তৃতীয় বর্ষ ।। অষ্টম ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ শ্রাবন ১৪২৯ ।। ১ আগষ্ট ২০২২
হিন্দিতে একটা কথা আছে "এ রুপেইয়া বোলতা হে।" অর্থাৎ টাকা কথা বলে। তাকে যেখানেই রাখা হোক না কেন? নিজের অনুসন্ধান নিজেই দিয়ে থাকে সে। তার অনুসন্ধান দেওয়ার জন্য অন্য কারোর দরকার পড়ে না।
কোনো মানুষের কাছে হঠাৎ করে টাকা এলে বা তার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি টাকা এলে বিভিন্ন সংকেতের মাধ্যমে তা পরিস্ফুটিত হয়ে উঠতে থাকে। তখন তার ঘেমে ওঠার জন্য গ্রীষ্মকালের প্রয়োজন হয় না। হিম-শীতল শীত কালেও, কথায় চলনে বলনে মননে অনুভূত হতে থাকে উষ্ণতা। যে উষ্ণতার প্রভাবে সাধারণ মানুষ, খাঁটি মানুষেরা দূরে যেতে শুরু করে। আর একশ্রেণীর শোষক পোকারা সেই উষ্ণতা সহ্য করেও দিব্যি তাল মিলিয়ে চলতে থাকে তার সঙ্গে। শোষনের এই পর্যায়ে এসে নিজের মনন তো দূরে থাক শরীরকেও ভুলে যেতে থাকে তারা। তখন আর মনে থাকে না তার নিজের অস্তিত্ব। আর এই অস্তিত্বহীনতা একদিন তাকে নিঃসঙ্গ করে তোলে। যে নিঃসঙ্গতা টাকা দিয়ে পরিপূরণ করা যায় না।
রাজ্য রাজনীতির এই দোলাচলের মহানায়ক মহানায়িকাদের দোষারোপ করে আমরা দিব্যি অন্য একটা দিককে আড়াল করে যাচ্ছি। যে দিকটাতে অন্তত একবার হলেও আলোকপাত করা দরকার। ঘুষ নেওয়া এবং দেওয়া দুটোই অপরাধ হলে যারা দিয়েছে তাদেরকেও ছেড়ে কথা বলা উচিত নয়। আমরা যারা চাকরির লোভে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে কুনো ব্যাঙ বানিয়েছি মন্ত্রীদের, সেই আমাদেরকেও মন্ত্রীদের মতোই জেলে পোরা দরকার। নচেৎ এই কেলেঙ্কারি কোনভাবেই বন্ধ হওয়ার নয়।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
নির্মল হালদার / হাবিবুর রহমান এনার / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / অয়ন জোয়ারদার / সত্যম কুড়মি /তপন পাত্র / শ্রীদাম কুমার
______________________________________________
নির্মল হালদারের কবিতা
হরিতকী গর্ভের আলোয়
------------------------------------
১.
একটি নাম একটি জীবন
যদি গ্রামের নাম
উমাকান্ত সিং সর্দার হয়ে থাকে
কেমন লাগবে?
যদি শহরের নাম
উমাকান্ত সিং সর্দার হয়ে থাকে
কেমন লাগবে?
যদি কল কারখানা হয়
উমাকান্ত সিং সর্দার
সকলের কাজ।
যদি ফসলের জমি হয়
উমাকান্ত সিং সর্দার
সকলের চাষ।
কাছে নেই দূরে নেই উমাকান্ত।
উমাকান্ত একটি নাম।
একটি আনন্দ,
উমাকান্ত সিং সর্দার।
২.
ডিম
ডিম তো পেড়েছে মুরগি
রক্ষা করবে কে?
ওগো ও অবনীর মা, ঝুড়িতে রেখেছো?
ভালো তো বাসতেই হবে
ডিম তো আমাদের,
ব্রহ্মাণ্ড।
৩.
যা বলতে চাই
চাস আবাদ করতে কটা বৃষ্টি লাগে
আমাকে বলবেনা বনবিহারী।
কদিন তা দিলে ডিম পাড়বে
আমাকে বলবে না হাঁস।
কেনই বা পলাশ বসন্ত দিনে?
লাঙ্গলের ফলার ধার কমলে
আমিতো জানবো না।
আমাকে বলেছে বনবিহারী---
নখের ধার কমাও
নখের ধার কমাও।
হাবিবুর রহমান এনারের কবিতা
১.
শূন্যের মায়াজাল
দেখো
মোহময় মেঘমালা কেমন
ওই দূর পাহাড়ে ঘুমিয়ে আছে
একসময় ঠিকই বৃষ্টিধারায় ভাসাবে নদী
নদীর ভালোবাসা সমুদ্র অনুকূলে বড় বেশি
ওই দূর গ্রামে
কোন স্বপ্ন হৃদে কাত হয়েছে আকাশ
পেতে চায় বোধ হয় মৃত্তিকার সুধা ঘ্রাণ
না-কি সে এক শূন্যের মায়াজাল
লোকেরা দেখছে- ঘোর চোখে দাঁড়িয়ে.....
আমি অন্তহীন পথ পেছনে ফেলে ফেলে
শুধু ছুটে চলেছি...
পায়ে জমছে পথের ধূলো রাশি রাশি!
২.
পাতা
বৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় দেখো—
দেখো কেমন অটুট বন্ধনে জড়িয়ে আছে
পাতাদের সবুজ সংসার
অপলক আর কী লোলুপ দৃষ্টিতে দেখছে
দেখো মৃত্তিকা- তার বুকে প্রতিপালিত— পাতাদের...সংসার
আমরা পাতারা- কালের আবর্তে ঘুরপাক
খেতে খেতে ক্রমান্বয়ে ঝরে পড়ি মৃত্তিকায়
এবং
মৃত্তিকা দেখো- কেমন নির্দ্বিধায় আমাদের
গিলে গিলে খায়...
৩.
রূহ
আজকাল আমারই রূহ
এ দেহ-তানপুরাকে
করছে অতিশয় অবজ্ঞা-হেলাফেলা
কায়মনে সে চাইছে না আর
এ দেহ-তানপুরাকে করবে......সঞ্চালন
এ দেহ-তানপুরাঙিনায় কষ্টের পায়তারা
আকাশ ভেঙে নেমে আসে এক টুকরো
হিমশৈল- দেহ-তানপুরা স্পর্শ করে.......
নিথর-নিস্তব্ধ দেহ-তানপুরা বাজে না.....
অন্ধকার কবর আস্তানায়
রূহ বসে আনমনে খেলছে তারার মেলায়
উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
দাগ
নৈঃশব্দ্য একটা সবচেয়ে বড় শব্দ
অমাবস্যা নিষিক্ত রাতে যেন এক
নির্বাসনের কবিতা
রক্তাভ যৌবন------প্রেমিকার মতো
শরীর জুড়ে সাদা আঁশ.........প্রকল্প গড়ে
অনাদৃত বারান্দায় থামে সহজিয়া প্রতিশ্রুতি
আমাকে অন্ধকার জাগায়,
পৃথিবীর দুর্দিনে এমন শুকনো আহ্বান,
উপচে পড়ে শিশিরের ঠোঁট
উপচে পড়ে অসুস্থ সময়
সূর্যাস্তের ছায়া ঢেলে তবুও নতুন আলো
এখনও আজন্মের কপালে নির্লিপ্ত হয়
প্রতিদিনের বেজন্মা ফাটা দাগ
২.
প্রতিশ্রুতি
কি সুন্দর পা
ও পায়ে নূপুর বাঁধো
আমার দুঃখের উপর তুলে রেখো ছাপ
ছুটন্ত হরিণীর মতো
ভয়ের ছন্দ জুড়ে আপন স্বরবৃত্ত-এ
মৃদু কম্পন তুলো
আমার দ্বিধার ভেতর
কি সুন্দর পা
ও পায়ে রাঙা আলতার
ছোপ
বর্ণহীন মেঝের গায়ে যৌবনের রঙ তুলি
স্পর্ধা তুলে রাখি নীল শিখার আগুনে
এখন হাত রাখো হাতের উপর
চোখ রাখো চোখে
ভুলে যেও না
এই তোমার যৌবনের প্রতিশ্রুতি
এপিটাফ - ২
অয়ন জোয়ারদার
থাকব না যেদিন সেদিন, আমার রচনার ছত্রে ছত্রে কি আরাম বাস করবে।
বইপোকারা আস্তে আস্তে এসে কেটে নেবে অক্ষর।
ক অক্ষর, ব অক্ষর, ৯ অক্ষর, ট অক্ষর, ত অক্ষর।
কোন বাক্য কেউ ধার করে কোন চটুল গানের প্রথম লাইন করে দিল।
বইপোকারা দাঁত বসাচ্ছে অক্ষরে, আমি আমার কৃতকর্মে।
কি করবে ভেবে নাও। এভাবে তো চলতে পারে না।
তাই সিদ্ধান্তটা নিতেই হল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে ঘর-গেরস্থালি-পুইডাঁটা।
অর্যমন মাঝে মধ্যে ডাকে--- ও বাবা...বাব্বা...বাবো...বাবু...আব্বা।
সে ডাক মাটি স্পর্শ করে রেল লাইনের খুঁটি ধরে ওপরে
ওঠে, বাতাসে মেশে... আকাশ ছুঁয়ে সূর্যের কাছাকাছি
গিয়ে ঈষৎ গরম হয়ে চাঁদের গায়ের কলঙ্কের ওপর বসে,
খানিক পরে আরও জোরে ঘুরতে ঘুরতে নষ্ট হয়ে যায়।
আমার হৃদ, তুমি যে ছোট, আঙুল দিয়ে
তারা চাঁদ দেখাও, ওখানে থাকিনা আমি।
ওখানে আমার শরীর। মন তোমার নামে। হৃদকমলে।
জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া তোমার ওই স্পর্শ, এ আমি
ফসিল করে নিয়ে গেলাম।
সমকাল
সত্যম কুড়মি
প্রশ্ন কোরো না
আনুগত্যে শুকতলা ক্ষয়ে যাক
তুমি ভালো লোক।
পরামর্শ দিও না।
সহমতিতে বিবেক ঝুঁকিয়ো।
তুমি অনেকের প্রিয়।
প্রতিভা নয়, বক্র মেরুদন্ড তোমার সাফল্য
মেধা, মনুষত্ব চুলোয় যাক
পরিবার বিরিয়ানি পাক।
ভালোবাসা নয়, অঙ্ক কষো
হৃদয় গেছে হাটে
তুমি কেউকেটা,রটে গেছে তল্লাটে।
সেবা নয়, নয় সাহায্য
ফেলো কড়ি মাখো তেল
ডারউইন, নিউটন সব উহ্য।
ভালো নয়, মন্দ হও
মানুষের মুখে চর্চা
ফিসফাস আওয়াজ আসে,
এলেম আছে বাছা!
বিশ্বাসী নয়, সততা নয়
মিরজাফ্ফর সিঁড়ি বেয়ে ওঠো।
জীবনের চেয়ে বড় অভিনয়।
দেশ দশ নয়, আখের গোছাও
রক্ত মেখে হাতে
চোখের জল করো পানীয়
তবেই কেল্লা ফতে।
দয়া নয়, ক্রুরতা আরোও
"ঝুঁকেগা নেহি শালা" সিলেবাসী আদর্শ
কে, কেনো মানব হবে বলতে পারো?
বন পুড়লে সবাই দ্যাখে ....
তপন পাত্র
বন পুড়লে সবাই দ্যাখে , মন পুড়লে কেউ দেখে না --- কথাটি বাংলা ভাষাভাষী মানব সমাজে সুদীর্ঘকাল ধরেই প্রচলিত রয়েছে । কিন্তু সত্যিই কি কোন কিছু পুড়লেই কেউ দ্যাখে ? হ্যাঁ দ্যাখে । নিছক ভ্যাবাচেকা নীরব দর্শকের মতো দ্যাখে । কেউ কেউ হয়তো দেখতে দেখতে পাথরও হয়ে যায় । কিছু করার থাকে না ! কিছু বলার থাকে না ! প্রতিবাদ যে করতে নেই ! মেরুদন্ড ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হ'য়ে মিশে গেছে পথের ধুলায় । সুতরাং অনর্থক কে চায় ফুটাতে কাঁটা নিজের শরীরে ?
ওরে ভাই , ওই দ্যাখো , চেয়ে দ্যাখো , আগুন লেগেছে বনে বনে । ডুংরি-টিলা ঝোপ-জঙ্গলস্থ পল্লী বাংলার লোকসমাজের খড়ের ঘরই শুধু নয় , নগর সভ্যতার নোটপড়া শিক্ষিত মানুষদের ফ্ল্যাটে-ফ্ল্যাটে গগনচুম্বী আবাসনেও । ভাইটি যেন আমার আড়কালা ; ও শুনলো টাটকা কলিজার মতো টকটকে লাল পলাশে ফাগুন লেগেছে বনে বনে ।
কিন্তু আমি মোটেই লাল পলাশের যে আগুন লাগে দিক হতে দিগন্তে, সেই ফুলের আগুনের কথা বলছি না । আমি তো ভুলের আগুনের কথা বলছি । মূলে আগুনের কথা বলছি । বসন্ত এলো মানেই এখানে ওখানে বনে জঙ্গলে আগুন আর আগুন । কে লাগালো ? কারা লাগালো ? মাত্র একটা গাছ সারা জীবনে মানুষ করা বড়ো দায় ! কিন্তু চোখের সামনে যখন অগণিত বৃক্ষ পুড়ে ছারখার হয়ে যায় , তখন প্রকৃত আগুনটা লাগে আমাদের মনের ভিতরে, শান্তিনিকেতনে । চোখের আড়ালেই ভষ্মীভূত হয়ে যায় কত নাম জানা ও না জানা বন্য পশুপক্ষী , কীটপতঙ্গের দল । গর্ভিনী বন্য প্রাণীর গর্ভে চিরন্তন মাতৃত্বে লালিত অসহায়, অবলা, পৃথিবীর আলো দেখবো বলে আকাঙ্ক্ষার বীজ ছড়ানো গর্ভস্থ প্রাণীটিও । আমরা যারা জ্যোৎস্না রাতে বসন্তের মাতাল সমীরণে বনে বনে মধুকরের মতো ভ্রমণবিলাসী, তারা তো ভাববাদী, রসতীর্থ পথের পথিক, আমাদের তো বীররসের বাস্তব কাব্য সৃজনের কোন দায় নেই , প্রয়োজন নেই । কারণ সব কাজ তো সকলের পক্ষে করে ফেলা সম্ভব নয় । সুচতুর সচেতনেরা তো আরো একধাপ বাড়িয়ে বলবেন, করে ফেলা সম্ভব হলেও করতে যাওয়া উচিৎ নয় ।
শুধু কি গাছ পুড়ছে ভাই ? শুধু কি উদার , উদাসীন বন্যপ্রাণ ? শুধু কি আগুন লেগেছে বনে বনে ? আগুন লেগেছে আমাদের অতি সাধারণ সুখী গৃহকোণে । কে লাগালো , কার হাতের একটি ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি পুড়িয়ে ছারখার করলো , পুড়িয়ে ছারখার করছে শিশু-নারী-বৃদ্ধ সহ এক একটি পরিবার ? এ কোন আগুন ? বিবেকের বাণী বলছে, আর যাই হোক এ নাকি কোনোমতেই রাজনৈতিক আগুন নয় । আচ্ছা , সেই লোকটা কে , সেই লোকটা কোথায়, যে একদিন বলেছিল --"এই দুনিয়ায় রাজনীতি ছাড়া কোনো হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে না" । কার কথা শুনবো, সেই চিরন্তন বাণী , নাকি আজকের জাগ্রত বিবেকের অমানবিক নির্লজ্জতার সগর্ব ঘোষণা ?
তা বুদ্ধিজীবীরা কী বলেন ? সুশীল সমাজ,আপনাদের মতামত কী ? আপনারা আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় কেন গা ? কোথায় গেল আপনাদের বিদ্রোহের সেই ঝোলা ব্যাগ , ইতস্তত প্রক্ষিপ্ত ঘুঁটে দেওয়া দেওয়ালের দাগের মতো চুরকু দাড়ি , উদাস উদাস রঙ্গিন মেঘাচ্ছন্ন রেশমি চুল ? আর আপনাদের সেই মহাকাব্যিক মাত্রাবৃত্তের স্লোগানগুলিই বা গেল কোথায় ? মেকি নিরপেক্ষতার সব লোভী গর্ত কি ভরে গেল ই-ভূষণ, উ-ভূষণ , উত্তরীয় , ভৃত্যভাতার কুকৃষ্ণ গরলে ? আপনারাই তো ঋষি প্রজাপতি, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা , বীণাবাদিনী সরস্বতী ; প্লিজ --বড় দুঃসময়, আমরা ওরা নয়, মানুষ পুড়ছে ! নারী , শিশু সহ অসহায় মানুষ । একটু ঝেড়ে কাশুন ।
হ্যাঁ ...? কী বললেন , আপনাদের দু'টি চোখ আগুন দেখতে পাচ্ছে না, আপনাদের মতো কুবুদ্ধিজীবী,দুঃশীল অমানুষগুলোর অপরের যেকোনো কাজে নাক সিঁটকানো নাকে এসে প্রবেশ করছে না মানুষের জীবন্ত চামড়ার মস্তিষ্কের ঘিলু ওলট-পালট করে দেওয়া ছিঁছিঁপোড়া গন্ধ ? কারণবারি পান করে এখনো বিভূষণ উৎসব নিয়ে ব্যস্ত আছেন ? ছিঃ ছিঃ ! লাজে মরে যাই ! যাদের বসনই নেই, তাদের আবার ভূষণে এতো লোভ কেন ? হায় রে, উলঙ্গ রাজা দেখতে দেখতে আপনারা নিজেরাও উলঙ্গ হয়ে যাচ্ছেন ! আপনাদের লজ্জা করে না !!! আকাশ যদি ভরে যায় জীবন্ত মানুষ পোড়ার গন্ধে , বলুন তো বৃষ্টি নামবে কোথা থেকে ? কবি-শিল্পীর তর্জনী যদি বাঁধা পড়ে সুবিধাবাদী পলিটিক্যাল ফাঁসে, সভ্যতার চাকা তবে গড়াবে কীভাবে ? . . . তাহলে তো মানুষের গায়ে আগুন লাগাবেই ওরা , তাহলে তো পুড়বেই শাল-পলাশ-মহুলের বন । বন পুড়লেও কেউ দ্যাখে না আর , ন্যাড়া পাহাড়ের চূড়ায় বসে পুড়ে আমার মন ।
গ্রন্থালোচনা: আঁকাবাঁকা শিকড়ের ছায়া
ছোঁয়া প্রকাশনী থেকে নির্মল হালদারের নতুন কবিতার বই ' আঁকাবাঁকা শিকড়ের ছায়া '-- এক শিকড় অভিলাষী মগ্নতার ফসল।
লোকসংস্কৃতির সঙ্গে প্রাণের গভীর মিতালী পাতিয়ে লোকজীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়েই এক একটি নিটোল কবিতা উঠে এসেছে এই কাব্যগ্রন্থে।তাই এক অনাবিল যাপনের ঘ্রাণ আর স্পর্শ কবিতাবইটির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। প্রকৃতি বড় বেশি জড়িয়ে আছে কবিতাগুলির সঙ্গে, পড়লেই পাই এক অনন্য স্বাদ।
জাওয়া করম-এর আলেখ্য আবহকে ঘিরেই কবি নির্মল হালদার গড়ে তুলেছেন কবিতার ভুবন--যেখানে বাংলা কবিতারও এক অনন্য মুক্তি। ভাব ভাবনার অনন্য সন্ধানে, সম্ভাবনায়।
কবিতাগুলির কোথাও কোথাও লোকছড়ার সহজ ছন্দের দুলুনির স্পর্শ পাওয়া যায়।
নগর-পরিধির থেকে মুক্ত জীবনের বৃত্তে ডুব দিতে দিতে ১-সংখ্যক কবিতায় পাই--
"কোন বনেরে সুগা জুড়াবো পিরিত?
পিরিতের রং-ঢং বড় ঘাম ছুটায়
করয়া ফুল ফুটলে পিরিত টুটে যায়
অরুণ বনে রে সুগা জুড়াবো পিরিত "
--পিরিতের এমন নিশান আর কোথায় মিলবে লোকজীবন ছাড়া?
নগর সভ্যতার বাইরে বহমান জীবনের অঙ্গে প্রেমবেদনার অতলস্পর্শী গভীরতা চিরন্তন অক্ষরে ফুটে উঠেছে ২-সংখ্যক কবিতায়--
"ঘরের কাঁথে ময়ূর এঁকেছি
ময়ূর চলে গেল বনে।
মনের কাঁথে তোকে এঁকেছি
তুই চ'লে গেলি গরুর সনে । "
--ময়ূর গরুর অনুষঙ্গে রাখালের ছবি ভেসে ওঠে। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের আভাসটি চিনে নেওয়া যায় সহজেই।যা লোকঐতিহ্যে উজ্জ্বল ও জাগরুক।আরেকটি কবিতায় স্পষ্টতই পাই--
" শ্যাম সরোবরে শালুক ফুল
চাঁদ আমার বেয়াকুল
সজনী রে, চাঁদ আমার বেয়াকুল।
শ্যাম সরোবরে লাল শালুক
চাঁদ আমার আকুল
সজনি রে, আমার মনে বিরহের সুখ।"
লোকায়ত জীবনের আনাচে-কানাচে চলতে চলতে শিকড় চলে এঁকেবেঁকে, উৎসমূলের খোঁজে নির্মল হালদার কুড়মালি ভাষাকেও তুলে এনেছেন কবিতার বলয়ে। কোন রকম মেকিপ্রলেপ ছাড়াই। এই শিকড়ের ছায়া সর্বব্যাপী।তাই শহুরে বাংলাসংস্কৃতি ছাড়াও বাংলার সংস্কৃতির এক অনন্য মুখের ছবি এঁকে দেন গাঢ় মমতায় লৌকিক উজ্জীবনের রঙে।
পুরুলিয়া তথা মানভূমের জীবন-প্রকৃতির অন্তর্লীন ধারাকে ছুঁয়ে ভিন্নতর জীবন-চর্চা ও ভাবনার কথা বাংলাকবিতার বৃত্তে তুলে আনতে কবি কুণ্ঠাহীন--
" ঝিরিহিরি পানিআ
পাতাল ফুঁড়ে পানিআ
আউ ভউজি ভরে গাগরিয়া
তহর গাগরিয়া
নেহি জে লেবন ভউজি তহরি চুঁয়া পানিআ
ঘরে আহি হামর হলবত পানিয়া । "
তবে এই কাব্যগ্রন্থে কুড়মালি ভাষার প্রয়োগ কবি সর্বত্র করেছেন তা নয় ।এক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট পরিমিতিবোধ ও মাত্রাবোধের পরিচয় দিয়েছেন। কবিতার ভাষাকে জীবন্ত ও রসোজ্জ্বল করার জন্য কোথাও কোথাও কুড়মালির আলতো ছোঁয়া দিয়েছেন। যেমন--
প্রেমের অসূয়া ও তার তীব্রতাকে বোঝাতে ভাষার বয়নটি হয়ে ওঠে এরকম--
"বল রে দেওড়া, কন্ রসিকা মালা পিঁধি গেলা?
বল রে দেওড়া, কন্ সতিনে সিঁদুর পিঁধি গেলা?
দুধ যে দুইলি কন্ পুতে খাবে?
রাহেড় যে ছিঁড়লি,কন্ পুতায় খাবে?
দেওড়া আমার করে ককর ক "
নির্মল হালদারের কবিতায় যে প্রকৃতিময়তা পাওয়া যায় এখানেও তা চোখে পড়ে--
" আমার মন চরে আকন ফুলের শোভায়
বুক আমার ধুক -পুকায়
চল্ রে দেওড়া আমার সঙ্গেই চ
বল্ ন তুই, আগুন কী হাওয়ার সাথে শুবে ?"
এই কাব্যের পরতে পরতে নগরসভ্যতার কলুষমুক্ত জীবনের স্পন্দন আর প্রকৃতি পরস্পর সম্পৃক্ত হয়ে আছে--
" রুখা মাঠে বক চরে
কার মুখ দেখি ঘরে ঘরে "
-- ভিনদেশে রুজি রোজগারের আশায় খাটতে যাওয়ার প্রসঙ্গ আছে। আছে অসহায়তা। তার মাঝেও নিসর্গ প্রকৃতি--
"মাঠে বক সারি সারি
আমার বুকে মেঘের বারি
আমি বারণ করতে নারি
বারণ করতে নারি ।"
নুনের মতো অমূল্য তো আর কিছু নাই। এই কথাটি কবি এখানেও বিস্মৃত হননি। জীবনের স্বাদও এই নুনে -- যা ছুঁয়ে আছে লোকজ জীবনস্পন্দন। বস্তুত ৫ -সংখ্যক কবিতাটি শালগাছকে নিয়ে, কবির প্রকৃতি-চিত্রণের আধারে হয়ে উঠেছে লোকায়তনিক প্রেমের আশ্চর্য সুন্দর নিটোল কবিতা--
" শালগাছটি দাঁড়িয়ে আছে, পাশেই কুসুম
দু'জনই বাতাস চেটে খায়
দু'জনই বাতাস থেকে নুনু চেটে খায়
শালগাছটি দাঁড়িয়ে আছে, পাশেই কুসুম
দু'জনই খুনসুটি করে
পাতা ঝরে
দুব্বাঘাস নড়ে-চড়ে পোকাটি লাফায় "
সীমান্তবাংলার বুকে বাংলারই এক স্বতন্ত্র রূপ চিনিয়েছেন কবি--
" ইরিঝিরি যমুনায় শ্যাওলা বহে না
বাঙালি বিটি করমের ডাল ধরে না
ইরিঝিরি যমুনায় শ্যাওলা বহে না "
* * *
এখানের লৌকিক জীবনচর্যায় ভাবনায় ঐতিহ্যে ভাদু ,জাওয়া,করম ,ডালপূজা(জিতা অষ্টমী) এসবের বহুধা প্রভাব দেখা যায়।সব ছাড়িয়ে করমের মুলটি গভীরে প্রোথিত। তারই বিভাময় রূপ এই কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতায় ধরা আছে।
কৃষিকেন্দ্রিক জীবনে মেঘের কার্পণ্য কী দুর্বিষহ! করম পরবে বহু আকাঙ্ক্ষিত বছরদিনের করমডালা কন্যাকে পাঠাতে -না- পারা এক পিতৃ হৃদয়ের যন্ত্রণার আর্তি ফুটে উঠেছে ১৫- সংখ্যক কবিতায়--
" পানি নাই
পিয়াসে পিয়াসে ফুটলো না ধান
গরু নাবলো জমিতে, কি গান ধরবি বিটি
কি গাইবি করমের গান
মেঘ এসেও মেঘ হলো না ছ্যাঁদা
কপাল গেল টুটে ধানের বদলে
আকাশেও ফুটেছে গ্যাঁদা
পানি নাই
বিটিরে কি করে পাঠাই তোকে নতুন ডালা
ভগমান শুনবে না আমার রা
সে তো বেজায় কালা "
---কার কাছেই বা নালিশ প্রার্থনা জানাবে, ভগবানও যে বধির হয়ে আছেন এখানে।
আবার , করমকে ঘিরেই এখানে প্রেমের উন্মেষ ঘটে--যেমন ১২-সংখ্যক কবিতাটি---
" বিনা বাতাসে অশথ গাছ ডলে
বিনা বাতাসে প্রেম-পিরিত চলে।
বিনা বাতাসে খেজুর রস মাটির তলে
বিনা বাতাসে তোর মন গলে
তুই তো আমার ভাদরিয়া
আমাকে করম নাচতে দেখেছিস
বর্ষার ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছিস "
তবে করম যে শুধু প্রেমেরই বাতাস বইয়ে দেয় ,তা নয়--করমডালা সাজানোর জন্য বোনের ভূমিকাটিও পরম মমতায় কবি তুলে ধরেছেন --
" ৬.
জনার ক্ষেত রুনু-ঝুনু
আখের ক্ষেত ঝঝর্
বহিন কাঁদে অহর-পহর
কে সাজাবে করম ডালা
কে নাচাবে কুত্থি-কলাই
মরিচ করে আলাঝালা "
করম যে কত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে এখানকার জীবনে তা বোঝা যায় 'বিটি'কে করম উপলক্ষে বাপের বাড়িতে কটা রাত থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধটিতে--
"১১.
পাবি না তুই করমের রাত
থেকে যা তুই আর কটা রাত।
পাবি না তুই সখিদের হাসি
পাবি না তুই আখড়ার বাঁশি
থেকে যা তুই আর কটা রাত
করমগাছ থেকে টপটপাছে সুর
বিটিরে
থেকে যা তুই আর কটা রাত। "
এখানের জীবনে করমের প্রভাব সর্বব্যাপী অতলস্পর্শী। তাই তা রচনা করেছে ভাই- বহিনের মধ্যে মায়া মমতার অটুট বন্ধন--
"৪২.
ভাদর লাগি বসে আছে বহিন
ভাদর লাগি বসে আছে ভাই
কবে আসবে ভাদর একাদশী
কবে আসবে করম একাদশী
বহিন বাঁধবে ভাইয়ের হাতে হলুদ সুতা
বাঁশের ডালায় আট কলাইয়ের চারা
ভাই বোনের পারা। "
পরিশেষে বলা যায় কাব্যগ্রন্থটিতে শেকড়ের টানের কথা--নাড়ির টানের আকুতির কথা ছড়িয়ে আছে --
" ........ ......... ......
পরবে আসো দাদা, বন্ধু-বান্ধব পাবে
খুড়ি-খুড়াদের ভালোবাসা পাবে
গাই গরুও আছে ভাই, তোকে দেখতে পাবে।
মুরগিরা লাফাতে লাফাতে তোর কাঁধে পাবে।
দাদারে তুমি দেখতে পাবে সবার মনের জমি।"
কবিতাগুলি পাঠের শেষে কাব্যগ্রন্থটি কবিতার ভাই দাদাদের নয় নিবিষ্ট পাঠকের মনের জমিও অধিকার করে নেয়। আমাদের চেতনাকে টেনে নিয়ে যায় শেকড়ের এক অমোঘ টানে...।
শ্রীদাম কুমার
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহযোগিতা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছবি : মধুবনী চিত্রকলা
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
এবারের 'অরন্ধন' খুব সুন্দর হয়েছে মধুবনী পেন্টিংএ সেজেছে পত্রিকা। সম্পাদকীয় কলম ভালো হয়েছে। এবারেও তপন পাত্র বাবুর লেখা খুব ভালো।
উত্তরমুছুন