গুচ্ছ কবিতা ।। তৈমুর খান
গুচ্ছ কবিতা
তৈমুর খান
১
নিশিবেলায়
পাখির মতো ক্লান্ত দিন
চলে যায়
যেতে যেতে ডাকে
ডাকার সংকেতে
নিভে যায় আলো
আঁধারের চুলগুলি জড়াই
প্রিয়ার মতোন চোখেমুখে
২
আমার ঘর
এখানে শহর নেই
মাটির বাড়ির দাওয়ায়
নিঃস্ব পিতার ছায়া পড়ে আছে
মায়ের নিকোনো উঠোনে বৃষ্টির দাগ
আমাদের কিশোরবেলা আজও ছুটোছুটি করে
অদূরে মাটির কলসি ঠাণ্ডা জল নিয়ে বসে আছে
পিপাসা পেলে যাই তার কাছে
পাতার জ্বালে সেদ্ধ হয় ভাত
নতুন ধানের গন্ধে ঘর ভরে আছে
৩
খিদে
পালাতে পারি না কোথাও
আমি ও আমার ছায়া কাছাকাছি থাকি
দুপুরে গরম ভাতের ঘ্রাণ এলে
খিদে পায়
রোজ রোজ খিদে পায় শুধু!
এই পুকুরের ঘাটে দু'দণ্ড বসি
বহু পুরনো সিঁড়িতে দেখি নূপুরের শব্দ লেগে আছে
আলতা পরা খালি পা কার উঠানামা করে?
দুয়ার খোলা আছে
বাগানের হাওয়া আসছে বসন্তের আমন্ত্রণ নিয়ে
সব কুঁড়ি ফুটবে এবার অনুরাগের পরশ পেয়ে!
পালাতে পারি না,
মাঝে মাঝে কোকিলের মতো ডাকি—
কেন ডাকি?
আমার ছায়াটি বোঝে সব, শুধু আমিই বুঝি না;
আমার শুধু খিদে পায়
এ আর এক অন্য খিদে—
খিদের আগুনে হৃদয় সেঁকি!
৪
প্রস্তুতি
তোমার আঁচলে কত নক্ষত্র ফুটেছে
বিচিত্র আলোর ঝিকিমিকি
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি!
ওখানে হৃদয় রাখবো তোমার আলোয়
ওখানেই রেখে দেবো আমার বাঁশির সুর
ওখানে কখনো হবে না অন্ধকার!
শুধু রাত্রির সন্তান হয়ে বেঁচে থাকা যায়?
মাইল মাইল রাস্তা হেঁটে জীবনের আয়ু হলো ক্ষয়
অন্ধকারে নিজেকেও বিশ্বাসঘাতক মনে হয়
সারারাত যদিও জেগে থাকি
সারারাত যদিও নক্ষত্রফুল কুড়াই
তবু এক উজ্জীবনের ডাক আসে শুনি
দীর্ঘশ্বাসগুলি লুকিয়ে ফেলি
আর তৃষ্ণাগুলি অস্বীকার করি
গভীর নির্জনে একা চুপি চুপি যাই…
৫
এই জন্ম
যে শব্দ গান হয়নি
আমি সে শব্দের কাছে যাইনি কোনোদিন;
যে মেঘ বৃষ্টি দেয়নি
আমি কি সেই মেঘের কাছে গেছি?
আমার শস্যের ক্ষেতে শব্দ আর গান
আমার মাথার ওপর মেঘ আর বৃষ্টির সম্মোহন।
এই জন্ম শুধুই বাঁশি
এ জীবন শুধুই ভেজা ভেজা অভিমান
দুপুর বিকেল হয়ে আসে
বিকেল রাত্রির ডাক পায়—
গেরুয়া আলোর পথে নামে রাঙাচেলি
রাত্রিতে হেসে উঠবে অদ্ভুত জ্যোৎস্নায়!
বিশ্বাসের ধ্বনিগুলি বেজে ওঠে
অলৌকিক সমুদ্রের নৌকাগুলি ছেড়ে যায়
একে একে সমস্ত নাবিকেরা সাদা পোশাক পরে
আমিও ধূসর গন্ধ মুছে ফেলি মনে মনে
উপলব্ধির সব জানালায়
আমার আসক্তি তীব্র হলে
আবার আবার মেঘ জমে
শব্দেরা গান হয়ে ফেরে।
৬
আমার ইচ্ছা
ও জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দেয়
ডিমের খোসা, পচা আম আর
আমি ওর মুখের দিকে চাইতে পারি না
ছাদের উপর উঠে ও চাঁদ দেখে,
নক্ষত্রদের ডাকে
অন্য গ্রহের মানুষদের ডাকে
আমি ওর মোবাইল নম্বর চাইতে পারি না
আলো নিভিয়ে চুপচাপ বসে থাকি
অন্ধকারে ওর মুখ হেসে উঠে
ওর মুখের হাসি লিখে রাখি
আমার সাইকেল ওর রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ায়
আমার চপ্পল নিঃশব্দে ওর জানালা পেরোয়
আমার ইচ্ছা লুকিয়ে থাকে
লুকিয়ে লুকিয়ে পাখি হয়
শরৎ ঋতুর মেঘ হয়
সোনালি ধানের রোদ হয়
পদাবলির ঢেউ হয়
৭
প্রাচীন কুমির এক
শীতের সকালে রোদ পোহাচ্ছি
চোখ বুজে আসছে,রোঁয়া ওঠা সোয়েটার
ঝুলে পড়েছে শরীরে
প্রাচীন কুমির এক
রুক্ষ হাত-পায়ে খড়ির দাগ
চামড়া খসখসে
সংসারটি প্রাচীন সমুদ্র
এখন ঢেউ নেই
স্তব্ধতায় ঝরে পড়ছে সবুজ কুয়াশা
মাছগুলি গভীর জলের তলায় কিছুটা উষ্ণতা ভিক্ষা করে
আমার শিকার কাহিনি আর কাহিনির চিৎকার
কত যুগ বয়ে চলেছে
আর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছি কেবলই
নিজের সামনে নিজেই দাঁড়িয়ে কেঁপেছি
আদিম শ্যাওলা আর জলজ আকাঙ্ক্ষার উপজীবীগুলি
কীরকম আস্তরণ ফেলেছে সারা পিঠে
চোয়ালে ধূসর সংকেত মূর্ছনায় কাঁপে
কুয়াশার পোস্টম্যান হাহাকার চিঠি দিয়ে যায়
৮
পৃথ্বীরাজ
ঝড়ে হড়কম্প কুঁড়েঘর
সংযুক্তা লন্ঠন জ্বেলে দিচ্ছে পৃথ্বীরাজকে
কাচ ভাঙা লন্ঠন বলে ঝড়ে ও আগুনে ঠেলাঠেলি
উঠোনে নুয়ে পড়ছে বেগুন গাছ
গাছের কোটরে লুকিয়ে যাচ্ছে কাঠবেড়ালি
ইতিহাস উঠে দাঁড়াচ্ছে আজ আমাদের পাড়ায়
নেহাৎ দুর্গম ঝোপঝাড়ে আটকে যাচ্ছে আলো
আদিম জোনাকির ভাষায় রাতের গুহালিপি
পাঠ করছে ঐতিহাসিক শবর
ছেলেপুলে কী করে বাঁচবে পৃথ্বীরাজ?
ঝড়তো মামুদ বাহিনী, ঝটিকায় উড়িয়ে দেয় চাল
এই বাংলার মাটিতে মিশে যায় তোমার রক্ত-ঘাম
ঘর বেঁধে আবার আলো জ্বালো, পৃথ্বীরাজ চৌহান!
৯
ভাঙা সেতুর উপর
খুব ভোরে নদী ছুটছে
আমি চাষা হতে গিয়ে কাক হয়ে গেছি
শুধু জীবিকা উড়ছে বাতাসে
শুধু চোখ উপড়ে অন্ধ হচ্ছি ভিক্ষুক পেশায়
পর্যাপ্ত কৌশল সব আরও বন্য করে দেয়
সুতরাং বিনম্র আবেদনও ক্রূর
ঠাণ্ডা হাত আগ্নেয় রসদে পূর্ণ
জিভের স্নেহাশিস বাক্য ভিজে যায় বিষাক্ত লালায়
নদীকে দেখি না আমি।
ভাঙা সেতুর উপর
নিজেরই ঘাতক হয়ে নিজেকেই টেনে আনি
নিজের কাছেই নিজে প্রাণভিক্ষা চাই
১০
নিজের মুখোমুখি
বয়স্ক প্রেমিকের চোখ আমার চোখে নেমে গেছে
কোনও ঋতুই আর মশাল জ্বেলে বলে না :
এসো, এসো, ঘরে এসো….
কখন সূর্য ডুবে যায়
ঘরের দুয়ারে শীত কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে বসে থাকে
নিজেই এখন নিজের পুতুল
ঘুমাই জাগাই হাঁটাই অথবা বসাই
এখন নির্জন সংলাপে কুশল বিনিময়
এখন ঈশ্বর এবং না-ঈশ্বরের কোচিং ক্লাস
১১
পরিত্যক্ত
সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে একেবারে নিচে
একেবারে রাস্তায়
যেখানে পলিথিন, ছেঁড়া কাগজ, শালপাতা
উড়ে আসছে—
সেখানেই এসে দাঁড়িয়েছি
এখন আর কোনো কাজ নেই আমার
ছুরি ভোঁতা হয়ে গেছে
শরীরে আগুন নেই
গৌতম বুদ্ধ বহু যুগ আগে
আমাকেই প্রথম দেখেছিলেন
১২
পুরনো রাস্তা
মা-বাবাও পুরনো হচ্ছে
বউও পুরনো হচ্ছে এখন
নিজেও পুরোনো হতে হতে
নিজের কাছেই বাতিল
বিজ্ঞাপনের খসড়া প্রস্তুত
বাইরে যারা অপেক্ষা করছে
তাদের দিয়ে দাও —
এখন নতুন ঘুম
যে আলোগুলি চোখের ওপর পড়ছে
তাও পুরনো—
পৃথিবী কি পাল্টেছে কোনওদিন ?
কেউ বলতে পারে না।
অথচ সবাই নতুনের দাবি নিয়ে
পথে নামছে—
যে পথে হাজার হাজার বছর ধরে
বুদ্ধ যিশু কনফুসিয়াস হেঁটে গেছেন
পরিচিতি
তৈমুর খান, নব্বই দশকের কবি ও গদ্যকার। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'কোথায় পা রাখি'(১৯৯৪) । আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : বৃত্তের ভেতরে জল, জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা, উন্মাদ বিকেলের জংশন, স্তব্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি, নির্ঘুমের হ্রস্ব ধ্বনি, আকাঙ্ক্ষার ঘরের জানালা ইত্যাদি । গদ্যগ্রন্থ : কবির ভাঁড়ারের চাবি, মুক্তির দশক নব্বইয়ের কবি ও কবিতা, কবিতার বাঁক ও অভিঘাত এক অন্বেষার পরিক্রমা, আত্মসংগ্রহ, আত্মক্ষরণ, আত্মস্বর, এই কবিতাজীবন ইত্যাদি । পুরস্কার পেয়েছেন দৌড় সাহিত্য পুরস্কার, নতুনগতি সাহিত্য পুরস্কার, আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার, অক্সিজেন সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি । পেশা শিক্ষকতা । ঠিকানা : রামরামপুর (শান্তিপাড়া), ডাকঘর রামপুরহাট, জেলা বীরভূম, পিন কোড ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ । ফোন নম্বর ৯৩৩২৯৯১২৫০
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন