চতুর্থ বর্ষ ।। একবিংশতি ওয়েব সংস্করণ ।। ২৮ মাঘ ১৪৩০ ।। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ভোট আসে ভোট যায়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে উন্নয়ন। দেশে স্কুল কমে, মন্দির বাড়ে। বাড়ে মসজিদ। স্কুল শিক্ষকের জায়গায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে মৌলবী, পুরোহিত। ছাত্রদের শিক্ষায় মেধাবৃদ্ধির বদলে মেধাবৃত্তি ঘটে ইউটিউবে। বিজ্ঞানীর বদলে সংসদ ভবন উদ্বোধনে আসেন হিমালয়ান সাধু। তারপরও থেমে থাকে উন্নয়ন?
১০০ দিনের টাকা খানিক কেটে খানিক দেওয়া হয় জবকার্ড হোল্ডারদের। মামলা ঠুকে বন্ধ করে দেওয়া হয় আবাস যোজনা। দু'বছর পড়ে থেকেও একই থাকে টাকার পরিমাণ। কাঁচামালের দাম বাড়ে তিনগুণ। পোক্ত হবে না গরীবের আবাস? থেমে থাকে উন্নয়ন?
চাষির নিজের জমির মাটি নিজের জমিতেই স্থানান্তর করণে প্রশাসনিক বাধা। নিজের জমিতেই নিজের মাটি দিয়ে ইট প্রস্তুতিতে চড়া কর। একই ট্রেনের একই গতি একই মতি রেখে কেবল নাম পরিবর্তন করে যাত্রীর পকেট খালি করার পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্ৰহণ। তারপরও থেমে থাকে উন্নয়ন?
আমরা এক আজব দেশের নাগরিক। যেখানে কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত থাকে। থাকে ফুটপাতে। অথচ আরাম কেদারায় বসে আরাম করে পোষ্য। পোষ্যের পেটে যায় বিরিয়ানি, কোরমা। আমি সর্বস্ব রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বন্যায় ভাসতে থাকা নাগরিকদের হেলিকপ্টারের উপর থেকে হাতছানি দেয় রাজনেতা। তারপরও থেমে থাকে উন্নয়ন?
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
লালন চাঁদ / উৎপল দাস / রূপক চট্টোপাধ্যায় / রিঙ্কু চট্টোপাধ্যায় / দেবযানী ঘোষাল / বিলকিশ বেগম / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / ময়ূখ দত্ত / সুজন পণ্ডা
_____________________________________________
লালন চাঁদের কবিতা
কুর্নিশ
কখনো আমার দুচোখে আটকে থাকে রাত
আঁধারে নদী ভাঙে। হৃদয় ভাঙে
জনসমুদ্রে ভেসে যায় নিঃস্ব জীবনের খড়কুটো
নীড়ে ফেরা পাখিরা জেগে থাকে সারারাত
ব্যথাগুলো ফিরে ফিরে আসে
আমি ঝরে পড়া শিউলি কুড়োই। কুড়োই শীতের রাত
প্রতিদিন কতো কথা ভিড় করে আসে মনে
রুক্ষ বালুচর
তবু বারবার আমি যেনো অগোছালো জীবন সাজাই
চারদিক অন্ধকার
সুতীব্র টর্চের আলো ফেলে আজও কারা ছড়ায় ত্রাস
বুকের ভেতর অশ্বেতর সংশয়
ফেলে আসি কারুকাজ করা প্রাচীন দিন
বুকের উইঢিবি ভাঙি
দেখি হাজার হাজার মানুষ সমাজ বদলের ডাক দেয়
আমি ওদের বুকে বারবার এঁকে দিই হাজার কুর্নিশ
ইস্তেহার
জল ভাঙলে জল
জল ভাঙলে শুকনো বালুচর
তবু জীবন তরী সাজাই। পেরিয়ে যাই অজানা সাগর
তোমার সাথে দেখা
হৃদয়ে এলোমেলো ঝড়
তুমি এলে না। আমার বুকের উপর জগদ্দল পাথর
ইষ্টনাম জপি
কোথায় ঈশ্বর
তবু প্রতিদিন ঈশ্বর ঈশ্বর বলে নিজেকেই হাতড়াই
কথা ছিলো
ফিরে এলাম
শূন্য ভাণ্ডার। দেখি পড়ে আছে বিবর্ণ জীবনের ইস্তেহার
সুন্দরী
ভালোবাসা !
তোমাকে সেলাম
তুমি কখনো উদার। কখনো কপট
সামনে কোনো সুন্দরীকে দেখলেই
ভালোবাসতে চাই
বলি, আই প্রপোজ ইউ
ও তেড়ে আসে। বলে, আই হেট ইউ
তাই আজও আমি অকৃতদার
নিজেকে বদলাই
নিজেকে বদলাতে বদলাতে আমি আজ বৃদ্ধ
এখন আমি কোনো সুন্দরীর দিকে তাকাতে পারি না
কোনো সুন্দরীও আমার দিকে তাকায় না
পৌষের রোদেলা তন্ময়
উৎপল দাস
রোদের দিকে পিঠ করে বসল যে ছায়া, তার পুরোনো ক্ষত-জখম শুকনো হয় কি কমলা রঙের উষ্ণতায়? কম্বল পেতে শুষে নিচ্ছি আকাশের পিঠ পিছু ষড়যন্ত্রদের, সেই কম্বলটি যে রোজ রাত হলেই বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে— দম বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ে না— এমনই বিকৃত জিসম্ ভুখা তার, ক্রমাগত উত্তুরে হাওয়ায় আবার গা এলিয়ে দিলাম— গাছের মর্মর শব্দে— পাতাদের শনশন শব্দে লোমকূপে সিরসির অনুভূতি জাঁকিয়ে ধরেছে, তবুও শীত প্রিয়, ভোরের কাঁপা কাঁপা কুয়াশার মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়— কিছু অবসাদগ্রস্ত দুশ্চিন্তাদের ও সরল-স্বাভাবিক জলপানে খানিক আশ্বস্ত হই এই ভেবে যে আবার কোনও গাছ কাটার ভোঁ ভোঁ শব্দে নির্মীয়মাণ গদ্য-কবিতা ছাপা হবে না— শুধুই শয্যার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ একমাত্র তৃপ্তি; যখন সময় থাকবে না তাড়াহুড়োয় গম্ভীর পরিস্থিতি সামাল দিতে বেরিয়ে আসবে সচেতন স্বভাব ভঙ্গির ম্যানিপুলেশন এবং কোনওভাবেই চিন্তার অবসেশন ক্ষতিগ্রস্ত না করেই ঠান্ডা জমবে লেখায়— হস্তাক্ষরে
রূপক চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
ত্রিপদী
১.
সময় হলোও আর বাড়ি ফিরেতে ইচ্ছে করে না।
ঘড়ির কাঁটা ভেঙে
টুপটাপ নির্জনতা ঝরে। শুকনো পাতায়
পা ফেলে ফেলে কৈশোর খুঁজি, সদ্য ফোটা
কুঁড়ির ভেতর মায়ের ময়লা কাপড়ের গন্ধ খুঁজি।
দিকে দিকে গুমটি খুলে
বিপননে মশগুল হয়েছে মানুষ।
পানের স্টলে বসে বখাটে হচ্ছে রোদ বান্ধব।
ভালোবাসার চাতাল জলে ধুয়েমুছে
একটি ইচ্ছাপূর্ণ ঘট বসাই।
আমি বাড়ি নয়, একটি অনন্ত উৎসবের দিকে
হেঁটে যেতে চাই।
..... ক্রমশ!
২.
ধৃতি সেন শর্মা সাদাকালো টিভিতে
খবর পড়তেন। কপালের ওপর টলটলে
একগোছা চুল দুলে উঠত বৈকালিক সংবাদে!
তখন থেকেই আমি তার প্রেমিক। নব কিশোর।
তাকে দেখিনি কোনদিন। শুধু একটা
টিভির সাদাকালোর ভেতর তার বসন্ত বিচ্ছুরণ দেখেছি।
বয়সে তার ধারে কাছে ছিলাম না।
তবু মনে মনে ডিঙিয়ে যেতে চাইতাম
সেলুলয়েড সভ্যতা। আংরাভাস নদী। চা বাগান।
বরফ শরীর নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্যন্ত অপেক্ষা
আমাকে এখনও ফার্ন বিকল করে রাখে।
৩.
এতোটাই জমি অধিগ্রহণ করেছি আমি।
এতোটাই পৃথিবীর পরিধি। এর বেশি নয়।
কবেকার সম্মোহনী আগুন
টেনে নিয়ে যায় ওই যজ্ঞের দাউদাউ উচ্চারণে।
এইতো গিজার্ড গরজে ওঠা জলে
উষ্ণ হচ্ছে মন ভালোকরা বিন্ধ্যচল। রাত জুড়ানো
রুটির পাশে একটি বিষন্ন শূন্যের ভ্রমরী
গান গায়। আমার কান্না আসে।
এতোটা কান্নাই অধিগত করেছি আমি
যতটা কাঁদলে দেহ বৃক্ষ পাখি এসে বসে।
সব মানুষ নাগরিক পোশাক থেকেও
বেশি ভালোভাসে মানুষের ঘেঁষে ঘেঁষে থাকা
হৃদয়ে হৃদয়ে।
প্রতীক্ষার আর একটি দিন
রিঙ্কু চট্টোপাধ্যায়
প্রতীক্ষার আর একটি দিনের সমাপ্তি হল।
ভোর বেলা ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি,
প্রভাতের সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়া
রোদের কুচি,সবুজ ঘাসে পড়ে থাকা
শিশিরকে করেছে উজ্জ্বল।
প্রতীক্ষার আর একটি দিনের হল সমাপ্তি,
ভেবেছিলাম ঐ রোদ্র-কুচির মত আজ
তোমার লেখা একটা নীল খাম
আমার চোখের অশ্রুজলে
এনে দেবে খুশির ঝিলিক।
কিন্তু......।
প্রতীক্ষার আর একটি দিনের অবসান হল
রাতের শেষে আবার আসবে ভোর
জাগবে ভোরের সূর্য;
তার দিকে চেয়ে শুরু হবে
আবার আমার তিতিক্ষা,কি জানি
আগামী দিন পূর্নতা বয়ে আনবে কিনা?
প্রতীক্ষার আর একটি দিনের হল অবসান,
আজকের রাত হল শেষ,
না পাওয়ার বিসর্জনের কান্না দিয়ে
আগামী দিন আবার শুরু হবে,
তার শেষে আবার অন্য দিন,
তবু, ভোরের নরম রোদের মত
কোন আলো
আমার শূন্য মনকে ভরাবে কি?
কল্পনায়
দেবযানী ঘোষাল
জীবনের প্রায় সায়াহ্নে এসে মনে হয় অনেক কিছু বাকি রয়ে গেল।
ব্যার্থতাগুলো যখন আষ্টে পৃষ্টে বাঁধে, তখন মনে হয় চ্যালেঞ্জগুলো এক একটি পরীক্ষা।
সেই পরীক্ষাগুলোতে সেরার সেরা না হতে পারি সফল যেন হই।
এমন মনবৃত্তি অনেকেরই মনে হয় কমজোরীর দুর্বলতার কথা।
আসলে লড়াই করে জেতার চেয়ে সহিষ্ণুতাকে অবলম্বন করে সময়কে আঁকড়ে ধরে অপেক্ষার ফসল ফলাতে ভীষণ ইচ্ছে করে।
ললাট লিখন হোক বা হস্তরেখার কাটাকুটি।
জন্মবধি অপ্রাপ্তির মধ্যে যে দয়া মায়া করুণার অশেষ প্রাপ্তি তাকেই স্বীকার করেছি অহরহ বাঁচবার তাগিদে।
কেন বারবার মনে হয় এ পৃথিবী বুঝি দৃষ্টিহীনদের কাছে অনেক বেশী আদরের।
অনেক বেশী আপনার।
বিলকিশ বেগমের কবিতা
রাতের আঙিনা
আজও আঁধার রাতের আঙিনায়
তারা করে আলাপন
আমি জোছনা মাখি গায়
জোছনার গভীরতায় নিজেকে খুঁজি
পেয়ে যাই অনায়াসেই
আড়াল থেকে মুচকি হাসি হাসে চাঁদ
চারদিকে অলোক ছড়ায়
নক্ষত্রদের দোলনায় আমি বসে লিখি
অনন্ত লেখা
দিন যায় রাত যায় কবিতার পাতায়
আজও প্রভাতফেরির গান শোনায়
ভোরের দোয়েল
২.
ভেজা নকশী কাঁথা
হৃদয় কাঁদে
কাঁদতে পারে না চোখ
কান্নায় ভেজাই নকশি কাঁথা
বিষণ্ণ বসত
ঘূর্ণিঝড়ে হৃদয় উথাল পাথাল
চোখের কোণে জমে বৃষ্টি
হৃদয়ের খুশি খুঁটে খুঁটে খায় দুষ্টকীট
৩.
ভোর আসে না ভোরে
বুকে মরুভূমি নিয়ে
সাজাই বিছানা
ভোর আসে না ভোরে।।
তাজা ফুলদানির ফুল
হয়ে ওঠে গন্ধহীনা
পুরোনো স্মৃতিগুলো নীলনদের জলে ভাসাই।।
বৃথা এ জীবন
আজও সোহাগী রাত জাগি
তারই অপেক্ষায়।।
হাজার বছরেও ঘুম আসে না চোখে
আঁধারে জেগে থাকি
অনন্ত বেদনায়।।
উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
আয়নার ভেতর অভিসার
আয়নার ভেতর অভিসার
লজ্জাবতী পাতার মতো নিখুঁত নুইয়ে পড়া
প্রতিবিম্বটির গায়ে শীত আসে
রোদ্দুর ফুরিয়ে ক্রমশঃ বিকেলের মতো
অনিবার্য পোশাকের এপার ওপার
কেবলই অন্ধকার
অস্ফুট অভিযোগে শ্বাস ফেলে কেউ
কেউ বা প্রেমিকের মতো শিশির শব্দে
কপাল ভেজায়
পুষ্ট হয় আলোর প্রভা
স্বপ্ন সন্ধানে মেতে ওঠা শিরস্থানে আদর
আয়নার ভেতর অভিসার
শুধু একা অথবা একা থাকার
২.
রাস
অজান্তে লিখি
বর্ণচোরা শেষ পাতাটি তুমিই
তোমাকে নিয়ে গায়ের লোম
লোমশ বুক প্রীতিকাব্য
শুনেছ? রুলটানা শিরায় রক্তের হাহাকার
দেখেছ? নিরবিচ্ছিন্ন কথার ফাঁকে
নগ্ন বুকে শিথিল ঘাম
অমৃতের সাধনায় অনাহুত যাচক আমি
দেহ রসে সঞ্চারি সুখ
এরপরও বলবে? তুমি রাধা নও
কৃষ্ণ প্রেমে তবু আমি পরাজিত চন্দ্রাবলী
দীর্ঘ দিনান্তের ক্লান্ত সূর্য পেরিয়ে
খুলে ফেলি যত দেহজ পোশাক
আলিঙ্গন শুধু আলিঙ্গন
তুমি আর আমি
নিষ্কাম রাসে বিমুক্ত পৃথিবী
৩.
স্বাগত বসন্ত
মুমূর্ষু আনন্দের দিকে মন
পুরোনো শরীর ছুঁয়ে আছে মাটি
দেবতার গ্রাসে এবার বিদায় প্রহর
নিমিত্ত নিঃশ্বাসের তীব্র ঘ্রান নিয়ে
চঞ্চল বাতাস
আলোকের নিঃসারি উত্তাপের আগুনে
তখনও সুখ ছুঁয়ে আছে
নিবিষ্ট সময়ের কোলে ঢালাও শূন্যতা
এভাবে অতিবাহিত স্বপ্নের রেশ টেনে
জাঙ্গল শব্দ বিন্যাসে মূর্ত প্রকৃতির রূপ
মুগ্ধ কোকিলের কন্ঠে বিজয়ী স্লোগান
অপেক্ষার চরমে এসে হারানো পরিচয়ে
বেঁচে থাকা শেষ কটি পাতার জীবন
কিশলয় কিংশুকে স্বাগত বসন্ত
দূর্বার আরো একটি গ্রীষ্মের জন্ম দেবে দিনান্তের
পশ্চিমী সূর্য
থাইল্যান্ডের ডাইরী...
ময়ূখ দত্ত
রাস্তায় চলতে ফিরতে একটা ব্যাপার খুব নজরে পড়ে এখানে----রাস্তাঘাট, ফুটপাথ বেশ পরিষ্কার। বোঝাই যায় যে এসব পরিষ্কার করার জন্য মাইনে করা লোকজন থাকা ছাড়াও সাধারণ মানুষজনের মধ্যেও সচেতনতা আছে যথেষ্ট!! তার সাথে আর একটা জিনিষ নজরে আসে... ফুটপাথে অনেক ডাস্টবিন রাখা। ময়লা ভর্তি, কিন্তু কুকুর বা বেড়ালের দেখা পাই না কোনোদিন সেসবের ধারে পাশে। আমাদের চেনা, অভ্যস্ত চোখে কেমন যেন হিসেবটা ঠিক মেলে না!! খবরের কাগজে পড়া বা কোনো কোনো সময়ে নিজের চোখে দেখা সেইসব অসহায় মানুষগুলোর কথাও মনে পড়ে যায়, যাদের দেখা যায় সবার অলক্ষে ওইসব ডাস্টবিনে মাথা ঢুকিয়ে খাবার খুঁজে বেড়াতে...
ময়লাতে উপছে পড়া ডাস্টবিনের আশেপাশে কেন কোনোদিন কোনো কুকুর বা বিড়াল দেখতে পাই না, এই প্রশ্নটা সবসময়েই মনের অবচেতনে ছিল...
আমাদের সাইটে লাঞ্চ আসে হোটেল থেকে থাক থাক বাটি ভরা টিফিনবাক্সে, আমার নিজের খাবারের পরিমানের থেকে অনেকটা বেশি। অর্ধেক পরিমাণ খাবার নষ্ট হয়, প্রতিদিন... কতৃপক্ষকে জানালাম, আমার টিফিনবাক্সে খাবারের পরিমাণ কম করতে!! সবমিলিয়ে ১৫০ জনের টিফিনবাক্সে প্রত্যেকের চাহিদা মত এরকম 'কাস্টমাইজ' পরিমাণ খাবার প্যাক করে দেওয়া নাকি খুব অসুবিধের হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে... তাই বেশি পরিমাণের খাবার আসতেই থাকে, খাবার নষ্ট হওয়া চলতেই থাকে, আমার চোখের সামনে, আমার আপত্তিতেও...
অফিসের ঝাড়পোঁছ করা মেয়েটি আমার পড়ে থাকা লাঞ্চের ডাব্বা আমার অফিসের টেবিল থেকে নিতে এসে কেমন যেন খুব খুশী হয় প্রতিদিন, এত এত খাবার বেঁচে থাকে বলে নিশ্চই!! এসব কি আর ও ফেলে দেয়? নিশ্চই বাড়িতে নিয়ে চলে যায়!! এতেই হয়ত ওর বাড়ির লোকজনের একবেলার খাবার হয়ে যায়...এসব ভেবে আমি কিছু কিছু বাটির খাবার একেবারে স্পর্শই করি না, যাতে খাবার ঘেঁটে না যায়...
তারপরে একদিন বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে চোখে পড়ল, ওই মেয়েটি সবার লাঞ্চ হয়ে যাওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া সব খাবার একটা বড় পাত্রে ঢেলে পরম যত্নে হাত দিয়ে ডাল-ভাত মাখছে, তরকারী বা মাংস আলাদা করে আরেকটা বড় বাটিতে। মাছ হলে তার কাঁটা বেছে আলাদা করে রাখছে...আমি ওকে দেখছি দেখে একটু যেন নিজের মনেই গুটিয়ে গেল... ভাত মাখা থামিয়ে অপেক্ষা করল কখন আমি দৃষ্টি সরিয়ে নেব....কেমন যেন একটা খটকা লাগল, আমি ভাবতে বসলাম বাড়িতে নিয়ে যাবে তো সব এক জায়গাতে জড়ো করে মাখবে কেন?..... একটু নজরে রাখলাম কয়েকদিন, একই ব্যাপার!! সন্দেহ হওয়াতে একদিন জিজ্ঞাসাই করে বসলাম "... এভাবে মাখছ কেন? আলাদা করে বাড়ি নিয়ে গেলে তো ভাল হয়!!" তারপরে জানতে পারলাম যে আমাদের প্রোজেক্ট সাইটের আশে পাশে যত কুকুর বা বিড়াল আছে, তারা নাকি লাঞ্চের পরে আমাদের অফিসের পেছনে একটা ছোট্ট মাঠে জড় হয়, এই মেয়েটি পরম যত্নে তাদের খাওয়ায়...আমাদের ওই উচ্ছিষ্ট খাবার দিয়ে...একদিন সেটা দেখেও এলাম, প্রায় ৩০/৪০ টি কুকুর...এক্কেবারে আমাদের পাত পেড়ে খাওয়ানোর মত করে মেয়েটি ওই কুকুর গুলোকে খাওয়াচ্ছে!! মেয়েটির নিজের জীবনে প্রতিদিন দুই/তিনবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা কতটা আছে, সেটাই হয়ত একটা বড় প্রশ্ন, কিন্তু তারপরেও বেঁচে যাওয়া ওইসব উচ্ছিষ্ট খাবারদাবার পরম মমতায় হাতে মেখে রাস্তার কুকুরদের এইভাবে পরিবেশন করাকে সেলাম না জানিয়ে পারলাম না.... সাথে সাথে নিজেকে একবারের জন্য হলেও কেমন যেন খুব ছোট মনের মানুষ বলে মনে হল...।
আকাশ পাতাল
সুজন পণ্ডা
বাসের জানালায় দেখলাম একটা মুখ। বিষণ্ণ। শ্রাবণের মেঘ যেন।
অর্ধেকটা জানলার কাঁচে আড়াল। কিছুটা আড়াল চুলে। তবুও যেটুকু দেখা যায়, ওই চোখ, কপাল আর চিবুকের তিল... হায় কি ধূসর আজকের দিন।
কোনো যুবক হয়তো কথা দিয়ে আসেনি... অথবা এসেও ফিরে গেছে সাত তাড়াতাড়ি... বিদায় বেলার চুমু টুকু কি লেগে আছে কোথাও? ওই তিলে? কিম্বা আঁখি পল্লবে?
যুবকের গায়ে কোনো হলুদ পোশাক ছিল নিশ্চিত... পাঞ্জাবি? নাকি ঢিলে শার্ট? বুকের বোতাম খোলা... ওর চোখে এখনো সেই হলুদ ধরা আছে দেখছি।
এমনটাই যে হয়েছে... যুবকটি ফিরে গেছে আমি আন্দাজ করছি নিশ্চিত ভাবে... যেন বা দেখতেও পাচ্ছি। ওই যে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছে সে... পায়ের চাপে শুকনো পাতারা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। শব্দ আসছে। যতদূর হেঁটে যাচ্ছে যুবক ভেঙে যাচ্ছে কারোর মন।
বুঝতে পারছি এক্ষুনি দুয়েক ফোঁটা তারা খসে পড়বে। আঁচলে বিষাদের কণা নিয়ে বসে থাকতে থাকতে এই তরুণী আরো সংকুচিত হবে।
আমার ইচ্ছে করছে ওর হাত ছুঁয়ে দেখতে। আমি জানি ওর হাত ছুঁলে আমার চামড়া পুড়ে যাবে এখন। এই উষ্ণতা সহ্য করতে পারে ওই বোতাম বিহীন শার্টের বুক শুধু। খেয়াল করলে আন্দাজ করা যায় যখন ওই বুক এই হাত ছুঁয়েছে অপার্থিব শব্দে বাষ্পীভূত হয়েছে কতো অপেক্ষার যন্ত্রণা। ওই আঙুল জানে সব উষ্ণতা থার্মোমিটারে মাপা যায় না।
যুবক বলেছে হয়তো "এবার আসি... তোমার বাসের সময় হলো আমারও টিউশন আছে...আজ হয়তো বেতন পেতে পারি।"
হয়তো।
হায় যদি কাল আসতে পারতো মেয়েটি... তাহলে একটা রেস্টুরেন্ট, নান রুটি চিকেনের কোনো ডিশ... কিছুটা সময়.. শেষ বেলায় আইসক্রীম।
হায় যদি গতকাল বেতন পেয়ে যেত সে....
যুবক ফিরে গেছে তাড়াতাড়ি... শেষ বিদায় জানিয়ে যাওয়ার সময় টুকু ও দেয়নি ভালো মতো... যাবার বেলায় পিছন ফিরে তাকাতে হয় অনেকবার... অথচ সে তাকায় নি কেন? কিছু কি লুকিয়ে রেখেছে?
থাক... লুকোনো থাক।
পৃথিবীর শুকনো যান্ত্রিকতা থেকে লুকোনো থাক কয়েকটা কারণ.. ওই মেয়েটিও বরং তার জানলা টেনে দিক... যেন কেউ দেখতে না পায় ওকে...। ওরা নিজেদের রং ধনু নিয়ে থাক... এই বিশ্বের ধূসর বাস্তবে দুটো প্রাণী না হয় না-ই আসুক এক্ষুনি... ওদের লুকোনো যা কিছু ওরা প্রাণ ভরে উদযাপন করুক। সব না পাওয়ার মাঝেও শেষ চুমু টুকু ওরা লুকিয়ে রাখুক চিবুকের তিলে... যুবকের ফিরে যাওয়া দেখুক ওই এক জোড়া চোখ... এই শূন্যতা বোধ ওর পাওনা... ওদের পাওনা। কয়েকটি মুহুর্ত প্রকৃতি সব কোলাহল থামিয়ে দিক...
সব থেমে যাক...
শুধু হেঁটে যাক একটি হলুদ পোশাক... শুধু তাকিয়ে দেখুক দুটি গভীর কালো চোখ। তারা খসে পড়ুক। আঁচল ভিজে যাক। জন্ম হোক কয়েকটি নীল পদ্মের।
______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া
______________________________________________
১/ আলোকচিত্র ও আপনার সম্পাদকীয় (২৯ জানুয়ারি ২০২৪) ভালো লাগল।
-------কবি উজ্জ্বল ঘোষ
২/ অনেক ধন্যবাদ, উত্তমদা। আমারও মনে মনে ইচ্ছে ছিল 'অরন্ধন'এর একটি সংখ্যা দেখার।
পরের সংখ্যা কবে বেরবে?
--------গল্লকার পবিত্র মন্ডল
৩/ সম্পাদকীয় লেখাটাতে আপনার নিজস্বতা অভিভূত করলো। অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইলো।
--------কবি বিজয়াদিত্য চক্রবর্তী
৪/ তোমার সম্পাদকীয়টা দারুণ! ছবিগুলো বেশ ভালো। শুভেচ্ছা রইল।
-------কবি সোমেন মুখোপাধ্যায়
৫/ নতুনগ্রামের নতুন রঙ ও আন্তরিকতা সকলকে ঋদ্ধ করুক একইসাথে অরন্ধন আমাদের পথ চলায় নিয়মিত সাথে থাকুক।
-------অনন্যা আচার্য
৬/ খুব ভালো সম্পাদকীয়।আরও সমৃদ্ধি কামনা করি।
--------কবি শান্তনু রায়চৌধুরী
৭/ খুব সুন্দর পত্রিকা হয়েছে। অনেক অনেক ভালোবাসা ভাই।
--------ছড়াকার সুমিত বেরা
৮/ সম্পাদকীয় সহ সম্পূর্ণ পত্রিকাটির একটি অনন্য মাত্রা রয়েছে। এভাবেই সুস্বাদু গন্ধে এগিয়ে চলুক অরন্ধন।
---------কবি উৎপল চট্টোপাধ্যায়
৯/ পড়লাম ও ছবি প্রদর্শন দেখলাম। বেশ ভালো লাগলো —চমৎকার আয়োজন!
শুভ কামনা!
---------কবি হাবিবুর রহমান এনার
______________________________________________
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : রামকিঙ্কর বেইজ-এর পেন্টিং, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
বেশ ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন