এ ভরা ভাদর

এ ভরা ভাদর


                 তপন পাত্র


সাহিত্য-শিল্পের প্রধানতম বিষয়টি যে প্রেম একথা রসিকজন মাত্রই স্বীকার করবেন। বিদগ্ধজনেরাও বিপক্ষে যাবেন না। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, বলা যায় সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমের ভান্ডারটি বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য। রাধা-কৃষ্ণের সরস প্রেমলীলা তথা শ্রীরাধার প্রেমের ক্রমবিকাশ যে শুধুমাত্র স্বর্গীয় নয়, কল্পরাজ্য বৈকুন্ঠের সম্পত্তি নয়, এই মর্ত্যের তরুণ তরুণীর, মানব মানবীর প্রণয় লীলা এ কথা আমরা প্রায় সকলেই স্বীকার করি। মানবপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথও বৈষ্ণব কবিদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তুলেছিলেন --

     "সত্য করে কহ মোরে, হে বৈষ্ণব কবি,
      কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমছবি,
      কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
      বিরহ-তাপিত? হেরি কাহার নয়ান,
      রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে?
      বিজন বসন্তরাতে মিলন-শয়নে
      কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে,
      আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে
      রেখেছিল মগ্ন করি! এত প্রেমকথা,
      রাধিকার চিত্ত-দীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা,
      চুরি করি’ লইয়াছ কার মুখ, কার
      আঁখি হ’তে ?"


              আসলে প্রকৃত প্রেম যেখানে, সেখানে মানব ও দেবতার মধ্যে কোন ব্যবধান নেই। তাই তো ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
   "দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি, আকাশে প্রদীপ জালি, 
আমাদের এই কুটিরে দেখেছি মানুষের ঠাকুরালি।"
  সে কারণেই --

                       "আমাদেরি কুটীর-কাননে
           ফুটে পুষ্প, কেহ দেয় দেবতা-চরণে,
           কেহ রাখে প্রিয়জন তরে—তাহে তাঁর
           নাহি অসন্তোষ! এই প্রেম-গীতি-হার
           গাঁথা হয় নর-নারী-মিলন-মেলায়
           কেহ দেয় তাঁরে, কেহ বঁধুর গলায়!
           দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
           প্রিয়জনে—প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই
           তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!
           দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা!"

             সে যাই হোক মানবখেলা অথবা ভগবৎ লীলা যেখানে প্রেম, সেখানেই বিরহ। বিরহ প্রেমের একটি মহামূল্যবান অঙ্গ। বর্ষায় সেই বিরহ বহুগুনিত হয়। বৈষ্ণব কবি  ভাদ্র মাসের ভরা বাদল দিনে বিরহিনী রাধিকার চিত্তবিদীর্ণ তীব্র হাহাকারের কথা লিখেছেন --

                "এ সখী হামারি দুখের নাহি ওর।
   এ ভরা বাদর                            মাহ ভাদর
                       শূন্য মন্দির মোর।।"


             সখিরে আমার দুঃখের সীমা পরিসীমা নেই। এই ভাদ্র মাসের ভরা বাদল দিনে আমার গৃহ শুন্য। কারণ আমার কান্ত প্রবাসী। মানভূমের ঝুমুরেও প্রায় একই অন্তর্দহনের কথা রয়েছে --

      "ঝিঙা ফুল সারি সারি 
       বঁধু বিনে রঁইতে লারি,
       সহচরী দিবা নিশি ঐ ভাবনায় ঝু'রে মরি।"

   আর একটি গানে ঝুমুর কবি বলছেন--

           "এমন কে জানে
            বঁধু গে'লে ভা'বতে হয় মনে,
            ভাদর আদর মাইরি গেল অকারণে।"

                  এরকম সাহিত্যের আরো অন্যান্য শাখাতেও ভাদ্র মাসের যন্ত্রণাদায়ী পরিবেশ পরিস্থিতির কথা শুনতে পাই। মানভূম-পুরুলিয়ায় অন্য ধরনের হাহাকার বিজড়িত প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে "ভাদর মাসে রাজার ভান্ডারও খালি"। ভাদর মাস কোন কোন বছর ৩২ দিনের হয় । তাই লোকে বলে, " সমান ভাদরের ভাত নাই ,আরঅ দুদিন বা'ড়তা।"কিন্তু এই বিরহ বেদনা এই অন্নের হাহাকারের মধ্যেই ভাদর শেষ নয়। এখানে অনেক কিছু নাই এর মাঝেও ভাদর যেন আনন্দের মাস, প্রত্যাশার মাস, স্বপ্ন পূরণের মাস না হলেও স্বপ্নদর্শনের মাস। এই সময় আউশ ধান কাটা হয়, তা বড়ই স্বল্প; প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। গোড়া ধানের মাড়ভাত খেয়ে মানভূমের নবান্ন উৎসব পালিত হয়। অপরদিকে আমনের চাষবাস চুকিয়ে অঘ্রাণ পৌষের দিকে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো তাকিয়ে থাকা।


                  মানভূম-পুরুলিয়ায় ভাদ্র মাসটির গুরুত্ব অপরিসীম ।বহু পূজা-পার্বণ উৎসব অনুষ্ঠান আর চতুর্দিকে সবুজের সমারোহে মাসটি ভরা নদীর মতোই উচ্ছল, চঞ্চল, গতি তরঙ্গময়। করম, জাওয়া, ইঁদ, ছাতা, এবং জিতা, গোয়াল পূজা, তিথিতে তিথিতে মনসা পূজা ইত্যাদি উৎসবের গন্ধে উঁচা নিচা বন-ডুংরী, জঙ্গল, নদী-নালা গ্রাম-গঞ্জ ঢেকে থাকে। কুমারী , কাঁসাই, অজয়, শিলাই সুবর্ণরেখার হাড় জিরজিরে শরীরে ষোড়শী যুবতীর মত ভরা যৌবন।
                নানা দিক থেকে ভাদ্র মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রেম বিরহের পাশাপাশি এতদঞ্চলের মানুষের আর্থ সামাজিক জীবনযাপনের ছবিও ফুটে উঠেছে সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গে প্রত্যঙ্গে। মূলত কৃষিভিত্তিক সভ্যতার মানুষ সমস্ত কিছুর মধ্যেই উৎপাদনের প্রার্থনা আরাধনা করে থাকেন। ভাদু, করম জাওয়া,জিতা-এই চারটি লোক উৎসবের মূল সুর প্রজনন শক্তি ও উৎপাদনের জন্য লৌকিক ব্রত উদ্ যাপন। ইঁদ, ছাতা রাজা তথা জমিদারদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রদর্শনের উৎসব। অন্যান্য উৎসবের সঙ্গে এই উৎসব দু'টির বা প্রায় একই উৎসবের দু'টি অঙ্গের একটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য উৎসবগুলি একেবারে কৃষক ও কৃষিশ্রমিক সাধারণ জনগণের উৎসব কিন্তু ইঁদ ও ছাতা অভিজাত জমিদার সম্প্রদায়ের উৎসব।
                    ভাদ্র মাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব করম। এই পরব শস্যবৃদ্ধি কামনার পরব। উর্বরতাবাদের পরব। পরবটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কুমারী যুবতীদের জাওয়া পরব। করমে পাশাপাশি দু'টি করম ডাল প্রোথিত করে পুজো অর্চনা। এ যেন রাজা ও রাণীর বিবাহ অনুষ্ঠান। করম রাজাকে সূর্য দেবতা এবং করম রাণীকে ভূ অর্থাৎ পৃথিবীর প্রতীক রূপে কল্পনা করা হয়।


                  এখানে ইঁদ পরবের ১২ দিন পর জিতাষ্টমির ব্রত উদ্ যাপিত হয় বা জিতুয়া পরবের অনুষ্ঠান হয়। জিতাষ্টমীর ব্রত অনেকাংশে করম-জাওয়ার মতোই। করমে করম ডাল আর জিতাতে আঁখ দাঁড়ি এবং ডুমুর গাছের ডাল প্রোথিত করে পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও থাকে বট গাছের ডাল। গাছের ডালে শালুক ফুল।পূজার উপকরণ এবং পদ্ধতির মধ্যেও অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। পার্থক্য এটাই যে সামাজিক দৃষ্টিতে উচ্চবর্ণের মানুষদের মধ্যে করম জাওয়ার প্রচলন নেই কিন্তু জিতার প্রচলন রয়েছে।
                 ভাদ্র মাসের আরেকটি প্রাণবন্ত উৎসব ভাদু পূজা। ভাদু পূজাতেও কুমারী মেয়ে এবং সধবা মেয়েদের আধিপত্য। এই ভাদুব্রত বা ভাদু উৎসব সারা ভাদ্র মাস জুড়ে চলতে থাকে। এটি করম যাওয়া বা জিতার মতো সরাসরি কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে হয় না। তবে প্রচ্ছন্নভাবে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে যেহেতু যুবতী কুমারীদের মধ্যে উর্বরতার বিষয়টি প্রকট এবং তারাই এই ব্রত উদযাপন করে থাকেন এবং কৃষি উৎপাদনের মরসুম ভাদ্র মাস জুড়ে এই উৎসব উদযাপিত হয় সুতরাং এই ব্রত বা উৎসবের সাথেও কৃষি উৎপাদনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত মেলে।
                লোকসাহিত্যের সঙ্গে ভাদ্র মাসটির যোগ যে কতো নিবিড় তা বোঝা যায় এখানে প্রচলিত ঝুমুর গানের একটি সুর "ভাদরিয়া সুর" নামে পরিচিত , এক বিশেষ শ্রেণীর ঝুমুর গান "ভাদরিয়া ঝুমুর" নামে নামাঙ্কিত। সাধারণভাবে কেউ কেউ বলেন ভাদ্র মাসে অনুষ্ঠিত লোক উৎসবগুলিতে যে ঝুমুরগানগুলি গীত হয়, সেগুলিকে  বলে ভাদরিয়া ঝুমুর। যুক্তিটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর পাঁচটা ঝুমুর গানের সঙ্গে ভাদরিয়া ঝুমুরের বিষয় ভাবনাটিতে হয়তো আকাশ পাতাল প্রভেদ নেই, কিন্তু অন্যান্য ঝুমুরের সঙ্গে ভাদরিয়া ঝুমুরের গঠনগত ও রচনার কারুকর্মগত, বিশেষ করে সুরের দিক থেকে একটা প্রভেদ অবশ্যই আছে। এই শ্রেণীর ঝুমুর অন্যান্য ঝুমুরের তুলনায় আকৃতিগত দিক থেকে ক্ষুদ্র এবং সুর লয়ের দিক থেকে দ্রুত। তবে অন্যান্য ঝুমুরের মতো এখানেও রাধা -কৃষ্ণ প্রেম কথা এসেছে, এসেছে আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের ঘর কন্যার কথা।
                 আগেই বলেছি ভাদর বিরহের মাস। পদাবলীর রাধিকার মতো পুরু'লা-বৃন্দাবনের প্রেমোন্মাদিনী বিরহিনী নায়িকা বলছেন -

     "কোকিলার ডাক শুনি নিজে মনে ভাবি গুণি,
      আমার কলপি কলপি উঠে ছাতিরে।।
       ওরে পাখি কেনে ডাক, নিশি ভোর রাতি।
       দিবানিশি কেঁদে মরি, না আসিল বংশীধারী,
       আমার ঝর ঝর ঝরে দু'টি আঁখিরে।।
       নিশি হল অবসান, না আসিল বাঁকা শ্যাম,
          শ্যাম আমায় দিয়ে গেল ফাঁকিরে।।"

     শুনতে পাচ্ছি পদাবলীর চরণ -- 

             "মত্ত দাদুরি,         ডাকে ডাহুকী, 
                     ফাটি তাওতো ছাতিয়া"।
               চির দিগ ভরি।          ঘোর যামিনী
                       অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।
              বিদ্যাপতি কহ      কৈছে গোঁয়াঅবি
                     হরি  বিনে দিন রাতিয়া।।"

       কবি ভরত কিশোরের একটি ঝুমুরের কলি ---

           "ঘন ঘটা রাতিয়া চমকে বিজলিয়া ,
            থাকি থাকি জলে বিরহ আগুনিয়া।
            কোথা আছো প্রিয়তম দেখ ন আসিয়া,
            তব আদর্শনে আছি মরমে মরিয়া।।"

                 এ তো গেল নর-নারীর চিরন্তন শাশ্বত প্রেম বিরহের কথা। কিন্তু অন বস্ত্র বাসস্থান তো যে কোন মানুষেরই জীবন যাপনের প্রাথমিক শর্ত। এই অঞ্চলে যে মৃত্তিকা তার গঠন প্রকৃতি এবং জলবায়ু তাতে এহেন প্রবাদের জন্ম হয় যে,"চাষ নাই বাস, টুরুই ব্যাঙের আশ"। ইতিপূর্বে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আকাশের প্রসন্ন দাক্ষিণ্য মেলেনি। কালো মেঘ কৃপণ হয়ে উঠেছিল।
 একটি ঝুমুরে কবি বলছেন,

      "আষাঢ় শ্রাবণ মাসে নবীন মেঘে ঘেরোলি
       ওহো রে পানিক বুঁদা না বরিষে,
       ও প্রাণ দিন ধরিব কেইসে।"

          আবার যদি কোন বছর নামিবর্ষা হয়, অর্থাৎ বর্ষার আগমন ঘটে বিলম্বে, তখন হঠাৎ বৃষ্টিতে একসঙ্গে সকলের চাষ লেগে যায়। কৃষক কামিন মুনিশ খুঁজতে গেলে পায় না।

             "শরাবন ভাদর মাসে
              চাষী বুলে ঘরে ঘরে,
              কামের মাসে।
              কত ছল করে গো কামিন মুনিসে
              বড় 'রীত ভাদর মাসে।"

              শ্রাবণ-ভাদর মাসে চাষবাসের পর মানভূমবাসীর পরিবারে পরিবারে অন্যের হাহাকার। সে সময় মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তির একটি বড়ো মাধ্যম জনহা'র অর্থাৎ ভুট্টা। পুড়িয়ে,সিজিয়ে, পাকা জনহা'র শুকনো করে খই ভেজে অথবা ছাতু বানিয়ে  মানুষ ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটায়। বাড়িতে অতিথি এলেও তখন জনহা'র পোড়া দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। প্রতিবেশীদেরও খাওয়ানো হয়। না খাওয়ালে অভিমান হয়। অভিমান ধরা দিয়েছে গান হয়ে --

                   " এত বড় ভাদর মাসে
                     পথে চ'লে  যাই হে ,
                     কেউ না শুধা'ল মুখে
                     জনা'র পড়া খাও হে।"

      মানভূমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লোকনৃত্য কাঁঠি নাচ। এই নাচের গানেও এসেছে ভাদ্র মাসের কথা।

         "ও ভাদরের ভরা নদী     
          ছে'লা নাই মোর ঘরে গো 
          আর আশ্বিনে অম্বিকা পূজা 
          আমরা সবাই করি গো।"


               আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজাতে মন্ডপে মন্ডপে গ্রামে গ্রামে কাঠি নাচের দল নিত্য পরিবেশন করে ঘুরে বেড়ায়। সেই নৃত্যের আখড়া বা অনুশীলন টি শুরু হয়ে যায় ভাদ্র মাসেই। তাই ভাদ্র শুধু বিরহের মাস আর মনস্তাপের মাস নয়, মানভূম-পুরুলিয়ার দৈনন্দিন জীবনে ভাদ্র ভাদরের যৌবনবতী ভরা নদীর মতোই প্রাণবন্ত টইটুম্বুর, ভাদর প্রত্যাশার মাস, প্রস্তুতির মাস, স্বপ্নযাপনের মাস।

"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। মুকেশ কুমার মাহাত

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। নাচনী শিল্পীদের আলোক-চিত্র ।। সন্দীপ কুমার