প্রত্নযাত্রার জীবনানন্দ: প্রসঙ্গ অগ্রন্থিত কবিতা

প্রত্নযাত্রার জীবনানন্দ : প্রসঙ্গ অগ্ৰন্থিত কবিতা


শিমুল আজাদ


'এই কবিতাগুলির পরিবেশ প্রকৃতি অনেক বেশি ছড়ানো, প্রাথমিক স্তরগুলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।'
-এ যাবত জীবনানন্দ দাশের সব কটি কাব্যগ্রন্থের কম-বেশি আলোচনা ও মূল্যায়ন হয়েছে। অপ্রকাশিত লেখার উল্লেখযোগ্য মূল্যায়ন হয় নি। প্রকাশিত লেখার পাশাপাশি অপ্রকাশিত লেখার মূল্যায়ন বা আলোচনা ভিন্ন স্বাদ ও বৈচিত্র্যের দাবি রাখে। -এক্ষেত্রে কবি জীবনানন্দ দাশের ৪০টি অপ্রকাশিত কবিতা তাঁর অন্যান্য কবিতার মতো সমৃদ্ধ-সন্তাপে উষ্ণতা ছড়ায়। মহাকবিতার আলোড়ন টের পাওয়া যায়। সৃষ্টির রূপ-বৈচিত্র্য বৈভবে- মানবাত্মার জয়-পরাজয়-তৃষ্ণা, হাহাকার-আকুতি-প্রচেষ্টা কর্মময় উদ্ভাস জেগে ওঠে। পৃথিবীর রঙ-গন্ধ-বিভা-আলোড়নে আলোড়িত, প্রাণিত কন্ঠস্বর, গন্ধগাথা ঐতিহাসিক রূপ-নির্মাণে- ব্যক্তির সামষ্টিক পদযাত্রা ধ্বনিত হয়। কবি প্রত্নরাখালের মতো সভ্যতা- সংস্কৃতির আদি- অকৃত্রিম সত্তায় ডুব দেন; অন্বেষণ করেন প্রকৃতির রূপ-রীতি, কাঠামো, পরকাঠামো। হাতড়ে ফেরেন নক্ষত্র-চাঁদ-আকাশ-নদী-পাহাড়-মানুষ-বৃক্ষসারি; একস্থান থেকে আর একস্থান, এক বন্দর থেকে আরেক বন্দর, এক সমুদ্র থেকে সাত সমুদ্র, এক নক্ষত্র থেকে আরেক নক্ষত্রে- অক্লান্ত প্রাণে, তৃষ্ণার্ত যাত্রায় জেগেছেন কবি; এঁকে গেছেন মানবের অভিব্যক্তি, চিন্তার আলোড়ন, বোধের বিবর্ণ আরশি ও বিস্তৃতি।
‘কালপুরুষের উক্তি প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশ বলেন, 'জীবন ও প্রকৃতির অবাধ, অগাধ সমুদ্রকে রোমান্টিক কবি সামুদ্রিক সাপের মতো আহত ও আলোড়িত করে চলেছেন। কখনও ভোরের-দুপুরের-নকটান-রাঙা পশ্চিমের মেঘ কখনও নক্ষত্রের আকাশ কখনও সেই সমুদ্রের ছবিকে বদলে বদলে দিচ্ছে।' রোমান্টিক কবির মানস অংকন করতে গিয়ে তাঁর এই আবিস্কারের অবয়ব- কবির অপ্রকাশিত কবিতাগুলিতে প্রবল।
নিসর্গ-প্রীতি, প্রেম-জীবন-মৃত্যু-স্থবিরতা, সময়-সভ্যতা-প্রকৃতির ভাঙচুর, রহস্য বিস্ময় এসেছে -এই সমস্ত কবিতার বিষয় হিসেবে। আত্মসুধা-জাগরণ বিধৃত হয়েছে: সুখ-অসুখ-ব্যথা-কাতরতা-আনন্দ-উল্লাস- স্তিমিত-নমিত ডানার উড়াল, নেমে আসা ধ্বনি অপার গান; আলো অন্ধকার নিভৃতে জাগরণ, নক্ষত্র-সমুদ্র-আকাশ-পাহাড় বরফ আগুন কোলাহল শান্ত-অস্থিরতা, শান্তি-স্বস্তি স্পর্শের অনুরূপ অনুভব ঘনিয়ে এসেছে শিশিরের মতো। নিরাশা নিয়তি ভাঙা গড়ার আন্দোলন, ক্ষয়-ক্ষতি, নির্মাণে- নিজস্ব ঐতিহ্য অবস্থানে সজ্ঞানে- অজ্ঞানে করেছেন আত্ম-আবিষ্কার। প্রাণে, মর্মে ধ্বনিত করেছেন। স্বপ্নচারী হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে দূরচোখ মেলে দিয়েছেন একাল-সেকাল।
পৃথিবীর পথে-প্রকৃতিতে- সমুদ্রের সৈকতে-নির্জনে, রাতের নিস্তব্ধতায়-সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যে এবং ঘনিভূত অন্ধকার রাত তুলে এনেছেন; আবিষ্কার করেছেন, নিয়মের ভিতর অনিয়ম, শৃঙ্খলার ভিতর বিশৃঙ্খলার অবস্থান।
'মানুষের বেদনার গহ্বরে অন্ধকারে 
আলোর মতো যেই আশা জেগে থাকে
হলুদ পাতার বুকে লেগে থাকে
যেই মিষ্টি মরণের ঘ্রাণ' 
আদি অকৃত্রিম সাহস ও প্রথম প্রলয়ের প্রাকৃতিক উদ্ভাস থেকে চিরন্তন বিষয় ও বিশ্বাস, নিঃশ্বাস ও প্রত্যয়ে বেড়ে ওঠে- জেগে থাকার গান। প্রকৃতির নিবিড় স্বাদ আস্বাদ, আহ্লাদের কোলে শরীরে আত্মায়, সমুদ্রে, মাটিতে, পাহাড়ে সাঁতরাবার, মিশে গিয়ে উড়ে যাবার গান -এসব। অনুভবে উড়ে উড়ে বিস্তৃৃত বিশাল জলে ভেসে ভেসে, পর্বতের কর্কশে, আকাশের নীলে, মাটির ধুলোয়, আদিম কৃষকের সাজে পরিব্রাজক হয়ে, সমুদ্রের তীরে বসে থেকেছেন। বিস্মিত বালক কেবল খেলা আর খেলার সাজে সেজেছেন। নিবিড় নক্ষত্রের সান্নিধ্যে কথোপকথনে কেটেছে তাঁর সময়, তাঁর আলো-অন্ধকার আর স্থিরতা, গেঁথে গেঁথে বিদীর্ণ করেছে কবির হৃদয়।
'যে ফসল ঝরে যায় তার মত আমাদের হতেছে ফলিতে' জীবনের অর্থ আবিষ্কার এবং তার পরিণতির কালে চিন্তাস্বরে উচ্চকিত এই বোধ। ফসলের ঝরে যাওয়ার সাথে জীবনের উদ্গীরণ সম্ভাবনা নিয়ে জাগরণ; কেবল ঝরে যাওয়া ট্রাজিক অনুভব মর্মে আক্রান্ত করে। আদিম জীবন ও গ্রামীণ সরলতা, শিশির প্লাবন, সবুজ-সন্ধ্যায় কৃষকের ফসল জীবনের গান হয়ে যায়। 
'ঘুমায়ে পড়িতে হবে একদিন আকাশের নক্ষত্রের তলে। 
শান্ত হয়ে উত্তর মেরুর শাদা তুষারের সিন্ধুর মতন! 
এই রাত্রি, এই দিন, এই আলো, জীবনের এই আয়োজন।' 
ক্লান্তি ও মৃত্যুচেতনা জীবনানন্দ দাশের অন্যান্য কবিতার মতো এই কবিতাগুলিতেও এসেছে। এখানে মৃত্যুকে ঘুমানোর উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়েছে। যে ঘুম বিশেষ থেকে নির্বিশেষের। যার ভিতরে জাগরণ ও মহা আলোড়ন লুকিয়ে আছে। উপমা হিসেবে, উত্তর মেরুর শাদা তুষারের স্তুপের যে চিত্রকল্প তা অনুভবে হিম শীতল স্পর্শ সৃষ্টি করে। শিহরিত পরিবেশে নিয়ে যায় রাত্রিদিন, আলো আয়োজন সব পড়ে থাকে। তুচ্ছতা পায়, মৃত্যুর জগতে।

'আকাশ ভরিতে পারি, 
শান্ত করে দিতে পারি পৃথিবীর জ্বর, আমাদের গানে যদি;-
হাত ধরে আসিয়াছি তাই পরস্পর! আমরা জ্বলিতে পারি, 
যদি পারি নক্ষত্রের মতন জ্বালাতে। 
পৃথিবীরে; আগুনের অসহিষ্ণু স্ফুলিঙ্গের মতো আজ দহে। 
তারার আলোর মত জ্বলিয়া উঠিতে পারি যদি কালরাতে!' 
মৃত্যুঞ্জয়ী চিন্তা-চেতনা দুরন্ত সাহসে উজ্জীবিত হয়েছে এই কবিতায়। পৃথিবীর পথে প্রাণের আলোড়ন কম্পন বিচ্ছুরিত হয়। প্রাণের জাগরণ প্রচেষ্টা প্রকৃতির নিয়মকেও পাল্টে দেয়। নিয়মের ভিতর যে অনিয়মের রাজত্ব সংগোপনে রয়ে গেছে তারই আভাস ও আবিষ্কার প্রবণতা লক্ষ্যযোগ্য। প্রত্যয়ের প্রকৃষ্ট পথে, কর্মে জেগে ওঠার সাহস শক্তি বর্ষিত হয়েছে মানব প্রাণ থেকে। প্রকৃতি পাল্টায় জীবন পাল্টায়। যাত্রাপথের পথগুলি পরিবর্তিত হয়। পূর্ব হয়ে যায় পশ্চিম। পশ্চিম চলে যায় পূর্বে। বিশেষ-নির্বিশেষে যাত্রারম্ভ করে। প্রকৃতির জ্ঞান-আলোড়ন-উদ্ভাস-নিয়ম-নীতির রহস্য ভেদের যাত্রা- মানুষের আত্মার আকুতি-স্বাদ বিস্বাদে জ্বলে। আকাশকে পূর্ণতায় ঢেকে পৃথিবীর অসুখকে উপশম করে। মানুষের গান, মানুষের প্রাণ- নক্ষত্রের সীমা ভেঙে মহানাক্ষত্রীকতায় পৌঁছে। প্রাণের দুর্দমনীয় যাত্রা হয় এই কবিতা।
'পৃথিবীর ফসলের ক্ষেতে বসে অবসাদ ফেলেছে হৃদয়। 
আমাদের এই দুই চোখে তাই ঘুম আরো ঘুমে উঠিয়াছে কবে।' 
দুর্দান্ত প্রাণের স্ফুরণে-জাগরণে ও ক্লান্তি ভর করে। জীবনানন্দ দাশ কবি প্রাণে দুর্দমনীয় জাগরণে হাস-ফাঁস করেছেন। প্রকৃতির সত্তায় নিজস্ব সত্তার অনুরণন জাগাতে যেয়ে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়েছেন ভীষণ। জাগরণের দুরন্ত উজ্জীবন যেমন লক্ষ্যযোগ্য হয়, তেমনি লক্ষ্য করা যায় ক্লান্তি ও অবসাদ। সমগ্র মানব সত্তার জাগরণে- যেমন তিনি জেগেছেন, তেমনি তার সত্তার ক্লান্তি ও অবসাদে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কবি প্রাণে-কর্মের ধর্মে জাগরণকে ফসল ফলানোর কৃষকের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছেন এবং এই কর্ষিত ফসলের মাঠ হৃদয় উৎসারে দুই চোখে ঘুমিয়ে পড়তে চেয়েছেন। সেই ঘুম, যে শান্তি, স্বস্তি ও যন্ত্রণার উপশম দিতে পারে। 
'এই ভালো, - নক্ষত্রের স্থির আলো  
পথিকের চোখের ধীরতা; 
পৃথিবীর কোলাহলে জাগিবার 
যতটুকু রয়েছে সময়-তাপ নয়, - 
তারার মতন আলো আর নিশ্চয়তা, 
আকাশের বুক থেকে চেয়ে নিয়ে 
আমাদের স্থির হতে হয়!' 
মানব সত্তার অস্থিরতা, উন্মাদনা- যাতনার ক্ষেত্রে স্থিরতার পোশাক পরাতে জীবনানন্দ প্রচেষ্টা নিয়েছেন। অস্থির-যাতনা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে নক্ষত্রের স্থিরতা। নক্ষত্রের আলোর নিশ্চয়তায় জীবনকে দাঁড় করানোর কথা। 
-তোমার পায়ের পথ প্রতীক্ষায় 
প্রেমিকার মতো জেগে রয়! 
তোমার মত সেও-ভুলে গেছে ঘুম,
গেছে মানুষের ভুলে।' 
প্রেমের অতীন্দ্রিয় উদ্ভাস, আবিষ্কার এবং তার পরিক্রম জীবনানন্দে ঘুরে ফিরে এসেছে। প্রত্নযাত্রায় রাখালের পায়ের চিহ্নের, স্নেহমমতাও প্রাণ পায়, হৃদয় উৎসবে-আনন্দে-স্নিগ্ধতা বোনে। ক্লান্তিহীন যাত্রা - জাগরণের মন্ত্রে সেই মহাভাবনা, দ্যোতনার টান, সমস্ত ঘুমকে ভুলিয়ে রাখে। এমনকি মৃত্যুর বাস্তবতা, সেই যাত্রাপথে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। 
'তারে আমি বলিলাম, 
আমিও তো খুঁজছি এ আকাশের তল,
সহিষ্ণু নদীর মত ঘুম ভুলে। 
সব চেয়ে ক্লান্ত পথ বয়ে। 
পৃথিবীর অন্ধকার পথে ঘুরে 
মানুষের ব্যথা সয়ে খুঁজেছিতো
চেয়ে আমি দেখিলাম চোখে তার প্রাণ-'
কবির মন-প্রাণ-হৃদয়সারে উৎসারিত, প্রাণের স্বপ্ন, আন্দোলনে, সহমর্মিতার স্বপ্ন ছুঁয়ে গেছেন। চোখে বোধে, হৃদয়ে। সেই গভীর ছল ছল সহমর্মিতার আগুন, উত্তাপ জ্বলে, ক্লান্তি ও বেদনা ভুলে। এই শিহরণ আনন্দ লালিত পালিত হয় ডালপালা ছড়ায় মৃত্যুরদিকে, মৃত্যু-জীবন অন্তঃসার অভিজ্ঞতায়। প্রকৃতির রহস্য - অপার আনন্দের অংশী হয়ে এই প্রেম অমরতা পায়।
'আকাশের বুক থেকে পুরাতন দেবতারা পড়িতেছে খসে; 
মৃত্যু শুধু জেগে আছে, 
- মৃত্যুর মতন জেগে রয়েছে সময়;' 
- জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির ঘটমান দৃশ্য থেকে, অবস্থান থেকে, তাঁর হৃদয়ের মননের আলোড়নকে টেনে তোলেন। প্রকৃতির তন্ময় ও শৃঙ্খলায় ভাষা-বোধ-চিন্তা-চেতনায় সংমিশ্রণ ঘটান বর্তমান ও অতীতে। অতীত থেকে বর্তমান এবং বর্তমান ভেঙে ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করেন। চিরন্তন বোধ ও সত্যে পৌঁছানো, জীবনের ও প্রকৃতির অর্থ রূপ-লাবণ্য-আনন্দ-ঐতিহ্য -এ সবেরই অন্বেষণ। 

প্রকৃতির ভিতর অবস্থান করে প্রকৃতির স্বরূপকে অঙ্কিত করতে চান। উপর্যুক্ত দৃশ্যে পুরাতন দেবতার খসে পড়ার দৃশ্যচিত্র-মৃত্যুর জেগে থাকা-সময় মৃত্যুর উপমায় জাগে। অবস্থান বর্ণনার এই ভাবনা, মনোজগৎকে প্রবল আলোড়িত করে। দেবতার খসে পড়ার চিন্তার-চিত্রকল্প। চিন্তার পরিবেশকে নতুন ভাবে 'পৃথিবীর ভাষা' 'আকাশের ভাষা,' ইত্যাদি ভুলে যাওয়ার কথা কবি বলেছেন। সময়ের অবস্থানগত কারণে, আত্মকৃতজ্ঞান ভুলে যাওয়ার কষ্ট স্বীকার করেছেন। যন্ত্রণাকে স্বীকার করেছেন। পৃথিবীর ভাষা, আকাশের ভাষা-প্রকৃতি জ্ঞান চিহ্নিত করে। যা কবিসত্তায়, জ্ঞানসত্তায় অনুভব করা যায়। হৃদয়ের গভীর অবস্থান এই ধাপ টেনে তোলে। এই জ্ঞান সামান্য ব্যাপার নয়। পৃথিবীর ভাষা, আকাশের ভাষা, বোঝার মতো অনেক বড়ো ঘটনা।'চারিদিকে ধোঁয়াগুলো - পৃথিবীর প্রতিহত মানুষের ভিড়,' যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশে প্রকৃতির পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রকৃতির স্বচ্ছতা, স্নিগ্ধতা হারিয়েছে। এই সব ঘটনায় মানব প্রাণের আকুতি, প্রচেষ্টা ফুঠে ওঠে সচেতনতায়।
'অব্যর্থ অতীত হৃদয়ের পিন্ডের
আজো তুলিতেছে সেই শিহরণ। 
তার ক্রীতদাস হয়ে তবু আমাদের 
অন্তরের রক্ত,আজো হয়ে যায় জল।' 
আজকের জীবন, আজকের পৃথিবী অনেক কালের, অনেক জীবনের কলতানে, অনেক বিবর্তনে এসে ঠেকেছে। অতীতের যাত্রা-জীবন-কর্মচাঞ্চল্য-ঐতিহ্য-কৃষ্টি ভাবনায় আলোড়িত তৃষাতুর জীবনানন্দ এসবই বলতে চান। তার স্বাদ টের পান এবং পাওয়াতে চান। হৃদয়ের পিন্ডে অতীত অব্যর্থ শিহরণ জাগায় এবং একমাত্র তারই ক্রীতদাস হয়ে রক্ত-ঘাস-হৃদয়-মেধা আন্দোলনে জল শুধু জল তুলে আনে।

'সব চেয়ে লাগিয়েছে ভালো আজ; 
আজ ঐ পরিশুদ্ধ আকাশের দিকে চেয়ে আছি, 
পবিত্র শিশির এই নক্ষত্রের 
এই বিশুদ্ধতা হৃদয়ের শান্তি স্বপ্ন অবসর,
 যাত্রা শুধু বেঁচে থাকে-যাহা থাকে টিকে।' 
ক্লান্তি ও ক্লান্তিহীনতার ভিতর প্রাণের উচ্ছল আন্দোলন- লক্ষ করা যায় অস্তিত্বের আন্দোলনে। ভালো লাগা, আত্মার আনন্দে, প্রকৃতির মুহূর্তের রূপরাশির গন্ধে, দৃশ্যে উদ্ভাসিত অন্তর মুগ্ধতা বোনে। আকাশ, নক্ষত্র, শিশির, বিশুদ্ধ শান্তির পরশ নিয়ে, চিরন্তন অবস্থানে পৌঁছায়। চির আনন্দের দীপ্তিতে এই বর্তমান, ভবিষ্যতের ক্লান্তিসমূহ দূর করে। 

'অনেক পতাকা ছেড়ে;
অনেক আশ্বাস শান্তি সান্তনার পথ থেকে ফিরে। 
ড্রাগনের দাঁত দিয়ে বীজ বুনে চলিতেছি আজ
এই পৃথিবীর পর, চলিতেছি পথ খুঁজে 
সে অনেক বেদনার সে অনেক চিলদের ভিড়ে!'
জীবন-জগৎ প্রকৃতির শৃঙ্খলা ও অবস্থানের ভিতর অর্থময়তা, বিস্ময়বোধ মানবের চিন্তাশীল বোধ তার সাহিত্যকে চিহ্নিত করে। পরম প্রাণে কবি দেখেছেন, শুনেছেন-জন্ম মৃত্যুর হাহাকার! ক্ষয়! সৃষ্টি নিয়মের পরস্পর বিচার, হাঁটা-চলা, বোধ থেকে বিবেকের হৃদয় স্বাদ-আস্বাদ তুলে এনেছেন তিনি। 
'মানুষের মত কাঁদে একা একা যে পাহাড় 
বৈকালের হাওয়ার আঘাতে তারে তুমি কাঁদায়েছ;
তাহার বুকের পরে ফোঁপায়েছে শিশুর মতন। 
তোমার বুকের ঢেউ; একা একা মানুষের মত সেই সমুদ্রের মন- 
নিঃশ্বাসের মত ভেসে ফিরিয়াছে পাথরের পাশে পাশে অন্ধকার রাতে।'
নির্জনতা প্রীতি জীবনানন্দ দাশের কাব্য প্রেরণার প্রধান উৎস। প্রকৃতির শক্তি, সাহস বিষয়ের ভিতর তিনি ঢুকে যান। তাকে প্রাণে সঞ্চালিত করে তোলেন। জড় বস্তুকে প্রাণময় আরতীতে উপলব্ধি জাগান। মানুষের মত সমুদ্রের মন। ক্রমান্বয় পাহাড়ের দৃশ্যকল্প-ভাবনার অনুভব, ট্রাজিক; বিস্ময়কে ভীষণ উসকে দেয়। এক মানুষের কান্না, অসংখ্য মানুষের শক্তিতে এক পাহাড়, এক সমুদ্র হয়ে বৃহৎ অংশের অবস্থানে পৌঁছায়।
'এই সব আকাশের পিছে আরো, 
অন্যসব নক্ষত্রের সে একা জাগতে 
বিস্ময়ে লয়েছে জন্ম সেইখানে; 
সেইখানে জন্মিয়াছে বিস্ময়ের ভয়!
...গ্রীকতারা সমুদ্রের মত ঢেউ ক্ষুধা- 
ঢের পিপাসার ধার তাহাদের বুকে ছিল; 
সব নক্ষত্রের শেষে, 
করে গেছে তারা আবিস্কার নতুন নক্ষত্র আরো;' 
প্রকৃতির বিস্ময় আলোড়ন ও দৃশ্যময়তার অন্বেষণ ঐতিহাসিক স্বাক্ষরতা এবং তার আবিষ্কারের নেশায় বিভোর যাত্রী জীবনানন্দ। তিনি প্রাচীন জনপদ, জলপদ, আকাশপথে বিচরণ করেন, আবিষ্কৃত চোখে দেখে ফেলেন সব। সমুদ্রে প্রাণময় ঢেউয়েই সৃষ্টি করেন। সমুদ্রের কান্নাকে নিজের কান্নার সাথে, সমুদ্রের কান্নাকে পাহাড়ের কান্নার শরীরে একাকার করে তোলেন। আর এখানেই কবি জীবনানন্দ দাশের বিশিষ্টতা।

                             _________
 



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪