাল ও ডাল যাওয়ার অভ্যেস চিরকালের।কলা বাগান ছেড়ে আম বাগানে যাওয়া। সুমিষ্ট আম না পেয়ে কলা বাগানে ফিরে আসা আবার। মালিককে বলা," থাকতে চাই কলা বাগানেই। দিতে চাই সেবা সুদীর্ঘকাল।"
         সেবার অর্থ যে কী? বুঝে ওঠা মুশকিল। ইদানিং সেবার অর্থ মেওয়া খাওয়াকেই বোঝায়। তাই এক বাগান থেকে আরেক বাগানে যেতে হয় বানরদের।
          তুমি কে? তার লেজে ধরে টান মারার তুমি কে? তোমার কাছে লাফাতে শিখেছে বলে তোমার কাছেই থাকতে হবে কে বলেছে? 
          সুদীর্ঘ ঘুমহীন রাত শিখিয়ে যায় কত ঢং। সুদীর্ঘ অনুজ্জ্বল দিন দেখিয়ে দেয় কত রং। তোমার আমার কাছে পড়ে থাকে খোসা আর আঁটির বাহার।
          তুমিও তো এ বাগান ও বাগান হয়েছো কখনও। হবে নাকি আরো একবার?



সম্পাদক, উত্তম মাহাত








দুর্গা দত্তের কবিতা


১.
সদূক্তিকর্ণামৃত

পরম্পরা : দুই


যা ইচ্ছে তাই কথকতা বুনে যাচ্ছো
মত্ত হে ধুরন্ধর গগনবিহারী গজপতি !
বিদ্যাদিগগজ তুমি , তোমার তো
মুখে কেউ কুলুপও আঁটেনি !

আর আটকাবে বা কে ? এ তোমার 
ব্যক্তিগত নির্গমন পথ --
ধুলো ধোঁয়া কাদাজল যা কিছু গরল পাঁক নখ
অনর্গল ঢেলে দিয়ে সাজিয়েছো রম্য দিনরাত।
বুনেছো নিজের মতো চারপাশে বেড়া বাধাহীন
উন্মুক্ত প্রান্তর । ভেবেছো যে 
কোথাও কখনো কোনো প্রতিধ্বনি 
উঠেও আসবে না --

না-ও যদি জানো , তবু জেনে রাখো প্রভু 
কখনো কখনো কোনো ঘুরপথে বাঁকে
রাতের আঁধারে কেউ চুপিচুপি এসে 
তোমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে যাবে 
তোমার প্রতাপ দম্ভ মদমত্ত মিনারের কথা --  
কিম্বা
তোমার সড়কপথে বুক চিতিয়ে প্রকাশ্য আলোয় মেরুদণ্ডী কেউ এসে তুলে এনে
গেঁথে দিয়ে যাবে শিলালেখ --

ইতিহাস থেকে তুমি পালাবে কোথায় ?



২.
আড়বাঁশি : তেরো


আমার সমস্ত জন্ম তোমার গহ্বরে
আমার সমস্ত শ্বাস তোমার জিম্মায়
আমার সমস্ত স্বপ্ন তোমার তালুতে
আমার সমস্ত মৃত্যু তোমার গঙ্গায়

আমাকে ভাসাও যদি ,ভাসাও দুহাতে
আমাকে পোড়াও , পুড়ি, বুকের আগুনে--
কিছুই জানবে না কেউ, শালের বাকলে
ছাই জমে ধুনো হবে ,গন্ধ পাবে তুমি

আমার সমস্ত গন্ধ চৈত্র শালবনে
আমার সমস্ত ঋতু তোমার উৎসবে
আমার সমস্ত আয়ু তোমাকে ঘিরেই
আমার সমস্ত বাঁচা তোমার প্লাবনে





সময়

কমলেন্দু সরকার


কাজ-শেষে চলে যায় কেউ
কেউ-বা আধা তুলে রেখে
আমি শুধুএকা আছি বসে
না-জানা সে কোন অপেক্ষায়!
বাতাস আসে ঘরে, আধো অন্ধকারে 
একা একা বসে থাকা
হারিয়েছে চাবি কুয়াশায় ঘেরা ইমারতে।
উপুরচুপুর অন্ধকারে
নিজেকে চিনতে চেয়েছি আরো
উন্মুক্ত ঘরে কেউ তো ফেরে না আর
ঘরের গন্ধে আসে না বাঁশির সুর
কেবলই ঘড়ির শব্দ টিকটিক টিকটিক...




সায়ন রায়ের কবিতা

বিবাহ-প্রস্তাব

১.
অন্ধকার খাঁড়ি বেয়ে চলতে চলতে এক ফালি চাঁদ
চাঁদের পেলব তাপ স্পর্শ করেছে হাত
এই হাতে মিথ্যে অসম্ভব।
বহু রাতজাগা ভাের সাক্ষী
জীবনের সুপ্ত হাহাকার
এই হাত আজ দীপ, শুধু কবিতার।


২.
ভাসমান দড়ি আর নিঃস্ব এক মানুষের
ফনফনে গলা। যাবতীয় উচ্চাশার নিভৃত আলাপ।
সেই ক্ষণে তুচ্ছ হয় জীবনের দেনা
হ্রদের গভীর জলে শান্ত নীল মাছ
জলজ উদ্ভিদ কীট শ্যাওলা ধরা নুড়ি ছুঁয়ে
আলাে খেলা করে। মেঘ আর রােদ্দুরের
বিবাহ-প্রস্তাবে আমারও সম্মতি আছে জেনাে৷


৩.
একটি অলীক বল গড়াতে গড়াতে এতদূর
খাদের কিনার বেয়ে নিঃস্ব হেঁটে যাওয়া
কখনাে বা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে পথ।
ইতস্তত প্রজাপতি অকারণ ওড়াউড়ি করে
হাসি তামাশার মাঝে বেদনার এক টুকরাে বােধ
সেতুটিকে গড়ে তােলে থাকা ও না থাকার ভিতর।




সৌরভ লায়েকের কবিতা

১.
সেই ছেলেটা
              

রাত পেরিয়ে সকাল তোমার ঘাসফড়িংএর ডানায়
তোমার জন্য দস্যি ছেলের হারিয়ে যাওয়া মানায়
হারিয়ে গেল তোমার মনে আকাশ ধরার আশায়
শরত জলে কোন গোপনে প্রেমের ভেলা ভাসায়

সেই ছেলেটার হটাৎ করেই ধরলো ভীষন ব্যামো
দেখতে যদি পাও কখনো তার জন্যেই থেমো
এমন এখন একলাষেঁড়ে নিজের মতোই থাকে
জমি জিরেত প্রেমিক জীবন সবকিছু বন্ধকে

বন্ধকী দিন ঋণ খেলাপি শুঁড়ির ঘরেই বাস
শান্ত ছেলের গন্ধ দেহে চোলাই বারো মাস
দেখতে কেমন উদাস উদাস বিষণ্ণ তার মুখ
শ্যেন নজরে দগ্ধে কে তার সৃষ্টিছাড়া সুখ 

এক ছিল তার বাঁশের বাঁশি হারিয়ে গেছে ওটা
ধোঁয়ায় পোড়া কালচে ঠোঁটে বন্ধ সুরের ওঠা 
ঝলমলে দিন তাহার ঘরে আঁধার ঘিরে থাকে
ভালোবাসার সূর্য কি তার দাঁড়ায় না চৌকাঠে ?


২.
সতর্কতা


রেখো গোপনে অস্ত্রটি অপ্রতিহত খঞ্জর
রেখেছে খুলে বর্মটি , বিঁধে দিয়ো বুকের ভিতর

স্বার্থপরের মতো কথা " আমিই আসলে সব "
চিতায় - কবরে পাইনিতো খুঁজে মানুষের বৈভব

যতটুকু শোক নিজের আড়ালে হোক প্রিয়
আনন্দ যজ্ঞোদ্ভূত সুধা ভাগ করে দিয়ো

প্রেমিকের ছলনায় ভুলোনাকো , রেখেছো ভিতরে
আত্মনিমগ্ন হলে বিঁধে দিও বুকের পাঁজরে 

ততটুকু শোক সকলের হোক যতটুকু মরুদ্যান
সকলেই পরজীবী অবিনস্ত ঝড়ের মেহমান




শর্বরী চৌধুরীর কবিতা

১.
বোধন

        
আকাশটা অনেক দূরে চলে গেছে। আবাস বদলেও তাকে দেখতে পাই না আর। কানে আসে ঝিঁঝির ডাক। অন্ধকার ঘরে শীতের নির্জনতা। যে জীবন ঘিরে ধরেছে, তাকে উপেক্ষাই শ্রেয়। এসো জলপ্রপাত দেখি, দেখি গাছে গাছে পাখির উড়ান। সমস্ত বিসর্জন থেকে উত্তীর্ণ হই বোধনে।

২.
অব্যক্ত
          

যে কথা হয়নি বলা কারো কাছে, আজ যেন সেসব কথারা ভার হয়ে আছে। নিস্তব্ধ দুপুরে তাদের খুঁজে বেড়াই। দুচারটে গোলাপ ঝরে পড়ে। প্রার্থনা লুকিয়ে পড়ে লেপের ওমে।



অন্যপথ

উজ্জ্বল রায়


ব্রজ বিন্দুতে মিলন যমুণা ও হরির। প্রণয় লিপির 
মত তুলুসি পাতার গায়ে কংসাবতী কথা। ঘাটে ঘাটে তরীগুলি প্রণয় চিহ্ন আঁকে। অমাদের কাসাইয়ে 
তরী ঘাট নেই। নেই গোবর্ধনের শিস। মৌরলার 
সর্পিল পথ ধরে ছড়ানো কড়াই শুটির দানা।  
পরিব্যাপ্তি জুড়ে গোর্গাবুরু, ভজাবুরুর ঢালে মহুলের 
নেশাতুর মৃত্তিকা। এই আদিম প্রণয় কাহিনীর 
জোটেনা ঘোমটার কানিছেঁড়া।




গরম ভাতের মত


সুজন পণ্ডা


মুঠো ভর্তি বর্ণ আর অক্ষর কিছু
ছড়িয়ে দিই উঠোনে
শালিক আর চড়ুই এসে ঠোঁটে
তুলে নেয় কিছু
কিছু ছড়িয়ে যায় পাখির পায়ে..
যখন কাঠবিড়ালি আসে
দু হাতে তুলে নেয়
স র আর প

বেছে বেছে স্বরবর্ণ গুলি
লাল আর কালো পিঁপড়ের দল
মাথায় নিয়ে যায়...

শীতের দুপুরে আমি
উঠোনে ভাত খেতে বসি... 
গরম ভাতের মত অজস্র নতুন শব্দ
নতুন কবিতা গান সাজিয়ে
পাত পেড়ে দেয় ওরা...





ডরোথী দাশ বিশ্বাসের কবিতা

১.
নিজস্ব পৃথিবী...


তুমি এতোদিনেও চিনলে না নিজেকে ?
তোমার চরিত্রে হাল্কা অনুভূতিরা যে জন্ম নিতে শেখেনি কখনো,
তোমার চেহারায় স্বতঃস্ফূর্ত মহিমার প্রসাধন,
তোমার মননে সুচারু কথকতার ভান্ডার,
তুমি তো জানো কতোটা ভাবাবেগে ভাসতে হয়,
তুমি তো বেহিসাবী কখনোই নও অর্জন বর্জন বা সৃজনে,
তুমি জানো,মানুষ বড় বেশী সন্দিগ্ধমন।
সূর্যের মতো ঔজ্জ্বল্য তোমার,
শিশুর মতো সারল্য,
অথচ দেখো,তুমি হাসলে দোষ,
কাঁদলে দোষ,
সত্য বললেও তা মিথ্যের নামান্তর।
তুমি দিতে পারবে,চাইতে পারবে না কিছু।
একটা ছবিও নয়,
তুমি বড় অন্যরকম।
তাই তো দিনের পর দিন,মাসের পর মাস
এক পাবলিশার্স ছাড়া
তোমার ফোনের রিংটোন বাজেনা।
অথচ কতো মানুষ তোমার চারপাশে,
তারা উত্তর আধুনিকতায় বিশ্বাসী।
অথচ তারা তোমাকে কখনোই আধুনিক দেখতে চায় না।
তোমার নিজস্ব বলতে কিছু নেই,কিছু থাকতে পারে না।কিন্তু তুমি মনে মনে জানো,
ঘরের একটি কোণই তোমার জন্য যথেষ্ট।
সেটাই তোমার একান্ত নিজস্ব পৃথিবী।



২.
পাহাড়ের ফাঁকে...


এ এক অন্য সকাল,
এ এক অন্য পথ,
যে পথে কখনো পড়ে নি তোমার পায়ের চিহ্ন।
আজ যাবে নামচির পথে।
অনন্তপ্রসারী পথের দু'ধারে সারি সারি অরোকেরিয়া, ধুপিবন,
অভ্যর্থনার আঙ্গিকে দাঁড়িয়ে সতেজ সবুজ। 
আজ এ পথে এঁকে দাও তোমার পদচিহ্ন।

প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ততার জীবন,
যানযট-তুচ্ছ ক্লেদ গ্লানি-মান-অভিমান-বেদনা, ঈর্ষা ও অহংকারের দূষণ, ক্লান্তিকর সময় অতিক্রম করে
দু'দন্ড কলহাস্যে দিগন্ত-আকাশ-বাতাস হোক উতরোল। 

নিজস্ব বৃত্ত ছেড়ে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে দেখো, 
সূর্য থেকে আলো কেমন ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে,
ছড়িয়ে পড়ছে অমল বাতাস,
জীবনের সব রসদই পরিপূর্ণ এখানে। 
বনস্থলী ধূপের গন্ধে পবিত্রভূমি।
মন্ত্রপূত রঙ-বেরঙের সার সার ধর্মীয় পতাকা উড়ছে বাতাসে।
রঙীন পোশাকে সজ্জিত,নাকে
কাঁচা সোনার নোলক, পায়ে রূপোর ভারী মল,
গলায় রঙিন পাথরের মালা,
রৌদ্রের আঁচে আর্দ্র কুঞ্চিত ত্বক, 
সহজ সরল হাসিমুখ,
অথচ কতো নির্লিপ্ত পাহাড়ি নারী পাকদন্ডী পথ বেয়ে
চলেছে মেঘবাড়ির ঠিকানায়।

ধ্যানগম্ভীর প্রকৃতির রূপ দেখো আর শুধু স্তব্ধ হও।
সমস্ত ইন্দ্রিয় একত্রিত করে 
পান করো ধরার এ অমৃতরূপ।

আজই কি আসবে ফিরে,
চড়াই উৎরাই ভেঙে সমতলে, চা- বাগান, ছায়া গাছ, অরণ্য ঘেঁষা পড়ন্ত বিকেলের ঝিমধরা আলোয় ?

না হয় একরাত থেকে যাও,
টুপ্ করে জ্বলে ওঠা সন্ধ্যাতারা আর
বনজোছনার সাথে পরিচিত হতে।
তোমার উপস্থিতিতে বনস্থলী শনশন হাওয়া, অতলতম খাদে ছলছল ঝর্ণা,
কুলকুল শব্দে এঁকে বেঁকে বয়ে চলা শীর্ণ জলধারা,
ঝরঝর পাতাঝরা শব্দে মাতোয়ারা।

স্মৃতি হিসেবে নিয়ে এসো 
সেখানকার মাটিসহ
অন্ততঃ একটি চারাগাছ,
স্থান দিও তাকে টবে বা উঠোনের এক কোনে,
সে হোক না সেলাজিনেল্লা,
লাইকোপোডিয়াম বা
অনিসিয়া অরাটাম।



শিকড়ের ভাষা

পল্লব গোস্বামী


মহুলবনি থেকে ফেরার পথে মনে হচ্ছিল
প্রবীর মুর্মু , যেন এক : দীর্ঘ অশ্বত্থ গাছ 

সারা গায়ে তার
কাঠবেড়ালি,নেউল ছানাদের ছুটোছুটি

সারাক্ষণ  
দুটি টসনা পাখির 
ঘুরঘুর

ঝাঁকড়া মাথায় 
কত রকমের 
লতাপাতা,ঘাসফুলের বাসা 

দুপাশারি শ্যাওড়া আর গাব গাছের বন
অথচ, গাঁয়ের এয়ো মেয়েরা  
স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে 
তারই গায়ে 

মেলার মাঠে সেজে উঠেছে ,ধামসা-মাদল -মেগো 
শুরু হয়েছে , টিয়া নাচ
                     বাঘ নাচ 
প্রবীর মুর্মুর 
          শিকড় ছড়িয়ে পড়ছে
              মাটির গভীর থেকে 
                 ক্রমশ আরও গভীরে ....




বিপন্ন

সন্দীপ মুখোপাধ্যায়


 এই আছি, এই নেই 
বিষন্ন চারিদিক ! 

তোমাতে আমাতে দেখা 
কোন্ যুগে কোন্ কালে
জানি না সঠিক! 

যুগ আসে যুগ যায় 
কালে কালে বদলায় 
মানবতা রয়ে যায় 
প্রেম প্রেম গীত গায় 
প্রেমিক... প্রেমিক!




দেবাশীষ সরখেলের কবিতা

১.
সত্য
 

 নৃত্যে  নুপুর নিক্কন নেই
 অতৃপ্ত উঠোন।

 বিড়াল মাছ ছুলো না
 কাশীবাসী হল ।

 কেউ  একজন ঋজু রৈখিক
 হেরে যেতে যেতে
 তিন সত্যি 
রেখে গেলো 
মঞ্চের উপর ।

 সুবর্ণরেখার বালিখোঁচা শ্রমিক  সোনা পায়
 একদিন সুবর্ণ বণিক ছিল ।

 রাবণ বিষয়ে সুনীতিকুমার 
 মৃত্যু উপেক্ষা করে যে সত্য বলেছেন
 তার প্রাসঙ্গিকতা আছে ।



২.
সফর
 

 সাদা স্কুটি বিদ্যুৎবাহীত
 মৌসুমী বাতাসে ছোটে খরতর বেগে ।
 মন্দী ভবনের সিগন্যাল দেখে  দ্বিচক্র লাফায় ।
 উষ্ণ ঋতুরাজ শেষে  বর্ষা বিদ্যুৎ খাতা তারকাখচিত ।

 ধারা জলে পতঙ্গেরা  কলরব করে ।
 আধার জোনাকি রেখা  ও তারকামন্ডলী
 ক্রস করে
 স্কুটি ছোটে অনন্তের পথে ।

 যে পথে পড়ল গাড়ি
 মাখামাখি তপত দোআঁশ ।

 আন্ধারে   অমল ধবল  দ্বারে
 বাঁশি হাতে কে ?
  এক লহমায় মিশে গেল সে ।

 রহস্যের দেশে এক রহস্য গাড়ি
 আড়াআড়ি পড়ে আছে  পড়ন্ত দুজন ।
 জামের জঙ্গলের পাশে  নিধুমন
                            কুসুমিত কদমের বন ।

 এই পড়ে যাওয়া এ ঘটনা
  দুর্ঘটনা নয়
 গরমের শেষে এই বর্ষার সময় ।

 মোহিনী আড়ালে হাসে
 দুই হাত বাড়ালে চাঁদের বসতবাড়ি ,
 সূর্যের ঘর ।
 দোঁহে দোঁহাকার প্রণয় পয়োধি জলে  সমাপ্ত সফর ।


৩.
রাজার জামাই
 

 স্বপ্ন বিলোতে গেলে  দম লাগে
 চাকরি ছেড়ে দিলে বউ রীতিমতো সমাজতান্ত্রিক
 সে এক দৃষ্টান্ত ।

 বলে আমি ত্যাগ 
আমিই লড়াই
 মহিশিলা ঘাটশিলা কোথাও যেও না আমাকেই দেখ ।
 সসাগরা বসুন্ধরা এই দেহে
 ফালগুনীর সন্দেহে  জল ঢেলে আমি
 হে সুদামসখা  মুক্তির কান্ডারী ।

 দেখে দেখে বিভোর সকলে ।

 নব মেঘদলে  সাক্ষাৎ বরুণদেব
 কথার প্রাসাদ  কথা জাদু কথাশিল্প
 কথামৃত গিলেছে সকলে ।

 হাতে এলো রংদার ছডি
 উপযোগিতার প্রশ্নে গাড়ি এসি
 সমাজের মহার্ঘ সম্পদ সে ।

 মানব সম্পদের সেরা মুখ ।

 বস্তুর ভেতরে দেখে বস্তুত দ্বন্দ্ব নাই
 আহ্লাদ রয়েছে ।

 আহ্লাদে নাতিকে খেলায়
 পোল্ট্রি মুরগি সব ভাতুয়ারা বলে
 ডিম ডিম ডিম দিব ।

 দশ আনা ছয় আনা রেটে পোস্টার লেখে
 তুষার সিংহের পদতলে 
শেকল ছেঁড়ার  খোঁজে
  যে আদাব দিয়েছেন সমরেশ ।
 তার লেশ মাত্র  নাই
 স্বপন বপন করে রাজার জামাই ।






অম্বুবাচী, যেখানে যেমন

                   তপন পাত্র
                   

আজ ছয়-ই আষাঢ় । আগামীকাল সাত । কাল অম্বুবাচী । কৃষি প্রধান দেশ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে অম্বুবাচী বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয় । মানভূম-পুরুলিয়াও লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই কৃষি উৎসব পালন করে থাকে । কৃষিজীবী মানুষ মনে করে আষাঢ় ধরিত্রীর উর্বরা কাল । চাষবাসের উপরেই যখন মুখের গ্রাস ওঠার বিষয়টি নির্ভর করে , তখন বৃষ্টির বারিধারায় একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে , "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে "। 


               মানভূম-পুরুলিয়ায় এই উৎসব উদযাপনের সাথে অসম প্রভৃতি প্রদেশের উদযাপনের কিছু কিছু মিল আছে , আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিল নেই । এখানে অম্বুবাচী উদযাপন একটু পৃথক প্রকৃতির ।

                     আমরা জানি হিন্দু ধর্মের দু'টি উল্লেখযোগ্য ধারা --শাক্ত এবং বৈষ্ণব । যাঁরা শাক্ত, অম্বুবাচী মূলত তাঁদেরই উৎসব । বৈষ্ণব ধর্মে এর বিশেষ কোনো প্রভাব নেই বললেই চলে ।

                  মহাজাগতিক ধারায় সূর্যের মিথুন রাশিস্থ আদ্রা নামক নক্ষত্রে যখন বসুমতি অবস্থান করে তখন শুরু হয় বর্ষা ঋতু । আষাঢ়স্য প্রথম দিবস । নীল নবঘন আষাঢ় গগনে যখন, মেঘের হুংকার , তখন কৃষকের ঘরের বাইরে না গেলে চলে না , দু'টি গরুর কাঁধে জোঁয়াল দিয়ে লাঙ্গল জুড়ে , নিজের কাঁধে কোদাল নিয়ে যখন তখন মাঠের দিকে এগিয়ে যায় । তাই "আষাঢ় মাস" পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গবাসীর "আশার মাস"।


                 এই মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে বসুমতী ঋতুমতী হয় । চতুর্থ পদের নাম অম্বুবাচী । জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলা হয়েছে , সূর্য যে বারের যে সময়ে মিথুন রাশিতে গিয়ে পৌঁছায় তার পরবর্তী সেই বারের সেইকালে অম্বুবাচী ।
অম্বুবাচী ধরিত্রী মায়ের ঋতুকাল । আষাঢ়ের বর্ষায় যখন মৃত্তিকা বারিধারায় সিক্ত, তখন বসুন্ধরা ঋতুমতী নারী । ঋতু কালে নারী রজঃস্বলা হলে সন্তান ধারণে সক্ষম হয় । তেমনি ধরিত্রী মাতাও রজঃস্বলা হবার পর ফসল উৎপাদনের জন্য উর্বরা হয়ে ওঠে । কৃষক মনের আনন্দে কৃষিকাজ শুরু করে । 

                ঋতুকালে মেয়েদের যেমন যে কোনো মাঙ্গলিক কর্ম থেকে বিরত থাকার রীতি রেওয়াজ সমাজে প্রচলিত আছে , কঠোর পরিশ্রম থেকে বিরত থাকার ধারা চলে আসছে , তেমনি এই দিনগুলি পৃথিবীর উপর হালচালনা ; গাঁইতি- কোদাল পাড়ারও নিষেধ রয়েছে । এমনকি শৌচকর্মের জন্য হাতমাটি করার মাটিটিও কৃষক হাতে তুলে নেন না । গৃহপ্রবেশ , বিবাহ , অন্নপ্রাশন, উপনয়ন ইত্যাদির মত শুভকর্ম বন্ধ থাকে ।

                   গ্রামাঞ্চলের হিন্দু বিধবা মহিলারা তিন দিন কোন গরম খাবার খান না । ব্রহ্মচারী , সাধু-সন্ন্যাসী , যোগীপুরুষেরা নিরামিষ ভোজন করেন । কারণ একদিকে যেমন ধরিত্রী মায়ের উপর উনুনে আগুন জ্বালাতে নেই , অপরদিকে তেমনি মায়ের পূজার আয়োজন । 


                    ৭ই আষাঢ় অম্বুবাচীর প্রবৃত্তি আর ১০ই আষাঢ় নিবৃত্তি । ভারতবর্ষের মধ্যে অসমের গুয়াহাটি শহরের কামাখ্যা দেবীর মন্দিরে অম্বুবাচী উৎসব পালিত হয় মহা সাড়ম্বরে । তিন দিন কামাখ্যা দেবীর দুয়ার বন্ধ থাকে। চতুর্থ দিন দেবীর স্নান এবং পূজা । শুধু কামরূপ কামাখ্যাতেই নয় , অন্যান্য অনেক জায়গাতেই শক্তি দেবীর পূজা-অর্চনা হয় । কোথাও কোথাও কালী, দুর্গা , জগদ্ধাত্রী, বিপত্তারিণী, শীতলা ও মা চন্ডীর মূর্তি লাল কাপড় দিয়ে তিনদিন ঢেকে রাখা হয় ।

                        দক্ষ যজ্ঞের ফলস্বরূপ সতীর দেহ ৫১ টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে ৫১ জায়গায় পড়েছিল । গুয়াহাটিতে পড়েছিল সতীর যোনি খন্ড । এখানকার মন্দিরের নাম কামরূপ কামাখ্যা । এখানে এই সময় দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে হাজির হন । শোনা যায় অম্বুবাচীর দিনগুলি কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে লাল রংয়ের তরল বের হয় । ভক্তরা জীবনে মঙ্গলের আশায় মন্দিরের পূজারীদের কাছ থেকে রক্তবস্ত্র সংগ্রহ ক'রে হাতে অথবা গলায় পরিধান করেন ।

            অসমে এই উৎসব সাথ , আমতি , আমেতি ইত্যাদি নামেও পরিচিত । উড়িষ্যায় এই পার্বণের নাম রজ উৎসব । 

                  ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্রই এই উৎসব নানা ভাবে উদযাপিত হয় । মূলত আমনের সূচনা উৎসব হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অম্বুবাচী উদযাপন । এখানে এই উৎসব "অম্ববতী" বা "অমাবতী" নামে পরিচিত ।

                     এ অঞ্চলে এটি নিছক কৃষি কর্মারম্ভের আনন্দ-উৎসব এবং প্রবৃত্তির দিনটিই বিশেষভাবে উদযাপিত । বাকি তিন দিন তেমন কোন প্রভাব থাকে না । 

                  ধর্মশাস্ত্র অনুসারে এই ব্রত পালনে সর্বত্র ঠান্ডা খাবার, ফল মুলাদি নিরামিষ আহারের রীতি আছে । এখানে তথাকথিত উচ্চবর্ণের মধ্যে সেই রীতির প্রচলন থাকলেও বেশিরভাগ নিম্নবর্গীয় মানুষের ক্ষেত্রে ঠিক যেন তার উল্টো । অম্বুবাচীর প্রথম দিন কৃষিকাজ এমনকি অন্যান্য কাজকর্ম বন্ধ । সারা এলাকা জুড়ে উৎসবের মেজাজ । চলে কর্মবিরতি । উৎসবে আহারের তালিকায় আম অবশ্যই থাকবে । তবে মনে হয় অম্বুবাচীর সাথে আম সেবনের ধারণাটি অবাঞ্ছিত ভাবে এসে ঢুকে পড়েছে । ফল হিসেবে রাজা , পুষ্টি বর্ধক তাই আমের পাশাপাশি কাঁঠাল , জাম , দই , মিষ্টিরও আয়োজন থাকে । তবে পশুপক্ষীর মাংসেরই প্রাধান্য । অগণিত হাঁস , মুরগি , ছাগল , ভেড়ার প্রাণ যায় । এটি এই উৎসবের বিকৃতি ছাড়া কিছু নয় । 


                      অম্ববতী উপলক্ষে মানভূম এলাকায় গরাম ঠাকুরের পূজা , মা চন্ডীর পূজা এবং আম দুধ ইত্যাদি নৈবেদ্য দিয়ে মনসার পূজার রীতি আছে । লোকবিশ্বাস গ্রামদেবতা কে সন্তুষ্ট করার জন্য এদিন গরাম থানে পশুপক্ষী বলি দিতে হয় । তা না হলে আগামী কৃষি কর্মে কিছু অমাঙ্গলিক ঘটনা ঘটতে পারে । একথা সত্য যে, এখানে এই উৎসব কৃষক ও কৃষিশ্রমিকের সম্ভাব্য ফসল উৎপাদনের আশায় মনানন্দের লৌকিক উৎসব । কী অম্বুবাচী (?) , কেন অম্বুবাচী (?) ---মানভূমবাসীর সেইসব তাৎপর্য বিচারের গা করে না । কোন একটা ছুতো পেলেই তারা ধমসা মাদলের তালে তালে , ঝুমুরের সুরে সুরে নাচতে থাকে , পশুপক্ষীর মাংস আর মহুল ফুলের রস খেয়ে ত্রিভুবন জয় করে । এই অম্ববতী বা অমাবতী পরবও সেই ধারার ব্যতিক্রম নয় ।

(অম্বুবাচীর ছবি : লেখক)

-----------------------------------------------------------------




                              আমাদের বই









সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : পেন্টিং, ছত্রপতি দত্ত
যোগাযোগ হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

  1. সম্পাদকীয়তে রূপকের আশ্রয়ে যে অপরূপ সংশয়াতীত এই সময়ের নীতি হীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন সম্পাদক তার জন্য তাকে শ্রদ্ধা । প্রতিটি কবিতাই খুব ভালো লেগেছে । বরাবরের মতই সমৃদ্ধ হয়েছি স্যার তপন পাত্রের লেখা প্রবন্ধে । ধন্যবাদ ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। নাচনী শিল্পীদের আলোক-চিত্র ।। সন্দীপ কুমার