দ্বিতীয় বর্ষ ।। ষষ্ঠ ওয়েব সংস্করণ ।। ২০ আষাঢ় ১৪২৮ ।। ৫ জুলাই ২০২১





সর্বাধিক সুযোগ সুবিধা দেওয়ার নামে কিছুই সুযোগ সুবিধা না দেওয়ার নীতি নিয়ে অগ্ৰসর হয়ে চলেছে সরকার। তাই একদিকে বিনামুল্যে বা কম মূল্যে রেশনের মাল প্রদান, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান, আই সি ডি এস সেন্টারে বাচ্চাদের খাদ্য দ্রব্য প্রদান, গৃহহীন বা মাটির গৃহ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের পাকাগৃহ প্রদান সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে চলেছে এবং অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া করে চলেছে।
       কৃষকদের "কৃষক বন্ধু সহায়তা" "কিষাণ সম্মান নিধি" প্রভৃতি সহায়তার নামে বেশ কিছু টাকা প্রদান করলেও চাষের কাজে ব্যবহৃত উপকরণ ও উপাদানের মুল্য বাড়িয়ে দিয়েছে লাগাম ছাড়া। বাড়িয়ে দিয়েছে জমির খাজনা। বাড়িয়ে দিয়েছে জল সেচের কাজে ব্যবহৃত মেসিনের তেলের দাম।
        বাসে যে দূরত্ব যাওয়ার জন্য দু'বছর আগে পনেরো টাকা নেওয়া হতো সেই দূরত্ব যাওয়ার জন্য বর্তমানে নেওয়া হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকা।
        শুধু তাই নয়, সমস্ত ক্ষেত্রেই এইভাবে মুল্য বৃদ্ধির কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে মানুষ। 
         সরকার সাধারণ মানুষকে সুযোগ সুবিধা দেওয়ার নামে বঞ্চিত করে রেখেছে কর্মসংস্থান প্রদান এবং কর্মের বিনিময়ে নাহ্য বেতন প্রদান থেকে। যার ফলে এতকিছু সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে মানুষকে। ভাবতে হচ্ছে এইসব সুযোগ সুবিধা বন্ধ হয়ে গেলে কি করে চলবে?


উত্তম মাহাত, সম্পাদক
       

______________________________________________

দু খন্ড

সার্থক রায় চৌধুরী


১. 
এই মুহূর্তে


এবং ঈশ্বরের হাত আবার চূড়ান্ত হল
সহস্র হাতের বিনিময়ে.. 
মৃত্যু,.. রোমাঞ্চকর,.. 
আরো বিস্তারিত সব, সব মৃত্যুভয়..

মানুষ প্রথম, তবু.. পরবর্তী দাস অনুদাস, 
শান্ত পৃথিবী, রোদ, স্বাভাবিক সব সন্ত্রাস..
স্তনের ভিতরে যোনি, যোনির ভিতরে অধস্তন
বিদ্রোহ করে..শব উঠে বসে,..আর কতক্ষন 
দাহের কর্মকান্ড! কতপল? অনুপল? ক্ষুধা
দিয়ে সাজিয়েছ পিন্ড.. প্রিয় প্রেম.. এই বসুধা?..

সবই তো হওয়ায় ওড়ে, খই, 
ক্ষোভ, খিদে, ক্ষত, বোধ..

একটি অসমাপ্ত দাহ..
আরো একটি স্থির প্রতিশোধ..


২. 
ভোরের গোধূলি


মৃত্যু যত সহজ হয়ে আসে
দৃশ্যত খুব হাল্কা, এবং সবই 
আস্তে আস্তে যাপন জড়তায়ে
জন্মাবধি আনন্দ ভৈরবী..

গাছের পাতা যদি নকল ঝড়ে
ঝর ঝরিয়ে ঝরে পড়ার পর,
অসংখ ডাল অনন্ত আর্তির
নকল করে কয়েকটি মর্মর..

শব্দভেদী জন্ম নিতে থাকে,
যদি এ প্রাণ বদলা নিতে চায়!..
বলবো-' আরো মৃত্যু আছে বাকি, 
এসো,বোসো, তমাল তরু ছায়ে',..

শব্দ-সে এক ধর্ম ভীরু ন্যায়,
যা কিছু, তার স্বাক্ষী রেখে এলে,..
গন্ধ কি এক হাওয়া-লাজুক প্রেম,
খোঁজ করে কে কখন ফিরে গেলে?...

কোথায় জন্ম, ভূমি, কোথায় কে!..
সন্ধে বেলা সূয্যি উঠেছে..




রায়গুণাকর : ২০২১

দুর্গা দত্ত


জলসেচনের সেই কাঠের সেঁউতিটি আজও 
পড়ে আছে নদীতীরে শ্যাওলাধরা মুখে
ভেতরে ভেতরে ঘুণ,  কুরকুর ধ্বনি অবিরাম
ঈশ্বরী তো দূর অস্ত্ কোথাও পাটনী নেই একূলে ওকূলে
আলতা ধোওয়ার মতো শ্রীপাদযুগল আজ
কুড়েঘরে নমো নমঃ 
মাটির দেওয়ালে ঝোলা ছাপ দেওয়া পটেতে সাজানো...


বর্গিরা আসে যায় সকাল সন্ধ্যায়  
নানা রূপে নানা অছিলায় মাগো ঘরে ঘরে বছর বছর...

আমার সংসারে মাগো পরম্পরা জুড়ে দ্যাখ 
বাড়ন্ত তণ্ডুল --
দ্বাদশ শতক থেকে আমার একটাই কথা মাগো, 
আর কিছু নয়,
দুধ টুধ নয় মাগো আমার একটাই মাত্র কথা :--

আমার সন্ততি যেন চিরদিন 
পেটভরে থাকে মাড়ে ভাতে






লুপ্ত আলোয়

সুনৃতা রায় চৌধুরী


আলোগুলো দিনে দিনে ঝাপসা হয়ে আসে....
মনে পড়ে না কবে কারা জ্বালিয়েছিল....
কারা মেতেছিল সেই আলোর উৎসবে?

আলোর অনুভূতিও চোখে তেমন ধরা পড়ে না।
শুধু ক্ষীণ আশা
বিস্মৃতির অতল থেকে যেন
মোমবাতির শিখার মত 

নিভু নিভু হয়ে জ্বলে।

কার প্রতীক্ষায়?

অভিজাত বৃদ্ধাশ্রমের একটি কক্ষে আজ বিশ বছর....
কে রেখে গিয়েছিল?
স্মৃতিতে নেই....
পূর্ব নিবাস... 
কে ছিল সেখানে.... 
নাম কি?
উত্তর নেই...

কাকে দেখতে ইচ্ছে করে?

বৃদ্ধার নিভে আসা চোখে একটু যেন আলো ফোটে।
অস্ফুট স্বরে, বিট্টু.... বিট্টু.....

বিট্টু কে? তোমার ছেলে?
আয়ার সহৃদয় প্রশ্নে আবার বিস্মৃতি, আবার বিভ্রম...
সব রঙীন আলো আবার ম্লান, 
অন্ধকারে একটি নিভু নিভু মোমের জ্যোতি।

সাগর পারে বহুজাতিক সংস্থার কর্ণধার বিতানের চোখে তখন সাফল্য বৈভবের আলো।



মনে পড়ে

বাপি কর্মকার


তুমি ছুটে গেলে 
তোমার পায়ের নুপুরের শব্দ 
আজও শুনতে পাই।
এই বৃষ্টির শব্দেও।

ঘাসের উপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জল, 
মনে পড়ে যায় 
তোমার ওই নাকছাবির রূপ।





সুদীপ্ত চক্রবর্তীর কবিতা


১.
সন্তান


কাটা চাঁদের দিকে চেয়ে
গলাটি উঁচিয়ে সে ডাকে
হারানাে সন্তান, মৃতদেহ প্রসব
এসবের মাঝখানে
চাঁদ খুঁজে ফেরে

মধ্যরাতের সেই আচমকা
আর একটানা
ছিলা ছেঁড়া কান্না জুড়ে

সন্ধ্যার আগে
মুখে ধরে
তুলাের পুতুল নিয়ে আসে



২.
গৃহদেবতা


জানালার বাইরে বিস্কুটের গুঁড়াে, চাল, মুড়ি
এক বাটি জল রেখে দিয়েছি

একদিন একা একজন
বিস্কুটের গুঁড়াে তােলে ঠোঁটে আর
ত্রস্ত সরে সরে যায়
চোখ ঘােরে এদিক সেদিক
অতঃপর দুই, পরদিন তিন চার
শেষে এক দঙ্গল ছাতারে পাখি আকাশ পেরিয়ে
জানালায় ভিড় করে আসে

খাবার ফুরিয়ে গেলে জানালার কাঁচে
ঠোঁকরায় আজকাল
মৃদুমন্দ হাসি নিয়ে কাঁচটি সরাই
পরদিন আরাে খানিকটা ছড়িয়ে দিই
কিছুটা বিস্কুটের গুঁড়াে, চিড়া, মুড়ি
ঘরের সামানে, জানালার ভিতরে এনে রাখি
ভাবি একদিন একে একে
ঢুকে আসবে ঘরে...

বুঝবে এ খাবার আকাশ থেকে পড়েনি





বর্জ্য

সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়


আমার এ আঙুল কেটেকেটে
নিও যত শিকড়ের প্রাণ
চামড়ার বল্কল চেঁচেচেঁচে
নিও চূর্ণ বিশল্যকরণী
আলোদেরও সাথে নিয়ে যেও
সঙ্গে নিও ছায়ার ছেনালি
অম্লযান নিও, নিও যকৃৎ
নিও এই হৃদযন্ত্রে মাদল বাদল
পায়ের চরৈবেতি নিলে নিও যদি
চলার রশদ খোঁজো বৃত্তাকারে
দিন নিও, রাত নিও, নিও অসম্মান
নিও ব্যর্থতার ভুশি, ধুলোর প্রলেপ
কলম আঁচড়ে আদিম কলঙ্কদাগ
খাতাদের পাতা উল্টে নিও
জীবনের যত অপলাপ...

নিও না, নিও না শুধু 
নিঃশব্দের বজ্রনিনাদ।




জনৈকার প্রতি

পারমিতা ভট্টাচার্য


চল মোহনায় যাই। দলবেঁধে।
নদীর অবৈধপর্বে কাঁটাতার নেই।
জলের অঢেল দাবি সমুদ্র মেনেছে ওইখানে !

চল,ভঙ্গুর দ্বীপে তাঁবু ফেলি ,― তিনদিন,
লোনাহাওয়া -মাছশস‍্য, শ্বাসমূল, আদুরে ঝিনুক...

খুব ক্ষতি হবে ,
ভাঙা-ছক-বদলাবদলি জীবন সাজালে,― যদি
সেরে যায় নিহিত অসুখ?
সমুদ্র পাল্টিয়ে দেখ, নিজেকেই অন্যভাবে পাবে...

অসৈরণ চিন্তা জানি,
তবু কেউ ভাবে না এভাবে?



উৎপল দাসের কবিতা

১.
রথ


বছর বছর একটাই রথ চলে ঘষে মেজে। 
উৎসুক জনতা দূর দূরান্ত থেকে আসে, 
দড়ি ধরে টানে, 
ঠুঁটোজগন্নাথ মাসির বাড়ি যায়। 
এই অবধি 
 
তারপর সকলেই বাড়ি ফেরে। 

এরা যদি দড়িতে টান দিয়ে 
ভেঙে দিত রাজার চেয়ার --

শাসকের হাত ভেঙে ঠুঁটো করে দিত 

তোমাদের কলা বেচা বন্ধ হয়ে যেতো।



২.
বর্ষা


সুন্দরী বর্ষা রাত আলোয় আঁধারে
গরু বাছুর ভিজে গেল সব।
এই প্রথম বড়জল এবারের বর্ষার 
চুঙি খাপরার ছাউনিতে 
জল পড়ে বড়জল হলে।
 
এবছর সারাতে নাই পারি  
ভিজে যায় কোলের শিশু, ভিজে যায় কাঁথা।


৩.
বিজয় নিশান


বহুদূর অতিক্রম করে 
যে পথ চলে গেছে 
পাহাড়ের দিকে
সেই পথে হেঁটে 
চূড়ায় পৌঁছাতে চাই,  
ওড়াতে চাই বিজয় নিশান।

পৌঁছে দেখি, রমণীরা ঝাঁকে ঝাঁকে 
নেমে আসে সমতলের দিকে, মাথায়
কাঠের বোঝা। বিজয় নিশান।



চাঁদের ছেনালী দেখে

সৌরভ লায়েক


চাঁদের ছেনালী বড় গা সওয়া লাগে সুকান্ত 
তাই দরজা বন্ধ করে দিয়েছি ঘরের

উঠোন কে পারিনি 

আমি তার বাড়ি যাইনি কখনো
সেই আসে তৃষ্ণা মেটাতে পূর্ণিমায় পাড়াতুতো 
প্রগলভ এয়োটির মতো 

তৃষিত চাঁদের বাড়ি যায় যারা
আকন্ঠ ডুবে তৃষ্ণা মিটিয়ে যেন জয়ী হয়ে ফেরে

আমি হাসি ; মনে মনে বলি
চল শ্লা ফোট 
পারলে তোদের জন্যও দরজার আগল তুলে দি 





গোসাপ খাওয়া জেলে

পল্লব গোস্বামী


সেই গোসাপ খাওয়া জেলেটিকে ভালোলাগে : সারা গায়ে যার আঁশটে গন্ধ 
ভোর হতেই কাঁধে তুলে নেয় -
ঘুগি
সিয়াড়া
ফাঁসজাল 
সারাদিন গরু খোঁজা করে খুঁজে বেড়ায় -    
মৃতপ্রায় সব ঝিল 
পুকুর 
ডোবা
খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হলে,ভাঁট ফুলের ছায়ায় চুটি ধরায় 
                 আর ভাবে
          একশো আট নদী
সেই গোসাপ খাওয়া জেলেটিকে ভালোলাগে :যে কখনও আকাশ ভাবেনি 
                      মাটি ভাবেনি  
                      গাছও ভাবেনি 

শুধু ভেবে এসেছে , 
   কখন কোন মাছের পেট কেটে
         পাওয়া যাবে
              শকুন্তলার আংটি !




অপত্য - ৯

সুপ্রিয় দেওঘরিয়া


বালক অশ্বত্থামাকে দুধ কিনে দিতে পারেনি বলে
গাভী ভিক্ষা চেয়েছিল তেজস্বী ধনুর্ধর দ্রোণ
অপমান গিলেছিল বিষসমান!

অপত্য স্নেহে নিজের ঔরসের জন্য
এমনই অনেক দ্রোণাচার্য দেখি
সংগ্রামের লাইনে,অনুরোধে,অনুনয়-বিনয়ে

নিজেকে বিসর্জন দিয়ে
সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য
প্রতিটি পিতাকে লড়তে দেখেছি দারিদ্রের লাইনে

আসলে পিতা এক জন্মে আরেক জন্মের 
সন্ধান পায়, সন্তানের হৃদস্পন্দনে




তীর্থঙ্কর রায়ের কবিতা


১.
জন্ম বীজের দান...


হাওয়ায় হাতে থাকে যখন,  
দু'চার খানা, 
শুকনো ঝরা পাতা;
কি দিন কি রাত, তাদের নিয়ে, 
বাউন্ডুলে
ইতস্ততৎ উড়ে ---
হাওয়া বেড়ায় গেরে মাটির
বাউল পাড়ায়
বৃথাই ঘুরে ঘুরে !

ভোরের শিশির কিংবা হঠাৎ 
পশলা মতো
বৃষ্টি কেবল নেমে ---
এলোমেলো , ছড়িয়ে থাকা
'তাদের' নিয়ে
আলতো করে ধরে - - - 
যত্ন দিয়ে সিক্ত ক'রে, 
ভারী ক'রে, 
শুচিমন্ত স্নানে--- 
মাটির কোলে আসন পেতে
বসায় এনে
জন্ম বীজের থানে।



২.
অভিমান


মাটির উপর থেকে আকাশটা যত বড় চোখ করে দেখি ---
আকাশ কি ততোটাই আমাকে নিচের থেকে দেখে !
দিন রাত মাস ঋতু বছরের অজস্র রং গরিমায়---
মাঝখানে কত মেঘ বিদ্যুৎ বজ্র ঝড় বয়ে যায়।
হা করে শুধু দেখি হাল ধরা, দাঁড় টানা আঁকে বাঁকে ফাঁকে---
আমি তাকে যত চিনি সে তো ততখানি আর চেনেনা আমাকে !!





অগোছালো পথকথা

সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়


পায়ের ধুলোতে কোথাও ঠিকানা লেখা নেই। পথ ডেকেছে বলেই পথে নেমে আসা। হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যাচ্ছি গাঁ _ ঘর। মানচিত্রের বাইরে পড়ে থাকা হাড়াপাথরের ডাঙা। উঁচু নিচু বাইদ ক্ষেত। তালগাছের লিঙ্গছায়ায় গামছা পেতে শুয়ে আছে গোঠের বাগাল। বাঁশি নেই। কানে গোঁজা হেডফোন। একটা ধ্বজভঙ্গ কুইলা বলদ ছুটে গিয়ে চেপে পড়ছে ধলা বলদের পিঠে। সমকামে সদ্য সিলমোহর পড়েছে। হাওয়াতে দুলে উঠছে বোকাভেড়রি ফুল। বুয়ানপাতার গন্ধ মাখতে মাখতে পেরিয়ে যাচ্ছি বিরি উপড়ানো দুপহর। নদীর থেকে দূরে নদীর কোলাহল। জুয়ান মরদের মতো বুক খুলে শুয়ে আছে চাটান পাথর। ঘুঘু ডাকছে কাছেই কোথাও। শরীর দৃশ্যমান নয়। সঙ্গীত আছে। আর এই একা একা মনখারাপ। আকনঝোপে মাথা নাড়ছে বেহায়া ক্যাকলাস। কে যেন ভেঙে নিয়ে গেছে সব ফুল। অথচ এখনো স্পষ্ট দুধের দাগ। 
        আসলে এ সবই স্মৃতিকল্প। চলতে চলতে হোঁচট খাওয়া পাথর। রক্তপাতের ভেতর যে আনন্দ জেগে ওঠে _আমি তাতে ঢেলে দিয়েছি গোপন আত্মরতি। যন্ত্রণা যতই দীর্ঘ হবে, ততই পুটুস ফুটবে ঝোপেঝাড়ে। হাওয়া জমতে জমতে ঝড় হয়। ধানসিঝা টিনের পারা মেঘ উঠে। পায়ের ছাপ মুছতে মুছতে বৃষ্টি আসে। ধুয়ে যায় কাদাজল। সামান্য পথকথা।                                                                                    



খিদে

বিউটী সান্যাল


সাত বছরের মেয়ে ফুলমনি। ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়লো গতকাল রাতে মা আর মেয়ে কিছুই খায়নি। মা বলেছিলো, হাঁড়িতে আর খুদ নেই যে ফুটিয়ে পাতে দেবে। ফুলি ছুটে গিয়ে হাঁড়িটা ভালো করে নেড়ে চেড়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখেছিল কিন্তু একটা দানাও পায়নি। 
         ফুলি ক'দিন ধরেই দেখছে মা আর কাজে যায়নি। ফুলির মা একশো দিনের কাজ করে। গেলে পয়সা পায়, না গেলে কিছুই জোটে না। ফুলির যখন দু'বছর বয়স তখন ওর বাবা মারা গেছে। সেই থেকে মা হলো ওর সব। একটু পরে ফুলি দেখলো পাশে রাস্তার কল থেকে এক বালতি জল নিয়ে ফুলির মা ঘরে ঢুকলো। ঘর বলতে খড়ের ছাউনি দেওয়া চারটে মাটির দেওয়াল আর একটা টিনের ভাঙা দরজা। মা ঘরে ঢুকতেই মেয়ে জড়িয়ে ধরলো মাকে, বললো, "এতো বেলা হোলো মা, তুই মাটি কোপাতে যাবি না?" মা উত্তর দিলো, "না রে মা, কাজ সব বন্ধ। কি একটা অসুখ এসেছে না, সরকার লকডাউন করে সব বন্ধ করে দিয়েছে।" 
         ফুলি ভয় পেয়ে গেলো, আর বললো, "তাহলে আমরা খাবো কি মা?" 
          ফুলির মা'য়ের দু'চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগলো। ফুলি বললো, "কি অসুখ মা?"
          মা বললো, "মহামারী।"
          ফুলি তারপর বললো, "চল মা তুই আমি ঢোল কলমী শাক তুলে আনি। সেদ্ধ করে মা বেটি খেয়ে নেবো। তাড়াতাড়ি চল, বড্ড খিদে পেয়েছে আমার।" "কিন্তু ঢোল কলমির বন তো বাঁধের ওপারে, বড় রাস্তা পেরোতে হবে। আর তখনি পুলিশ ধরবে। ওরা যে আমাদের পেটের জ্বালা বোঝে না ফুলি।"
       শুনেই ফুলি এক ছুটে দরজার বাইরে বেরোলো, আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, "মহামারী তুমি কে? আমার মাকে কাজে যেতে দাও। আমারও তো খিদে পায়। আমারও তো খিদে পায়....।"  
        দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চললো, ফুলির মা বললো, "আয় ফুলি এক গ্লাস জল খেয়ে নে, আর আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, তুই ঘুমিয়ে পড়। ফুলি তখন ছলছল দু'চোখ নিয়ে বললো, "মা কয়েকদিন আগে যে গাড়ি করে খিচুড়ি দিতে এসেছিলো কতগুলো লোক, তুই সেই গল্পটা বল। আমি চোখ বুজে থালায় করে গরম খিচুড়ি আনার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। 






______________________________________________

                 "লোকসংস্কৃতি" না "লোকযান" ... ? যে ভূগোল সীমায় সংস্কৃতির অর্থ নিছক নাচ , গান , আনন্দ বিনোদনই নয় , যেখানে লোকসংস্কৃতিই হয়ে ওঠে লোকজনের জীবনচর্চার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । সেই সংস্কৃতি মানব অন্তরে জন্ম দেয় কৃতজ্ঞতাবোধের । মা লক্ষ্মী হয়ে ওঠেন ঘরের আদরিণী মেয়ে । গরু বাছুর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য । কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন থেকে বাদ যায় না সংসারের জড়বস্তুগুলিও ।

              লিখছেন - তপন পাত্র
______________________________________________

পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি : কৃতজ্ঞতার সংস্কৃতি

---------------------------------------------------------------------------

              শুভারম্ভে শিরোনামে ব্যবহৃত শব্দগুলি একটু সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা যাক । "পুরুলিয়া" শব্দটি বিশ্লেষণ করার দরকার নেই । আমরা সকলেই জানি ১৯৫৬ সালের পয়লা নভেম্বর পুরুলিয়ার পুনর্জন্ম । সেদিন "মানভূম" -- এই গালভরা শব্দটি ভারতবর্ষের মানচিত্র থেকে মুছে গেলেও মুছে যায় নি আমাদের মনচিত্র থেকে । আমরা মনে মনে মানভূম বলতে যা বুঝি , পুরুলিয়াও তাই । 

                আর একটি শব্দ , শব্দ নয় শব্দবন্ধ -- "লোকসংস্কৃতি" যা ভাঙলে দাঁড়ায় দুটি শব্দ ---এক, "লোক" আর দুই, "সংস্কৃতি"। লোক কে , বা কারা ? উত্তরে বলবো ---প্রায় প্রথাগত শিক্ষার আলোক থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত , বন-জঙ্গল-পাহাড়-ডুংরী-টিলাব্যষ্টিত নিসর্গ পল্লীপ্রকৃতির কোলে লালিত পালিত গ্রামীণ জনতা । বলতে পারি প্রায় নিরক্ষর আদিবাসী , যারা একটি বিশেষ ভূগোল সীমায় বসবাস করে , জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে আজও কিছু নিজস্ব রীতি-প্রথা মেনে চলে , স্ত্রী আচারের মধ্য দিয়েই উদযাপন ও সম্পাদন করে যাবতীয় পারিবারিক উৎসব অনুষ্ঠান । আর লোকজীবনের সংস্কৃতি হল তাদের নিজস্ব আচরণ , ভাষার বিশেষ শব্দগত ও উচ্চারণগত প্রকৃতি , পূজা-পার্বণ-উৎসবে নিজস্ব ঘরানা ; আনন্দে-নাচে-গানে স্বতন্ত্র বাদ্য-বাজনা ও পরম্পরাগত ভঙ্গিমা । যেকোনো লোকজীবনের সংস্কৃতির কয়েকটি বিশেষ দিক হল --উপভাষায় কথা বলা , বংশপরম্পরায় দলনেতাকে মান্য করা , পূজাপাশায় ব্রাহ্মণের পরিবর্তে পূজা-আর্চার জন্য স্বজাতির বয়স্ক , সমাজজীবন অভিজ্ঞ , উদার প্রকৃতির একজনকে "লায়া" রূপে মনোনীত করা । এছাড়া সামাজিক অনুষ্ঠানে জটিল দেবনাগরী মন্ত্রের বদলে থাকে স্ত্রী আচার , প্রকৃতি প্রীতি , নিজস্ব গান , নিজস্ব ভাষা , নিজস্ব সুর , নান্দনিকতার নিজস্ব দিক , শিষ্টাচার , নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ-আতিথেয়তায় একটি বিশেষ স্বতন্ত্রতা ।

                     আর "কৃতজ্ঞতা" বোঝাতে গেলে , আমরা সাধারণত বলি "উপকারীর উপকার স্বীকার করা" । কিন্তু এটিতে মনে হয় না যে কৃতজ্ঞতা শব্দটিকে উষ্ণ ও পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হল । এতে একটি অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা গেল মাত্র । আমাদের তথাকথিত সভ্যসমাজ তো অকৃতজ্ঞে ভরা । তাইতো কবি অনেক আগেই লিখে গেলেন ---

  "ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে ,
ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে ।"

               --- অর্থাৎ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি উপকারীকে এড়িয়ে চলা , কপট চাতুরী আর ছলে-সুকৌশলে উপকারীর উপকার স্বীকার না করা ।

                      এবার সার্বিকভাবে যদি "সংস্কৃতি"র কথায় আসি , প্রশ্ন ওঠে সংস্কৃতি কী ? তাহলে এক বাক্যে বলতে হয় "সংস্কৃতি" খুব ভারী শব্দ । সুবিস্তৃত তার অর্থ , তার দ্যোতনা ; তার ব্যপ্তি ঠিক কতোটা , সে কথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না । তার কোন সর্বজনগ্রাহ্য , সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞাও নেই । সাধারণ ধারণায় সংস্কৃতি মানে নাচ-গান, নাটক, আঁকা, লেখালেখি , জাত সাহিত্য , ঐতিহ্য , স্বদেশীয় অন্তরাত্মার বাণী ইত্যাদি । কিন্তু এ সব বাহ্য বা অপ্রধান। সংস্কৃতি আসলে সুরুচিপূর্ণ এক নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিক উৎকর্ষতার বিরামহীন চর্চা । সেই চর্চা মানুষের জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রকেই ছুঁয়ে থাকতে পারে । আর পূর্বেই উল্লেখ করেছি লোকসংস্কৃতি তো একেবারে লোক সাধারণের সংস্কৃতি । তবে আমার বিশ্বাস, এ ক্ষেত্রে "লোকযান" শব্দটির ব্যবহার অধিকতর যুক্তিসঙ্গত । কারণ, ‘লোকযান’ হল, জীবনচর্চার এক চিরজীবন্ত দিক । প্রথাগত শিক্ষা বহির্ভূত জনসাধারণের যুগান্তরের এক প্রকার বিশ্বাসের ধারা । আজও পুরুলিয়ার গণসাধারণের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের নানা মাঙ্গলিক ক্রিয়ায়, আচার-অনুষ্ঠানে, গানে-গল্পে, প্রবাদ-প্রবচনে— সবেতেই লোকসংস্কৃতি বা লোকযানের ছোঁয়া রয়েছে।

               পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চল বলতে সমগ্র পুরুলিয়া , অধুনা ঝাড়গ্রাম জেলা, দক্ষিণ বাঁকুড়া এবং বাংলা ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডের পূর্ব অংশকে বোঝায় । শুধু পুরুলিয়া নয় এই সমগ্র জঙ্গলমহল এলাকার লোকসংস্কৃতি বলতে অনেকেই একবাক্যে বলবেন, কয়েকটি লোকগান এবং লোক উৎসবের কথা । কিন্তু এই নাচ-গান-বিনোদনের ঊর্ধ্বে সারা বছর ধরে যে লোকাচার, পূজাপাঠ এখানকার মানুষ পালন করেন , তার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের কৃতজ্ঞতাবোধের সংস্কৃতি।

               এক এক করে নানা দিক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে সেকথা বিশ্লেষণের চেষ্টা করে যাক । প্রথমেই প্রচলিত লোকগল্পের উল্লেখ করি । এমন অনেক গল্প এককালীন এতদঞ্চলে মানুষের মুখে মুখে বুলতো , পাড়া বেড়াতো । পরে অবশ্য কেউ কেউ ভাষার রূপবদল ঘটিয়ে গল্পগুলিকে নিজস্ব রচনা বলে চালানোর সুচারু কৌশল অবলম্বন করেছেন । কেউ কেউ আবার নীতিমালার গল্পে স্থান করে দিয়েছেন । সরকারিভাবে শিশুপাঠ্যে স্থান দিলেও এগুলি যে প্রকৃতপক্ষে পুরুলিয়ার লোকগল্প সে বিষয়টি উল্লেখ করার কথা তাঁরা সযতনে এড়িয়ে গেছেন । স্বাভাবিক ! কারণ বরাবরই "পুরুলিয়া মায়ের ল্যালহা ছানা , ছ্যাঁড়া ট্যানাও জু'টল নাই "। অসংখ্য মূল্যবান লোকগল্পের মধ্যে আমি এখানে মাত্র দু'টি গল্প উল্লেখ করবো খুব সংক্ষেপে ।

                  একটি "সিংহ ও ইঁদুরের গল্প" । একদা এক বনে এক সিংহ বাস করতেন । একদিন দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন । নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন ‌। এমন সময় এক নেংটি ইঁদুর এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে করতে সিংহের নাকে গিয়ে ঢুকে পড়ে । সিংহ তো তাকে মেরে ফেলতে উদ্যত । ভয় পেয়ে নেংটি ইঁদুর হাতজোড় করে মিনতি জানায় , "আপনি এই বনের রাজা । আমি ক্ষুদ্র প্রাণী , আপনার প্রজা । আমাকে মেরে ফেলে আপনার কোন লাভ নেই , বীরত্বও নেই । বরং আমি বেঁচে থাকলে কোনদিন না কোন দিন আপনার উপকারে আসবো হুজুর । আমি আপনার প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবো । " একথা শুনে সিংহ তো হেসেই অস্থির । তবে ইঁদুরটির কথায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তাকে মুক্তি দেন । কিছুদিন পর সত্যি সত্যিই একদিন সিংহমশাই বনের মধ্যে এক শিকারীর জালে জড়িয়ে গেলেন । 'বাঁচাও -- বাঁচাও ---' বলে তিনি চিৎকার করছেন । তা শুনে নেংটি ইঁদুরটি সেখানে গিয়ে উপস্থিত । তৎক্ষণাৎ সে তার ধারালো ছোট্ট ছোট্ট দাঁতগুলি দিয়ে জাল কেটে সিংহকে মুক্ত করলো । সিংহ মশাই ছোট্ট ইঁদুরটির তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মুগ্ধ হলেন ।

                  অন্য আর একটি গল্প হলো ---"পিঁপড়ে ও পাখির গল্প" । একবছর বরষায় কাঁসাই নদীতে খুব বান এলো । বন্যায় নদীর তীরবর্তী পলাশ গাছের গোড়াতে বসবাসকারী পিঁপড়ে রা ভেসে গেল । যখন ভেসে যাচ্ছে , তখন "বাঁচাও -- বাঁচাও --" বলে তারা চিৎকার করছে । নদীর পাশে একটি গাছে একটি পাখি বসে ছিল । পিঁপড়েদের চিৎকার শুনে পাখিটি কয়েকটি পাতা নদীর জলে ফেলে দিল । পিঁপড়েগুলি ওই পাতায় চেপে ভাসতে ভাসতে এক সময় তীরে এসে উঠলো । এ যাত্রা তারা প্রাণে বেঁচে গেল । পাখিটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নিজেদের ডেরায় ফিরলো । কিছুকাল পর একদিন এক শিকারী সেই গাছের ডালে বসে থাকা পাখিটিকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়ার চেষ্টা করছেন শিকারের জন্য । দৃশ্যটি দেখে পিঁপড়েদের মনে বেদনার উদয় হল । তৎক্ষণাৎ সেখানে তারা ছুটে গেল । ছুটে গিয়ে যখনই শিকারি পাখিটিকে তাক করেন তখনই শিকারির পায়ের গোড়ালি , চেটো ও হাঁটুতে কুট্ কুট্ করে কামড় বসাতে শুরু করে । শিকারি লক্ষ্যভ্রষ্ট হন । পাখিটি বেঁচে যায় । 

                ---- এর নাম কৃতজ্ঞতা । এ গল্প পুরুলিয়ার । মানভূমের । জঙ্গলমহল তথা পশ্চিম সীমান্ত বাংলার ।

                   এতো না হয় গল্প ; এরপর দেখা যাক শুধু মানুষ নয় , অন্য সমস্ত প্রাণীই নয় , অচেতন সামগ্রীর উপরও চেতন ধর্ম আরোপ করে, তাদের পূজা করে বন্দনা করে কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হয় । কৃতজ্ঞতাই প্রমাণ করে মানুষ সংস্কৃতিবান কি না । কৃতজ্ঞতা প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতির অপর নাম , অপর একটি দিকচিহ্ন । এই পশ্চিম সীমান্তবঙ্গের লোকাচার, লোকসংস্কৃতি আসলে কৃতজ্ঞতা জানানোর সংস্কৃতি।
        
                      বঙ্গের এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নৃত্য গীত বাদ্য সংস্কৃতির কথা আজ সর্বজনবিদিত । এখানে "চললে নাচ আর বললেই গান" এমন কথার চল রয়েছে । কথাটি প্রায় প্রবাদে পরিনত হয়ে গেছে । নাচ-গান-বাজনা এখানে দৈনন্দিন জীবনের মূল্যবান অঙ্গ । যে কোনও নাচ , গান পরিবেশনের প্রথমে ‘'আখড়া’' বন্দনা করা হয় । এর মাধ্যমে যে মাটিতে দাঁড়িয়ে বা বসে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কৃতজ্ঞতা জানানো হয় সেই মাটি মায়ের প্রতি । মঞ্চ এখানে আখড়া । তাই গান শোনা যায় ---

      ‘আখড়া বন্দনা করি
        গাঁয়ের গরাম হরি
       তা'পরে বন্দনা বজনারী
মদনে ঝুম'র লাগে ভারী ....."

             শুধু মাটি নয়, গ্রাম দেবতাকে এবং ব্রজনারী বলতে ব্রজের নারী নয়, স্থানীয় মহিলাদের স্তুতি করা হচ্ছে, কারণ তাঁদের সাহায্য ছাড়া সকল লোকজ শিল্পই অসম্ভব । 

              আবার মাদ'লে "তুং --" না উঠলে সব লোকনৃত্য , লোকগানই বৃথা । তাই লোক নৃত্যশিল্পী , ঝুমুর রচয়িতা ও ঝুমুরিয়া সকলেই "মাদ'লা" অর্থাৎ মাদল বাদকের প্রতি কৃতজ্ঞ । তার দুঃখে সকলেই সমব্যথী , তারা যথাসাধ্য আহারের ব্যবস্থা করে দিয়ে তার প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা জানাতে প্রস্তুত । সে কথা চোখের জলে ভেজা গান হয়ে এসেছে ---

      মাদল করে রাঁই রাঁই
       মাদ'লা ত ঘরে নাই ,
 মাদ'লাকে কাঁধে ক'রে আ'ন্ ব ,
 তবু হামরা নাচ্অ লাগাব ।।

  ছানায় করে মাই -- মাই ---
  মাদ'লার ত খা'তে নাই ,
  মাদ'লা কে মাড় মা'গে খাওয়াব ,
    তবু হামরা নাচ্অ লাগাব ।।"

         --- আমরা দেখি টুসু পূজা, ভাদু পূজায় মূল উদ্যোক্তা কুমারি মেয়েরা । এই উৎসবে শ্রদ্ধা জানানো হয় এই দুই লোকদেবীর প্রতি । পূজাগুলির উদ্দেশ্য, উৎপাদিকা শক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন । সম্মান প্রদর্শন । একই ধরনের ভাবনার প্রকাশ ‘করম’-এ , ‘জাওয়া’-য় । তাছাড়া করমে বৃক্ষ দেবতারও পূজা করা হয় । "একটি গাছ একটি প্রাণ" , "একটি গাছ হাজারো প্রাণ " --এসব বিজ্ঞাপন মূলক প্রচার এর বহু পূর্বেই সীমান্তবাসী মানব জীবনে , পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের অপরিসীম অবদানের কথা স্মরণ করে বৃক্ষ বন্দনা করেছেন । 

              ইন্দ পরব , ছাতা পরবে মানভূম এলাকার রাজা ও জমিদারদের বিশেষ উন্মাদনা লক্ষ্য করা যেত , এখনও সে ধারা রয়ে গেছে । ইন্দ্র ধ্বজা ওড়ানোর জন্য একটি প্রকাণ্ড সাল গাছের কান্ডের প্রয়োজন হয় । নির্দিষ্ট দিনে রাজা বা জমিদার শালবন গিয়ে একটি বিশেষ বৃক্ষ নির্বাচন করেন , যে গাছে কোন পাখির বাসা নেই । গাছটি ছেদন করার পূর্বে গাছের গোড়ায় নতজানু হয়ে বসে বনদেবতার উদ্দেশ্যে বলেন , " হে দেবতা, কৃষিই আমাদের বাঁচার অবলম্বন । কৃষি কাজের জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন । বৃষ্টির জন্য আমরা প্রত্যেক বছর ইন্দ্র দেবতা কে পূজার মধ্য দিয়ে তুষ্ট করি । সেই কারণে একটি বৃক্ষ আমরা আপনার কাছে চেয়ে নিচ্ছি এবং তার পরিবর্তে আমরা কয়েকটি বৃক্ষচারা অবশ্যই রোপন করছি।" নিসর্গ প্রকৃতির প্রতি , বনদেবতার প্রতি এই নিবেদন ও প্রার্থনা মানবমনের কৃতজ্ঞতার পরিচায়ক ।

            আবার ১৩ জৈষ্ঠ্য রোহিনীর দিন "বীচপুহ্ণা" । কৃষক তাঁর খেতের এক কোণে মাটি তৈরি করে লৌকিক পদ্ধতিতে পূজা-অর্চনা সেরে ধানবীজ ছড়িয়ে দেন । আমন ধান প্রাণে বাঁচার প্রধান রসদ । তাই মা লক্ষ্মী জ্ঞানে তাকে সম্মাননা জানানো হয় । কৃষক তার বাড়ির কাজের মহিলাটিকে এদিন রোহিনী মাটি আনার জন্য স্নান করতে ভাল তেল সাবান দেন , খাবার হিসাবে পিঠে পায়েসের ব্যবস্থা করেন । দিকে যেমন কৃষি লক্ষ্মীর বন্দনা অপরদিকে তেমনি কাজের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতার ।

               ৭ আষাঢ় অম্বুবাচী । মা বসুন্ধরার রজঃস্বলার সূচনা দিবস । এদিন পুরুলিয়ার কৃষক-শ্রমিক মাটিতে লাঙ্গল দেয় না , কোদাল পাড়ে না । এমনকি জলশৌচের পর হাতমাটির জন্য মাটিটিও তারা আগের দিন কোন পাতায় তুলে রাখে । সেদিন ধরিত্রী মাতার গায়ে হাত দেয় না । 

                   সীমান্ত বঙ্গে যেখানে যেখানে রাজবাড়ী রয়েছে , সেখানেই রথযাত্রার আয়োজন । রথের দিন পুরুলিয়াবাসী গরুর গাড়ি চালায় না , এমনকি চাষ জমিতে লাঙ্গলও দেয় না । গো-গাড়িকে তারা রথ জ্ঞান করে সেদিন গো-গাড়ি চালনা বন্ধ রেখে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথ এর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় । শ্রাবণ সংক্রান্তিতে দেবী মনসার পূজা । মনসার বাহন সর্প বিষধর ভয়ঙ্কর হলেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই সমস্ত প্রাণীর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে । তাই মানুষ শুধু শ্রাবণ সংক্রান্তিতেই নয় ১৩ জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন সংক্রান্তি পর্যন্ত দশহরা , অম্বুবাচী প্রভৃতি দিনগুলিতেও সর্পদেবী মনসার পূজা করেন এবং সর্প নিধন থেকে বিরত থাকেন ।

                 আশ্বিনে শরৎ আলোর অঞ্জলিতে যখন সারা মাঠের সোনার ধান ঝলমলিয়ে ওঠে সন্তানসম্ভাবনাময়ী যুবতীর মতো , তখন সংক্রান্তির দিন মা লক্ষ্মীর সাধভক্ষণ । কৃষক শুভ্র-সুচি বস্ত্র পরে আতপচাল, দুধ, মিষ্টি, ফল, আখ ইত্যাদি মিশিয়ে সাধ-অন্ন তৈরি করে খেতে নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়ে আসেন । মানপাতায় সাজিয়ে দেওয়া হয় অন্ন, পাশে থাকে ওলের টুকরো। উচ্চারিত হয় লৌকিক মন্ত্র— 

       "ওল গোল গোল, মানের পাত, 
    ভজ মা লক্ষ্মী দুদুভাত" ।

         --- এই খাবারগুলির সঙ্গে ধানগাছের স্বাস্থ্যবতী হওয়ার কোনও বিজ্ঞানসম্মত কারণ হয় তো নেই , কিন্তু যা আছে তা হল, মেয়ে বা গর্ভসম্ভাবনাময়ী মায়ের প্রতি ভালোবাসা ।  

               আবার যে দিন কৃষকের খেতের সব ধান এসে যাচ্ছে খামারে, সে দিন শেষ আঁটিটিকে ফুলে-পল্লবে সাজিয়ে ধূপধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে মাথায় করে নিয়ে আসা হয় খামারে । পরদিন খামারের তালপাতা , খেজুর ডাল , বুয়ান বাতা দিয়ে তৈরি আগুড় থাকে বন্ধ । সে দিন লক্ষ্মীর বিশ্রামের দিন।

                 কার্তিক মাসে কালীপূজার পরদিন গো-বন্দনা করেন এখানকার চাষিরা । এটি ‘বাঁধনা পরব’ নামে পরিচিত । এই পরবে আদর যত্ন করে গরু-গাভীদের স্নান করানো হয় । সর্ষের তেল দিয়ে মালিশ করে দেওয়া হয় শিং দু'টি । গরুর সারা গায়ে আঁকা হয় নানা রঙের ছবি । ভালো-মন্দ খাবার-দাবারের ব্যবস্থাও থাকে । সন্ধ্যায় উত্থন থালা সাজিয়ে, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে গোদেবতার পূজা করা হয় । পূজা করা হয় কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলিরও । লাঙল, মই, জোয়াল, ঘরের খুঁটি, ঢেঁকি, দরজা, জানলা—কেউ পূজা থেকে বঞ্চিত হয় না এ দিন । এগুলি অচেতন বস্তু হলেও বারোমাস আমাদের সেবায় নিবেদিত । তাই সেগুলির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্যই এই উৎসবের মত্ততা ।

                 বাঁধনা পরবের পর দিন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া । তার পর দিন যমদ্বিতীয়া । সে দিন গো-বন্দনার রীতিতেই মোষের বন্দনা করা হয় । কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় গবাদিপশুর উপকারিতা কম নয় । তাই তা স্বীকার করে তাদেরও পূজো ।

              আবার এ সময় এই এলাকার বাউরী সম্প্রদায় হাঁড়িকাড়া বলে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পূর্ব পুরুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় । তারপর অঘ্রাণ এলে প্রতি রবি ও বৃহস্পতিবার ইতু পূজার আয়োজন । ইতুর মধ্য দিয়ে সূর্য ও মৃত্তিকা বন্দনা করা হয় । বিজ্ঞানও বলে সূর্য এবং মৃত্তিকার মহাসংগমের মধ্য দিয়েই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অস্তিত্ব রক্ষিত হয় । পুরুলিয়াবাসী ইতু পূজার মধ্য দিয়ে সেই সূর্য ও মৃত্তিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় ।

                     এই অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির রাতে অনুষ্ঠিত হয় মাড়া পূজা । পূজা করা হয় কৃষকের খামারে । পূজা পায় টাঁড়, মুগুর, বাঁশের ঝু়ড়ি-ঝাঁটা-কুলা-ডালা ,দড়ি , দড়া , বড়্ , আঁদ , বিউনি ইত্যাদি কৃষি কর্মের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি । পরদিন সেগুলি ছোঁয়া নিষেধ, এমনকি , সেগুলি যে খামারে রাখা হয় , সেখানে ঢোকাই নিষেধ । সে দিন ওই সব সাংসারিক সরঞ্জামের বিশ্রামের দিন ।

            পৌষ সংক্রান্তির দিন হয় পিঠের উৎসব । সংক্রান্তির আগের দিন ‘বাউড়ি’ । ‘বাউড়ি’ মানে পিঠে তৈরির হাঁড়িতে খড়ের দড়ির পৈতে পরানো । এ বিশেষ সম্মান প্রদর্শন ছাড়া আর কী ! শুধু পিঠের হাঁড়ি নয় , ঘরের খুঁটি , দরজার চৌকাঠের উপরেও পৈতে পরানো হয় । পরদিন মকর স্নান সেরে এসে নতুন পোশাক পরে সেই সমস্ত পৈতা খুলে দেওয়া হয় ।

            মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে অর্থাৎ সরস্বতী পূজার দিন রাঁধাবাড়া আর তার পরদিন বাঁসি ভাত বা ভিজা ভাতের পরব । সে দিন রান্নাঘরের বিশ্রামের দিন । সেদিন ষষ্ঠী । ষষ্ঠীপূজার দিন উনুন পূজা, শিল-নড়া, বঁটি— এক কথায় যাবতীয় রান্না-সামগ্রীর পূজা এবং বিশ্রামদানের প্রয়াস । সারাবছর যে অচেতন দ্রব্য গুলি আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আত্মত্যাগ করে আসছে , তাদের অন্তত সম্বৎসরে একটা দিন বিশ্রাম দেওয়া , শ্রদ্ধা জ্ঞাপন । এটাই কৃতজ্ঞতা , এটাই কৃতজ্ঞতার সংস্কৃতি ।

        তবে সময় যতো এগোচ্ছে লোকসংস্কৃতির সকল শাখাতেই দ্রুত পরিবর্তন চোখে পড়ছে । আজকের প্রজন্মের বেশির ভাগই এই সমস্ত লোকাচার , সুস্থ সংস্কৃতিকে প্রাচীন অভ্যাস , কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছে । লোকশিক্ষার অবলুপ্তি ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে মানবিক গুণাবলী , মেকি সভ্যতার নষ্ট কোলাহলে ফুরিয়ে যাচ্ছে মা মাটির সঙ্গে নাড়ীর যোগ । তবু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আধুনিকতার বিষবাষ্পে যেন ঢাকা পড়ে না যায় আন্তরিকতার এই মহান ঐতিহ্য ।







সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : দেবাশিস সাহা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪