জলশ্যাওলার বিরহকথা

জলশ্যাওলার বিরহকথা

দীপংকর রায়



১৪ তম পর্ব


              নতুন ঠান্ডা পড়েছে। গায়ে একটা চাদরও দেওয়া হয়নি । এমনি এমনিই বাইরে বেরিয়ে এসেছে । উঠোনের মাঝে চক্কর খাচ্ছে যেন। কেউ জেগে গেলে কী মনে মনে ভাববে? বাঁ পাশের রান্নাঘরের মাথার উপরে বাঁশঝাড়ের মাথায় কিসের যেন ঝপাং করে আওয়াজ হলো। পুয়ো গাছের থেকে কদম গাছের ডালপালাতেও ঝপ ঝপ করে আওয়াজ। মনে হয় সেই ভাম বেড়ালটাই হবে হয়তো! সেই কি, যাকে সে এর আগেও কয়েক দিন দেখেছে ওই জায়গাগুলোতে ঘোরাঘুরি করতে। কিন্তু সেই কি? হয়তো সে নয় , নয়তো অন্য আরো একটি। যে হয় হোক গে। যেদিকে যায় ওরা যাক না। তাতে কার কী! ওদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই তো! ওরা তো কাউকে দাসখত দেয়নি, এই রাতে চলাচলে ! তাই যাক না কদম গাছ থেকে পুয়ো গাছে । যাক না বাঁশঝাড়ের মাথার থেকে কাঠাল-জাম-জামরুল-জারুল যেদিকে খুশি চলে-ফিরে ঘুরে এই জীবনের গন্ধ সুবাস মাখুক, তাতে কার কি! এই রাতের বেলায় কত আরো নিশাচর প্রাণীরা তো আছে, তারাও ঘুরুক, ভেসে বেড়াক এইসব শীত রাতের মিহি-আলোয় প্রাণ ভরে। তাতে কার কি! ওদের কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না তো! 

              অঘ্রাণের এই শীত রাত্তিরে তার এই জেগে থাকা ; ওই বাঁশ বনেরাও কি জেগে নেই! তারাও তো জেগে থাকে ; জেগে থেকে দেখে না কি এইসব জীবনের ছন্দ?
             হয়তো দেখে, নয়তো দেখে না কিছুই। শুধুই অভ্যাসে জিরোয় খানিকটা হয়তো বা, হয়তো বা জেগে উঠেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর কত রাতচড়া প্রাণীদের আসা যাওয়া চলে এমন কত রাত্তিরে কত কাল ধরে যে, সে হিসেব কেনই বা রেখে বেড়াবে তারা! 
             তার এই জেগে থেকে ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গে কেন সে খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন কত কিছু, যার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই ওই বাঁশঝাড়, ওই ভাম বেড়ালদের জীবনের সঙ্গে! তাহলে সেও কি এই রাতে এক দঙ্গল ভাম বেড়ালের, বাঁশজঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যেতে চায়? 

            যত সব আজগুবিতে পেয়ে বসেছে তাকে। এর আগেও তো কতবার একা একা এসেছে সে, কই ,এমন ভাবে এমন রাতের আঁধারে ঘুরে মরতে হয়নি তো তাকে! 
             ঘুমের দোষ তার এর আগেও ছিল না যে তা তো না! সেসব সব সাথি সামলায় তার প্যাঁচে ফেলে। এমন সে সব প্যাঁচ, যাতে ঘুম আসবে না তো যাবে কোনখানে। এখানে সাথি তো নেই কাছে, তাই এত রাত্তিরের ভীমরতিরা পেয়ে বসেছে বুঝি? অথচ সেই ছিয়াশির থেকে কতবার তো এলো আর গেল, এমন দশা তো এর আগে হয়নি। যাতে এই মধ্যরাত্তিরে উঠোনের মাঝে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল।   
            কেন, কত রাত্তির তো এর আগেও, গৌতমের সঙ্গে বকবক করে কেটে গেছে তার! তাতে হয়তো দু'একটা সিগারেট বেশি পুড়েছে এই যা। 
              এই তো ওর বিয়ের আগে, ওপাশের বাড়ির সীমার সঙ্গে, সেই যে মধ্য রাত্তির পর্যন্ত পেন্সিল টর্চ ঘুরিয়ে দুই দোতলার কথোপকথন নিঃশ্বব্দে বিনিময় হতো ওদের, তাতে তো তুমিও কম ভাববিহ্বল হওনি পথিক! সেই যে গৌতমের সকাল-দুপুর-রাত্তির 'ওই কূলে তুমি আর এই কূলে আমি,...'  গান শোনা, একঘেঁয়ে মান্না দের গলায় ব্যর্থ প্রেমের ঘ্যানঘ্যানানি। সেসব শুনে শুনে একদিন ক্ষেপে গেলে তুমি, বললে, দাঁড়া তো, তোদের এই ছটফটানির একটা বিহিত করতে পারি কি না দেখি.....! 

             সীমার মা নাকি এদের দূর সম্পর্কের পিসি। তা পিসির মেয়ের সঙ্গে বিয়েতে কি বাধে?..... সে বাধে বাধুক, আর  যা হয় হোক গে, তোর জন্যে না হয় গেলামই ওদের বাড়িতে ---- ; তাতে আমার কোনো লজ্জা নেই! যাবো না হয় ষোলো বছর পরে ওদের বাড়িতে আবার একবার, দেখি ও আমায় কি বলে এই বিষয়ে। 
              গৌতম না না করেও শেষ পর্যন্ত বললো, "আচ্ছা যান না হয়। দেখেন ও কি বলে।" 

              এ বাড়ি আর ও বাড়ির মাঝের খিড়কি দরজা খুলে ওদের বাড়ির ভেতরে সীমাই ঢুকিয়ে নিল তাকে। সে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে  সীমা দরজা খুলে দিতে দিতে চিৎকার করে বলতে থাকলো , ও মা, মাগো, দেখো দেখো, দেখো কে এসেছে আজকে আমাদের বাড়িতে ; জামাইবাবু, জামাইবাবু এসেছে দেখ পথ ভুলে ---- এতকাল পরে এলেন যে ;  আরে ,  আজ তো আর রীতা নেই , যে আসবেন---! 

             রীতা ওদের বড় বোন। সাথির সহপাঠী ছিল। একটু লাজুক প্রকৃতির। বাড়ির থেকে কোথাও খুব একটা এদিক ওদিক বেরোতে দেখা যেত না তাকে। শুধু এ বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসতো এই যা। সাথির  সঙ্গে তার বেশ ভাব ছিল। সাথির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এটা ওটা নিয়ে প্রায়ই কিছু না কিছু নিয়ে মজা করে,  ছুঁড়ে ছুঁড়ে কথা বলতো জানলা দিয়ে। যদিও খুব অল্পবিস্তর সে সব কথা। সাথিদের এই ঘরটির নিচে চাপা পড়ে গেছে যে মাটির ঘরটি। মাটির হলেও সে ভীষণ মজার ছিল। জৈষ্ঠের তীব্র দাবদাহ সেই খড়ের চালের চারপাশ ঘুরানো চালা ঘরের ভেতর কী যে শীতল করে রাখতো, তা বলে বোঝানোর  মতো না । এই তো, ক' বছর আগেরই বা কথা সে সব! তবু তার হাড়পাঁজরা ভেঙেচুরে বুকের ভেতর কঙ্কালসার হয়ে পড়ে রয়েছে! আর ঠিক সেই চালা দেওয়া সোনের খড়ের চালের পেছন বারান্দার দরজা দিয়ে সীমার দিদির আস্তে আস্তে তার সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে , প্রায় বিকেলেরই সঙ্গী হওয়া সে সব। তার বড় বড় চোখের মায়াময় গভীরতা কী যে ছুঁয়ে যেত তাকে! সে সব তার ঐ পিঠ ভর্তি ছড়ানো চুলের জন্য পথিকের বাঁধন ছাড়া অন্যমনষ্কতা! 
             এসব সেদিন আবার সীমাই মনে করিয়ে দিয়েছিল। যেদিন সে তাদের এই লুকোচুরি খেলার অবসান ঘটাতে ওই বাড়িতে ষোলো-সতেরো বছর পরে একবার গিয়েছিল। 

             যদিও গিয়ে অবশ্য বিশেষ একটা ফল লাভ হয়নি। আর পাঁচটা গ্রাম্য সামাজিক জটিলতা, নানা কেন্দ্রবিন্দু ছুঁয়ে কত প্রতিবন্ধকতা যে তুলে দাঁড়ালো! তাছাড়া যেমন এইসব গ্রাম্য মেয়েদের অস্বীকার করার একটা প্রবণতা থাকে, তেমনই সীমারও চরিত্রে সেটাই এসে তাকে হয়তো সবটা অস্বীকার করতে বাধ্য করালো । আর তা না হলে উর্মিই বা আসবে কী করে?ষোলো-সতেরো বছর আগের একটা মুগ্ধতার খোঁচা সয়েও সীমার আপ্যায়নে তাদের দোতলায় বেশ কিছুক্ষণ তার সঙ্গে কাটিয়েছিল সে। 
              এদিকে গৌতম যে খুব উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেছিল কতক্ষণ, তা সেই জানে। তবে সে যখন জিজ্ঞাসা করেছিল, কি হলো জামাইবাবু। কি বললো ও তারপর। তারপর কী হলো বলুন না।  আপনি এবং ও একেবারে একা একা কথা বললেন, কেউ এল না সেখানে! একেবারে খালিখালি কাটালেন ওর সঙ্গে! 
             বললো, কী আর হবে গৌতম, যাই হোক ভালোই তো হলো, একটা মেঘ কেটে গেল, এখন তো আকাশ একদম পরিষ্কার। তুই একটা সংশয়ে কাটাচ্ছিলি সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল, এইটাই বড় লাভ নয় কি? এসব মন থেকে সরিয়ে ফেল একেবারে। ও তো কিছুই স্বীকার করলো না! 
            গৌতম বললো, তাহলে আপনি এতদিন ধরে যা যা দেখলেন, তা কি সবটাই মজা? 
            জীবনে এরকম অনেক মজা আসবে গৌতম। তুইও এসবকে ওই মজা হিসেবেই ধরে নে না। 
            গৌতমও বিষয়ী ছেলে তো কম না, ক'দিন পরে নিশ্চয়ই সব ভুলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তার মান্না দের গান শোনা থেমে গেছিল কি না তা তো আর জানা যায়নি, তবে তার কিছুদিন বাদেই উর্মির সঙ্গে তার বিবাহ হয়ে গেল। 
            সে সব যা হয়েছে হোক, কিন্তু এই মধ্যরাত্তিরে উঠোনের উপর দাঁড়িয়ে পাক খেতে খেতে এইসব ভাবনা ভাবা কি তোমার শোভা পায়, বলো একবার সেই কথাটা। কেন যে এইসব পর্বে তুমি এখনো মশগুল হও ,তা তুমিই জানো । আঠেরো উনিশ বছর কি তোমার বয়স এখনও, তোমার বয়স হয়েছে, সে কথাটা আর কবে ভাববে ?

             ভাবলে সত্যিই পানসে লাগে তোমায় বড়! অথচ আবার এইসব সমস্যা যখন বড় একটা জায়গায় গিয়ে ঘা মেরে আরো বড় হয়ে ওঠে, সে একটা অদ্ভুত রকমের সংকট খাড়া করে একেবারে হোইহল্লা বাধিয়ে জামার কলার ধরে টানাটানি করে , তখনই হয় আরো বড় সংকট ; তখন এইসব অনুষঙ্গ, তাকে আর শুধু অনুষঙ্গ বলে না ছেড়ে, সে এসে যেন বুকের বোতাম ছিঁড়ে ফেলে মনে করায়, দেখো, দেখো ভালো করে, তাকিয়ে দেখো, এর মধ্যেই সব গতকালগুলি কীভাবে একটু একটু করে ম্লান হয়ে যাচ্ছে! আজকের অপমান, আর অসম্মানগুলি ,যাকে তুমি পাওনা বলে ধরে নিতে গিয়ে ইতস্তত করছ, কালই সেসব হয়তো আরো জলভাত হয়ে শুধুমাত্র এক খাবলা থুতু হয়ে তোমার মতো কারো কারো মুখ দিয়ে পথের এককোণায় পড়ে থাকবে যেমন নিঃশব্দে, আবার তেমন কারো হয়তো গলার নিচে সে নেমে যাবে অবলীলায় একটুখানি ঢোক চিপে। তাই কাল বড় অমূলক হয়ে উঠেছে। ঘরে যাও তো এখন। যাও যাও, বিছানায় যাও ,  এখনো রাত আছে অনেকটাই। ভালো চাও তো শুয়ে পড়গে এখনি। 

              বাইরে থেকে ঘরে এসে সে একনিঃশ্বাসে বেশ খানিকটা জল খায় যেন ঢকঢকিয়ে জলের বোতল থেকে। তারপর দরজা বন্ধ করে চিত হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়  অনেকক্ষণ। 
              ঘুমের ভেতর তাকে এই বাড়ির আঠেরো বছর এবার অন্য আর এক রূপে ধাওয়া করে ফিরতে লাগলো যেন। মনে করাতে থাকলো একটু একটু করে পাল্টে যাওয়া দিনরাতগুলির এক একটি মুহূর্তের পর্বগুলি ; মনে করাতে থাকলো সাথির  প্রথম প্রথম চিনিয়ে দেওয়া তার এক একটি কাকা-কাকিমা, ভাই-বোন, ঠাকুমা, প্যারালিসিস হওয়া ঋষিকেশ রায়ের জীবনের নানা পর্যায়গুলি একটু একটু বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল চলে আসা। সেই সব নতুন দিনে সে কত দিন  যেন সাথিদের এখানকার হিন্দু মুসলমানদের নানা লোকের বাড়িতে গিয়েও বুঝতে পারত না কে কার আত্মীয় নয়। মনে হত কি সরল এবং একান্ত আপ্যায়ন পর্বগুলি । কারোর থেকে কাউকে আলাদা করতে পারত না। তার দেখা ছেলেবেলার সেই কলিমুদ্দিন সামসুদ্দিন থেকে আজকের মন্টু কাকা মকবুল কাকারা, জহর দাদুরা কিম্বা তার জামাই-এর সেই যে হাঃ হাঃ করে যাত্রা করার ঢং-এ কথা বলা, ইদ্রিস আলীও কত আন্তরিক ! মনে পড়ে মন্টু কাকার স্কুল পড়ুয়া বোনটির চামচে তুলে তুলে কাঁচাগোল্লা খাওয়ানোর সেই সব মুহূর্তগুলি ! তারপর যেটুকু সে খেতে পারল না, তা সে নিজেই ওই একই চামচে তুলে মুখে তুলে দিল । তাই দেখে সে বলে উঠেছিল হেই হেই করে, এ কি করছ সোনালী, এটা তো এঁটো চামচ আমার....! 
               সে তাতে বলেছিল, আপনি তো আমাদের জামাই , নিজের জন ;  জানেন তো , জামাই কে হয় তা জানেন, জামাই হলো গিয়ে মাথার মণি! 
                আজও মনে পড়ে, সোনালীর সেই ড্যাবডেবে চোখের বিস্ময়কর কথাগুলি! ভাবতে অবাক লাগে, এই দেশে এত সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দেয় কী করে! কোন সূত্র ধরে সে গলা বাড়িয়ে দেয় এইসব সহজ সরল প্রকৃতিতে? 

              পথিক ঘুমের মধ্যে  এই সব স্বপ্ন চিন্তা বেদনা নিয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় ভুলে যায় মাঝখানের দরজা, যা ভেজিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে পড়ে আছে। 
              একসময় তার সকল একাকীত্ব কেটে গিয়ে অসাড়তা ,ঘুমের অসাড়তা  টেনে নিয়ে যায় তাকে আরো অনেক দূরে......। 
               কাপুতকুপুত করে জল তুলে ফেলার আওয়াজ আসছে। তার সঙ্গে ঠুকুস-ঠাকাস করে বৈঠা ফেলার আওয়াজ। মানুষজনদের কথা বলার ফিসফিসানো। অন্ধকার আকাশের তারাগুলো যেন নৌকোর ছোই-এর গায়ে ঝুলছে। চারটি প্রাণী না তিনটি ছিল! গুড়ুম গুড়ুম করে কামানের আওয়াজ আসছে অনেক দূর থেকে। কোনো আলো নেই। মাথার ভেতর শুধুই দুলুনি। নৌকোর দুলুনি। পিলপিলিয়ে যেন মানুষের মত দেখতে কিছু প্রাণী দৌড়চ্ছে। বাঁশি বাজছে। হোঁচট খেয়ে কে একজন পড়ে গেল। জল খাবো.... জল.... জল.... জল খা....বো.....।
             জল কোথায় ?
             এই যে জল,  তাই বলে আঁজলা ভরে তুলতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁদলা উঠে এল। পচা জলের ছ্যাঁদলা ।
              এ মা-আ, এ কি জল! এ যে পচা জল! শ্যাওলা পচা জল ; -----
              খাও,  খাও শোনা --- এই-ই খেতে হবে , আর না হলে, এই নাও খেজুরের আঁটি, শাঁস ছাড়িয়ে দিচ্ছি, এই নাও, এইটে একটু চোষো খানিক সময়।.....
               আবার দৌড়। কাদের সঙ্গে যেন দৌড়তে দৌড়তে হুমড়ি খেয়ে পড়া ।
               গান আসছে ভেসে, হ্যঁচড়া পুজোর গান। মনসা  পুজোর। লক্ষীর পাঁচালী পড়া চলছে পূর্ণিমার সন্ধেবেলাগুলোতে। আবার হ্যঁচড়া পুজোর গান। চত্তির পুজোর। বালার শ্লোক পড়া ঝুঁকে ঝুঁকে..... ; আবার সেই লুটের শোরগোল। সেই কালো কালো মানুষগুলোর যেন শূণ্যের উপর দিয়ে ভেসে চলা। শরণার্থী ক্যাম্প। বর্ডার। উলটো করে মানুষ পুঁতে রাখা । ছুটতে ছুটতে খাল পেরোনো। কামানের আওয়াজ। মেশিনগানের ট্যা......ট্যা.....;  কার একটি  লম্বা হাত প্রশস্ত হতে হতে তাকে জড়িয়ে ধরছে। হুস্ হুস্ করে ছুটে যাচ্ছে যুদ্ধ বিমান। চারদিকে বালি উড়ছে। বালির মধ্যে  লম্বা লাইন মানুষের, বাটি ঘটি থালা হাতে ---- সেই লাইনে কে বা নেই! পথিক- সাথি -গৌতম - উর্মি -- কল্যানী --ইতি --গতি --সঞ্চয় --বিদ্যুৎ মামা ---- যেন পুরো একটা গ্রামের মানুষজন, সব এই বালির রাজত্বে। তাঁবু উড়ছে হাওয়ায় বাতাসে। তাঁবুর তলা দিয়ে বাতাসের প্রচন্ড শব্দ হু হু করে এদিক ওদিক করছে। 

             ও মা-আ, হঠাৎ এসব সব উড়ে গিয়ে, পরপর খাসি কেটে  ঝোলানো হয়েছে দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকের ধড়ের সঙ্গে মাথাগুলো নিচেই উবুড় হয়ে ঝুলছে সারিবদ্ধ হয়ে। ও মা-আ, সেগুলো খাসি কই ! সেগুলো দেখছে শামুক হয়ে গেছে ! আবার দেখছে কে যেন কাটা খাসির পেটের ভেতর দিয়ে দু'ভাগ পাঁজরার মধ্য দিয়ে বালতি বালতি জল ঢেলে দিচ্ছে। সে দেখছে, খাসির পুরুষাঙ্গ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। রক্ত-জল !
             ও মা-আ, সেকি! এ আবার কি দেখছে সে, কাটা খাসির অণ্ডকোষগুলি ছিটকে পড়ছে মাটিতে। তারপরেই সে কি লাফালাফি! তিড়িংবিড়িং করে করে লাফাচ্ছে ! এর খানিকক্ষণ পরেই সব ট্যাঁপা মাছের মতো পেটফুলিয়ে তরবর তরবর করে হাঁটছে এদিক ওদিক , আর সওয়াল করছে । ক্যাম্পের বড়বাবু বর্ডার স্লিপ চাইছে। তাদের হাতে নেই কারো কারো। তাই তারা ফাঁকি দিয়েছে এই আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠছে। লাফাচ্ছে! লাফাচ্ছে আর খিল খিল করে হাসছে। যেন বলছে, ফাঁকি দিয়েছি, ফাঁকি দিয়েছি, কী মজা, কী মজা, চিড়েগুড় নেব না, চিড়েগুড় নেব না, শুধু চুপসে যাবো , কেবলই চুপসে যাবো , তারপর দেশে যাবো, দেশ কই! দেশ কই! এতো শুধুই বালি! বালি, আর বালি, হু হু বাতাস ......



                                                          চলবে.....




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। নাচনী শিল্পীদের আলোক-চিত্র ।। সন্দীপ কুমার