চতুর্থ বর্ষ ।। দ্বাবিংশতি ওয়েব সংস্করণ ।। ১৩ ফাল্গুন ১৪৩০ ।। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪


আমরা কুড়মি কামার কুমোর মুচি মেথর হাঁড়ি ডোম মুখার্জি ব্যানার্জি চ্যাটার্জি সকলেই পুতুল নাচের চরিত্র। পুতুল নাচের চরিত্র রাজা মন্ত্রি সান্ত্রি, জর্জ উকিল ব্যারিস্টার, চোর ছ্যাঁচোড় লেঠেল, এমনকি শবদাহকারীও। সকলেই কারোর না কারোর অঙ্গুলি হেলনে নেচে চলেছি সব সময়।
          পুতুল নাচ একটা খুবই ইংগিতবাহী নাচ। যা প্রতিনিয়ত আমাদের শিখিয়ে যায় অনেক কিছু। প্রতিনিয়ত শিখিয়ে যায় এই অখিল ভূমন্ডলে আমাদের কিছু করণীয় নেই। কোন একজনের অঙ্গুলি হেলনে নেচে চলা ছাড়া। সেই অঙ্গুলি সঞ্চালকারী আমাদের জিতিয়ে দেয় বা পরাজিত করে দেয়। অথচ আমরা ভাবি সব শ্রেষ্ঠত্ব নিজস্ব অর্জন। রাজনৈতিক জয় পরাজয়, বড় কবি ঔপন্যাসিক হওয়া, বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হওয়া নিজেরই অর্জিত ফসল। কিন্তু এই অর্জন কতটা নিজস্বতা দর্শায় তা ভেবে দেখি না কখনও। আর ভেবে দেখি না বলেই অহং বোধে মদমত্ত হয়ে উঠি। পরাজিতকে হেয় করি। ছোট করি। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি। অথচ তারাও সেই অঙ্গুলি সঞ্চালনেই পরাজিত যে অঙ্গুলি সঞ্চালনে বিজিত কেউ কেউ। কেউ কেউ উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত।
            এমন কেউ কী আছে, যে পুতুল নয়? কারোর আঙ্গুলে হেলনে সঞ্চালিত করে না নিজেকে?



উত্তম মাহাত, সম্পাদক 



______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
সুশান্ত সেন / সৌভিক বসু  / গৌতম দত্ত /  কিরণ মুখোপাধ্যায় / অনুপম নিয়োগী / শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / সুজন পণ্ডা / ময়ূখ দত্ত / জয়িতা দত্ত সিনহা /
_____________________________________________


সুশান্ত সেনের কবিতা 

১. 
তৈমুর খান

তৈমুর খান এর হাতে একটা আস্ত ময়ূর - সিংহাসন তুলে দিয়ে বললাম - চিবিয়ে চিবিয়ে খাও দেখি।
তা তৈমুর খান সেটা খেলেন
তার বংশধররাও খেল।
এদিকে ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গেল
এখনকার বংশধররা 
বর্ধমানের রাস্তায় আপাতত সাইকেল রিক্সা চালাচ্ছে।
সীতাভোগ মিহিদানা তাদের ভাগ্যে জুটছে না।

সব কেমন গোলমাল হয়ে 
তৈমুর খান কে একটু বুঝিয়ে বললে
খামোখা এতগুলো মানুষ মারা পড়ত না !

ম্যালথাসের উপপাদ্য আবার নানান কথা বলে।




২. 
ঘাট

চেনা ঘাটে নৌকা এসে থামলে
বেশ স্বস্তি।
তখন গন্তব্যে পৌছতে অসুবিধা নেই
নাহলেই ঠিকানা বল
দিক - নির্দেশ নাও
পারানি'র কড়ি ফেলে
ভাসতে থাকা - এদিক সেদিক।

শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে 
কে জানে !

তাই বারবার চেনা ঘাট খুঁজে চলেছি
জীবন ভোর
নৌকায় দোল খেতে খেতে ।




৩. 
মাতৃ - স্নেহ 

সদ্য জাত কচ্ছপের বাচ্চা গুলোকে যখন
মধুমিতা অশেষ যত্নে
সমুদ্র পাড়ে  নিয়ে এসে ছেড়ে দিচ্ছিল
তখন কি সে জানতো 
বাচ্ছা গুলো গুটি গুটি পায়ে সমুদ্রের দিকে রওনা দেবে।

না জানলে সে অশেষ যত্নে 
তাদের সমুদ্র পাড়ে এনে ছাড়ত কি ?

বালি, সমুদ্র জল, মাতৃ স্নেহ, বাতাস, মা ও শিশুদের নিয়ে  পূর্ণ পৃথিবী 
কেমন লাগছে মহাশয়রা ?








সূর্য 

সৌভিক বসু 

সেদিন রাস্তায় হঠাৎ সূর্য'র সঙ্গে দেখা। ধোঁয়া আর কুয়াশার আবছা পথ ধরে সে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার ঘুমন্ত শরীর ,একটু একটু ধাক্কা খাচ্ছে বন্ধ দোকানের সাইন বোর্ডে - সাইকেল - চায়ের দোকানে। এইভাবে কিছুক্ষণ দেখতে দেখতে, আমি সুর্যের হাত দুটো ধরে হাঁটতে লাগলাম। পেরিয়ে গেলাম বাঘাযতীন গার্লস ইস্কুল, হরির বাসনালয়, আই ব্লক মোড়, লায়েলকা'র সুদীর্ঘ জলের ট্যাংক...সূর্য কিছুই বলে না ।আমি শুধু নিজের মনে এঁকে চলেছি তার ছবি। তার বিরাট গোল দেহ ঘিরে লাল আর কমলা রঙের জামা ,আর কালো রঙের প্যান্ট। একজন অস্বাভাবিক সুন্দর দেখতে পুরুষ, যার জন্য কতো কি-ই না ঘটছে পৃথিবীতে। 
আমরা হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালাম রিজেন্ট এস্টেট পার করে ছোট্ট এক পার্কের ভেতর... দুটো একটা পাখি ডাকছে সেখানের গাছে। আমাকে একটা দোলনায় বসিয়ে রেখে, সে গড়াতে গড়াতে ফুটিয়ে তুলল কয়েকটি ফুল, খুলে দিলো চায়ের দোকান, ডেকে দিলো বাচ্চাদের পুলকার, ময়লা ফেলার ভ্যান, অপূর্ব মেয়েটির চোখে তুলে দিলো বিদেশি সানগ্লাস। আর আমি, একঠায় সূর্যের গড়াগড়ি দেখতে দেখতে অনুভব করলাম - পার্কের প্রত্যেকটি প্রজাপতি নিজের ডানা রেখে হয়ে উঠছে ,একেকটি উজ্জ্বল মেয়ে ,আর প্রত্যেকটি মেয়ে নিজেদের হাত ডানায় বদলে ফেলে ,হয়ে উঠছে একেকটি রঙিন প্রজাপতি। তারপর, অফিস কলেজ কিংবা ইস্কুলের উদ্দেশ্যে উড়ে যাচ্ছে কলকাতার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে....







পলাশ পরব

গৌতম দত্ত

কবি হারিয়ে যায়
কবি ফুরিয়ে যায়
কবি তবু মরে না
কবি বেঁচে থাকে
পৃথিবীতে মানুষ যতদিন
বেঁচে থাকবে

জলের খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে
মাটির খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে 
এতদূর এগিয়েছে
মানবসভ‌্যতা

সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে
এবার না হয় সে বেরোবে
কবিকে খুঁজতে
শালপলাশের দেশে








কিরণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা 


১.
তীক্ষ্ণ হিংস্রতা

নির্বিকারে জ্বলন্ত সিগারেটের ধোঁয়া
তীব্র যন্ত্রণা আর অতীতের প্রকোপ ।
হিংস্র শরীরের হিংস্রতা যেনো আরো বেড়ে গিয়েছে ,স্তব্ধ বেডরুমের বিছানায়।
অন্ধকারের মাঝে....ধূসর ভালোবাসা আজকাল প্রায় ফিকে...।
অযথা কান্নার প্রশ্রয়  হাতছানি দেয়,দুর সীমান্তে।
বোবা হৃদয়ের হাহাকার বড্ড তীক্ষ্ণ।
নির্লিপ্ত জড়তা আর তোমার নীল পোশাকের 
তীব্র ঘ্রাণ,অস্তিত্বকে ছিনিয়ে নিচ্ছে বার বার।i 
হারিয়ে  যাওয়া লেখা গুলো আজ দাগ কাটে,
জানি তুমি আছ অতীতের আস্টেপৃষ্টে,
তবুও লাঞ্ছনার বশে বোকা বনে যাই প্রতিবার।
ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় তোমার খোলা পিঠটাকে ,
আঁকড়ে ধরে রেখেদিতে ইচ্ছে হয়,
অবশেষে ব্যর্থতার বাতাসের আঁচ গায়ে লাগতেই 
সব শেষ ,ওই পরিত্যক্ত আকাশ মাঝে 
ছেঁড়া চিঠির খামের ভাঁজে......।




২. 
অপার্থিব

নির্বিঘ্নে আমি আকাশে ঘুড়ি উড়িয়েছি বহুকাল হলো 
তারা খসে পড়ে আজকাল মাঝরাতে , অথচ 
কবিতা লিখিনি আমি কতকাল , 
লিখে গিয়েছি শুধু নিজেকে আর হারিয়ে যাওয়া জোছনাকে
অনেক হয়েছে আর না এবার আর বাঁশি ধরবো না 
বড়ো বুক ব্যথা হয় আমার গভীর রাতে , আমি ঘুমোতে পারি না
অনন্ত কাল ধরে আমি ঘুমোতে চেয়েছি এক অস্পষ্ট আঁচলে
ঠিক আছে এখন তুমি যাও , 
আমার অনেক গল্প খুন হয়ে তলিয়ে গেছে অতল সমুদ্র জলে।




৩. 
শেষ ( আবার আসবো)

বিদায় নিতেই হয় , তবুও কলমে দাগ লেগে যায়।
                                     হয় তো অজান্তেই....। 
বারবার ফিরে আসার অভিযোগে
যদি গেলাসের জল কমে আসে তাহলে দোষ তোমার।
বাইরে এখন অন্ধকার ...মানুষ নেই ,
                       পড়ে আছে শুধুই ইতিহাসের ম্লান হাহাকার।




৪. 
ধূসর রঙের কবিতা

এক মৃত রবিবার কড়া নেড়ে ছিল আমার দোর গোড়ায় 
আমি দুঃখিত স্বরে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম 
আমার কাছে কবিতা ছিল না তখন  ,জ্বর প্রায় একশো
ছোট্ট একটা আধমরা নিঃশ্বাস ফেলে বাড়িয়ে দিয়েছিলাম একটা জ্বলন্ত আগুনের কাঠি , হাঃ ! তারপর,
নিমেষেই ঝড় এসেছিল বারুদ মেখে ।
আমার আবছা ঝিমুনি দেখে ছাই মেখেছিল বৃষ্টিকণা 
দেখলাম সবুজ আর নেই  
সর্বত্র ছাই এ মুখ ঢেকেছে ধূসর রং ।
আমি হাসছি আর শুধুই হেসে চলেছি আর
একটার পর একটা ঘর ভেঙে নিঃশেষের দিকে
পোড়া চৌকাঠ পেরিয়ে জীবন ডাক দেয় অন্য সুরে।
চশমার কাঁচে  এখন বাষ্প আর , হাতে পোকা ধরা খাতা
ভোরে শিউলির রঙে রক্ত লেগে থাকতে দেখে বুঝি
খুন হয়েছে ধূসর ধোঁয়ার কবিতা।  




৫. 
কলঙ্ক
    
ত্রিবর্ণ রক্তের দাগে কলঙ্ক লেগেছে যেখানে,
প্রলয় ঘনিয়ে আসে মুচকি হেসে স্ফীত অভিমানে 
সময়ের ঝাঁকুনির ভয়ে কথা লুকিয়েছে যারা তীব্র গ্রীষ্মে
শরীর নেই তাদের ,মাংস আছে ধুলোর গল্পে ,
                 জীবন আছে জীবিত তবুও মিথ্যে রাতে

পচে যাওয়া মৃত্যুর ছোঁয়া ছোঁয়াতে চাও কাকে 
যেজন মিথ্যে বলে গল্প লেখে আর স্বপ্নে মৃত্যু আঁকে।
নির্ভয়ে তুমি সূর্য ডোবাও , সন্ধে নামার আগে 
আস্ত একটা প্রদীপ জ্বেলে ডাক দিও জোছনাকে।









অনুপম নিয়োগীর কবিতা 

১. 
শ্রাবণ 

সারাদিনের শেষে বৃষ্টি নামবে বলে খুলে রেখেছি আমার দুয়ার। এসব দিনে কোনো কাজে মন বসে না। জীবনের হিসেব ভেঙে মেঘ জমে আকাশে। তথাগতর পথ ধরে কখন আসবে তুমি আজ, হে বিরহী ? দু হাত বাড়িয়ে পড়ে আছি দিগন্তের ওপারে।




২.
শূন্যস্থান

মায়াবী দুপুর জানে
জাহাজের খবর 
বন্দর ছেড়ে যাওয়া গান, 
চটি জোড়া পড়ে আছে যার
কেউই জানে না তার 
বেদনার নীরব সন্ধান।




৩. 
ফেলে আসা সময়কে 

আকাশে এমন মেঘ দেখলে পাতলা হয়ে আসে ঘুম। ঘুমের পাশেই একদিন এক নদী এসেছিল। দীর্ঘ শূন্যতা নিয়ে আজ তার নুপুর পড়ে আছে উঠোনে।








২১ ফেব্রুয়ারির কবিতা 

       শ্যামাপদ মাহাত বাঁশি 

হাতেখড়ি হয় নি আমার মায়ের
উনানশালায় হয়েছে সহজপাঠ।

ছাগলছেড়ির লালন পালনই 
বর্ণপরিচয়।

ভেতরে বাইরে কোনো দেওয়াল নেই

পাঁচিলের কপালে পরায় গোবরের টিপ।

আমার মায়ের একহাতে গোবর থাকলেও
আমার মায়ের দুহাতে শাঁখা চুড়ি।

কুটুম এলে পিঁড়ির উপরে তেলে মাজা জলের ঘটি।

তার স্বরেই ব্যঞ্জনের স্বাদ।








উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা 

এপার - ওপার 

বিপথগামী হয়েছিলে 
আঙুলে লেগেছে মাটি 
ধুইয়ো না
কালো রঙে সুন্দর এ কলঙ্ক 
বসন্ত ব্যঞ্জনে
স্বরবর্ণে ধরেছে উইপোকা 
ছুঁয়ে আছে জলের অতল 
তেমনি একদিন শীত শতদল ছুঁয়ে 
আঙুলের ফাঁকে নীল প্রজাপতি 
আমার এপার থেমেছে 
বিশ্বাসের চড়া বাধায়
ওপারে সর্বধর্ম লোপ 
মাঝে নদী ----- মনস্তাপ 
সব মুছে এখন 
    শুধু পথ পবিত্র হোক




২.
নষ্ট সময় 

তোমার শব্দের কাছে এসে দাঁড়াই 
তোমার আটপৌরে বাক্য ছুঁতে 
আমার যত বিলাসিতা 
ছন্নছাড়া বিদেহী শোক 
তোমার শোকের পাশে এসে দাঁড়াই 
এখন তুমি প্রশ্ন করবে কেন ? 
এখন তুমি প্রশ্ন করবে কিসের শোক ? 
আমার উত্তরের দিকে তোমার ডান হাত 
দৃষ্টি উচ্ছ্বাসে নষ্ট সময় 
ও দিকে সর্ব ত্যাগী পতিতার নগ্ন দেহ 
ও দিকে নষ্ট পল্লীর জারজ সন্তানদের হাসি 
তুমি তাকাবে না ? 
তুমি চাইবে না কারো শরীর ? 
দেখো, তোমার কবিতা হতে উদগ্রীব 
কত দৃশ্য , কত পাখি , 
কত ঝরনা , কত নদী , 
শত রচনায় তুমি তাদেরই সংস্করণের দেহ দিয়েছ বার বার 
সংযোজনের দৃশ্যান্তরে অকপট এই সত্যি 
তুমি কি অস্বীকার করবে ? 
তুমি কি ভাঙবেনা লজ্জ্বার এই উৎস, সুখ ? 
এখনোও চিনতে পারোনি আমাকে ? 
বিস্মরণের পাশে এমনই এক দেহাবশেষ আমি 
পৃথিবীর দশম দুয়ারে এসে 
কেবলই শুধু নষ্ট প্রকৃতির ছাই উড়িয়ে বেঁচে আছি একা ...... অন্তহীন








শূন্য থেকে শূন্যতে

সুজন পণ্ডা 

এই প্রথম এত তারা দেখলো নিখিল। আকাশে এতো তারা... এতো স্পষ্ট।

তার শহরের আকাশে এরম হয় না। রাত নামে না সেখানে... নক্ষত্রের বিস্ময় তাই চোখে পড়ে না। অথচ এখানে, বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে যেটুকু আকাশ তাতেই বিছানো জোনাকির হলুদ আঁচল। কদম ফুলের মতো অযুত নিযুত নক্ষত্র।
হায়... যদি এদের নাম জানতো নিখিল...।

বিছানা ছেড়ে খুব ধীরে উঠে আসে সে, জানালায় দাঁড়ায়। সিগারেট ধরায়। মন খারাপ হয়... আজ কতোদিন একটাও কবিতা আসেনি, একটা লেখা আসেনি। বুক ভারী হয়ে আসে... অনেক খানি না বলা কথা যেন আটকে যায়... । অনেকদিন কথাও বলেনি সে... আড্ডা দেয়নি কতো কাল।

হঠাত কাঁধে কারো স্পর্শ টের পায় নিখিল। রিক্তার ঘুম ভাঙল কখন কে জানে?  নিখিলের কাঁধে মাথা রাখে সে... অজস্র তারায় ভরা আকাশে ডুবে যায় ওরা। অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় অথচ কেউ কিছুই বলে না... নিরব শ্বাস প্রশ্বাস।

নিরবতা ভাঙে রিক্তাই,
--"ঘুমোবে না?"
 -- আসছে না...
 -- কি ভাবছো? কোনো প্রবলেম?
-- আরে না.. সেরকম কিছু না।
--তাহলে? কিরকম? আমাকে বলতে পারো তো...

রিক্তা কে আরেকটু কাছে টেনে আনে নিখিল, আরেকটা সিগারেট ধরায়। তারপর বলে
--  কিছুই হচ্ছে না রিক্তা।বেঁচে থাকার বাইরে আর কিছুই হচ্ছে না.. এই নক্ষত্রের রাত দেখ.... কি বিপুল.. কি অসম্ভব। আর আমরা কি সংকীর্ণ.. রুটিন ভাঙা তো ছেড়ে দাও... রুটিনের বাইরে এক চুল বেরোতে পারছি না। কি বিস্তৃত একটা পৃথিবী, একটা বিশ্ব অপেক্ষা করছে। আমরা চিড়িয়াখানার পশুদের মতো জানলা থেকে দেখছি শুধু.. আর কিছু না, কিচ্ছু না।

-- লেখা আসছে না? অনেকদিন কবিতা আসেনি?

--হুমম... অন্যদের রাইটার্স ব্লক আসে, আমি ওখানেই থাকি, মাঝে মাঝে দুয়েকটা দিন ব্যতিক্রম।

হাসতে হাসতে নিখিলকে জড়িয়ে ধরে রিক্তা। বলে
-- পড়াশোনাও কি হচ্ছে না? পড়ো। দেখবে ভালো একটা পড়া তোমার এই লেখা না আসার ফেজ থেকে তোমাকে বাইরে নিয়ে আসবে।

নিখিল উত্তর দেয় না... নীরবে সায় দেয়।
কিছুক্ষন পরে বলে, আচ্ছা তোমার মনে হয় না বেশি বেশি পড়লে লেখা কপি করার প্রবণতা আসতে পারে... বিশেষ করে যারা নতুন তাদের জন্য?

--আসতেই পারে। সে আর কি অপরাধ?

--অপরাধ নয়? সেই লেখায় নিজস্বতা কোথায়? কপি হতে থাকলে নিজের থাকবে কি?

--তোমার সত্যি মনে হয় দু খণ্ড শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা জীবনানন্দ পড়লে তাঁদের লেখা কপি করা যাবে? এর চেয়ে ভ্রান্ত ধারণা আর কি হবে?

--পুরোটা না হোক, সেই স্টাইল, সেই শব্দ চয়ন?

-- নিখিল ওই দেখো.. চাঁদ

আকাশে তখন এক খণ্ড চাঁদ উঠেছে বটে...

প্রথমে রিক্তা, তার পিছু পিছু নিখিল উঠে আসে ছাদে। খোলা ছাদ জ্যোৎস্না মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। একটু পাশ ফিরে জায়গা করে দেয় ওদের....

--জানো নিখিল, আমার মনে হয়, গদ্য সাহিত্য বিশেষত গল্প উপন্যাস সব দিনের মতো... ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। যেমন চলবে তারা... পায়ে পায়ে জড়িয়ে নিতে হবে নিজেকে... তোমার আর গল্পের গতি যদি এক সুরে বাঁধা পড়ে যায় দেখবে কি আরাম। গল্প উপন্যাস শারিরীক শান্তি দেয় যেন।

--আর কবিতা? সেখানে শান্তি নেই? গতি নেই?

--সেকথা বলিনি তো... কবিতা এই আজকের রাতটির মতো। কোথাও যাওয়ার নেই শুধু চুপ করে বসে থাকা। কবিতার পাশে বসে পড়তে হয়। কবিতা তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, আলোয়... নক্ষত্রে... জ্যোৎস্নায়। তোমাকে শুধু সমর্পণ করতে হবে, কবিতা তোমার সব নিয়ে নেবে নিখিল। সব। প্রকৃত কবিতা বোধ হয় অলীক কল্পনা মাত্র। প্রকৃত কবিতা তোমাকে সম্পূর্ন গ্রাস করবে... দেখবে তখন আর আলাদা অস্তিত্ব নেই... সেই কবিতাই তুমি.. অথবা তুমি নিজেই কবিতা। গল্প দেবে শারীরিক আরাম, কবিতার আছে মানসিক উপশম।

নিখিল দেখে আলোয় ভেসে যাচ্ছে তেপান্তর। জ্যোৎস্নায় আর নক্ষত্রের আলোয়। রাত ঘিরে ধরেছে তাকে...
একটি দুটি শব্দ... একটি দুটি লাইন আসতে থাকে... একটি কবিতা অনেকদিন পর।

নিখিল নিচে নেমে আসে। মুঠোফোনে লিখে রাখে একটি কবিতা। আসতে আসতে স্বাতী নক্ষত্রের পাশ দিয়ে উড়ে যায় একটি সাদা বক। ভোরের আলো ফোটে।

নিখিল একা তার বিছানায়। কেউ নেই... কিচ্ছু নেই। স্বপ্ন ভেঙে গেছে... রিক্তা নেই। মোবাইলে কয়েকটি কবিতা ফিসফিস করে ওঠে......







গল্পবাসা 

দুগাছি চুল...

ময়ূখ দত্ত

এই বিশ্বের শুরু নাকি বিগ ব্যাং দিয়ে, সময় নাকি ওখান থেকেই শুরু হয়। কিন্তু রমার জীবনে চুল নিয়ে সমস্যাটার শুরু ঠিক কবে থেকে, হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই মনে করতে পারে না সে। অনেক চেষ্টা করে যে, ব্যাপারটাকে বেশী প্রাধান্য দেবে না—কিন্তু মাঝে মাঝেই মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে!! বাবা-মা দুজনেরই মাথায় প্রচুর চুল ছিল, দাদুর বুড়ো বয়সেও ঘন কালো চুল!! জিনের দিক দিয়ে ওর মাথায়ও ঘন, কালো, লম্বা চুল হওয়ার কথা... জন্মের পরের এক আধটা ছবিতে রমা নিজেও দেখেছে যে বাচ্চা বয়সে ওর মাথাতেও বেশ ঘন চুল ছিল... স্কুলে পড়ার সময়ে মনে আছে মা বেশ যত্ন নিয়ে প্যারাস্যুট নারকেল তেল লাগিয়ে দিত, দুটো বিনুনীতে লাল ফিতে বেঁধে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, বকবক করতে করতে যখন স্কুল যেত, ভালই লাগত, পাড়ার রকের ছেলেপুলেরা যে আড়চোখে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, সেটা বেশ বুঝতে পারত একটু বড় বয়সে!! তারপরে কখন যে সেসব চুল আস্তে আস্তে কমতে আরম্ভ করল কে জানে!! চুলের প্রান্ত ফেটে গেল, চিরুনী লাগালেই গোছা গোছা চুল উঠে আসতে লাগল!! একসময়ে মনে হতে লাগল যে কলেজ শেষ হতে হতে মাথার চুল আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। মায়ের যাবতীয় টোটকা বিফলে গেল। সম্বন্ধ করে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে আসার পরে নতুন বৌ-এর "দুগাছি চুল" নিয়ে কথা শুনতে শুনতে কান পচে গিয়েছে...শাশুড়ি খুব ভাল, কোনোদিন কিছু বলেন নি সেভাবে। হয়ত ভালর জন্যই অনেক রকমের ভেষজ জড়িবুটি চুলে লাগানোর উপদেশ দিতেন বিয়ের প্রথম কয়েক বছর!! খুড়-শাশুড়ী, মাসী-শাশুড়ী এদের বেশ কিছু কথা মাঝে মাঝেই কানে আসত, তাদের বৌদের সাথে প্রায়শই ওর চুলের তুলনা করে চকিত বাক্যবাণ!! তবে এসবে কোনোদিনই রমা খুব বেশি পাত্তা দেয় নি। বরের মাথা ভর্তি বাবরী চুল, বেশ কায়দা করে কাটা। ছোটোবেলায় অমিতাভ বচ্চনকে নকল করে নাকি মাঝে সিঁথে করে ব্যাকব্রাশ!! বর এমনিতে খুব ভাল, চুল নিয়ে বেশি কথা বলে না, হয়ত খুব তাড়াতাড়িই বুঝেছিল বৌ-এর অতি সযত্নে আড়াল করতে চাওয়া এই গোপন খুঁতখুঁতানির জায়গাটা!! রমা বোঝে যে লম্বা ঘন চুলের প্রতি ওর বরের মোহ আছে পুরোমাত্রায়... কোনো মেয়ে বা মহিলার লম্বা চুল দেখলেই তার চোখ আটকে যায়...মনে মনে হয়ত আউড়ে যায় "...চুল তার কবেকার, অন্ধকার বিদিশার নিশা.." 
"দেখেছ, ওই মহিলার এক্কেবারে কোমর ছাড়িয়ে চুল...এক্কেবারে সেই সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে আসা আজানুলম্বিত!!"
- তোমার ওই বনলতা সেনকে আড়চোখে বেশি দেখো না, আশে পাশেই হয়ত ওর স্বামী আছে ঘাপটি মেরে...
এইসব বলে রমা ব্যাপারটাকে লঘু করে দিতে চায়, রজতও বোঝে সেটা!!
একদিন রমা এক হাজার টাকা চাইল " আজ পার্লারে গিয়ে চুল কাটতে হবে, সামনের সপ্তাহে ভটার বিয়ে আছে!!"
- এক হাজার? ওই তো তোমার দুগাছি চুল, সেটা কাটার জন্যেও এক হাজার টাকা? আমি তো একশো টাকায় কেটে আসি পাড়ার জগার দোকানে প্রতি মাসে..
"মেলা বোকো না তো!! আমার চুল কম, তাই তো ওটাকে শেপ করে ঠিকঠাক করতে বেশী সময় লাগে, বেশী স্কিল লাগে, তাই আমার চুল কাটার খরচও বেশি!! তোমার চুলের জঙ্গলে জগা চারবার ভুলভাল কাঁচি চালালেও সেটা পরে ম্যানেজ করে নিতে পারবে, আমার ক্ষেত্রে সেটা হবে না... এসব তুমি বুঝবে না... আমার চুল কাটা পিকাসোর একটা আর্ট ওয়ার্কের মতন..."
রজত একটু হেসে পার্স থেকে হাজার টাকা বের করে দেয়। 

রমার মনে পড়ে রজত তখন সদ্য সদ্য কম্পিউটারে ফটোশপ শিখছে খুব আগ্রহ নিয়ে, প্রতিদিনই কিছু না কিছু একটা মজার ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে আসত, কোনটাতে বাবার একমাথা কোঁকড়া চুল, পুরো হিপিদের মত, কোনটাতে শাশুড়ির চুল লাল-সবুজ করা ইত্যাদি!! একদিন রমার একটা মুখের ছবিতে পুরো টাক!! পুরো পারসিস খামবাট্টা লাগছে!! একদম ভাল লাগে নি ব্যাপারটা, রমার মুখ একটু বেশিই গম্ভীর হয়ত.... রজত হাসতে হাসতে বলল-
"তোমার ভবিষ্যতের মুখ কেমন দেখতে হবে সেটা জানতে চাইছিলাম!!"
ভেতরে প্রচন্ড রাগ থাকলেও রমা সেটা চেপে গম্ভীর গলায় বলল—-তুমি জানো কিনা জানি না, বয়সকালে পুরুষদের টাক পড়ার প্রবণতা ৭০ শতাংশ, যেখানে মহিলাদের ৪০ শতাংশ। পুরুষ নিয়মিতভাবে মহিলাদের তুলনায় প্রচুর পরিমাণে "testosterone" উৎপাদন করে থাকে যার ফলে "DHT" বা "stress hormone" ক্রমাগত নির্গত হতে থাকে। যার কারণে চুলের ফলিকিউল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং টাক পড়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই আমার টেকোমুখের ছবি প্রিন্ট করে আনার চেয়ে তোমারটা প্রিন্ট করে দেখতে পারতে, ওটার মিলে যাওয়ার চান্স অনেক বেশি!! আর অন্যদিকে আমার ওই দুগাছি চুল আমার মাথায় সারা জীবনই হয়ত থেকে যাবে...
রজত বোঝে অজান্তেই হয়ত আজ রাগানোর মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে, চুলের অগভীর কিন্তু জটিল জায়গাতে আঘাত দিয়ে ফেলেছে হয়ত, আর কোনো কথা না বলে ব্যাপারটাকে কীভাবে সামলানো যায়, সেটা চিন্তা করে বলল ".. আরে রেগে যাচ্ছো কেন, বিয়ের এত বছর পরে, এই বয়সে নিজেদের মধ্যে একটু আধটু 'চুলোচুলি' না করে চলে? আচ্ছা, কাল আমার কুলভুষন খারবান্দা ("shaan" cinema) লুকের ছবি আনব!!"
রমার মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল যেন!! 

অ্যালোভেরা পাতা চেঁচে তার রস লাগানো থেকে, জবা ফুলের রস নিঙড়ে তেল বের করে লাগানো, ডিম ফাটিয়ে মাথায় লাগিয়ে সেই পচা গন্ধের মাঝে বসে থাকা –- প্রায় সবরকমের টোটকাই রমা চেষ্টা করে ফেলেছে, বাজারে প্রচলিত কোনো শ্যাম্পু বা তেলই আর মাথায় লাগাতে বাকি নেই... নারকেল তেল, ক্যাসটর অয়েল সবকিছু... তেল লাগানো ভাল না খারাপ সেসব নিয়ে প্রচুর গবেষণাপত্রও পড়া হয়ে গেছে। একবার অনেক টাকা খরচা করে "হেয়ার স্পেশ্যালিস্ট" এর কাছে গিয়েছিল, সৌরভ আর হর্ষ ভোগলে নাকি ওখান ত্থেকেই চিকিৎসা করিয়ে এক মাথা চুল করে নিয়েছে!! রিং-এর মত একটা হেডব্যান্ড টাইপের জিনিস পরিয়ে দিল মাথায়, তার থেকে আবার নীল আলোর আভা বেরোয়, ওই মেশিন দিয়ে কী সব স্ক্যান ট্যান করে ওই 'স্পেশ্যালিস্ট' জানিয়েছিলেন যে রমার মাথার 'খুলি' নাকি খুব "অয়েলি"...চুলে তেল মাখা এক্কেবারেই উচিত নয়, চুল পড়া বন্ধ করার চিকিৎসার সাথে সাথে চুল কীভাবে গজাবে সেটা জানা দরকার!! মাথা বেশি তৈলাক্ত বলে নাকি চুল গজাতেও পারছে না, তাতে নাকি আরো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে!! এত বছরে এসব না জেনেবুঝে একমাথা তেল মেখে মেখে নাকি চুলের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে, উনি এখন নাকি প্রথমে কয়েকমাস ধরে সেই ক্ষতির প্রতিকার করবেন, তারপরে চেষ্টা করবেন কি করে দুগাছি চুলকে চারগাছি করা যায়!! রমার মনে পড়ে ছোটবেলায় মা জোর করে কাছে টেনে পায়ের কাছে বসিয়ে চুলে একবাটি তেল মাখাত, চুলের গোড়া যাতে শক্ত হয়!! ভয়ে আর কিছুটা আঢ়ষ্টতায় এই স্পেশ্যালিস্টের কথা বৃদ্ধা মায়ের কাছে আর বলে উঠতে পারে নি। এই চিকিৎসার বড়সড় সম্ভাব্য খরচের হিসেব শুনে রজত প্রথমে একটু চমকে গেলেও বৌ-এর ইচ্ছের মান রাখতে হাসতে হাসতে বলেছিল—-
"যাক, তোমার তেলা মাথায় আর তেল দিতে হবে না...সংসারে মাথার তেল কেনার খরচটা অন্তত কিছুটা কমে যাবে!!"
- হ্যাঁ, একেই বলে সব কিছুর মধ্যেই কিছু না কিছু পজিটিভ জিনিস খুঁজে বের করা!! 

বেশ কয়েকমাস এই সব চিকিৎসা ও বাজেটের বাইরে খরচ করার পরেও দেখা গেল হর্ষ ভোগলে বা সৌরভ অনেক দূরের ব্যাপার!! রজত বলল "... ওসব চুলোচুলি করে নতুন চুল গজানো সেলিব্রিটিদেরই মানায়, এসব চিকিৎসা ওদের জন্যই ডিজাইন করা, তাই এসব চিকিৎসায় ওদের ভাল হয়, আমাদের মত ছাপোষা মানুষদের কিছু উপকার হয় না!!" রমাও কিছুটা যেন মেনে নিয়েই হাল ছেড়ে দিল...। 

ছেলের বিয়ের সময়ে দেখা গেল বৌমার চুল বেশ বড়, রমার মাথার সেই দুগাছি চুল তখনো কালো, কিন্তু ততদিনে রজতের মাথায় বেশ বড়সড় টাক পড়তে আরম্ভ করেছে, মেহেন্দি বা রং না করলে মাথার প্রায় সব চুলই সাদা। চুল কাটতে গিয়ে এখন এক্কেবারে ছোট করে চুল কেটে আসে, নাহলে নাকি কোনো চুলের স্টাইলই মাথায় আসে না, অত সাধের বাবড়ি চুলের গোড়াই নাকি দুর্বল হয়ে গেছে, লম্বা চুল হলে ফাঁপানো অবস্থায় আর ধরে রাখতে পারে না, চুলের শেপ আর কিছুই দাঁড়ায় না...রজত যখন আজকাল এই সব হতাশার কথা বলে, রমা খুব মন দিয়ে শোনে আর নিজের মনেই হাসতে থাকে "... আরো আমাকে বলো, দুগাছি চুল, দুগাছি চুল!! শুনে শুনে সারা জীবন ধরে আমার কান পচে গেল..!!" 

একমাত্র নাতনী তিয়াসা, সবার খুব আদরের, ছোটবেলা থেকেই খুব পাকা, বয়সের তুলনায়, ঠাকুমার সাথে খুব ভাব, সব কিছু গল্প যেন ঠাকুমার সাথেই। মায়ের মতই বেশ লম্বা ঘন কালো চুল। খুব ছটপটে, কত কিছু করে স্কুলের পড়াশুনা ছাড়াও...কত কিছুতে ইন্টারেস্ট!! রমা অবাক হয়ে যায়। আগের বারে বাড়ি মাত করে দিয়েছিল নতুন শিখতে আরম্ভ করা গীটার বাজিয়ে গান করে...এবারে ক্লাস এইটে পড়া সেই তিয়াসা গরমের ছুটিতে বাড়ি এসে ঠাকুমাকে ওর নানা ভলেন্টিয়ারীং কাজ করার গল্প শোনাতে লাগল। পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের কী কী করা উচিত, জলের অপচয় রোধ করতে কী করা উচিত এসব এইটুকু মেয়ের কাছ থেকে শুনে কত কিছু জানতে পারে!! জলের কল খুলে সবজি না ধুয়ে একটা গামলাতে ধুলে কত লিটার জল রক্ষা হয়, বা দাড়ি কামানোর সময় জলের কল খুলে না রেখে মগে জল নিয়ে দাড়ি কাটলে কীভাবে পরিবেশ রক্ষাতে আমরাও কাজ করতে পারি ছোট ছোট পদক্ষেপে, এসব শুনে রমার মনটাও কিছুটা বেশ উজ্জ্বীবিত হয়ে ওঠে। বিশেষ ভাবে সক্ষম বাচ্চা (অটিস্টিক) দের সাথে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে রমা বিভোর হয়ে যায়। পরোপুরি বা আংশিক অন্ধ মানুষেরা ঠিক কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয় শুনে রমার যেন চোখ খুলে যায়। আমরা মানে যারা দুচোখ দিয়ে এই সবুজ পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করি অনায়াসে, তারা ওদের কীভাবে সামান্য একটা app (be my eyes) এর মাধ্যমে ওদের সাহায্য করতে পারি, সেসব জেনে এই বয়সেও রমা আবার যেন যুবতী হয়ে যায়... মিউজিক থেরাপির কথা শুনে কিছুটা অবাকও হয়....গান শুনিয়েও অসুখ সারানো যায়? ছোট্ট নাতনীর দিকে অবাক হয়ে একটা কেমন যেন শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালবাসায় চেয়ে থাকে, ভাবে ".. সমাজের জন্য কত কিছু করার আছে আমাদের, কেন যে আমরা কিছুই করি না..."। 

এসবের মাঝে একদিন সকাল বেলা ঠাকুমা আর নাতনি দুজনে বাড়ির বাইরে বেরল, নাকি শপিং করবে দুজনে, আর কাউকে সাথে নিলে নাকি শপিং এর আনন্দ মাটি হয়ে যাবে!! যাই হোক, দুজনে সন্ধ্যেবেলা ফিরে এল, কিছু জামাকাপড় কিনে, কিন্তু বাড়িতে ঢুকে রজত দেখে বেশ ঝামেলা, নাতনির এত লম্বা ঘন কালো চুল গায়েব, ঠাকুমার উস্কানিতে নাকি একেবারে ছোট করে চুল কেটে চলে এসেছে কোন পার্লার থেকে!! বৌমার মুখ ভার...বেশ থমথমে ভাব চারদিকে!!
- অনেকদিন ধরেই চুল ছোট করে কাটবে বলে বায়না করত, আমরা বারন করেছিলাম, এবারে এখানে এসে মওকা পেয়েছে, মায়ের আস্কারাতে..এত সুন্দর লম্বা চুল হয়েছিল, এভাবে কেউ ছোট করে আসে?!!
ব্যাপারটা বেশ গুরুতর বুঝতে পেরে রজত রমাকে খুঁজতে লাগল...
রমা রান্নাঘরে চা করছিল পেছন ফিরে..."বসো, চা খাবে তো?"
- কিন্তু কী হয়েছে? তিয়াসার চুল কেটে দিয়েছ?
" ও মা, আমি কোথায় কাটালাম, ও তো নিজেই কাটল!!"
- তা বলে তুমি বারন করলে না?
" কেন, চুল কেটে ভালই তো লাগছে, ফুটফুটে.. তা ছাড়া আর কয়েক মাসের মধ্যেই আবার এত্ত বড় চুল হয়ে যাবে!! ওর চুলের ধাত তো বৌমার মত... তোমরা বেশিই চিন্তা করছ, এই নাও চা..."
বলে রমা গ্যাস স্টোভের দিক থেকে ঘুরে চা দিল রজতকে, রজত এবারে নজর করে দেখতে পেল রমার মাথায় ঘোমটা!!
- তোমার মাথায় আবার ঘোমটা কেন? বাবা বেঁচে থাকার সময়েও জীবনে কোনোদিন ঘোমটা দিতে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না, আর এখানে তোমার ভাসুর আবার কে এল?!!
" না, না, এমনিই লজ্জা লাগছে.."
- লজ্জা? মানে আমার সামনে লজ্জা?
"তোমার সামনে তো বটেই, ওদের সবার সামনেও..." 

ব্যাপারটা কেমন যেন ঠেকল রজতের কাছে, হাত দিয়ে রমার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে দিতেই চোখ ছানাবড়া!! মাথার চুল এক্কেবারে আগেকার দিনের বিধবাদের মত করে কাটা, ছোটো বললেও কম বলা হয়, শুধু মাথার খুলির ওপরে খাড়াখাড়া এক ইঞ্চি লম্বা কিছু চুল!! গলার স্বর আর হাবভাব ছাড়া এই মহিলা যে নিজের এত বছরের পুরোনো বৌ রমা, কে বলবে?
" এটা কি করেছ?"
- তিয়াসা বলছিল ওর নাকি অনেকদিনের শখ ক্যান্সার পেসেন্টদের পরচুলা তৈরীর জন্য চুল ডোনেট করবে!! ওই ক্যান্সার রুগীদের চুল উঠে যাবার পরে ওদের পরচুলা লাগে, আর আসল চুল দিয়ে পরচুলা বানালে সেটা নাকি ওদের খুব স্বাভাবিক লাগে, মানসিকভাবেও ওরা বেশি আত্মবিশ্বাসী থাকে। তিয়াসার কথায় আমিও খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলাম। জানি বৌমা হয়ত এক-আধদিন রাগ করবে আমার ওপরে, কিন্তু তিয়াসার এই ভাল কাজে উৎসাহ দেওয়াটা আমার দায়িত্ব বলে মনে হয়েছিল!! তাই আজ প্ল্যান করে দুজনেই চুল দান করে এলাম একটা NGO তে, আমার এই দুগাছি চুল থেকেই বা কী আর না থেকেই বা কী? সারাজীবন তো এই চুলের জন্যই কত কথা শুনে এলাম, কত হেয় হলাম, এই বয়সে এসে যদি আমার এই হেলার দুগাছি চুলও কাউকে কিছু সাহায্য করতে পারে!!
রজত অবাক চোখে এই নতুন রমাকে দেখছিল, এত বছরের পুরোনো বৌকে চিনতে একটু মুশকিল হচ্ছিল যেন- " আর ঘোমটা দিয়েছ কেন?"
- মাথায় তো এখন আর সেই দুগাছি চুলও রইল না, তাই কেমন দেখাবে জানি না, কিছুটা লজ্জাতেই ঘোমটা দিয়েছি!!
" লজ্জা তো আমাদের হওয়ার কথা, তুমি, না না তোমরা এত ভাল কাজ করে এলে...ভাবছি এবারে আমিও যাব ক্যান্সার পেসেন্টদের জন্য চুল দিয়ে আসব...
রমা এবারে যেন বুকে বল পেয়ে হাসতে হাসতে বলল - " তোমার সে ভাগ্য নেই!! কমপক্ষে ৮ বা ৯ ইঞ্চি চুল হলে তবেই সেটা দান করা যায়... তোমার এই বয়সে আর ঐ লম্বা চুল গজাবে না... কিন্তু মহিলা হওয়ার সুবাদে আমার ওই দুগাছি চুলই আবার হয়ত বড় হবে, তখন আমি আবার চুল দান করে আসতে পারব!! 

রজত অস্ফূটস্বরে বলে উঠল - যাঃ বাবা... তাহলে তোমার দুগাছি চুলেরই জয় হোক! 







প্রবাসী মেয়ের চিঠি
     
      জয়িতা দত্ত সিনহা

আমার 
পরম প্রিয় বাবাই,
                            কেমন? খুউব অবাক হচ্ছো, তাই না? ভাবছ, "এই তো আধ ঘন্টাও হয় নি এক ঘন্টা ধরে হাবিজাবি ভাট বকল। তাহলে আবার মেল করে এই লম্বা চওড়া চোতা পাঠানোর হেতু কি? তাও আবার বাংলায়! 'বড্ড শক্ত আর একঘেঁয়ে' বলে যাকে আজ পর্যন্ত শরৎ চাটুজ্জের পুরো একটা উপন্যাস শেষ করাতে পারা যায়নি, অথচ কথায় কথায় জন মিল্টন ঝাড়ে, সে কিনা আজ লিখছে আমায় বাংলায় চিঠি?" 
 তা তোমার অবাক হওয়া দোষের নয় কি বাবাই। এমন একটা ইংরীজি নবিশ ট্যাঁশ কন্যা, যার নাকি আবার তার মাতৃ দেবীর প্রশ্রয়ে বাংলাটা ঠিক কোনও কালেই আসে না, সে আজ হঠাৎ এমন সাহেবী প্রীতি ছেড়ে বাঙালি বিবি সাজতে চাইছে জানলে তোমার চক্ষু জোড়া ললাট ভ্রমণে যাবে তাতে আর আশ্চর্যের কী? 
আসলে কী জান বাবাই, দামী ইংরীজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৌলিন্যে মা আমার নাকটা ছোট বেলা থেকেই একটু মই-এর চূড়ায় তুলে রাখতে অভ্যেস করে দিয়েছিল। বাংলাটাকে সেই তখন থেকেই যেন মধ্যবিত্তের আটপৌরে ঘরোয়া চর্চার একটা সস্তা মাধ্যম ছাড়া আর কিছু বলে মনে হত না আমার। একটা বাংলা কথ্য বাক্যে অন্তত তিনটে ইংরীজি শব্দের অপ্রয়োজনীয় অকারণ প্রয়োগ না করলে যে মায়ের তথাকথিত উঁচু সমাজে আভিজাত্য বজায় রাখা যেত না। এমনিতেই তোমার মত বাংলায় খাওয়া, বাংলায় স্বপ্ন দেখা, বাংলাকে গায়ে জড়িয়ে ঘুমনো আভিজাত্যবোধে আনপড় আদ্যন্ত মেছো ভেতো বাংলা-সেন্টু সর্বস্ব গোঁয়ার বাঙালিকে নিয়ে মায়ের অস্বস্তির শেষ ছিল না, তারপর যদি আমি মায়ের মত না হয়ে তোমার মত বাংলা বিলাসী হ'তাম, তাহলে কী তুমি তোমার প্রিয়তমা পত্নীর সাথে নির্ঝঞ্ঝাটে একটা দিনও কাটাতে পারতে, বল? বলতে পার, ওটা ছিল তোমাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য আমার তরফ থেকে বোঝাপড়ার একটা হিসেবী বন্দোবস্ত। অবাক লাগছে তো এমন অদ্ভুত রকবাজ আর কঠিন শব্দের মিশেলে লেখা বাংলা চিঠি পড়ে? ভাবছ, 'দ্বিতীয় ভাষায় পাশ করার জন্য কোনও রকমে ভালবাসাহীন মাতৃভাষা লিখতে পড়তে শেখা মেয়েটা এমন পাল্টে গেল কীভাবে? এটা আমারই মেয়ে তো!' আজ্ঞে হ্যাঁ বাবাই। এটা তোমারই সেই মেয়ে যে কিনা আজ তার নাকটাকে মই-এর মাথা থেকে নামিয়ে স্বস্থানে ফিরিয়ে এনেছে। ঠুনকো আভিজাত্যের মোড়ক ছেড়ে বাংলাতে খেতে শিখেছে। রোজ রাতে সে স্বপ্ন দেখে বাংলায়, আর বাংলাকে গায়ে জড়িয়েই ঘুমোয়। ঠিক তোমার মত করে।
আসলে, এই এক বছরে নিউ ইয়র্কে এসে আমার ভাবনাটা আমূল বদলে গেছে বাবাই। আজ ছ'মাস ধরে প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার করে রাত্রে আমার সারা সপ্তাহের রোজকার দিনলিপি জানিয়ে কাগজ কলম নিয়ে তোমাকে চিঠি লিখি। আর সবকটা চিঠিই লিখি কিন্তু বাংলায়। এরমধ্যে কতগুলো চিঠি যে জমে গেছে বন্ধ খামের ভেতর তা আর গুনে দেখা হয়নি। পুজোয় যখন বাড়ি যাব সবকটা খাম তোমার হাতে তুলে দেব। আমি একমাস বাদে এখানে ফিরে আসার পর তুমি প্রতি শুক্রবার রাতে মাকে পাশে নিয়ে চিঠিগুলো পড়বে, আর তোমাদের দুজনের মাঝে আমার উপস্থিতি অনুভব করবে। আমার বাংলায় লেখা এই চিঠিই হবে তখন তোমাদের দুজনের ভাবনা আর সংস্কৃতির দূরত্ব ঘোচানোর একমাত্র সেতু। কেমন হবে বলো তো তখন? 
জান বাবাই, এই এক বছরে পয়লা বৈশাখ, দুর্গা পুজো, সরস্বতী পুজো, শীতের বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন সবই এখানে দেখলাম। দেখলাম আনন্দে ভেসে যাওয়া, হুল্লোড়, মজা, প্রাচুর্যের মোড়কে প্রবাসী জীবনের উৎসব পালনের হিড়িকও। তারমধ্যে পেয়েছি নতুন পোষাকের গন্ধ। সদ্য পাট ভাঙা শাড়ি কিম্বা রঙিন পাঞ্জাবীতে ঢাকা এক দিনের বাঙালিয়ানাও দেখেছি। কিন্তু এত সবের মধ্যে বাংলাকে কোত্থাও খুঁজে পাইনি। নববর্ষের অনুষ্ঠানে এখানকার নতুন প্রজন্ম ইংরীজি উচ্চারণে দেখে দেখে কষ্ট করে বাংলা কবিতা পড়ে, পিয়ানো বা বেহালায় বাংলা গানের সুর বাজায়, কিন্তু বাংলা বলতে পারে না। বাড়িতে বাবা মা বাংলায় কথা বললেও বাংলা বলতে শেখার জন্য শিক্ষকের কাছে যায়। কি অদ্ভুত না? বাঙালি বাংলায় কথা বলা শিখতে শিক্ষক খোঁজে। মজার কথা কোনও হিন্দী ভাষী বা গুজরাটি বাচ্চাকে কিন্তু তাদের মাতৃভাষা বলতে এত হোঁচট খেতে দেখিনি। না কলকাতায়, না এখানে। কোনও বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালির সন্তানকেও দেখিনি বাংলায় কথা বলা নিয়ে কোনও জড়তার মধ্যে থাকতে। শুধু আমরাই, বাবাই শুধু আমরাই, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বাঙালিরাই আবার নতুন করে বাংলা বলে বাঙালি হতে চাই। শিকড়কে ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টায় জোর করে বাংলা পড়ি। কষ্ট করে বাংলা লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমরা যে মাতৃভাষার আবেগকে আদিখ্যেতা আর এক দিনের উদযাপন বলে শিখে এসেছি সেই শৈশব থেকেই। তাই তো তোমার কাছে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের শহীদ রফিক, বরকত, সালাম বা জব্বারের নাম শুনলেও তাদের চেনার চেষ্টা কখনও করিনি। দিতে শিখিনি তাদের রক্তের দাম। কিন্তু আজ আমার বোধদয় হয়েছে বাবাই। গতকাল রাত জেগে আমি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পড়েছি। জেনেছি তাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা। জব্বারদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির গল্পও পড়েছি। বুঝেছি মাতৃভাষা নিয়ে আবেগের গভীরতা। সেগুলো জানতে গিয়েই যেন আরও গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছি বাংলা ভাষা নিয়ে তোমার আবেগ আর অনুভূতিকে।
বাবাই, আমি বাংলাদেশের এই ভাষা আন্দোলনকে, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বীকৃতিকে এতটুকু ছোট না করেই আজ এই ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটু অন্য ভাবেও ভাবছি। যদিও এ ভাবনা সম্পূর্ণই আমার নিজস্ব। তবু তোমাকে না বললে আমার ভাবনাটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। জানা হবে না আমার এই ভাবনার যথার্থতাও।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে পড়তে গিয়ে জানলাম, পৃথিবীর প্রথম এবং দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে নয়, আমাদের ভারতে। এবং সে আন্দোলন তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের আন্দোলন ছিল না। ছিল না কোনও প্রাদেশিক ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার আন্দোলনও, পড়াশোনা কিম্বা চাকরি পাওয়ার সুবিধার্থে। বরং সে আন্দোলন ছিল শুধুই নিজেদের মাতৃভাষাকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অন্য ভাষার আগ্রাসনে হারিয়ে না যেতে দেওয়ার আন্দোলন। সে লড়াই ছিল নিজেদের কথ্য ভাষার সরকারি স্বীকৃতি আদায়ের লড়াই। ইংরেজদের ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ঘোষনায় বাঙালির বাংলা ভাষার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলার ভয়ে যে লড়াই এর বীজ নিঃশব্দে বপন হয়েছিল তখনকার বিহারে, পরে ১৯১১ তে বঙ্গ ভঙ্গের আদেশ রদ হওয়ার পরও সেই লড়াই স্তিমিত হয়ে যায়নি। কারণ, সেইসব মানভূম অঞ্চলের নিজস্ব উচ্চারণে বাংলা ভাষা বলতে অভ্যস্ত বাঙালিরা বুঝেছিল, বঙ্গ ভঙ্গ রদ হলেও বৃহত্তর আঙ্গিকে বাংলা ভাষাকে অবদমিত করে রাখার চোরা গোপ্তা আয়োজন ইংরেজরা কখনোই বন্ধ করবে না। কারণ, বিপ্লবের আগুন যে বাঙলার মাটিতে বাংলা ভাষাতেই জ্বলেছে বারবার। প্রমাণও হয়েছিল সেই আশঙ্কা সত্যি বলে। আর সেটা শুধুই ইংরেজদের সৌজন্যে নয়, আমাদের দেশীয় কংগ্রেস নেতাদের দাক্ষিণ্যেও বটে। এবং তা ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাথে। সেসময় বাঙালি অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও মানভূম জেলাকে যুক্ত করা হয়েছিল বিহার রাজ্যের সাথে। গলা টিপে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল পুরো একটি জেলার বাঙালি ভাবাবেগকে। কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছিল বাংলা ভাষাভাষীদের। বাঙালি ছেলে মেয়েদের বাংলায় পড়াশোনা বন্ধ করে হিন্দী পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। তখন ১৯০৫ এ বপন করা সেই বাঙালি ভাবাবেগে লালিত চারাগাছ হঠাৎই যেন ডালপালা বিস্তার করে বৃহত্তর আন্দোলনের চেহারায় ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো মানভূম এবং বিহার-পশ্চিমবঙ্গের সীমানা বরাবর। আমাদের দেশের বরকত বা জব্বার ভাষা সেনানী ভজহরি মাহাতদের প্রাণ হয়ত যায় নি, কিন্তু নিজেদের কথ্য বাংলায় ছড়া আর গান বেঁধে চারদিকে পদযাত্রা সহ অহিংস আন্দোলন তারা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল। নাড়িয়ে দিয়েছিল দিল্লীর টনক। ফলে ১৯৫৬ সালের ১ লা নভেম্বর নিজেদের বাংলা ভাষার স্বতন্ত্র স্বীকৃতির দাবীতে সফল হয়ে বিহার ছেড়ে যুক্ত হতে পেরেছিল ১৬ টা থানা নিয়ে তৈরী পুরুলিয়া জেলা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সাথে। সফলতার সাথে বিনা রক্তক্ষয়ে শেষ হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম এবং দীর্ঘতম মাতৃভাষা আন্দোলন। তাহলে, বুঝলে তো বাবাই ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশ নয়, পথ দেখিয়েছে ভারতের মানভূম জেলা। আরবী, ফার্সী, সংস্কৃত কিম্বা ফরাসী, ওলোন্দাজ, পর্তুগীজ বা ইংরেজি ভাষার কাছে ঋণী হয়ে যাওয়া বাংলার জন্য নয়, একেবারের নিজেদের মাটির স্পর্শ লেগে থাকা আঞ্চলিক বাংলা ভাষার স্বীকৃতির লড়াইতে জয়ী হওয়ার জন্য।
তাই বলছি কি বাবাই, আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই যে, আমার ভাষা দিবস শুধু এই একুশে ফেব্রুয়ারীতে নয়, আমার ভাষা দিবস বছরের ৩৬৫ দিনই। কারণ, এই প্রতিটা দিনই যে ১৯০৫ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত ক্যালেন্ডারের পাতায় নিয়ম করে ঘুরে ঘুরে এসেছে। আজও আসে। তাই আমি শ্রদ্ধা করি রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার দের মতই ভজহরি মাহাতদেরও। আমি গর্ব বোধ করি এদের জন্য। আমি শুধু একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে গর্বে বাঁচতে চাই না বাবাই। শুধু একটা দিন নয়, নয় শুধু একুশে ফেব্রুয়ারী, বছরের তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই আমার কাছে মাতৃভাষার দিন। আমার গর্বের দিন। আর তাই আমি গর্ব বোধ করি পৃথিবীর প্রথম এবং দীর্ঘতম মাতৃভাষা আন্দোলনের দেশের মাটিতে আজন্ম লালিত এবং বড় হয়েছি বলে।
এবার বিশ্বাস হল তো বাবাই, আমি সত্যিই তোমার সেই মেয়ে যে বিদেশে থেকেও তোমার মতই বাংলায় গান গায়, তোমার মত করেই যে নিজেকে এই বাংলায় খুঁজে পায়। 
সবশেষে তোমাকে চুপিচুপি একটা কথা বলি, এখানে আসার সময় মা আমার বাক্সে অনেক গুলো নন্টে ফন্টে, চাচা চৌধুরী আর হাঁদাভোঁদা দিয়ে দিয়েছিল। আর দিয়েছিল শরৎ চাটুজ্যের উপন্যাস সমগ্রর পাশাপাশি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প সংগ্রহের কয়েকটা খন্ড আর শঙ্খ ঘোষ- শ্রীজাতর কবিতার বই।
বলেছিল, নিজের দেশে তো বিদেশি ভাষা শিখিয়েছি প্রতিযোগীতায় জয়ী করতে, পরের দেশে গিয়ে নিজের ভাষাকে একটু অনুভব করার চেষ্টা করিস নিজের শিকড়ের টান উপলব্ধি করতে। কোনও কারণে নয়, শুধুই ভালবাসার টানে। কি? কিরকম লাগছে?
আমি কেমন বাংলা লিখতে শিখেছি বাবাই? আজ তুমি খুশী তো তোমার মেয়ে তোমারই মত হয়েছে বলে? বুঝেছ তো, মা আমাকে মায়ের ভাষা একটু দেরীতে হলেও চিনতে শিখিয়েছে। আর আমি তা পেরেছি। আমি যে তোমারই মেয়ে বাবাই যে উল্লাসে করে বাংলায় চিৎকার, আর রেগে গেলে করে বাংলায় হাহাকার।

ভাল থেকো বাবাই। মাকে নিয়ে সুস্থ থেকো। আনন্দে থেকো। পুজোয় বাড়ি গিয়ে আমিও সামিল হব সেই আনন্দে।

                                        প্রণামান্তে
                                     তোমার দুহিতা

______________________________________________
আগের সংস্করণের পাঠ প্রতিক্রিয়া 
______________________________________________

১/ প্রতিটি কবিতা এক অন্য মাত্রায় নিজেদের তুলে ধরেছে। অরন্ধনের সকল কবি ও চিত্রগ্রাহকদের আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। সর্বোপরি সম্পাদকের সম্পাদকীয় প্রতিবারের মতো এবারও অনন্য। অরন্ধনের সমৃদ্ধি কামনা করি।
                               ---------কবি উৎপল চট্টোপাধ্যায়

২/ পড়ে ফেললাম দাদা । অসাধারণ একটি সংখ্যা হয়েছে ।
                                ---------কবি নিমাই জানা 

৩/ ভাই, আমি নিজে পড়ে বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক গ্রুপে ফরোয়ার্ড করে দেবো ভাই।
                                 -----------কবি গীতশ্রী সিনহা

৪/ তোমার সম্পাদকীয় পড়লাম।

বরাবরই এটা মুগ্ধ করে আমাকে।

সম্পাদকীয়টি পড়ার পরই একটি ছোট্ট কবিতা লিখলাম। যার উৎস তোমার সম্পাদকীয়টির-ই একটি বাক্য।
                              -----------কবি-প্রাবন্ধিক তপন পাত্র

৫/ এই পত্রিকাটি এগিয়ে চলেছে খুব সুন্দরভাবে এবং নীরবে।
অনেক শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা।
                              -----------কবি শর্মিষ্ঠা ঘোষ 

৬/ দেবাশিসদাকে অভিনন্দন। খুব ভালো লাগল।
                             -----------কবি সোমেন মুখোপাধ্যায় 

৭/ ভালো লাগলো সম্পাদকীয়টি। স্পষ্ট করে বলা সত্যি কথা। উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা গুলি চমৎকার....
অরন্ধন চলতে থাকুক অবিরাম... ।
                              -------------কবি সুজন পণ্ডা 

৮/ ছবি ও লেখা দুটোই সুন্দর। সম্পাদকীয় ভীষণ বাস্তব দাদা। ভালোবাসা জানাই।
                                ------------কবি শ্যামাপদ মাহাত, বাঁশি 

______________________________________________

                                আমাদের বই













সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : সুপ্রিয় দেওঘরিয়া 
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com





 

মন্তব্যসমূহ

  1. সম্পাদকীয় খুব ভালো। অনুপমের কবিতা ভালো লাগলো। বাঁশির কবিতার দু একটা লাইন অনবদ্য। সবে মিলিয়ে দারুন একটা সংখ্যা।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র ।। সন্তোষ রাজগড়িয়া

ছবি প্রদর্শ-শালা ।। আলোকচিত্র শিল্প ।। মুকেশ কুমার মাহাত

পঞ্চম বর্ষ ।। তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ০২ অক্টোবর ২০২৪