শ্রীসদনে দৈনন্দিন - ২
শ্রীসদনে দৈনন্দিন - ২
মধুপর্ণা
স্মৃতির উত্তরাধিকার এক অদ্ভুত বায়বীয় বাস্তব। শ্রীসদনে যে ছাত্রীরা থেকেছেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম বেশকিছু মাস যাবত৷ স্মৃতির সাঁকো বেয়ে একটা সামগ্রিক ধারাবাহিকতার ছবি দেখার ইচ্ছায়। রবীন্দ্রসমকালে এবং পরবর্তীতে ছাত্রীদের শান্তিনিকেতনবাস এবং আবাসজীবনের স্মৃতি বিষয়ে বইপত্র বিস্তর। যাঁরা বিগত, তাঁদের কথা সেইসব বইপত্র থেকে জানা গেছে। কিন্তু যাঁরা বর্তমানে রয়েছেন এবং একটা সময় কাটিয়েছেন শান্তিনিকেতনে, শ্রীসদনে তাঁদের কাছ থেকে জীবন্ত মণিমাণিক্য মিলেছে বহু। শ্রীসদনের আাবসিকাদের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আবাসজীবনের প্রসঙ্গে একটা উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে তাঁদের মুখের মনিটরে, কথায়, স্বরে। অপরিচিত তরুণী নিমেষে চেনা হয়ে যায়, বিচিত্র গল্প বলে যান সহজেই। সেইরকম এক কথোপকথন থেকে কিছু অংশ …
“বর্ষে বর্ষে দলে দলে, আসে বিদ্যামঠ তলে / চলে যায় তারা কলরবে...” গুনগুন করছিলেন তিনি। “ তারপর শোনো, আমার যিনি রুমমেট ছিলেন দারুন গান গাইতেন তিনি,পরবর্তীতে অবশ্য সেসব পাঠ চুকে যায় “, “ ওয়েটিং রুমটা এখনও সেরকমই আছে নাকি! দেয়ালের ছবিগুলো অপূর্ব এখনও চোখে ভাসে!” “ ছবি দেখবেন? গেছিলাম” “ কই দেখি! দেখতে দেখতে একটা স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়ে মুখে। নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে তাঁর ছাত্রীরা অতিথিকক্ষের দেয়ালজুড়ে এঁকেছিলেন ম্যুরাল। ম্লান হয়ে যাওয়া সেইসব ছবি তাঁকে দেখাই। বলেন, “১৯৮২ - ৮৭ ছিলাম ওখানে, তখন তোমার জন্মও হয় নি। এইসব গল্প করতে পেরে ভাল লাগছে। এতবছর পরে কেউ এসে শ্রীসদন নিয়ে গল্প করছে, এইটা উপভোগ্য”। তিনি গৃহিণী। তাঁর বৈঠকখানায় তখন পড়ন্ত বিকেলের হলুদ আলো, ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার আগে ঠান্ডা পড়ছে ক্রমে।কয়েকটা বিচ্ছিন্ন সময় পরস্পরের সঙ্গে মিশে ধারাবাহিক হয়ে পড়ছে, একটা প্রবাহ? হাইপোথিটিক্যাল প্রবাহ? না, বাস্তবটা প্রখর। নিকট বাস্তবের সঙ্গে দূরতম বাস্তবের একটা যোগ।
“তোমাদের সময় তো আর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট ছিল না। আমরা কিছুটা হলেও দেখেছি আশ্রমের ছিটেফোঁটা। দারুণ একটা সময়। ভবানীদা আসত সপ্তাহে একদিন। আমাদের যাবতীয় শাড়ি ধুয়ে মাড় করে দিয়ে যেত। শাড়ি নেবার সময় সামনের চাতালে কেমন হুল্লোড় হত ভাবতে পারবে না। ধোয়া শাড়ি প্রথমদিন পরে বেরোনোর মধ্যে একটা এমন আনন্দ ছিল, এখনকার এই ভয়াবহ উত্তেজনাময় সবকিছুর ভিতরে সেসব বোঝা যাবে না।“
ভবানীদাকে আমিও দেখেছি। ইলেভেনে। শাড়ি প্রতি তিনটাকা তখন।
“দেখেছ? বাহ। আসলে কি জানো? তখনকার যা কিছু মানসিক সঞ্চয়, সেইসব দিয়েই মূলত বাকীটা চলছে,বাকীদের যেটুকু স্নেহ, আশ্রয়, প্রশ্রয় দিতে পারি, তা আদতে সেই সময়ের রেশ। একটা মন তৈরি হয়ে যায়। প্রচুর টানাপোড়েনের পরেও ভাটা পড়ে না। কিছুটা হলেও থাকে”।
খুঁড়ে খুঁড়ে দেখা নেশার মতন। দূর সময়ের অপূর্ব এক আবাসিকার স্মৃতি খুঁড়ে, উল্টে পাল্টে আদতে কি দেখতে চাই? তাঁর স্মৃতিচারণের গলি বেয়ে শান্ত সফর, কথোপকথন। তিনিও বলে যান। গল্প করতে এখনও পারেন অনেকেই। শ্রীদসনের আবাসিকার গল্প আদতে একটা স্মৃতির মাদুর যা বিছিয়ে বসতে পারে পরের অথবা তারও পরের প্রজন্মের আরেক আাবসিকা।
একটা ছোট সাঁকো
স্মৃতির সাঁকো।
তাই ডিঙিয়ে
তোমার সময়
আমার সময়
যায় মিলিয়ে।
জেগে থাকে
স্মৃতির সাঁকোয়
শান্ত সফর।
নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে তাঁর ছাত্রীদের আঁকা ছবি শ্রীসদনের অতিথিকক্ষের দেয়ালে। ( নিজস্ব চিত্র )
পরিচিতি
মধুপর্ণা কর্মকার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা চর্চাকেন্দ্রে গবেষণা করেন। লিখেছেন - ' গার্লস হস্টেল ; আবাসিক নারীর মানসভূমি।'(২০১৮)
তাঁর ব্লগ লিঙ্কে প্রবেশ করুন
তাঁর লিঙ্কট্রি লিঙ্কে প্রবেশ করুন
মধুপর্ণার আগের সংস্করণের লেখা পড়ুন
মধুপর্ণার আগের সংস্করণের লেখা পড়ুন




মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন