নারীর পরিসর; 'ঘরে বাইরে' এবং সাইবার এলাকায়।

নারীর পরিসর; 'ঘরে বাইরে' এবং সাইবার এলাকায়।

প্রথম পর্ব - ব্যক্তিগত পরিসর।


মধুপর্ণা

পরিসর শুধুমাত্র স্থানিক নয়, মূর্ত এবং বিমূর্ত - এই দুই মাত্রা একত্রে মিলে নির্মিত হয় পরিসরের ধারনা। এই পরিসরে প্রতিষ্ঠিত কিছু নিয়মাবলী থাকে, আরো কিছু নিয়ম অলিখিত, অদৃশ্য ভাবে থাকে এবং প্রতিনিয়ত একটি নিয়ম উৎপাদন ও লাগু হবার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সামাজিক পরিসরকে আপাতত তিনটি ভাগে ভাগ করে কয়েকটা কথা বলতে চাইছি। ব্যক্তিগত পরিসর, বাহ্যিক পরিসর এবং সাইবার পরিসর। এই দৃশ্যমান বেঁচে থাকায় যখন বিভিন্ন পরিসরের জল-অচল ভাগ গুলো ক্রমে পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তখন এই সামাজিক পরিসর গুলিতে নারীর অবস্থান দেখার চেষ্টা করি তাহলে দেখা যাবে প্রতিটি পরিসরে নারীর অবস্থান আলাদা। এই 'নারী' একটা হোমোজিনিয়াস ক্যাটাগরি নয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থান ভেদে বদলে যায় অথবা নির্মিত হয় তার/তাদের অবস্থা/ অবস্থান। রিসোর্স, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণী ভেদে বদলে যায় বিভিন্ন পরিসরের সঙ্গে 'নারী'র সম্পর্ক, লগ্নতা, সমঝোতার সমীকরণ।

পারসোনাল স্পেস আর পাবলিক স্পেস অর্থাৎ ব্যক্তিগত পরিসর ও বাহ্যিক পরিসর - রবীন্দ্র উপন্যাস থেকে ধার করে যদি বলি "ঘরে-বাইরে"। প্রাথমিক ভাবে শুধুমাত্র স্থানিক পরিসর মনে হলেও, এই পরিসর গুলির নানাবিধ মাত্রা রয়েছে, হতে পারে মানসিক, হতে পারে অনুভূতিগত। আবার প্রতিটি পরিসরের মধ্যে রয়েছে একটি ও অন্যটির বিনিময়যোগ্যতা। নারীকে এই পরিসর গুলোর মধ্যে যাতায়াত করতে হয় খুব সন্দর্পনে। যে কোনো মুহুর্তে প্রোটোকল ভেঙে যাবার আশঙ্কা, আশঙ্কাটি কার ? তার নিজের ? সমাজের ? পিতৃতন্ত্রের ? কার ? নিজের সুবিধার জন্য যে বা যারা নির্মাণ করেছে তাদেরই আশঙ্কা। এবং তার আরোপিত চাপে নারীর মধ্যে সেই আশঙ্কার প্রতিফলন।

এই পরিসর গুলি মূলত নির্মিত হয়েছে নিষেধাজ্ঞার পরিখা দিয়ে। নারীর পারসোনাল স্পেস বা ব্যক্তিগত পরিসর নির্মিত হয় নিষেধের বেড়া দিয়ে। লক্ষ্মণ যেমন গন্ডী কেটে সীতাকে রেখে গেছিল, সেই গন্ডী থেকে বেরিয়ে আসায় ঘটল বিপদ। রাক্ষস এসে ধরে নিয়ে গেল সীতাকে তারপর একে একে ঘটতে থাকল অজস্র তুলকালাম ঘটনার পরম্পরা। এই রকম অজস্র গন্ডী আমাদের চারপাশে ক্রমাগত ঘুরছে। নারীর চতুর্দিকে ঘুরছে নিষেধাজ্ঞার অজস্র বলয়। এই বলয় গুলিই মূলত নির্মাণ করেছে এই ব্যক্তিগত পরিসর। একটা আরেকটার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অথবা জন্ম দিচ্ছে নতুন আরো কয়েকটির। সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থান ভেবে ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে তাদের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য। পরিবার, ঘর, একান্ত সম্বন্ধ ব্যক্তিগত পরিসর হিসাবে প্রাথমিক ভাবে বিবেচিত হয়। এখন প্রশ্ন হল, এই ব্যক্তিগত পরিসরে কি ব্যক্তি স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকে ? না। অবশ্যই না। একেবারেই না। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘনের যাবতীয় আয়োজন ব্যক্তিগত পরিসরে মজুদ রয়েছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার ডানা পাখনা ছেঁটে ফেলার জন্যই তথাকথিত ‘সুরক্ষিত' 'নিরাপদ' 'ব্যক্তিগত’( পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত অর্থানুসারে) পরিসরের অবতারণা। এই ব্যক্তিগত পরিসরের ঘেরাটোপ থেকে বাধ্যবাধকতা থেকে কাজের সূত্রে, শিক্ষালাভের সূত্রে বড় অংশের নারী বহু আগেই বেরিয়ে পড়েছে।

সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত 'ব্যক্তিগত পরিসর' এর সঙ্গে 'ব্যক্তিগত সম্পর্ক' নারী ক্রমে বদলে নিচ্ছে নিজের মর্জি ও প্রয়োজনমত। একজন আত্মসচেতন, মুক্তচিন্তার অধিকারী নারী যদি নিজের সংজ্ঞায় 'ব্যক্তিগত পরিসর' নির্মাণ করতে চায় বা যাপন করতে চায় তাহলে তা আবশ্যিক ভাবেই পছন্দ হবে না পিতৃতন্ত্রের। এবং এই দুই ধারনা মিলবে না। কারণ দুটি নির্মাণের শর্ত আলাদা। পিতৃতন্ত্র নিজের শর্তে যে 'ব্যক্তিগত পরিসর' নারীর জন্য নির্মাণ করে এবং স্বাধীন নারী নিজের ইচ্ছায় যে 'ব্যক্তিগত পরিসর' নির্মাণ করতে চায় তার মধ্যে আকাশ জমিন ফারাক। তাই 'ব্যক্তিগত পরিসর' তা স্থানিক হোক বা মানসিক হোক আলোচনার সময় পার্সপেক্টিভ ও স্ট্যান্ডপয়েন্ট, দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের উল্লেখ অনিবার্য হয়ে পড়ে। পোশাক, কথাবার্তা, আচার আচরণ, শরীরি ভাষা সবকিছুরই নির্দিষ্ট নিয়ম, নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ব্যক্তিগত পরিসরে। এই নিষেধাজ্ঞা আবার অবস্থান অনুযায়ী বদলায়। এই ব্যক্তিগত পরিসরের 'সামাজিক সম্মান' এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এবং 'ব্যক্তিগত পরিসর' নির্ধারণ করে নারীর 'সম্মান' যার প্রতিফলন পড়ে 'পারিবারিক সম্মান' নির্মাণে। সমাজ নির্ধারিত প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত পরিসর এর সঙ্গে নারীর সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারলে 'সামাজিক, পারিবারিক সম্মান' এর ভিত্তি পোক্ত হয়। সম্মানের বিচিত্র ধারনার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিসরে নারীর অবস্থানের এই সমীকরণ একটা অদ্ভুত লিঙ্গ রাজনীতি উন্মোচন করে। বিষয়গুলির আন্তঃসম্পর্ক ও পারস্পরিকতা নারীর চারপাশে একটা জমাট চাপ তৈরি করে আর তার উপর চাপায় ‘দায়িত্ব’ ও ‘জবাবদিহি'র বোঝা।

ঘর প্রাথমিক ভাবে ব্যক্তিগত পরিসর, ঘরের মধ্যে আরো ভিতরের ঘর নারীর জন্য বরাদ্দ ছিল। সে সব থেকে বহু আগেই তারা বেরিয়ে এসেছে, বোরখার আড়াল থেকে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে সূর্যালোকের মুখোমুখি সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ স্থানিক পরিসর থেকে বেরিয়ে এসেছে আর কেউ কেউ সঙ্গে মানসিক পর্দাকেও নস্যাৎ করতে পেরেছে। সর্বোপরি যে কথাটা বলবার যেখানে 'ব্যক্তি' স্বাধীনতা রক্ষিত হয় না সেই 'ব্যক্তিগত' পরিসর প্রশ্নাধীন কারন, ব্যক্তিস্বাধীনতাই একমাত্র শর্ত 'ব্যক্তিগত পরিসর' নির্মাণের। এই পরিসরের প্রতিষ্ঠিত চরিত্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো চিহ্নিত করে ভিন্ন সংজ্ঞা নির্মাণের চেষ্টা যারা করে যাচ্ছেন, ভবিষ্যতের স্বাধীন পরিসরের সূচনা করে যাচ্ছেন, সেই সব আপোষহীন নারীকে অভিবাদন।







মধুপর্ণা কর্মকার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্রে গবেষণা করেন। লিখেছেন - ' গার্লস হস্টেল ; আবাসিক নারীর মানসভূমি।'(২০১৮)


তাঁর ব্লগ লিঙ্কে প্রবেশ করুন

তাঁর লিঙ্কট্রি লিঙ্কে প্রবেশ করুন

মধুপর্ণার গত সংস্করণেরলেখা পড়ুন



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। নাচনী শিল্পীদের আলোক-চিত্র ।। সন্দীপ কুমার