একটি দলিত গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাঃ “প্রাণনারী” কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল।
একটি দলিত গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাঃ “প্রাণনারী” কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল।
মধুপর্ণা কর্মকার
গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষজনের শিক্ষার প্রতি দিয়েছিলেন সর্বাধিক গুরুত্ব। মানুষকে শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন, শিক্ষাই পারে নিগড় গুলো একে একে খুলে দিতে, অধিকার অর্জনের পথ প্রশস্ত করতে। আম্বেদকর দলিতজনের শিক্ষা ও অধিকারের প্রায়োগিক লক্ষ্যে বহুল পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে দলিত নারীবাদী, বিশিষ্ট দলিত স্বর, লেখক কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল ১১/০৮/২০২২ তারিখ তাঁর জন্মস্থান নদীয়ার বগুলা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘রেণুকা ঠাকুর দলিত গ্রন্থাগার’।
নদীয়া জেলার বগুলায় ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহন করেন কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল। বি কম পাশের পর তিনি রেলে চাকরি পান এবং চাকুরিরত অবস্থায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম কম পাশ করেন। ১৯৯৪ সালে ‘নীড়’ নামে একটি দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন, পরবর্তীকালে ‘নীড় ঋতুপত্র’ লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন। বিগত আট –দশ বছর থেকে এটি দলিত নারীদের রচনাস্থল এবং অনলস একটি প্লাটফর্ম হিসাবে কাজ করে চলেছে। তাঁর সম্পাদিত ‘নীড়’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যার শিরোনাম –‘ভারতীয় নারীর ছোটগল্প’ (২০১৫), ‘ দলিত মেয়েদের সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী-সহ অন্যান্য রচনা’(২০১৭),‘দলিত নারীর প্রবন্ধ সংখ্যা’ (২০১৮), ‘দলিত নারীর বিবিধ রচনা’(২০১৯), ‘দলিত নারীর বিবিধ রচনা’ (২০২১)।এছাড়াও তিনি ‘বাঙলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’র সদস্য এবং ‘চতুর্থ দুনিয়া’ পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য।পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দলিত সাহিত্য অকাদেমির সদস্য।
সাহিত্যের যাবতীয় শাখায় তাঁর বলিষ্ঠ ও সাবলীল বিচরণ, যা একটি স্বতন্ত্র স্বরকে অবয়ব দেয়। বক্তব্যের স্বাতন্ত্র্য এবং বলিষ্ঠতা তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকে করে তুলেছে প্রতিনিধিস্থানীয় যার পাঠ অনুরাগীরা ছড়িয়ে রয়েছেন সারা বিশ্বজুড়ে। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। একাধিক কবিতা সংকলন, ছোট গল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংকলন, আত্মজীবনী ও উপন্যাস তিনি লিখেছেন। ২০১৬ সালে অষ্ট্রেলিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে মেলবোর্ণে বক্তব্য রাখেন তিনি, ২০১৮ সালে ইংল্যন্ডের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কবিতা বিষয়ে একটি ওয়ার্কশপ আয়োজন করে, তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বি বি সি তাঁর রচিত সাহিত্য বিষয়ে সাক্ষাৎকার নেয়। তাঁর কাব্য সংকলন -‘ধরলেই যুদ্ধ সুনিশ্চিত (২০০৩-২০০৪), যে মেয়ে আঁধার গোণে ( ২০০৮), চন্ডালিনীর কবিতা ( ২০১১), চন্ডালিনী ভণে(২০১৫)। গল্প সংকলন – ‘ফিরে এল উলঙ্গ হয়ে’( ১৪২১)। প্রবন্ধ সংকলন – চন্ডালিনীর বিবৃতি -১ (২০১২), চন্ডালিনীর বিবৃতি -২ , আত্মজীবনী – ‘আমি কেন চাঁড়াল লিখি ( ২০১৬, ২০২১), উপন্যাস – আন্ধার বিল ও কিছু মানুষ (২০১৯)। চন্ডালিনী ও বনচন্ডালী ছদ্মনামে তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ- কৃষ্ণচন্দ্র ঠাকুর ( কেষ্ট সাধু)ঃ স্মৃতি সম্ভার(১৯৯৯), লোকসংস্কৃতিক প্রবন্ধ সংকলন ( ২০০৮), মতুয়া ধর্ম প্রসঙ্গে(২০১০), সুধাংশু দুলাল অধিকারী রচনা সমগ্র(২০০৮), Dalit Lekhika – Women’s writings from Bengal (2020)
কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল তাঁর জন্মস্থান নদীয়ার বগুলায় আগস্ট মাসের ১১ তারিখ ২০২২ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘রেণুকা ঠাকুর দলিত গ্রন্থাগার’। মতুয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির চিহ্ন ছিল অনুষ্ঠানের সর্বত্র। ঠাকুর হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদকে সম্মান জ্ঞাপন করে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁদের বার্তা উপস্থাপিত হয়। দলিত সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বিদ্দজনেরা উপস্থিত ছিলেন এই মহতী উদ্যোগের উদযাপনে। কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল এই গ্রন্থাগার নির্মাণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য গুলি স্পষ্ট করেন তাঁর বক্তব্যে। দলিত লেখক মঞ্জু বালা প্রস্তাব দেন এই গ্রন্থাগার এর সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে অভিলেখাগার (আর্কাইভ) নির্মাণের। উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা এই গ্রন্থাগারে পুস্তক প্রদান করেন। দলিত সাহিত্যে কিভাবে একটি স্বতন্ত্র আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে এবং তার তাৎপর্যের কথা বলেন কল্যানী ঠাকুর। গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা বিষয়ে আকুতির কথা বারবার উল্লেখ করেন তিনি। “খেতে পাও বা না পাও, পড়াশুনা করতে হবে যদি দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে চাও” এই কথা তাঁর কথায় বারংবার উঠে আসে। ঠাকুর হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের যে আহ্বান বহুমানুষকে প্রভাবিত করেছিল, শিক্ষা বিষয়ে সচেতন করেছিল সেই ধারা বলবত রাখার কথা তিনি বলেন। পড়াশুনার পরবর্তী যে ফলাফল, অর্থাৎ অর্থনীতিতে অংশ গ্রহন, সামাজিক ‘মর্যাদা’ বৃদ্ধি সে বিষয়ে সচেতনতার বিষয় উঠে আসে অনেকের কথায়। আম্বেদকরের শিক্ষা বিষয়ক বক্তব্য গ্রন্থাগার উন্মোচনের মূল সুরটিকে উচ্চগ্রামে বেঁধে রেখেছিল, যার প্রতিফলন ছিল উপস্থিত প্রত্যেকের বক্তব্যে। বাড়িতে বই রাখার উপযোগিতা, প্রতিটি শিশুর পাঠাভ্যাসের গুরুত্বের কথা বলা হয়। উপস্থিত বগুলা গ্রামের মানুষজনকে বই এবং পাঠাগারের গুরুত্বের কথা বলা হয় এবং ‘রেণুকা ঠাকুর দলিত গ্রন্থাগারে’ নিয়মিত ছেলেমেয়েদের পাঠানোর বিষয়ে সচেতনতা নির্মাণের উল্লেখ করা হয়। কল্যাণী ঠাকুর উল্লেখ করেন কিভাবে তাঁর পিতা মাতা তাঁকে এবং তাঁর সহোদরকের শৈশব থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সংগ্রাম করে লেখাপড়া করিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, শিক্ষার মাধ্যমে একজন প্রান্তিক মানুষ বলিষ্ঠ স্বর হয়ে উঠতে পারে। এই গ্রন্থাগারে দলিত লেখক –লেখিকাদের রচিত এবং তাঁদের সম্বন্ধীয় বই ইতিমধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে। বিগত দিনের দলিত অধিকার আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিদের রচিত বই রয়েছে। মঞ্জু বালা তাঁর বক্তব্যে বলেন “আমরা সব জায়গায় কেবল শুনছি ‘প্রাণ পুরুষ’ দের কথা, তাঁরা সব জায়গায় নানা ধরনের কাজ বা প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন, এই গ্রন্থাগারের কিন্তু ‘প্রাণ পুরুষ’ নেই, ‘প্রাণ নারী’ রয়েছেন। একজন বলিষ্ঠ নারীর উদ্যোগে এই গ্রন্থাগার নির্মিত হল। দলিত সমাজে শিক্ষা বিষয়ক সচেতনতার প্রসারে, দলিত সাহিত্যের বহমানতায় এই গ্রন্থাগার উল্লেখযোগ্য ভুমিকা নেবে নিঃসন্দেহে।সর্বোপরি এই প্রত্যয়, কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়ালের সৃষ্ট সাহিত্য, সম্পাদিত পত্রিকা “নীড়”, এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলিত গ্রন্থাগার একটা স্বতন্ত্র স্বরকে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।
রেণুকা ঠাকুর দলিত গ্রন্থাগার। প্রতিষ্ঠা -১১/০৮/২০২২
গুরুচাঁদ ঠাকুর, বুদ্ধদেব, আম্বেদকর, হরিচাঁদ ঠাকুর।
পাঠকক্ষ।
বিশিষ্ট দলিত লেখিকা মঞ্জুবালা।
কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল নব প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারের তাৎপর্য সম্পর্কে বক্তব্য রাখছেন।
নব প্রতিষ্ঠিত দলিত গ্রন্থাগারে পুস্তক প্রদান করছেন মঞ্জু বালা।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী –
১। কল্যাণী রচনা সমগ্র, কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল, ২০২১,চতুর্থ দুনিয়া, ২২ ভবানী দত্ত লেন, কলকাতা – ৭০০০৭৩
২। আন্ধার বিল ও কিছু মানুষ, ২০১৯ কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল, চতুর্থ দুনিয়া, ২২ ভবানী দত্ত লেন, কলকাতা ৭০০০৭৩
৩। ‘দলিত নারীর বিবিধ রচনা’ নীড় ঋতুপত্র, বিংশতিতম সংখ্যা, পঞ্চবিংশতি বর্ষ, সম্পাদক কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল, ১৭ ই আগস্ট, ২০১৯ , কলকাতা।
৪। ‘দলিত নারীর প্রবন্ধ সংখ্যা, নীড় ঋতুপত্র, সম্পাদক কল্যানী ঠাকুর, ঊনবিংশতম সংখ্যা, চতুর্বিংশতি বর্ষ, ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮।
পরিচিতি
মধুপর্ণা কর্মকার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্রে গবেষণা করেন। লিখেছেন - ' গার্লস হস্টেল ; আবাসিক নারীর মানসভূমি।'(২০১৮)
তাঁর ব্লগ লিঙ্কে প্রবেশ করুন
তাঁর লিঙ্কট্রি লিঙ্কে প্রবেশ করুন
মধুপর্ণার আগের সংস্করণের লেখা পড়ুন
মধুপর্ণার আগের সংস্করণের লেখা পড়ুন
ভাল হয়েছে
উত্তরমুছুন