দ্বিতীয় বর্ষ ।। চতুর্বিংশতি ওয়েব সংস্করণ ।। ২৯ ফাল্গুন ১৪২৮ ।। ১৪ মার্চ ২০২২
দুয়ারের সরকার আসলে একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এটা ঠিক যে উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছিল তা পরিপূর্ণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। মানুষ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্ম জমা দিলেও বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাই প্রচারসর্বস্ব এই দুয়ারের সরকার বন্ধ করে দেওয়া একান্ত দরকার।
দুয়ারে সরকারে জমা দেওয়া ফর্ম জমাই থেকে যাচ্ছে অথবা এমনভাবে পরিপূর্ণ করা হচ্ছে যা কোনো কাজেরই না। অর্থাৎ একটা রেশন কার্ড তৈরি করতে দেওয়া হলে তাতে ৭০% ভুল থেকে যাচ্ছে। এহেন রেশন কার্ড নিয়ে কি করবেন মানুষ? একটা দীর্ঘ হেনস্তার মধ্যে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
কোনো একটা পরিকল্পনা বা স্কিম চালু করলে তা সঠিকভাবে চলছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব অবশ্যই পরিকল্পনা রূপায়ণকারীর। সে কোনভাবেই এই দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এইসব কাজ দেখাভাল করার কোনো লোকই নেই।
অন্যদিকে দুয়ারে সরকার চালু হওয়ার পর থেকে পঞ্চায়েত অফিস, ব্লক অফিস সহ অন্যান্য অফিসগুলোতে প্রতিদিন যে সকল কাজকর্ম করা হতো সেইসব কাজগুলো করতেও অনীহা প্রকাশ করছেন অফিসারেরা। সেখানে সরাসরি বলে দেওয়া হচ্ছে, দুয়ারে সরকারে ফর্ম জমা দেবেন। তাহলে বিষয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো?
সরকার কি সাধারণ মানুষের পরিচয় পত্র গুলো নির্ভুলভাবে দিতে চাইছেন না?
একটা পরিচয় পত্র দেখিয়ে আরেকটা পরিচয় পত্র তৈরি হয় আমাদের। যদি প্রথম পরিচয় পত্রেই ৭০% ভুল থেকে থাকে তাহলে বাকি পরিচয় পত্র গুলো নির্ভুল পাওয়ার সম্ভাবনা ঠিক কতখানি, এর কি কোন উত্তর আছে?
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
কালীকৃষ্ণ গুহ / বিশ্বম্ভর নারায়ন দেব / ডরোথী দাশ বিশ্বাস / উমা মাহাতো / শীর্ষা / শুভদীপ ভট্টাচার্য / সুনীতি গাঁতাইত / শ্রীদাম কুমার / সৌরভ লায়েক / অমৃতা মন্ডল / তপন পাত্র / দীপংকর রায়
______________________________________________
অথচ
কালীকৃষ্ণ গুহ
তুমি সারা জীবন বহু কাজ করেছ --
গান গেয়েছ
বাগান করেছ
সংসার পরিচ্ছন্ন রেখেছ
গর্ভধারণ করেছ
বিশ্বভ্রমণ করেছ
আত্মীয়পরিজনদের দেখাশোনা করেছ
পশুপাখিপিঁপড়েদের খাবারের জোগান দিয়েছ
সারা বিশ্বের মঙ্গল কামনা করেছ
অথচ
গতকাল দেখলাম
তোমার হাত থেকে ভাতের থালা পড়ে গিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল
তোমার ভাত ছড়িয়ে পড়ল মেঝেয়...
অকালবৃষ্টি
বিশ্বম্ভর নারায়ন দেব
অকাল বৃষ্টি, আমার কথা কেউ কি বলো শোনে?
শিহরণে সরসমনে -
বেদম জোরে হাত মেরেছি একলা ছাদের কোনে ।
কীসব যেন আজকে লেখার কথা ছিল
ভাব ছন্দের অন্ত্যমিলও --
চারমাত্রার আবেগ নিয়ে ভীষণ চমকালো।
বিদ্যুৎ, নাকি গা শিরশির - নড়ে?
ভরফাগুনের ঝরে --
মেছো কবিতার ছাল-ছাড়ানো পেঁয়াজ রসুন ওড়ে।
সীমারেখা
ডরোথী দাশ বিশ্বাস
আজ বিকেলে যখন অস্তগামী সূর্যের লাল রঙ ছড়িয়ে পড়েছিলো মেঘে মেঘে,
সেই আলোতে দেখলাম
তরমুজের ছোট্ট চারা
তিনটি পাতা মেলে
আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যকে যেন বলছে-
"না, যেও না"।
মোটে তো সাতদিন বয়স,
এখনই বুঝে গেছে
সূর্য ছাড়া সবুজ হতে পারবে না সে।
পাশেই সদ্য চষা ডেলা পাকানো তাল তাল মাটি,
চৈত্ররোদে নির্জলা প্রায়।
এ তোর সন্তান।
সার দাও, জল দাও, ভিটামিন, কীটনাশক - প্রতিপালণের উপাচার।
এ পর্যন্ত আলাপচারিতা ঠিক ছিলো।
যখনই বলেছি, "একটি সন্তান, সে যদি কন্যা হয়, কখনো দুই কুল সামলাতে পারে না ....
তখনই অমুক কন্যা রাজ্য চালাচ্ছেন
তমুক কন্যা দেশ চালাচ্ছেন
ইত্যাদি নানা উদাহরণ!
শেষকালে রণে ভঙ্গ নয়,
একেবারে রেগে আগুন!!!
এই কান মুলেছি, অনাবশ্যক গন্ডী অতিক্রম করতে নেই।
উমা মাহাতোর এক গুচ্ছ কবিতা
।।দৈনিক কবিতা।।
১। ভোর
ঘুম না ভাঙতেও পারতো।
কিন্তু সুপুরির হাওয়ায়
পূর্বজন্মের আষাঢ় ফলে নোনা ধরা গাছে।ভোরের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্প। ….
তাই এখনো নিয়ম করে ঘুম ভাঙে।
২। সকাল
জল ও আলো ছায়া-মাখামাখি।
নরম, স্নিগ্ধ;জন্মাবধি বড়ো কাছাকাছি।
ক্রমশ দূরত্ব বাড়ে,
সকালেই শুরু হয় বাঁধানো ঘাটের নির্জন,আয়নার মুখ দেখাদেখি।
৩। দুপুর
তীক্ষ্ণ তীর ধেয়ে আসে দিনদেবতার চেতনা ফুঁড়ে।অন্ধত্বে রক্ত ফোটাতে চায় বলে দুপুর, বড় নির্মম।অলস।অপারগ।
৪। সন্ধে
গতিবেগ বড্ড বেশি হলে
আলো তো তাড়াতাড়ি ফুরোবেই।
নিজেকে কতটা প্রস্তুত করেছি নির্মম অন্ধকারের জন্য...
বিষাদ বাউলের কাছে, অবেলায় সেই গান শোনাবে পাখি।
৫। রাত্রি
কোথাও আলো খুঁজে পাইনা অথচ কত ঘনঘোর বাঁচি।ফুল,পাতা,জল, আকাশ সবই কালো।
তবু স্বপ্নের বিস্ফোরণে অপূর্ব জেগে ওঠে চিরঘুম । রাত্রি ও মৃত্যু সম-মানের, কিন্তু সমার্থক নয়।
পরজীবী আত্মার বই
শীর্ষা
*
আমাদের আদিগন্ত মরশুমি ক্ষেতের শহর,
আদিম ঝাঁকড়া চুলের বানানবিধি –
এরূপ লাবণ্য পেরিয়ে সুবিশাল হা-হুতাশ প্রান্তরদেশ!
আলকাতরা মেখে হেঁটে যাওয়া প্রতারক
এক মেঘ – ভস্ম করেছে দ্বৈত শয্যার খুঁট,
স্বজন করেছে আমাদের
*
বাদামের খোলার মধ্যে বেঁচে থাকা আমরা
যেন অভিশপ্ত যোগিনীর ছায়া – অনবরত চিবোতে থাকি
একে অপরকে,
বিক্রেতার দাঁড়িপাল্লা ধার করা আমাদের জিভ
হায়েনার মতো তারিয়ে তারিয়ে চেটে চলে
নগ্ন সূর্যাস্তের বেহায়া প্রসাধন!
আর খৈনির মতো চাঁট খেয়ে দূরে উড়ে যায়
আমাদের সোনালি সকালের দেশ
*
দূর পাহাড়ের সানুদেশে কৃষকবসতি –
মাথাকে পাহাড় বানিয়ে সুখ নিয়ে যায় ঘরে,
নিয়ে যায় শাঁখের মঙ্গলটুকু – সন্ধ্যাপ্রদীপে
আলোকিত হতে থাকে অপরূপ প্রেমারতির ধুন –
ফুট-ফুট চায়ের পাতায় আমাদেরই সাজ-সজ্জা
ফুটে ওঠে দ্যাখো, কষটা স্বাদ বেরিয়ে আসে
আধুনিক দাম্পত্য শহরের
*
ওহে প্রেম, ওহে নর্তকীর রূপ – এত
বিভাজন কেন? কেন এত দারিদ্র্যনৃত্য আনাচে-কানাচে?
তবে কি অস্তমিত সূর্যটুকুই সার? মহাকালের ঘুঙুর বেঁধে
নাচতে থাকা দুঃখের যম, ছিনিয়ে নেবার খেলায় সেজে ওঠে
অমরত্ব শিব – রাহুর চেহারা নিয়ে তাণ্ডব ঘোরে এ-দ্বার ও-দ্বার?
*
সকল প্রশ্নশেষে কী মধুর বাণী! জগতের তীব্রক্ষুধা
দুর্বহ এক গ্লানি – কুরে খায়, কুরে কুরে,
আমাদের সুপ্রাচীন গার্হস্থ্যকাঠ – ‘স্বাহা’ দিয়ে নিভিয়ে ফেলা
যত মনস্তাপ! বৃষ্টি আনে, সুধাবৃষ্টি – আপামর জ্বালায়।
আহুতি শব্দে জেগে ওঠে সন্তোষের মালা!
ওহে প্রেম, ওহে ক্ষুধা, যাতনাযৌবন – নগ্ন তাপে
হৃদে রাখো শান্তিনিবারণ, দারিদ্র্যকমল জুড়ে শুধু
হাসুক আহুতি, ক্লেশঘৃত হোমযজ্ঞে জয়ী হোক
আপামর পার্থিব সন্ততি
পাখি মানুষের কবিতা
শুভদীপ ভট্টাচার্য
১.
পাখিদের ঘর আছে, দেওয়াল নেই
মানুষের দেওয়াল-ই ঘর
সম্পর্কেরা পাশাপাশি আসলে একটা ঘর
অথচ, দেওয়াল আরও উঁচু হয়,
ছোঁয়াচে হয়
মানুষ বাঁধে দেওয়াল,
আর ভেঙেই ফেলে ঘর...
২.
হারানো যার স্বভাব তাকেই কি পাখি বলো ?
তাহলে মানুষও পাখি
হাত পা ছোঁড়ার বাহানায় পালক ছড়ায় বিছানাময়
মহাকাশ এক বদ্ধ জলাশয়
কচুরিপানার ভাসমান সংসারে
উড়তে চাওয়া চোখে অসংখ্য সেতু
সেতুর নিচে নদী
শ্মশানের পাশে দাউদাউ মুণ্ডকাটা লাশ
পাখিদের ডানা আছে, মানুষের পিছুটান...
নক্ষত্র
সুনীতি গাঁতাইত
পাতায় স্থির বিন্দুজল হীরে,বড়ো দামী মনে হয়,হাহাকারের ক্ষেত্রফলে বৃষ্টি নামুক।
উঠোন ভর্তি ধান ক ই!গা'ভর্তি সোনায় মেয়ে আর কই!
তামাটে শরীর রোদের পীড়নে
পেটভর্তি ছেলে নিয়ে পাগলীটাও বেশ দামী।
চলে গেল লতা-সন্ধ্যা,সুরের আকাশে নামল খরা,দেখে যাই শূণ্যতা শুধু বিয়োগের ঘরে কান্নার মায়াবী স্রোত।
অন্ধকার ক্রমশঃ গিলছে শহর-গ্ৰাম,আলোহীন পথে কোন্ দিকে যাই?কোথায় তুমি কালপুরুষ?হাত বাড়াও একটু পুড়বো না,পবিত্র হবো এই আগুনে দেহ ও মনে।
শ্রীদাম কুমারের কবিতা
অচেনা
তোমারই আশ্বাসে তোমারই বিশ্বাসে
উঠে দাঁড়ালাম।
বহুদিন পর বুক বেঁধে
পথে পথে হাঁটব সহযাত্রী....
কেন তবে কুয়াশাভরা ব্যবধান অথৈ?
হাতের দূরত্বেই, তবু কুয়াশা ঘেরা মুখ
কথার জাল বোনা, নিত্যদিন চলাফেরা অচেনা বলয়ে।
এ কি মুখোশ?
উদাসীনতা
১.
নজর এড়ায় না কিছুই
তবু অবুঝ হয়ে থাকি। সেই মঙ্গল
সেই উদাসীনতা হয়তো
একে একে সব ছেড়ে যাওয়া।
২.
নির্বানে স্থিত হয়ে যাব
স্থায়ী আশ্রয় নেওয়াটাই ভালো
অদৃশ্য ঠান্ডা লড়াই চলে মসৃণ
নিশ্চিহ্ন করে ঢেকে দিক উইঢিবি
বাল্মিকীকে।
সারেঙ
সৌরভ লায়েক
তুমি সুচতুর , সুন্দর করে ঘৃণা দিলে
বিরহী সারেঙ
উড়তে পারে না বলে ভেসে যায়
বিরহী সারেঙ
ভাসতে ভাসতে একদিন ডুবে যাবে বলে
ভেসে যায়
সুদীর্ঘকাল দাঁড়িয়ে একটি মিথ্যে নক্ষত্রের মায়ায়
ভয়ংকর তেষ্টায় জেগে ওঠে রাত ভোরে কাকে খোঁজো
যদি আমি হয় - তাহলে শোনো
সেই মৃতপ্রায় ক্যানিয়ন
মরবার আগে শেষ জলটুকু দিয়ে যেতে চায়
এসো তেষ্টা মেটাও
তুমি সুচতুর , রাত ভোরে উঠে ঠিক
কাপড়ের খুঁটে ঘাম মুছে নাও , কষ্ট লুকাও
প্রাক্তন
অমৃতা মন্ডল
কিছু কথা
তোকে বলতে ইচ্ছে হয়
তবু বলতে যে ভয় হয়
তোকে দেখলে
আজও হৃদয় কম্পিত হয়
তোর গলার স্বরে
আজও সর্বাঙ্গে জাগে শিহরণ
আমার মধ্যে তোর বাস
তাতেই আমার মরণ
তুই কে
তা না হয় অজানাই থাক
তোর সুখ
আমার মিছে স্বপ্নে মিশে যাক
জানি-
আজ আর তোর দরকার নেই আমাকে
তোর বাস এখন
রামধনু রঙ আলোকে
আমি সেই অন্ধকার_
যাকে আলো থেকে দেখা যায় না
তবু অন্ধকার থেকে
আলোকে দেখতে তো নেই মানা।
মানভূমের লোকছড়া
তপন পাত্র
পদ্যসাহিত্য হ'ল নান্দনিক শব্দ সহযোগে ছন্দোময় বাণীবন্ধ । আর পদ্যসাহিত্যের আদি বিভাগটি ছড়া । ছড়ার মূল পরিচয় নির্দিষ্ট ব্যবধানে শব্দ বা শব্দাংশের পুনরাবৃত্তি এবং প্রতি পর্বের আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাত । নির্দিষ্ট ব্যবধানটি পর্বাঙ্গিক , পর্বান্তিক বা চরণান্তিক হ'তে পারে । ছড়া স্বরবৃত্ত রীতিতে রচিত --বলার চাইতে বলা ভালো যে ছড়া যে ছন্দে রচিত হয়েছে সেই ছন্দটার নামই ছড়ার ছন্দ ; পরবর্তীকালে উচ্চারণ প্রকৃতির তাৎপর্য বিচার করে , পঠনরীতির কথা মনে রেখে এর নাম রাখা হয়েছে স্বরবৃত্ত, দলবৃত্ত, বলবৃত্ত, শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ ইত্যাদি। একটি ছড়ার প্রতি পর্বের আদি অক্ষরে থাকে শ্বাসাঘাত, লয়টি হয় দ্রুত , সাধারণত চার মাত্রার পূর্ণপর্বে গঠিত হয় চরণগুলি; তবে কখনো কখনো পর্ব পাঁচমাত্রার এবং তিন মাত্রারও হয়ে থাকে । চরণগুলি হয়ে থাকে কখনো কখনো দু'পর্বের , তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চারপর্বের । চার পর্বের চরণের ক্ষেত্রে শেষের পর্বটি হয় অপূর্ণ । সে যাই হোক, শব্দের ব্যঞ্জনা, সংগীতময়তা আর চমক সৃষ্টির জন্য ধ্বনির অলৌকিক মেল বন্ধনেই গড়ে ওঠে চিরকালের শিশুকর্ণ ও শিশুচিত্তের সহজপাচ্য এই শাব্দিক আহার ।
ছড়া শুধুমাত্র লোকসাহিত্যেরই প্রাচীনতম অঙ্গ নয় , সকল সাহিত্যেরই আদ্য বিভাগ । কারণ ছড়া যে সার্বিকভাবেই শিশুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । এর বিষয় শিশু , মূলত এর শ্রোতাও শিশু আর এর গঠন প্রকৃতির মধ্যেও যেন কোথায় রয়ে গেছে একটা শিশুসুলভ চাপল্য, ছড়া শুনতে শুনতে বুড়ো জেঠুও হয়ে ওঠেন সবুজ কচি শিশু । শিশুই তো এই মায়াময়, মোহময় বসুন্ধরার বুকে চিরনতুন ও চির পুরাতন প্রাণসম্পদ । তাই তাদের নিয়ে , তাদের জন্য, তাদের মতো করে যে সাহিত্য , যে ছন্দোবন্ধ বাণী ঝংকার সেই বেদ মন্ত্রগুলি কতোখানি ব্যাকরণগত দিক থেকে অসঙ্গত, অর্থহীন এবং 'যা ইচ্ছে তাই' হলো তার বিচার চলে না । সেগুলির ভেতর কিছু না থাকার মাঝেই থেকে যায় সব থাকার চিরন্তন ইন্দ্রজাল । সাহিত্য তো শব্দেরই খেলা । হয়তো কোন এক আদিম যুগে শব্দ নিয়ে লুফালুফি খেলতে গিয়ে, আবোল-তাবোল লুকোচুরি জমিয়ে তুলতে গিয়েই সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল ইন্টি-মিন্টি-পিন্টির হিং টিং ছট্ ।
সাধারণ ছড়া বা সাহিত্যিক ছড়ার সঙ্গে লোকছড়ার মূল পার্থক্যটি হলো, লোকছড়া অজ্ঞাত কবির রচনা । ঠিক রচনাও নয়, মুখে মুখে প্রচারিত , অবিচ্ছেদ্য ধারায় নির্ঝরিত , প্রবাহিত । এবং একের মুখ থেকে অন্যে শ্রবণ করে যখন তিনি আবার অপরজনকে বলেছেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তা পরিবর্তিত রূপ পেয়ে গেছে । কাজেই একদিক থেকে শেষমেষ আমরা যে লৌকিক ছড়াগুলির সাথে পরিচিত , সেগুলি শুধু অজ্ঞাত কোন একজন ব্যক্তির সৃষ্টি নয়, সমবেত লোক সমাজের সৃষ্ট এবং সে কারণেই এগুলি "লোকছড়া" বা "লৌকিক ছড়া" নামে নামাঙ্কিত । লোকছাড়ার সুনির্দিষ্ট একটি কোনো স্থায়ী রূপ নেই ; সময়ভেদে এবং এলাকাভেদে সেগুলোর রকমফের লক্ষ করা যায় । মানভূমের কোন একটি ছড়ার যে উচ্চারণ আমরা বান্দোয়ানে লক্ষ্য করি , মানবাজারে তা পৃথক, ঝালদায় ভিন্ন , পটমদায় স্বতন্ত্র আর ঝাড়গ্রামে আরো অন্য । এবং এ কারণেই বেশি বেশি করে প্রমাণিত যে সেগুলো লোকছড়া বা লৌকিক ছড়া । অপরদিকে আধুনিক সাহিত্যিক ছড়া একজন নির্দিষ্ট ছড়াকারের রচনা এবং রচনার পর সুরক্ষিত । কাজেই কালভেদে ও অঞ্চলভেদে সেগুলোর কোনো পৃথক পৃথক রূপ হ'তে পারে না ; সেগুলো সুনির্দিষ্ট রূপে মুদ্রিত এবং সেভাবেই সর্বত্র উচ্চারিত ,পঠিত । লোকছড়া যেহেতু সমবেত লোক সমাজের সৃষ্ট, কোন একজন নির্দিষ্ট মানুষের নির্দিষ্ট চিন্তাপ্রসূত নয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই সেগুলিতে সমাজ-ভাবনা, লোকজীবন অধিকতর জীবন্ত , প্রাণবন্ত এবং আকর্ষণীয় । এছাড়া লোকছড়ার সঙ্গে আধুনিক সাহিত্যিক ছড়ার গঠনগত ও পঠনগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় । লোকছড়া দীর্ঘ মাত্রায় রচিত , ঢিমেতালে উচ্চারিত । কিন্তু আধুনিক সাহিত্যিক ছড়া দীর্ঘ মাত্রায় রচিত নয় , এর তালটিও ঢিমে নয়, দ্রুত । লোকছড়ায় শ্বাসাঘাতের প্রাধান্য নেই কিন্তু সাহিত্যিক ছড়ায় শ্বাসাঘাতের প্রাবল্য ।
লোকছড়ার সাধারণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো --- এই ছড়া কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নিগড়ে বাঁধা নয় । দ্বিতীয়ত, চরণের সঙ্গে চরণের কোন অর্থযুক্ত পারস্পর্য থাকে না । তৃতীয়ত, অর্থের চাইতে ধ্বনি এবং লয়ের গুরুত্ব অধিকতর । চতুর্থত, এর পাঠ ছন্দ যতি অনুসারে , অর্থ যতির ধার ধারে না । পঞ্চমত, এতে কিছু কিছু অর্থহীন বর্ণগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়, যেগুলি ব্যাকরণ সম্মত ভাবে শব্দ নয়; কিন্তু শব্দের মর্যাদা পেয়ে যায় । এটি লৌকিক ছড়ার এক মস্ত জাদু ।
লৌকিক ছড়া বা লোকছড়ার কয়েকটি সুপরিচিত শাখা হলো --
(১) ছেলেভুলানো ছড়া ,
(২) ঘুমপাড়ানি ছড়া,
এগুলিকে আবার ঘুম পাড়ানি গানও বলা হয় । কারণ এগুলি উচ্চারণের সময় এমন একটি ধীর, ঢিমে সুর-তাল-লয় ব্যবহৃত হয় যে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় এগুলি না ছড়া, না গান; যেন উভয়ের এক মোহময় মেলবন্ধন ।
(৩) মেয়েলি ছড়া ,
(৪) খেলাধুলার ছড়া এবং
(৫) ঐন্দ্রজালিক ছড়া ইত্যাদি ।
(৬) নীতিমূলক ছড়া,
(৭) কৃষি বিষয়ক ছড়া,
(৮) লৌকিক জীবন বিষয়ক ছড়া,
(৯ ) নিসর্গ প্রকৃতি বিষয়ক ছড়া,
(১০) পূজা পার্বণ সংক্রান্ত ছড়া,
(১১) মন্ত্র বা ঝাড়ফুঁকের ছড়া,
(১২) ধাঁধার ছড়া,
(১৩) ছন্নছাড়া ছড়া বা আবোল তাবোল ছড়া,
(১৪) কাহিনী বিষয়ক ছড়া এবং
(১৫) রা'ত কথান্তিক ছড়া বা কথা শেষের ছড়া ।
ছেলেভুলানো ছড়া :--
""""""""""""''''"""""""""""""
ছেলেভুলানো ছড়াগুলির উপজীব্য বিষয় স্বয়ং শিশু । ছড়াগুলি যেন মাতৃমুখ থেকে বা অন্যান্য বয়স্কা নারীমুখ থেকে নিঃসৃত । উদ্দেশ্য কোন কারণে বিচলিত ও ক্রোধান্বিত শিশুকে ভুলানো, তার রেগে যাওয়া মনকে অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়া , ক্রোধের জ্বালা থেকে অন্যমনস্ক করা , এক কথায় তার মনোরঞ্জন করা । কখনো আবার নিছক শিশুকে খেলানোর জন্য হাসির খোরাক জোগানো । আবার যে শিশুর খাদ্য গ্রহণে অনাগ্রহ, তাকে ভুলিয়েটুলিয়ে খাবার খাইয়ে দেওয়া । এই ছড়ার ছন্দ -তাল -সুর -লয় দ্রুত ।
ছেলেভুলানো ছড়াগুলি কখনো কখনো শিশুকে হাঁটুতে বসিয়ে বা দুটো পা মেলে সংযুক্ত ভাবে রেখে তার উপর শুইয়ে, কখনো কখনো হাঁটি হাঁটি পা পা শিশুকে হাঁটাতে হাঁটাতে আবার নাচাতে নাচাতে ছড়াগুলি ব্যবহার করা হয় । মানভূম জননী স্নেহ গদগদ চিত্তে তার সন্তানদের যে কতো নামে ডাকে তার তো ইয়ত্তা নেই , ---নুনু ,সনা ,বাবু, ধনা, ম'না, মু'না , সনার চাঁদ ,টাকার গইরা আরো কত কি । ছড়ার ফাঁকে ফাঁকে সম্বোধন পদের মতো এগুলো চলে আসে ।
কোলের শিশু সদ্যে হাঁটতে শিখেছে । বাড়ির বড়োদের চোখের আড়ালে কোন্ সময় বাইরে বেরিয়ে গেছে সামনের বাঁশঝাড় ও ঝোপ জঙ্গলের দিকে , তাকে নিয়ে আসতে গেলে সে রেগে যায়, আসতে চায় না । তখন তাকে ভুলিয়ে ফুসলিয়ে আনার জন্য মা ছড়া কাটেন ---
"ধন গেছে রে কন্ খেনে ?
বাঁশ ফুলের বন যেন খেনে ।
সেই খেনে ধন কী করে ?
ডাল ভাঙে আর ফুল পাড়ে ।"
অথবা --
" ধন -ধন -ধন-
যাইঅ না রে বন ।
ঘরে ব'স, বনাঁই দিব
রতন সিংহাসন ।।"
--------------------------------------------------------------------
পরবর্তী অংশ পরের সংখ্যায় ---
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
________________________________________________
ঔপন্যাসিক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস---
"জলশ্যাওলার বিরহকথা" --- এবার পঞ্চদশতম পর্ব
________________________________
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
ট্রেন চলছে । ট্রাক চলছে। হুড়পাড় করে বাসনকোসোন হাঁড়ি-কলসি সসপ্যান ওঠানো নামানোর শব্দ। ওপাশে লিলিপুটের মতো মানুষগুলো। পথিকও অনেক ছোটো হয়ে গেছে যেন। ভীষণ ছোট্ট লাগছে তাকে। সে নিজেকেই চিনতে পারছে না। এরপর মানুষজনের হাহাকার রব শোনা যাচ্ছে। ছানার জলটুকু দেবে গো মা, ছানার জল ....!
ময়রা পাড়ায় ছানার জলের চাহিদা বেড়ে গেছে। ভাতের ফ্যান। ফ্যান দাও.... ফ্যান দাও গো মা..... ফ্যানটুকুই দেও.... ভাত চাইছি না গো, ভাত চাইছি না...... ফ্যান... একটু ফ্যান.... পারলি একটু লবন দিয়ো, এক ছিটে লবন.... লবনেরও বড় দাম গো, লবন ছাড়া কি চলে? লবন যে এ পোড়া দেশ থেকে কনে গ্যালো, তা কিডা কতি পারে আর... !
ওমা, ট্যাঁপা মাছের মুণ্ডুগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তার মুখের উপর! আবার তারা পেট ফুলিয়ে একবার মুখ ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে, আবার মুখের কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে। তার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওঁ..... ওঁ.... ও.... ও, আঁ.... আ.... আ..... ; এইসব গোঙানি শুধু।
পথিকের ঘর থেকে অনেকক্ষণ এই ধরণের আওয়াজ আসছে দেখে রুণী উঠে এসেছে মাঝের দরজা খুলে। সে চাপাস্বরে চেঁচাচ্ছে, ও জামাইবাবু, ও জামাইবাবু, কী হলো, কী হলো কি আপনার .....?
তাকে যেন বোবায় ধরেছে ----- এই ধারণা পোষণ করে রুণী এবং তার বড় শ্যালকের স্ত্রী গীতা। দু'জনেই উঠে আসে। উঠে এসে তার গায়ে ঠেলা দিয়ে কথাগুলি বলে যায় ---- জামাইবাবুরে মুখচোপায় ধরেছিল।
ততক্ষণে সেও উঠে বসে ভাবছে, এসব কী হচ্ছে .... কেন এসব দেখলাম, এমনভাবে....!
বাইরে সকাল হয়ে গেছে। শুধু সকালই নয় অনেকটাই বেলা হয়ে গেছে। প্রায় আটটা।
রুণী জিজ্ঞাসা করলো, ও জামাইবাবু, স্বপ্ন দেখছিলেন নাকি?
শ্যালকের বউ বললো, না না, এরে মুখচোপায় ধরাই কয়..।
রুণী বললো, চা আনি। চা খেলে এসব সেরে যাবে, দেখে নেবেন। আরও পড়ুন
______________________________________________
২০২২ ঐহিক সম্মানে সম্মানিত হলেন সাহিত্যিক সৈকত রক্ষিত
_______________________________________________
এবছর পলাশ পরবে অরন্ধন দুই বিশিষ্ট গুনীজনকে পুরস্কৃত করছে
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছড়ার ছবি : তপন পাত্র
অলঙ্করণের চিত্রশিল্প : সুনীল দাস (আন্তরজাল)
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন