শাক্তপদে পারিবারিক সমাজজীবন
শাক্তপদে পারিবারিক সমাজজীবন
তপন পাত্র
বাংলার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর "আমরা" কবিতায় বলেছেন ---
"দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি,
আকাশে প্রদীপ জ্বালি,
আমাদের এই কুটীরে দেখেছি ,
মানুষের ঠাকুরালি।"
কথাটি বাঙালি পরিবারে এবং এই বাংলার সমাজ জীবনে সর্বাংশে সত্য । কেননা বাংলার আকাশ , বাতাস , মাঠ-ঘাট-প্রান্তর , কুটীর , রাজপথ সাধনার ধন প্রাণের দেবদেবীকে কল্পরাজ্যের স্বর্গে থাকতে দেয় নি , নামিয়ে এনেছে ধুলো ধূসরিত মর্ত্যের ধুলায় । তাই বাংলার সমস্ত ধর্মীয় সাহিত্যের মতো শাক্ত সংগীতেও সমসাময়িক পারিবারিক জীবন তথা সমাজ জীবন তথা মাতা-কন্যার সম্পর্কের বা বাৎসল্য রসের বিশেষ ছায়াপাত আমরা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করি ।
শাক্ত পদাবলীর "লীলা" অংশে অর্থাৎ "বাল্যলীলা", "আগমনী" এবং "বিজয়া"র পদগুলিতে বাংলা সুপরিচিত সাংসারিক আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে । পারিবারিক সমাজ জীবনের ছবি রয়েছে "ভক্তের আকুতি" পর্যায়ের গান অর্থাৎ শ্যামাসঙ্গীত গুলিতেও ।এই চিত্র অত্যন্ত মধুর । সাধারণ পারিবারিক জীবনের সুখ-দুঃখ , হাসি-কান্না , ব্যথা-বেদনার মর্মস্পর্শী বাণীরূপ বড়ই হৃদয়গ্রাহী ।
সাধারণভাবে পিতা-মাতা এবং সন্তান-সন্ততি নিয়ে এ দেশের পরিবার গঠিত । বয়স্ক বয়স্কারাও থাকেন ; ঠাকুমা , ঠাকুরদা । দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশীদেরও একটা যোগ থাকে বৈকি । আনন্দ উৎসবের দিনে তাঁরা আনন্দে এবং দুঃখ-বেদনার দিনে বেদনায় অংশগ্রহণ করেন । আবার প্রতিবেশীদের সামাজিক সমালোচনাও যেকোনো পরিবারকে বিব্রত করে । কিছু কিছু সংসারে জামাতারও একটা বিশেষ প্রভাব নজরে আসে ।
শাক্ত পদাবলীর আগমনী এবং বিজয়া পর্যায়ে বর্ণিত চরিত্রগুলি দেবাদিদেব মহাদেব, জগজ্জননী দুর্গা, গিরিরাজ হিমালয় এবং তাঁর স্ত্রী মেনকা । এঁরা সকলেই দেব চরিত্র কিন্তু শাক্ত কবিদের হাতে পড়ে যেন মধ্যবিত্ত বাঙালি চরিত্রে পরিণত হয়েছেন । এই সকল পদাবলীতে যে স্থানগুলির বর্ণনা আছে, সেগুলিও বাংলাদেশের চৌহদ্দীর মধ্যে এসে পড়েছে । কৈলাস পর্বত ও মানস সরোবর যেন আমাদের ডোবার ধারে, পানাপুকুরের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে । আগমনী ও বিজয়ার গানে যেমন শাশ্বত মানবিক আবেদন আছে , তেমনি আবার সেগুলি তৎকালীন মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজজীবনের সুস্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য দলিল -এ পরিণত হয়েছে ।
বাল্যলীলার পদগুলিতে জগৎ জননী শ্যামা মায়ের অনন্ত লীলামাধুরী বর্ণিত হলেও দেবী এখানে স্নেহের দুলালী রূপে মর্ত্য জননীর কোলে আবির্ভূত হয়েছেন । রামপ্রসাদের একটি পদে মা মেনকা গিরিরাজ হিমালয়ের কাছে বলছেন , "আমার উমা সামান্য মেয়ে নয়" , ... "ওহে কার চতুর্মুখ , কার পঞ্চমুখ , উমা তাদের মস্তকে রয় " । চতুর্মুখ ব্রহ্মা এবং পঞ্চানন শিব উমাকে মস্তকে ধারণ করেন , কন্যা উমা "রাজ-রাজেশ্বরী হয়ে হাস্য বদনে কথা কয়" । রাজ-রাজেশ্বরী দশমহাবিদ্যার মধ্যে দেবীর একটি রূপ । স্বপ্নে মেনকা দেবীর এইরূপ দর্শন করলেও বাস্তবে দৈনন্দিন জীবনে গিরিরাণী গিরিরাজের কাছে উমার অভিমান ও দুষ্টুমির কথা বলে অনুযোগ জানান -- উমা অভিমান করে কাঁদে , মাতৃদুগ্ধ পান করতে চায় না । ক্ষীর , নবনীও খেতে চায় না । গগনে চন্দ্রোদয় হলে তা ধরে দিতে বলে । মায়ের আঙুল ধরে মাকে টেনে নিয়ে যায় । মা মেনকা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, আকাশের চাঁদ ধরা যায় না । তখন উমা অলংকার দিয়ে মাকে প্রহার করতে যায় । স্ত্রীর কাছে কন্যা সম্পর্কে এ সব কথা শুনে গিরিবাজ কন্যার কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেন ।
" উমা কেদেঁ করে অভিমান , নাহি করে স্তন্যপান
নাহি খায় ক্ষীর ননী সরে ।।
অতি অবশেষ নিশি , গগনে উদয় শশী ,
বলে উমা , ধরে দে উহারে ।
কাঁদিয়ে ফুলালে আঁখি , মলিন ও মুখ দেখি ,
মায়ে ইহা সহিতে কি পারে ?
আয় আয় মা মা বলি, ধরিয়ে কর-অঙ্গুলি,
যেতে চায়, না জানি কোথা রে ।
আমি কহিলাম তায় , চাঁদ কি রে ধরা যায় ,
ভুষণ ফেলিয়া মোরে মারে ।।
উঠে বসে গিরিবর , করি বহু সমাদর
গৌরীরে লইয়া কোলে করে ।।"
আবার কবি রাধিকাপ্রসন্নের একটি পদে মা মেনকা বলছেন ---
"আর জাগাস্ নে মা জয়া , অবোধ অভয়া ,
কত করে' উমা এই ঘুমালো ।
মা জাগিলে একবার , ঘুম পাড়ানো ভার . . . "
জয়া যেন উমাকে না জাগায় । চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে উমা , তাকে ঘুম পাড়ানোই দায় । এখানে মা মেনকার কথাটি একেবারে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের আটপৌরে মায়ের মতন ।
কালী মির্জা বা কালিদাস চট্টোপাধ্যায়ের বাল্যলীলা পর্যায়ের একটি পদে দেখছি , গিরিবালিকা মা মেনকার হাত ধরে চলেছেন , কখনো বা সখীদের সঙ্গে তিনি খেলা করছেন , সখীরা তাঁর "কালী" নামটি ধরে ডাকছেন । এই কালী বা কালিকাই এখানে গিরিবালিকা ।
"চঞ্চল চরণে চলে অচল নন্দিনী ,
...........
জননীর হাতে-ধরা , হাঁটিছে সুধা অধরা
সব সখী সঙ্গে খেলে ,কালী কালী বলে..."
এই পদে হাড়-মাংস , শিরা-উপশিরায় গড়া মানবী উমার মধ্যে যেমন দেবীর মহিমা কীর্তিত হয়েছে , তেমনি আবার পারিবারিক জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে , সখীদের সঙ্গে উমার খেলাধুলার ইঙ্গিতটি ব্যক্ত হয়েছে ।
আবার যখন বর্ষা বিগত প্রায় , মাঠে মাঠে সবুজের সমারোহ , এখানে-ওখানে কাশফুলের দোলা , নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা , পুকুরে দিঘিতে পদ্ম শালুকের লুকোচুরি , ভোরের শিরশিরে বাতাসে কনে বউয়ের মতো হলুদ বোঁটার সাদা ফুল শিউলি টুপ্ টুপ্ করে ঝরে পড়ছে ; রোদ্দুরের লেগেছে চাঁপা ফুলের রং , তখন মা মেনকা বলছেন ---
"সুনীল আকাশে ঐ শশী দেখি ,
কৈ গিরি, আমার কৈ শশিমুখী ?
............
শরতের বায়ু যখন লাগে গায় ,
উমার স্পর্শ পাই , প্রাণ রাখা দায়
যাও যাও গিরি , আনগে , উমায় ,
উমা ছেড়ে আমি কেমন করে রই ।"
গোবিন্দ চৌধুরীর লেখা আগমনী পর্যায়ের এই পদটিতে উমা-জননী মেনকা তাঁর অন্তর্বেদনার কথা গিরিরাজ এর কাছে প্রকাশ করেছেন । নির্মল নীল আকাশে শরতের চাঁদ উঠেছে , কিন্তু গৌরীর মুখশশী এখনও দেখা যাচ্ছে না । উমার বর্ণ নিয়ে শিউলির আগমন ঘটেছে , কিন্তু সে এখনো এলো না । শরতের মৃদু শীতল বায়ু গায়ে এসে লাগছে , উমার স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে । মায়ের প্রাণ রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে । তাই গিরিরাণী গিরিরাজকে অনুরোধ জানাচ্ছেন উমাকে পিতৃভবনে নিয়ে আসার জন্য ।
আমাদের শাস্ত্র বিধান দিয়েছে , "অষ্টম বর্ষে ভবেদ গৌরী"। স্বাভাবিকভাবেই উমা আট বছরে পদার্পণ করলেই পুণ্য লাভের আশায় গিরিরাজ হিমালয় তাকে পাত্রস্থ করেছেন , এখন সুদূর কৈলাস থেকে বৎসরান্তে মাত্র তিন দিনের জন্য কন্যার আগমনকে কেন্দ্র করে যে সকল করুণ বিষয়গুলি শাক্ত সংগীতে বর্ণিত হয়েছে তাতে মেনকা আমাদের বাঙালি ঘরের মা হয়ে উঠেছেন । মনে মনে যখন কন্যাকে নিয়ে আসার কথা ভাবছেন , গিরিরাজ কে এ বিষয়ে অনুনয়-বিনয় করছেন , তখনই গিরিরাজের কাছে বলছেন ---
"গিরি , এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাব না।
বলে বলবে লোকে মন্দ , কারো কথা শুনবো না ।।
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয় , উমা নেবার কথা কয় ----
এবার মায়ে-ঝিয়ে করবো ঝগড়া জামাই বলে মানবো না ।"
---এবার কোনমতে একবার কন্যা উমা বাপের বাড়িতে এলে তাকে আর শ্বশুরবাড়িতে পাঠাবেন না মা মেনকা । এতে যদি লোকে নিন্দা করে , অপবাদ দেয় , তাতেও কারো কথায় তিনি কান দেবেন না । এমনকি স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয় অর্থাৎ জামাতা মহাদেব যদি এসে মাকে নিয়ে যাবার আবেদন জানায় , তবুও তিনি পাঠাবেন না বরং মা ও মেয়ে জোট বেঁধে ঝগড়া করবেন । জামাইয়ের সম্মানটুকুও রাখবেন না ।
কন্যা উমার জন্য মা মেনকার নিদ্রাতেও শান্তি নেই । দুঃস্বপ্নের অতর্কিত আক্রমণে জেগে ওঠেন এবং গিরিরাজকেও জাগান ।
"কুস্বপন দেখেছি গিরি উমা আমার শ্মশানবাসী;
অসিত বরণ উমা মুখে অট্ট অট্ট হাসি ।
..........
উঠে হে উঠ অচল, পরান হল বিকল,
ত্বরায় কৈলাসে চল , আন উমা সুধারাশি।"
শারদীয় দুর্গাপূজার সময় উমা পিতৃগৃহে আসবে তার আগেই হতদরিদ্র পরিবারের কন্যার দুরবস্থার কথা ভেবে মায়ের উদ্বেগ ও ব্যাকুলতার অন্ত নেই । মেনকা এখানে স্নেহময়ী চিরন্তনী জননী । তিনি স্বপ্ন দেখেছেন উমা শ্মশানবাসিনী । তার গৌরবর্ণ কালো হয়েছে । মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে সে অট্টহাসি হাসছে । ভিখিরির সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ের জীবনে সুখ-শান্তির কণামাত্র নেই কোনোদিন । এখানে পৌরাণিক তত্ত্ব বঙ্গ-মৃত্তিকার জীবন রসে প্লাবিত হয়েছে । উৎকণ্ঠায় ও আবেগের মাঝে মেনকার কন্যাবাৎসল্য মাতৃমূর্তিকে জীবন্ত , প্রাণবন্ত করে তুলেছে ।
উমার জন্য মা মেনকার জাগরণে অশান্তি ও দুশ্চিন্তা আর নিদ্রায় শুধু মন্দ স্বপ্ন । মা মেনকা তাঁর স্বপ্নকথা স্বামীর কাছে বর্ণনা করেছেন । কন্যাকে তিনি স্বপ্নে দর্শন করলেন কিন্তু গিরিরাজ অচৈতন্য হয়ে নিদ্রা যাচ্ছেন । ওদিকে তার কন্যা একাকিনী শ্মশানবাসিনী । চারদিকে শুধু শেয়ালের ডাক । গিরিরানী প্রায় চোখের জলে ভাসছেন । গৌরী সঠিক কেমন আছে এই , সে খবর কে ইর এনে দেবে ?
"আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে !
গিরিরাজ অচেতনে কত না ঘুমাও হে ।
..............
আর শুন অসম্ভব চারিদিকে শিবা-রব হে ।
তার মাঝে আমার উমা একাকিনী শ্মশানে ।
বল কি করিব আর , কে আনবে সমাচার হে ?
না জানি মোর গৌরী আছে কেমনে !"
আগমনী পর্যায়ের এই পদটি মনস্তাত্ত্বিক এবং তত্ত্বগত মূল্যে ভরপুর । সে সময় কুল রক্ষার তাগিদে কুলীন ঘরের মেয়েকে ভিখারি নেশাগ্রস্থ বৃদ্ধ পাত্রের হাতে সমর্পন করতে হয়েছে । মায়েরা বহুবিবাহে বিবাহিত জামাইয়ের কারণে মেয়ের দুর্দশার কথা ভেবে বেদনা দীর্ণ হৃদয়ে কাল কাটিয়েছেন ।
দাশরথি রায়ের একটি পদে মা মেনকা গৌরীকে স্বপ্নে দর্শন করেছেন । সে স্বপ্নে দেখা দিয়ে চৈতন্য করিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই অন্তর্ধান হয়েছে । তাই মা বলছেন ---
"দেখা দিয়ে কেন হেন মায়া তার !
মায়ের প্রতি মায়া নাই মহামায়ার ।
আবার ভাবি গিরি , কি দোষ অভয়ার
পিতৃদোষে মেয়ে পাষাণী হলো ।।"
মায়াবিনী কন্যা তার সম্মোহনী শক্তি দিয়ে দেখা দিয়েও অদৃশ্য হয়ে গেল । মায়ের প্রতি মহামায়ার দয়া মায়া নেই । অভিমান বসত মেয়েকে অপবাদ দিতে গিয়ে তৎক্ষণাৎ বলছেন , কন্যার কোন দোষ নেই । তার পিতা যেহেতু পাষাণ , তাই কন্যাও পাষাণ হৃদয় হয়ে উঠেছে । এই অভিমান , অভিযোগ বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পায় না । দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে শুধু দুশ্চিন্তা । কবি হরিশচন্দ্র মিত্র তাঁর আগমনী পর্যায়ের একটি পদে বলছেন ,
"বাছার নাই সে বরণ, নাই আভরণ ,
হেমাঙ্গী হইয়াছে কালীর বরণ ;
হেরে তার আকার , চিনে উঠা ভার ,
সে উমা আমার উমা নাই হে আর ।"
পদটিতে পারিবারিক জীবনের একটি বিশেষ দিক ফুটে উঠেছে । সমকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক দুর্দশার চিত্রটি চিত্রিত হয়েছে । কৌলিন্য প্রথার চাপে অনন্যোপায় পিতা-মাতা বৃদ্ধ ভিখারির সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন নিজের ৮ বছরের মেয়ের । অভাবের চাপে, দুঃখে, মনোবেদনায় প্রিয় কন্যার গাত্রবর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে । মেয়ের সোনার বরণ কালো হয়েছে । তার চেহারা দেখে তাকে চেনা যাচ্ছে না ।
এই দুর্দশার কথার পরিচয় পেয়ে যাই ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তেরও একটি পদে ।
"তুমি তো অচল পতি, বল কি হইবে গতি ।
ভিক্ষা করে ভগবতী কুমারী আমার ।
বাঁচি বল কার বলে, দুঃখানলে মন জ্বলে ,
ডুবিল জলধি-জলে প্রাণের কুমার ।"
অন্তর্বেদনায় জর্জরিত হয়ে গিরিরাজের কাছে মেনকা বলছেন , কন্যার জন্য হৃদয়হীন গিরিরাজের কোন চিন্তা-ভাবনা নেই । মেনোকা সংবাদ পেয়েছেন স্বামীগৃহে স্নেহের দুলালী উমা ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন নির্বাহ করছে । কিছুদিন আগেই পুত্র মৈনাক জলে ডুবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে । এখন মেয়ের এই দুর্দশা । তাই দুঃখ যন্ত্রণার মর্মদাহে দগ্ধ হচ্ছেন মেনকা । হিমালয় তো পাষাণ হৃদয় , খুবই নির্মম , নিষ্ঠুর ; মেয়ের কথা তিনি আদৌ ভাবেন না ।
কন্যাকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা যে যথেষ্ট কারণ রয়েছে , তার পরিচয় পাচ্ছি কমলাকান্তের গানে ---
"হরের বসন বাঘছাল, ভুষণ হাড়মাল,
জটায় কাল-ফণি দুলিছে ।
শিবের সম্বল ধুতুরারি ফুল কেবল তোমারই
মন ভুলেছে ।।
একে সতীনের জ্বালা , না সহে অবলা , যাতনা প্রাণে
কত সয়েছে ।"
জামাই-শিব নেশাখোর । তার সম্বল ধুতুরার ফুল । পরণে বাঘছাল । জটায় ফণী । মেয়ের সতীন গঙ্গাকে শিব খুব আদর স্নেহ করে । উমার প্রতি অবহেলা অনাদর করে । সতীন সর্বদা উমাকে নানান কটু কথায় যন্ত্রণা দেয় । উমার অন্তহীন জীবন যন্ত্রণা । তাই মা মেনকা বলছেন --"আমি শুনেছি শ্রাবণে , নারদ বচনে , উমা মা মা বলে কেঁদেছে ।" কারণ "ঘরেতে সতিনী জ্বালা সদা করে ঝালাপালা" , আর " সারাদিন ঘরে ঘরে ভোলানাথ ভিক্ষা করে" ।
তাই মায়ের মন আর ধৈর্য ধরছে না । বারবার গিরিরাজকে অনুরোধ করছেন মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য । তিনি বলছেন ---
"কবে যাবে বল গিরিরাজ , গৌরীরে আনিতে।
ব্যাকুল হৈয়েছে প্রাণ উমারে দেখিতে হে ।"
কখনো বলছেন ---
"যাও গিরিবর হে,আনো যেয়ে নন্দিনী ভবনে আমার।
গৌরী দিয়ে দিগম্বরে , কেমন রয়েছো ঘরে ,
কি কঠিন হৃদয় তোমার হে ।"
নিধুবাবু মানে রামনিধি গুপ্তও মেনকার কন্ঠে প্রায় একই কথা বসিয়েছেন ---
"গিরি , কি অচল হলে আনিতে উমারে ,
না হেরি তনয়া-মুখ হৃদয় বিদরে ।
ত্বরান্বিত হও গিরি, তোমার করেতে ধরি ,
উমা 'ও মা -' বলে দেখো ডাকিছে আমারে।"
আর অন্ধ চন্ডী বলছেন ,
"আন তারা ত্বরায় গিরি , নয়নে লুকায়ে রাখি ,
হেরিয়ে গগন তারা , মনে হল প্রাণের তারা,
শুনেছি তারা কে নাকি পাঠাবে না তা'রা ।"
আসলে শরৎ আসতেই মায়ের মনে আর ধৈর্য ধরছে না । মেনকা বারবার গিরিরাজ কে কৈলাসে যেতে অনুরোধ করছেন । শুধু মেয়েকে নয়, জামাই নাতি নাতনি এবং প্রতিবেশীদেরও আমন্ত্রণ জানাতে বলছেন । মেনকার বক্তব্যের মধ্যে একজন সমাজ সচেতন নারীর প্রগাঢ় অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে রাম বসুর একটি পদে । পদটি হল ---
"গিরি হে তোমায় বিনয় করি , আনিতে গৌরী,
যাও হে একবার কৈলাসপুরে । "
কিন্তু অচল , পাষাণ প্রাণ গিরিরাজের টনক নড়ে না মেনকার পুনঃপুনঃ অনুরোধেও । মনোমোহন বসু তাঁর একটি পদে মা মেনকার মুখ দিয়ে বলছেন , গিরিরাজ আর কবে প্রাণের কন্যা উমাকে আনতে যাবেন ? তিনি যদি মা হতেন , তাহলে মায়ের বেদনা কী তা বুঝতে পারতেন । তখন তিনি আর কন্যাকে আনার বিষয়ে ছলনা করতেন না । মেনকার প্রাণ কাঁদছে কিন্তু হিমালয় নির্বিকার । নিষ্ক্রিয় । মা মেনকা কল্পনা করছেন, উমা এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা যদি আমাকে পাষাণী বা হৃদয়হীনা বলে দোষারোপ করে , তবু অসহায় আমার কিছু করার নেই । কেমন করে বোঝাবো আমি আমার মাতৃ হৃদয়ের যন্ত্রণা ?
"উমা ভাবে মা পাষাণী , লোকেও কয় পাষাণী রাণী ,
আমি যে পাষাণ-অধিনী , এ কাহিনী কেউ জানে না।"
অবশেষে গিরিরাজের মন গলেছে, তিনি বলছেন ---" আর কেন কাঁদো রাণী , উমারে আনিতে যাই ।" তিনি কন্যার গৃহে পৌঁছে উমাকে বলছেন , তার মায়ের বেদনাঘন অন্তরের হাহাকারের কথা । এবং জামাইয়ের কাছে অনুমতি নিয়ে বাপের বাড়িতে আসার কথা । পিতার মুখে সমস্ত কথা শুনে কন্যা উমা দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে গিয়ে প্রায় অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলছেন --
"ওহে ত্রিলোচন শুন মোর বচন
যাব মোর পিতার ভবন ।
সপ্তমী দিনেতে যাব অষ্টমী নবমী রব
দশমী দিনেতে ফিরবো তোমার ভবনে ।"
দুর্গার অশ্রুসিক্ত বিষন্ন বদন দেখে মহাদেব দরদের সঙ্গে জানালেন ---
"জনক ভবনে যাবে , ভাবনা কি তার ?
আমি তব সঙ্গে যাব, কেন ভাব আর !
আহা আহা মরি মরি বদন বিরস করি,
প্রাণাধিকছ প্রাণেশ্বরী কেঁদো নাকো আর ।
...........
প্রাণপ্রিয়ে যাবে যথা, সঙ্গে সঙ্গে যাব তথা,
ক্ষণমাত্র সঙ্গ ছাড়া হব না তোমার ।"
পিতার সঙ্গে কন্যা উমা বাপের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে । গিরিরাজ বলছেন , "গিরি রাণী এই নাও তোমার উমারে । ধরো ধরো হরের জীবন ধন । "উমাকে তার পিতা কৈলাস ধাম থেকে নিয়ে এসেছেন । মেনকার হাতে সমর্পণ করেছেন । জানিয়েছেন হরের প্রাণধন উমাকে তিনি নিয়ে এসেছেন বহুকষ্টে শিবকে তুষ্ট করে ।
উমাকে কাছে পেয়ে মা মেনকার আনন্দে অশ্রু ঝরছে । নারদ সহ অন্যান্য কত লোকের মুখে হর-পার্বতীর দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণা নিয়ে কত কথাই না শুনেছেন গিরিরাণী , বেদনায় তাঁর মাতৃহৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে । আজ কাছে পেয়ে তিনি মেয়েকে বলছেন ---
"ওমা কেমন করে পরের ঘরে ছিলি উমা বল মা তাই।
কত লোকে কত বলে, শুনে ভেবে মরে যাই ।
মা'র প্রাণে কি ধৈর্য ধরে , জামাই নাকি ভিক্ষা করে !
এবার নিতে এলে,বলবো -হরে, উমা আমার ঘরে নাই।"
কিন্তু মায়ের কাছে কন্যা উমা মায়ের দুর্ভাবনা দূর করার জন্যে বলছেন -- মা, আমি হরগৃহে বড়ো সুখে আছি । কে তোমায় বলেছে , তোমার জামাই শ্মশানবাসী । যে ঘরে আমার বসবাস তার শোভা বর্ণনায় আমি অপারগ । বহু মণিমাণিক্য খচিত সেই গৃহে সর্বদা রাশি রাশি রবি শশীর উদয় । সেই অতুলনীয় আলোকমালায় দিনরাতের ব্যবধান পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই । তোমার জামাই বাঘ ঝাল পারেন , গায়ে ছাই মাখেন আর মাথায় জড়িয়ে রাখেন সাপ ---এ কথা সত্য । কিন্তু তিনি বিশ্বেশ্বর । এই জগতের সর্বময় কর্তা । স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র পারিজাত ফুল নিয়ে তাঁর চরণে প্রণাম জানান । বাহিরের রূপ দেখে তোমার জামাইকে সাধারণ মানুষ চিনতে পারেন না মা । তিনি ষড়ৈশ্বর্যৈর অধিকারী । ভিক্ষা তাঁর জীবিকা হতে পারে না । একথা সত্য যে সুরধনী নামে আমার সপত্নী আছে , কিন্তু তাকে ঘিরে আমার দুঃখের কোন কারণ নেই । সে বড়ো দিদির মতো আমাকে ভগ্নিজ্ঞানে আদর করে ।
---অম্বিকাচরণ গুপ্তের লেখা "ছিলাম ভাল জননী গো হরেরি ঘরে " পদটিতে উমার জবানী শুনে মা মেনকার হৃদয় শান্ত হয়েছে কি না আমরা জানি না । তবে মায়ের বেদনা কন্যা বুঝতে পারছে না বলে , মা বলছেন --"বুঝাবো কি মায়ের ব্যথা, গনেশকে তোর আটকে রেখে "। উমা কিন্তু মায়ের কাছে নিজের সন্তান সন্ততি পরিবৃত সংসারের কথা বলে এবং তাড়াতাড়ি স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে চায় । মা বলেন --"এসেছিস মা, থাক না উমা দিন কত ।"
কিন্তু উপায় নেই । মাত্র তিন দিনের জন্য জামাইয়ের কাছে অনুমতি নিয়ে উমা এসেছে । বিজয়াদশমীর সকালে তাকে ফিরে যেতে হবে । তাই মা মেনকার জীবনে নবমীর রাত্রি কালরাত্রি । তিনি কখনো ভাবছেন ---"কালকে ভোলা এলে বলবো , উমা আমার নাইকো ঘরে।" আবার কখনো বা নবমীরাত্রিকে অতিশয় হল নারী রূপে কল্পনা করে নিন্দাবাদ করছেন । বলছেন --
"খলের প্রধান যত, কে আছে তোমার মত।
আপনি হইয়ে হত , বধরে পরেরি প্রাণ ।"
কখনো বা অনুনয়-বিনয় করছেন ---
"যেও না রজনী, আজি লয়ে তারাদলে।
গেলে তুমি দয়াময়ী , এ পরাণ যাবে !
উদিলে নির্দয় রবি উদয় অচলে,
নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে ।"
কিন্তু কিছুতেই কিছু কাজ হয় না । প্রাকৃতিক নিয়ম কে খন্ডাবে ? একসময় নবমী নিশি ভোর হয় ।
"কি হলো, নবমী নিশি হইল অবসান গো ।
বিশাল ডমরু ঘন ঘন বাজে , শুনি ধ্বনি বিদরে পরণ গো ।"
দশমীর সকাল হতে না হতেই মহাদেব গৌরী কে নিয়ে যাবার জন্য এসে উপস্থিত ।
"বিছায়ে বাঘের ছাল, দ্বারে বসে মহাকাল।
বেরোও গণেশ মাতা ডাকে বারবার ।"
কন্যা বিচ্ছেদ ব্যাকুল মেনকার যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয়ের ছবি ফুটে উঠেছে বিজয়ার পদগুলিতে । মা ভেবেছিলেন মায়ে-ঝিয়ে ঝগড়া করে হলেও জামাইকে ফেরত পাঠাবেন , কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কন্যা উমাই আর দেরি করতে চায় না ।
উমা মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে ছেলেমেয়েদের সাথে করে কৈলাস অভিমুখে রওনা দিচ্ছে । মা মেনোকা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলছেন ---
"এস মা এস মা উমা বলো না আর যাই যাই
মায়ের কাছে হৈমবতী ও কথা মা বলতে নাই।।"
উমা চলে যায় । তখন মা মেনকার একমাত্র সান্ত্বনা --"ভালোবাসি যারে, সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।"
তাই আমরা এতটুকু দ্বিধা না করে বলতে পারি, শাক্ত পদাবলীর লীলাপর্ব হলো পৌরাণিক কাহিনীর আড়ালে বাংলার পারিবারিক সমাজজীবনের সংগীতময় বাণীরূপ । তবে লীলাপর্বের পদগুলি ছাড়াও অন্য পদে যেমন ভক্তের আকুতিতেও এই পারিবারিক জীবনের ছবি দুর্লভ নয় । ভক্তের আকুতি পর্যায়ে মায়ের প্রতি সন্তানের যে মাতৃভাবের বর্ণনা পাই, তা-ও লৌকিকভাবেই পরিপূর্ণ । স্নেহ-আদায়ের ছলে সন্তানের অভিমান, অনুযোগ, ক্রোধ, সংশয় , একান্ত নির্ভরতা প্রকাশ পেয়েছে অত্যন্ত জীবন্ত রূপে । সন্তান চিত্র সেখানে প্রাণবন্ত । এমন স্নেহের লুকোচুরি , এমন মনের কথা বলাবলি শাক্তপদ ছাড়া বুঝি পৃথিবীর আর কোনো ভাষার কোনো সাহিত্যে নেই ।
_________


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন