বাইরে নৈঃশব্দ, ভিতরে হৈ চৈ / মধুপর্ণা

বাইরে নৈঃশব্দ, ভিতরে হৈ চৈ

মধুপর্ণা


দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন তখন। বাইরে নৈঃশব্দ, ভিতরে হৈ চৈ। হঠাৎ খবর পাওয়া গেল একজন গৃহবধু 'পালিয়ে গেছেন'। কোথা থেকে কোথায় পালিয়েছেন? পরিবারের 'সুরক্ষিত', 'নিরাপদ' আশ্রয় ছেড়ে বাইরের বধ্যভূমিতে। তিনি কোথাও যান নি, কোথাও পৌঁছোন নি, তিনি পালিয়ে গিয়েছেন। একা। অথবা নিজে। একা একা পালিয়ে গেছেন--- বলছিল একজন। কানে অনুবাদ হয়ে বাজল-- নিজে স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। মৃনালকে মনে আছে ? ‘স্ত্রীর পত্র’ এর মৃনাল । চলে গিয়েছিল 'চরণতলাশ্রয়ছিন্ন' করে। আর এই গৃহবধু, সারাজীবন যিনি কোনদিন বাইরে 'একা' যান নি। ঘরকন্নার কাজ সামলে উচ্চবর্ণীয় উচ্চবর্গীয় পরিবারটির সামাজিক উন্নাসিক সম্মান ধুনো দিয়ে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, স্বামী পুত্রদের ভীড়ে প্রায় অদৃশ্য হয়ে বেঁচে ছিলেন (হয়তো)। সেই তিনি হঠাৎ ‘পালিয়ে গিয়ে’ খবর হলেন, হলেন আলোচ্য বিষয়।

কেউ বলল-- মাথা ঠিক নেই। কেউ বলল-- কোথায় আর যাবে! গোয়ালের গরু ঠিকই ফিরে আসে। কেউ বলল-- আগে একবার মরতে গেছিল, এবার পালিয়েছে। কেউ বলল-- বিবেচকের মত কাজ এটা হল? পরিবারের মান সম্মানের কথাটা একবার ভাবল না বাড়ীর “বড় বৌ” হয়ে!? কেউ বলব-- পাগল তো ! আমি আগেই জানতাম, গন্ডগোল আছে মাথায়। কেউ কেউ বেজায় খুশি হল পরিবারের 'সম্মান’ টি তো গেল! যাক। খানিকটা তৃপ্তি। আগে গ্রামের মোড়ল 'জাত মেরে' যেমন তৃপ্ত হতেন, সেইরকম একটা ঢং মুখে খেলছিল তার আর চোখে ছিল পৈশাচিক একটা আনন্দ। পরিবারটির কর্তার সঙ্গে পুরোনো বিবাদের খানিকটা শোধ যেন এমনিতেই মিটে গেল। মাথার উপর ভগবান আছেন কিনা!

কিন্তু যিনি চলে গেলেন, তার চলে যাওয়ায় দুঃখের থেকে ক্রোধ হল সবার। প্রচন্ড ক্রোধ। ফিরে এলে নিশ্চয় তাকে দেখে নেওয়া হবে। যে কারনে তিনি চলে গেছেন তা বেড়ে যাবে বেশ কয়েক গুন। চলে যাওয়া আসলে সবার কাছে ধরা দিল 'পালিয়ে যাওয়া' হয়ে। আর সারাজীবনের শক্তি সঞ্চয় করে তিনি যে সাহসী কাজটা করলেন তা ছড়িয়ে পড়ল ‘কেচ্ছা' হিসাবে।

একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে সবার অনেক ঘটনা মনে পড়ে যায়। হামেশাই পালিয়ে যাচ্ছে নিম্নবর্গীয় নারী বলেছিল একজন। "ওটা কোনো ব্যাপার না, যায়, ফিরে আসে, কেউ অপেক্ষা করে না ফিরে আসার। ওরকমই"

কিন্তু এই গৃহবধুর জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল।

পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করছিল ফিরে এলে দেখে নেবার, নির্যাতন বাড়িয়ে কোথায় নিয়ে যেতে হয় দেখিয়ে দেবার। পাড়াপড়শি অপেক্ষা করছিল হেনস্থা প্রাণ ভরে দেখবে বলে। একজন উচ্চবর্গীয় গৃহবধু 'পালিয়ে গিয়ে’ আবার 'ফিরে' এলে কেমন দেখায় সে আগ্রহে অস্থির হয়ে পড়েছিল অনেকেই। তুমুল রগড়ের আয়োজন। মনের ভিতরে গেঁজিয়ে রাখা বিচারক একবার হলেও বাইরে এসে বিচার করবে আশ মিটিয়ে। বিভিন্ন জাজমেন্টাল কথা দিয়ে নিজেকে আর চারপাশ ভরিয়ে রাখার এই সূবর্ণ উদযাপন কার হাতছাড়া করতে ইচ্ছা করে !

শুধু তার বাচ্চা ছেলেটি ভয়ে, অসহায়তায়, আতঙ্কে কাঁদছিল, তার মুখ ক্রমে রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিল। কি ভেবে সে কাঁদছিল বলা মুশকিল। তবে অন্তত কোনো জিঘাংসা এই একজনের ভিতরে ছিল না। সে অকৃত্রিম ভাবে নিজের জন্য এবং তার মায়ের জন্য কাঁদছিল। গভীর ভাবে অসহায় হয়ে কাঁদছিল। একটা সময় পরে চোখে জল ছিল না, কেবল অনেকক্ষণ কান্নার পর এককোনে দাঁড়িয়ে হেঁচকি তুলছিল কয়েক সেকেন্ড পর পর। সবাইকে ভয় লাগছিল তার। এক পড়শি তাকে দুপুরে ভাত খাইয়ে ছিল সেদিন, তার বর্ণনা থেকে দৃশ্যটা চোখের সামনে এইভাবেই ভাসছিল। সবাই উত্তেজিত। কড়া কথাবার্তায় ভেসে যাচ্ছে সবদিক। সবাই পরস্পরকে দোষারোপ করে নিজে একটা অবস্থান নিতে চাইছে। পুলিশকে ফোন করে নাকি জানানো হয়েছে, সন্ধ্যের মধ্যে খোঁজ দেবেই বলে আশ্বাস দিয়েছেন তারা। প্রিন্ট আউট নেওয়া হয়েছে ছবি সমেত নিখোঁজের খোঁজের বিজ্ঞাপন। পরনে সাধারণ গোলাপী শাড়ী। বিশেষ চিহ্ন কপালে কাটা দাগ। কপালটা কেন কেটেছিল তার ইতিহাস অবশ্য বিজ্ঞাপনে থাকে না। শুধু তাকে চেনা যাবে এই দাগ দেখে। উচ্চতা, দৈর্ঘ্য প্রস্থ সবই দেওয়া হয়েছিল। তারপর বাইকে চেপে বৌদির হারিয়ে যাবার এই নিখোঁজের খোঁজের কাগজ দেবর সাটিয়ে এসেছিল অনেক দূর দূর সব জায়গায়। যেখানে সে ভাবতেও পারে না বৌদি একা আসতে পারে।

ফিরে নাকি এসছিলেন তিনি দুই তিন দিন পর। তারপর ফিরে আসার গল্প শুনতে ইচ্ছা হয় নি আর। বরং খানিকটা ভয়েই শোনার ইচ্ছা হয় নি বলা যায়। ফিরে আসার পর কি হয় আন্দাজ আর অনুমান করতে গিয়ে শিউরে উঠতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। ইনি ফিরে এসেছিলেন হয়তো থাকার আর কোন জায়গা, অর্থ সম্বলের অভাবে। অত্যন্ত ধনী পরিবারের বধূও হতে পারেন খুবই দরিদ্র নারীর দরিদ্র ভিন্ন একটা মাত্রা। পরিবারের আয়ের সঙ্গে তার সম্বন্ধটিও অদ্ভুত।

মৃনালকে মনে আছে ? 'স্ত্রীর পত্র' এর মৃনাল ?

মৃনাল পালিয়ে যায় নি। চলে গিয়েছিল। একা। নিজে।

ফিরে আসে নি।

কোন দিন।

মহাভিনিস্ক্রমন।

২০০৫ সালে গার্হস্থ হিংসা প্রতিরোধী একটি আইন ( The protection of women from Domestic Violence Act 2005) পাশ হয়েছে। সেইসূত্রে পরিকাঠামোগত ভাবেও বহু ব্যবস্থা সংযোজিত হয়েছে। অনেক কর্মী নিযুক্ত হয়েছেন শুধুমাত্র এই বিষয়টিকেই গুরুত্ব সহকারে দেখবেন বলে। বিনামূল্যে আইনী সহযোগিতা দেবার জন্য। কিন্তু অনেকেই এখনও জানেন না সমস্যা হলে কোথায় যেতে হয়, কাকে জানাতে হয়, কে এবং কারা তাকে বিনাপ্রশ্নে বিশ্বাস করবে। এবং ব্যবস্থা করবে, পদক্ষেপ নেবে। তাই চলে যেতে হয়, পালাতে হয় কাউকে। পালাবার কিছু নেই। নিকটস্থ থানায় যাওয়া যেতে পারে। স্বেচ্ছায় চলে যাবার আগে পিছনের হিংস্র জন্তু গুলোকে থামিয়ে দেওয়াটা জরুরি। অথবা ফিরে আসায় যেন ভয় না থাকে, গার্হস্থ হিংসার পুনরাবৃত্তি না হয়। অথবা পুনরাবৃত্তি হলে কোথায় যেতে হয় তা জানা থাকে পরিস্কার।
                             ------------












মধুপর্ণা কর্মকার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্রে গবেষণা করেন। লিখেছেন - ' গার্লস হস্টেল ; আবাসিক নারীর মানসভূমি।'(২০১৮)


তাঁর ব্লগ লিঙ্কে প্রবেশ করুন

তাঁর লিঙ্কট্রি লিঙ্কে প্রবেশ করুন

মধুপর্ণার গত সংস্করণের লেখা পড়ুন








মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪