দ্বিতীয় বর্ষ ।। ষড়বিংশতি ওয়েব সংস্করণ ।। ২৭ চৈত্র ১৪২৮ ।। ১১ এপ্রিল ২০২২
দেখতে দেখতে দুই বছর অতিক্রান্তের পথে। আগামী সংস্করণে তৃতীয় বর্ষে পা রাখতে চলেছে অরন্ধন ওয়েব। কলেবরে বৃদ্ধি না হলেও নতুন নতুন অনেক বন্ধু এবং স্বজনের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পেরেছি আমরা। আগামী দিনগুলোতে আরো নতুন নতুন সুজন এবং স্বজনদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবো এমন আশা নিয়েই এগিয়ে চলা।
অরন্ধন থেকে প্রথম সারিতে উঠে আসুক কেউ এমনটা আশা রাখি না। কারণ, লেখালেখিতে কেউ প্রথম কেউ শেষ হয় না। নিজের নিজের মতো লিখে যায় সবাই। কে পড়বে কে পড়বে না, সেটা তার ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার। সকলেই নিজের নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বাঁচে। তাই, আমরা আশা রাখি অরন্ধন থেকে ছড়িয়ে পড়ুক ভালোবাসা। ছড়িয়ে পড়ুক পায়ে পা মিলিয়ে চলার প্রবণতা।
কবিদের মধ্যেও গোষ্ঠী কোন্দল শেষ হওয়ার কথা নয়। আসলে কিছু কিছু কবি নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে বজায় রাখার জন্য দেশভাগের মতোই কবিদেরও নানা গোষ্ঠীতে ভাগ করে রাখে। তবু ইদানিং কিছু কিছু পত্রিকা এবং ওয়েবজিন এই গণ্ডিটাকে ভাঙ্গার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। অরন্ধন ওয়েবও সেরকমই একটা বাঁধন ছেঁড়া ওয়েবজিন। যেখানে গোষ্ঠী নয়, গুরুত্ব দেওয়া হয় লেখার মানকেই। আর জায়গা দেওয়া হয় নতুন লিখতে আসা কচি অথচ সবুজদের।
অগণিত কবি লেখক এবং পাঠকদের আন্তরিক ভালোবাসা জানিয়ে দ্বিতীয় বর্ষের শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হলো সকলের ভালোবাসা নিয়ে। সকলকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে।
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
দুর্গা দত্ত / উৎপল চট্টোপাধ্যায় / পল্লব গোস্বামী / দেবাশিস মণ্ডল / সুজন পণ্ডা / পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় / সুরজিৎ পোদ্দার / শ্রীদাম কুমার / তপন পাত্র / দীপংকর রায়
______________________________________________
পিঁপড়ে কথা : ১
দুর্গা দত্ত
মাথা নীচু করে মাটিতে পিঁপড়ের সারির দিকে তাকালেই দেখতে পাই, গা শিরশিরে বেলা পড়ে আসছে ধীরে ধীরে ফাগুন বিকেলে।
মা পা ছড়িয়ে দিয়ে মোষের শিং-এর কাঁকই-য়ে দিদির উলুরঝুলুর চুল আঁচড়ে খেজুর বিনুনি করে খোঁপা বেঁধে দিচ্ছে লাল ফিতেয় ; আঁচলের খুঁট দিয়ে তেল চিটচিটে পিঠ ঘষে দিচ্ছে তার কালো মেয়ের। এরপরেই হ্যারিকেনের কাচের কালি মুছে পলতের মাথা দুআঙুলে টিপে ঘষে ঘষে মামড়ি ছাড়িয়ে দু পয়সার মাটির তেল ভরবে দিদি। কাপাস তুলোকে হাতের তালুতে রেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সলতে পাকিয়ে প্রদীপে এক দশন তেল দেবে , তারপরেই তুলসীতলায় জলের ছড়া দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে 'সন্ধ্যা দেখাবে' ; থুপ থুপ করে গাল ফুলিয়ে শাঁখ বাজাবে তিনবার; শাঁখের মুখ মুছে হাঁটু গেড়ে তুলসীথানে মাথা ঠেকিয়ে নম: করবে চোখ বুজে।
মাথা নীচু করে মাটিতে পিঁপড়ের সারির দিকে তাকালেই দেখতে পাই, 'শুক' উঠলেই মা কাঠের উনুনে মাটির খোলায় মুড়ির চাল নাড়তে বসছে।কুমোর পাড়া থেকে আঁধার ভেদ করে হাড়ি পেটানোর শব্দ ভেসে উঠছে ঢপ্ ঢপ্ করে । তাঁতিদের তাঁতশাল থেকে মাকু ঠোকার শব্দ উঠছে ঠক্ ঠকর্ ঠক্ ...
তিন সের ভেজা চালের ওপরে আন্দাজ অনুসারে তিনটে ছোট ছোট নুনের ঢিপি। মায়ের নুনের হাত একটু বেশি। তিন সের চালে কম করে হলেও দেড়ষোলি মুড়ি তো হবেই !
আগুনের আভায় মায়ের মুখেও চকচকে আভা।
মাথা নীচু করে মাটিতে পিঁপড়ের সারির দিকে তাকালেই দেখতে পাই, ভেজা চালে নুন মাখিয়ে হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে একসময় ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের হাতা নেয় মা। তারপরে নাড়তেই থাকে, যতক্ষণ না রস মরে গিয়ে শুকনো কটকটে আর লালচে হয় চাল। উনুন থেকে চালের খোলা নামিয়ে রেখে চাল নাড়তে থাকে মা। দুটো চাল চিবিয়ে দেখে নেয় দাঁতে আটকে যাচ্ছে কিনা , ঠিক ঠিক বতর হয়েছে কিনা ! উনুনের আঁচ কমিয়ে দিয়ে মুড়িভাজার খোলা চাপিয়ে দেয় উনুনে। পুড়ে যাওয়া কালো কালো বালির সঙ্গে দুমুঠো নতুন বালি মিশিয়ে দেয় মা। দু'দিন আগেই নদীর থেকে ভেজাবালি ধুয়ে নিয়ে এসে রোদে শুকিয়েছে দিদি। সেই বালি। ডানহাতে বেনাকুচিখাড়ি ছড়িয়ে ধরে বালি নাড়তে থাকে মা। নাড়তেই থাকে। বেনাকুচিও পুড়ে পুড়ে ছোট হয়ে গেছে মাসখানেক হলো। সাঁওতাল খুড়ি দিয়ে যাবে বলেও এখনও দিয়ে যায়নি বেনাকুচি। নুনুকে দিয়ে কি খবর পাঠাতে হবে ডাংজুড়ি-তে ! বনের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে ও কি যেতে পারবে একা একা !
মাথা নীচু করে মাটিতে পিঁপড়ের সারির দিকে তাকালেই দেখতে পাই, উনুনের ওপরে সেই মুড়ি ভাজা খোলায় গনগনে গরম বালিতে মা একসময়ে একমুঠো গরম চাল দিয়ে দেয়।
লালচে গরম চাল কী এক অলৌকিক রহস্যে বেনাকুচির সঙ্গতে ধপধপে শাদা আর ফুরফুরে মুড়ি হয়ে খোলার মধ্যে লাফাতে থাকে। লাফাতেই থাকে।
মায়ের চকচকে বাসি মুখে ছড়িয়ে পড়ে মুড়ির আলো।
ভোরের আলো ফুটতে থাকে আকাশ জুড়ে।
উৎপল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
১.
গর্ভে ফোটে না আঁশ
গর্ভে ফোটে না আঁশ নখ ফোটে
ফোটে পাথর
পাথর জানে শতাব্দীর শত গর্ভবাস
তুমি শব্দ কর , শব্দ ধরো
সশব্দ চিৎকারে ঝরুক ফুল
স্বাদহীন স্বেদহীন ফুলেল সুবাস
শব্দ জানে দাঁত দিয়ে ছেঁড়া আনন্দ আরাম
শব্দ জানে পাথর গন্ধে মেতে ওঠা সমৃদ্ধ স্নান
তুমিও শরীর ঢাকো আঁশে
তুমিও আর একটু এগিয়ে নিয়ে বলো
গর্ভে ফোটে না আঁশ নখ ফোটে
ফোটে চোখ
চোখ জানে মায়া ঘুম অনন্ত বিশ্রাম
২.
আজ কতদিন পর . . . .
আজ কতদিন পর নতুন আলো
নুন মাখানো পান্তা ভাতে
চোখের জ্যামিতি ,
নিষিদ্ধ পৃথিবীর দহন ক্লিষ্ট
জাতকের কোনো শীতকাল নেই
আমরা ইশারার শ্রেষ্ঠ নাগরিক
বৃষ্টি শব্দে উচ্চারনের খন্ড দেহ
এমন নিমন্ত্রন রেখেছিলো একদিন
তীরপূর্নির জল
এমন নিমন্ত্রন রেখেছিলো বসন্তের
সীমান্ত ফসল
তবু যেন ইতিহাসের শেষ সিলেবাস থেকে
বাদ পড়েছে আগুন
রোদ আর জলের আয়ু কুড়িয়ে
জমিয়ে রাখা ডাকটিকিটে বসেছে
আঁশ রঙা প্রজাপতি
আজ কতদিন পর নোনতা আলো
মেপে নিচ্ছে ছাই ছাই মাটি
আর আধুনিক সভ্যতার বিষাক্ত নুন
দুটি কবিতা
পল্লব গোস্বামী
১.
বৃন্দাবনী বিকেল
ছেলেটি এখন আর কথা বলেনা তেমন। কেমন যেন একা একা থাকে। একলাই বাঁশি বাজায়। আনমনা হয়ে কুড়িয়ে আনে
রোদে পোড়া হলুদ পলাশ ফুল।
মেয়েটিও অপূর্ব একা এখন। বিনি সুতোয় রুমাল বোনে। বিকেলের ছেঁড়া ছেঁড়া রুমালি রুটি খেয়ে যায়, রোঁওয়া ওঠা খোঁড়া কাক।
অথচ, দুজনের দূরত্বের মাঝে এক আশ্চর্য বাগান। সেখানে হলুদ ঘনিয়ে এলে উড়ে আসে এক বৃন্দাবনী ময়ূর।
ময়ূরী আসেনা।
সাধ হয়, সুধাই তাকে -
কাওকে ভালোবেসে,তুমি কি
কষ্ট পেয়েছো ময়ূর ?
বিকেল ঘনিয়ে আসে ...
২.
মৃত্তিকাজন্ম
তারপর আবার যখন জন্ম নেব কোনো এক দুরন্ত রোদে বসে থাকা ভিখিরিনির কোলে। আমার পিঠেও সেদিন অবাক ডানা হবে। আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে পস্তু ফুলের হাওয়া, প্রাচীন প্রান্তর।
আনা দু'আনার বাটি ছলকে পড়বে রাস্তায়। বাঁদরলাঠি গাছের পাকা ফল দিয়ে
মা আমার ঝুমঝুমি বানাবে। আমি সেই ঝুমঝুমিতে বেঁধে দেবো শ্রীরাধিকার নুপুর।
পাগলের মতো করে ভালোবাসবো তাকে। আমি হবো মৃত্তিকার মতো নরম। হাজার লাঙল আসুক। বিঁধুক হাজার কোদাল, গাঁইতি, শাবল। বুক চিতিয়ে দাঁড়াবো শ্রীচৈতন্য হয়ে।
যাতে করে কেউ অবিরাম খননে খননে, গোলায় তুলতে পারে সোনালী মায়ার ফসল।
দেবাশিস মণ্ডলের কবিতা
১.
আহ্বান
এসো এসো অকাল এসো
বিলাই আহার অভাবী মুখে
এসো এসো অরূপ এসো
বানাই ‘রূপ’-এ সৃষ্টিসুখে।
এসো এসো আঁধার এসো
জ্বালাই আলো তোমার বুকে
এসো এসো আঘাত এসো
দাঁড়াই ঋজু তোমায় রুখে।
এসো এসো মরণ এসো
জীবন গড়ি তোমায় জিতে
এসো এসো ভাষণ এসো
সুর বেঁধে দিই কাব্য-গীতে।
এসো এসো বন্যা এসো
সাঁতরে খুঁজি যে দ্বীপ জাগে
এসো এসো কলম এসো
দাগ রেখে যাই যাওয়ার আগে।
২.
আশার যাত্রা পথে
এসো রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াই
দ্যাখো বকুল বিছানো পথ পড়ে আছে সোজা
বৃথা ব্যথা ভরা দু-পাশের মৃত্যুকে খোঁজা !
ওদেরও ডেকে নাও কাছে
হাতে হাত রেখে একসাথে চলো সবে হাঁটি
মৃত্যুকে জয় করে খুঁজে নিতে শিকড়ের মাটি।
আলো আছে ঠিক আধারের মাঝে
আঁধার হাতড়ে খুঁজে নিতে হবে সূর্যকে রেখে চোখে
বিষাদের মেঘ কেটে যাবে ঠিক দীপ্ত উজলালোকে।
চলো দল বেঁধে যাই চলো
হাওয়ার সঙ্গে মেঘও চলুক, ঢাকুক না পথ কালো
বেঁধে বেঁধে যদি এগিয়ে চলি, ঠিক খুঁজে পাবো আলো।
চলো সেই পথ ধরে চলি
বৃষ্টি যেখানে চোখের জলে দুঃখকে ধুয়ে চলে
বাতাস সেখানে বর্ষার নয়, ফাগুনের কথা বলে।
এসো রাস্তার মাঝখানে এসে দেখি
সুনীল হয়েছে নীলাকাশ আজ, আশায় ভরেছে বুক
খুব দূরে নয় এ পথের শেষ, ওপারে দাঁড়িয়ে সুখ।
ধূসর এবং পূর্ন
সুজন পণ্ডা
১.
কোনো মাঝবয়সী লেকের ধারে
একদিন তোমার সাথে দেখা হবে নিশ্চিত,
জলে আমাদের ছায়া পড়ে কাঁপবে
তিরতির ঢেউ তুলে।
সেদিন কিছু উপহার এনো
আমিও নিয়ে যাব
আমার আজীবন সঞ্চয়
এই মেঘ টুকু,
এই ধূসর এবং পূর্ন মেঘটুকু।
২.
দ্যাখো ওই আকাশ মিশছে
মাটির কোলে,
পবিত্র আলো
দ্যাখো ওইখানে কোনো তারা
এঁকে দিচ্ছে আগামীর আবির্ভাব চিহ্ন।
তোমার দু হাত ভরে নাও
আলোয় আলোয়।
মাটির বুকে মাথা রেখে শোনো
শস্যের ভ্রুণ কিভাবে শ্বাস নেয়
কিভাবে বেড়ে ওঠে আগামী।
দ্যাখো অঙ্কুর দ্যাখো আলো ।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি কবিতা
১.
নন্দন
গ্রামথান থাকে দূর বহেড়াতলের নিরঙ্কুশ ছায়ায়
মোরগের ডাক পৌঁছবে সেথা?
ঝুলের মতো আঁধার মেখে গ্রামীণ প্রাতঃকাল
দাওয়ায় বসে ভাবে এই কথা
সে বুঝি জনতার মন নয়? শুধু জন-পদ?
তাহলে ত ভালোই; মোরগের কন্ঠ ছিঁড়ে অবিলম্বে
পায়ে হেঁটে সরাসরি অকুস্থলে পৌঁছে দেবে তার ডাক
গাছতলের সেই নাথ বড়ো কুঁড়ে
মোরগঝুঁটি ফুল করেছে কতো নিজের ইচ্ছেয়
সম্পূর্ণ মোরগ ঘটায়নি কোনো
তা নয় আদিদেব, এ তোমার চিরনন্দিত চালাকি
ফিনকি দেয়া ডাক-পাখিটির টুঁটি তুমি
নিজে ছিঁড়ে খাবে না কদাপি
মানুষের মানতের আমানত ভেঙে ভেঙে খাবে...
২.
দংশন
বিবেককে কিসে যে দংশন করলো হঠাৎ
অ্যান্টিভেনম নেই; প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ফেল
বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে
বিবেক কাঁদছে অনবরত
তার স্ত্রী-কন্যা আছে; পরিজন-প্রিয়জন আছে; জনপ্রিয়তা ও শ্রেষ্ঠত্বের স্বপ্ন আছে; তাকে বাঁচতে হবে...
এ যাত্রা তাকে বাঁচানো গেলেও তার সকল সমুদ্রপান
অতিশিষ্ট জল হয়ে বয়ে গেল মেছোবাজারের নালায়...
আফিম
সুরজিৎ পোদ্দার
চকিত গন্ধে গন্ধরাজ ফুটে ওঠে, সূর্যেরও আগে, স্নান করে রাত
যেভাবে শিশু, তার পরম বিস্ময়সহ, হেসে ওঠে
মাঠে মাঠে ছুটে যায় ছেলেদের দল - সামান্য বিকালবেলা
এসবই শেষ হবে, গন্ধরাজ - দুর্গন্ধময় কালো নর্দমায়
সেকথা ঢের বলে গেছে, শোনা গেছে, পুঁথি আর পাথরের বুকে
পৃথিবীর বুক থেকে মহাপৃথিবীর বুকে জেগে আছে, অতিশয়
মানুষের লোভ তবু, স্পৃহা তবু, তবু রক্তের স্রোত
চেতনা কি খুঁজে পায় চেতনার তলদেশে মহাচেতনার রোগ?
প্রিয়তমা, কোনো এক মহাবলে, পৃথিবীর দিকে দিকে
ঘৃণা শুধু বয়ে যায়, বয়ে যায় চেতনা - নর্দমা স্রোত
মানুষের সভ্যতা মানুষকে মেরে মেরে জেগে থাকে
সারারাত। সারারাত ছোঁয়া থেকে ঘৃণা ঝরে, প্রেম ঝরে, ঝরে যায়
রাতের সহজ, সাধারণ উপশম, ক্ষতদাগে ফসলের ওম
পিতামহ বলে গেছে দুঃখ তিনখানি,
তাই তিনবার শান্তি বলো
তিনখানি গুণ আছে,
তাই তিন চোখ মেলে ধরো
তাই তিনখানি গুলি এসে, আমাদের রাজপথে
শান্তির প্রতীক হলো।
তিনখানি গুলি এসে মানুষের চেতনাতে
আফিম মেশালো।
দুঃখ তিনখানি - তাই তিনবার শান্তি বলো।।
কলমে নেই বারুদ
শ্রীদাম কুমার
লাশ জড়িয়ে কাঁদে শখের কবি।
স্যাঁতস্যাঁতে কবিতা।
অশ্রু রাখে সোনার রেকাবিতে।
আহা, কলমের বারুদ গেছে ভিজে।
মন্দ কপাল, পোড়া এ দেশ
ভুলে গিয়ে সবাই বলে------
জয় জয় জয়।
ইতিপূর্বে দু'টি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে তপন পাত্রের ধারাবাহিক রচনা "মানভূমের লোকছড়া" । শেষ অংশ প্রকাশিত হবে পরের সংখ্যায় ।
** ** ** ** ** ** ** ** ** ** ** ** ** ** **
এখন সারা মানভূম জুড়ে 'মহু'লা বাসাত' । ভোরবেলার নরম বাতাসে টুপ টুপ ক'রে ঝরে পড়ছে মোল । লাল পলাশ ঢেকে যাচ্ছে নরম কচি সবুজ পাতায় । মৃদুমন্দ গন্ধ ছড়াচ্ছে মহুল । মোহু'লা সুবাসে মন আজ রিঁঝে-রসে ড্যানা মেলিছে গো ... বৌ-বিটি-ছানা-পু'নারা- ফুল কুড়িয়ে ঝুড়ি ভরছে শাশ্বত উল্লাসে । মানভূমের মাটিতে মহুলের মহিমা যে কী দিগন্ত বিস্তৃত তার হৃদয়প্রসারী অবলোকন এই সংখ্যায় ---- তপন পাত্রের কলমে ।
মানভূমের মহুল মহুলের মানভূম
"মহুল বনে তোর সনে দেখা হ'ল ফাগুনে
আমি পুঢ়ে হলি, ধু'ড়শে গেলি লো
তোর রূপের আগুনে ।
মহুলবনে ..."
মানভূমের রাখাল বালক না জানি কোন্ ষোড়শী যুবতীর দিকে তাকিয়ে তার মোহন বাঁশিতে ফুঁ দেয় । হৃদয় নিঙড়ানো ঝুমুর কলির মন কেমন করা সুরে সারা মানভূমের ফাল্গুনী শাল -পলাশ-মহুলের বন গুমরে গুমরে ওঠে । আহাঃ ! শিরশিরে শিউরে ওঠা ফাগুন-ভোরের বাতাসে মহুলের ডাল থেকে টুপ করে সদ্য ঝরে পড়া মধুর রসে টইটুম্বুর মহুয়া ফুলের মতো উর্বশী রাখালিয়া বালিকার কপোলে সেই সুরের মূর্ছনায় জানি না কেমন মোহাচ্ছন্ন করা টোল পড়ে ! মহুয়া বালিকাটিও কম যায় না , সে মোহন বংশীধারী রাখালকে ঘিরে মনে মনে ভাবে --
" ও তোর বাঁশিতে কিবা গুন জানে,
... কি বা জাদু আছে গো ,
... চুরি করে পরান..."
বসন্ত এলেই চিকন কচি সবুজ পাতা ও সাদা ফুলে ফুলে শালবন , লালে লাল ট্যাঁশ-পলাশ আর মহুলের মাতাল সমীরণে ম ম করতে থাকে মানভূমের ঝোপ-ঝাড়, বা'দ-কানালী, পাহাড়-ডুংরি-টিলা , কাঁকরময় প্রান্তর । আনন্দে মন কতো নামেই না ডাকে মহুলকে । মহুলের কে বা কারা যেন আদর করে রেখে দিল অষ্টোত্তর শতনাম --- মহুল, মহুয়া,মহুলা, মধুক, মধুকা, মোহা, মউল, মোল, মোভা, মহুভা, মৌ, মওল ; আবার আদিবাসী সাঁওতালেরা বলেন --মাতকম । কিছু কিছু কবি সাহিত্যিক তো 'মহুল' শব্দটিকে 'সুন্দর' এবং 'সুন্দরী' শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবেও ব্যবহার করেছেন । আসলে শুধু মানভূম নয়, এ যে সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশেই বড়ো আদরের, বড়ো ভালোবাসার, আলো-আশার, কাম ও প্রেমের, ক্ষুধা ও পূজার, উপশম ও নিরাময়ের,শিল্প ও কৃতজ্ঞতার সমূহ কল্যাণকারী ,আপাদমস্তক সেবা ও শুশ্রূষাদায়ী মহান এক উদার বৃক্ষ ।
মহুল বৃক্ষকে এককালীন বনবাসী উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য প্রাকৃতিক পুরস্কার রূপে বিবেচিত করা হ'ত । আজো সে-কথা খাটে। শুধু মানভূম-পুরুলিয়া-ঝারিখন্ডই নয়; উড়িষ্যার রায়গড়া, কালাহান্ডি; ছত্তিশগড়ের বিজাপুর, জগদ্দলপুর, সুকমা, দান্তেওড়া সহ বিভিন্ন রুক্ষ শুষ্ক এবং কিছুটা আর্দ্র আবহাওয়াতেও এই গাছটি জন্ম নেয়, মহীরুহ হয়ে ওঠে । সারা ভারতবর্ষে প্রায় তিরিশটি প্রজাতির মহুয়া গাছের অস্তিত্ব আজও লক্ষ করা যায় । কথিত আছে যেখানে সাঁওতাল গ্রাম সেখানে মহুয়া থাকবেই । প্রতিবছর শীত এলে এই মহুয়ার ডিম্বাকার পাতাগুলি ঝরে যায় , তখন যেন মৃত বৃক্ষ পত্রহীন শাখাগুলি নিয়ে সন্ন্যাসীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে । ধীরে ধীরে ফাগুন এলেই বসন্তের মাঝ বাতাসে বেরিয়ে আসে ধূসর কচি পাতা , সেগুলি পরিণত হলে গাঢ় সবুজ । তারপর মহুয়া ফুল ফুটলে ভোর থেকে মা-বোনেদের গাছের তলায় গিয়ে ডবডবে হালকা হলুদ নরম ফুলগুলি একটি একটি করে সাদরে কুড়িয়ে টকা, ডালা , ঠে'কা ও বাঁশের ঝুড়িতে বোঝাই করে ঘরে নিয়ে আসা । ফুল ঝরা শেষ হলে ফল । ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ আর পাকলে হলুদ ।
মহুয়া যেন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী , দাতা হরিশচন্দ্র । এর পত্রাঙ্কুর কোমল, হালকা সবুজ । মানুষ তা শাক হিসাবে রান্না করে খায় । কচি কচি ডালগুলি দাঁতন হিসাবে ব্যবহার করে । ফল কাঁচায় সবজি আর পাকলে পাকা ফল । মহুয়ার ফলকে কচড়া বলে । সাঁওতালরা বলেন কুঞ্চডি । কচড়ার সাথে খসলা আর ডাঁটা দিয়ে খুবই উপাদেয় তরকারি তৈরি হয় । বীজ থেকে হয় তেল । কচড়া তেল । শুকনো পাতা জ্বালানি রূপে ব্যবহৃত হয়। পাতা দিয়ে তৈরি হয় বাটি বা খালা , থালা আর ঘঙ্ । খালা ও থালার ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে শালপাতা প্রথম আর মোলপাতা দ্বিতীয় । আবার ঘঙ্ তৈরীর ক্ষেত্রে কেঁদ পাতার স্থান প্রথম, দ্বিতীয় স্থান মহুয়া পত্রের । মহুয়া গাছের ছায়াও মনোরম, স্নিগ্ধ সুশীতল । বটবৃক্ষের ছায়ার পরই এই ছায়া মানুষের সর্বাধিক প্রিয় ।
এই বৃক্ষের শিকড় থেকে পাতা , ছায়া থেকে মায়া --সবই হিতকর, মানবকল্যাণকর । বৃক্ষটি অত্যন্ত মূল্যবান । লোহার মতো শক্ত কাঠে দরজা জানালার ফ্রেম তৈরি হয় । পিটাই ছাদের কড়ি, বর্গা তৈরি হতো এক সময় । এখন পিটাই ছাদ নেই , কিন্তু আজও মাটির ঘরের খুঁটি ও সরদল ; মুদু'ন কাঠ ও রলা-ভাগটানের কাজে এর সমান ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । জল না পেলে ১০০ বছর চলে , লোকে বলে ১০০ বছর পর নাকি কাঠটি আরও বেশি শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হতে শুরু করে ।
মহুলের শিকড়, বাকড়, ফুল, ফল, বীজ এবং বীজ থেকে তৈরি তেল নানান রোগের মহৌষধ । স্নিগ্ধ কারক, শক্তিবর্ধক কামোদ্দীপক এবং জ্বালা ও প্রদাহ নিবারক, কৃমিনাশক , ব্রণ ও যে কোনো পুরাতন ক্ষতের পক্ষে হিতকর । বীজ থেকে যে তেল তার নাম কচড়া তেল, সাঁওতালদের কথায় "কুঞ্চডি সুনুম" । এই তেল চুলের পক্ষে উপকারী এবং শরীরে থেরাপিউটিক ম্যাসেজেও ব্যবহার করা হয় । আধুনিক প্রযুক্তিতে এই তেল থেকে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের আয়ুর্বেদিক সাবান, যা দাদ , হাজা একজিমা ইত্যাদি চর্ম রোগ নিরাময়ের বিশেষ সহায়ক । এছাড়া সর্দি-কাশি, অগ্নিমান্দ্য, আন্ত্রিক, অর্শ, বাত -ব্যথা, মাথা যন্ত্রণা , পুরানো ক্ষত থেকে নিরাময় ও কীটপতঙ্গের দংশনেও এই তেল ব্যবহৃত হয় । মহুয়ার পাতা গরম জলে সিদ্ধ করে সেই ক্বাথ দিয়ে শেঁক নিলে অন্ডকোষের প্রদাহ উপশম হয় । ছালের ক্বাথ বলকারক । গাছ থেকে বেরিয়ে আসা আঁঠা কফ নাশক, বাতের প্রতিশেধক । ছাল বেটে হাতসোওয়া গরম গরম লাগালে হাঁটুব্যথা প্রশমিত হয়, দাঁতের মাড়ি ফুললে , রক্ত পড়লে এবং টনসিলাইটিসে কাজে লাগে । মহুয়া ফুলের ক্বাথ কাশি কমায়, ফুলগুলি পরিষ্কার করে ঘিয়ে ভেজে খেলে অর্শ রোগ সেরে যায় । আর এই ফুলের মধু চোখের রোগের পক্ষে পরম হিতকর ।
আলাদা করে মহুয়া ফুলের গুণের কথা বললে তো ফুরোবে না । ছেলেমেয়েরা সদ্য ঝরেপড়া মহুলের রেণুগুলি ঝেড়ে ফেলে কাঁচাই মুখে পুরে নেয় । তৎক্ষণাৎ অল্প গবা লাগলেও পরে বেশ অম্লমধুর । ফুলকে শুকিয়ে রেখে সাধারণত বর্ষার দিনে কৃষিকাজ চলাকালীন অথবা চাষ উঠলে পূর্বে মাটির পাত্রে , পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ধাতব পাত্রে হালকা গরম জ্বালে ধীরে ধীরে সেদ্ধ করা হয় দীর্ঘ সময় ধরে । সাথে দেওয়া হয় তেঁতুল বীজ ভাজা । এ এক অসাধারণ মধুর , সুস্বাদু খাদ্য এবং অতুলন ক্লান্তিনাশক । কেউ শুধুই বাটি ভর্তি খেয়ে নেয় আবার কেউ কেউ খায় মুড়ি মেখে । রোদে শুকিয়ে পরাগ ছাড়িয়ে ভাজা মহুলও খায় অনেকেই । ভাজা মহুয়ার সাথে খই মুড়ি চাল ভাজা মিশিয়ে ঢেঁকিতে কুটে তৈরি হয় মহুল লাঠা । এমন মিষ্টি , মন্ডা মিঠাই মনে হয় পৃথিবীর কোন শ্রেষ্ঠ ভিয়ানদারের দোকানেও তৈরি হয় না । প্রথাগতভাবে রথের দিন চালগুঁড়ির সঙ্গে মোল শেদ্ধ মেখে ঝোল ঝোল পাগ করে তৈরি হয় মহুলচকলি । এই পিঠেকে পিঠে সমাজের রাজরানী বলা যেতে পারে । এটি খেতে খেতেও বেশ মজা আর খাবার পরেও মৃদু মাদকতা । মহুয়ার গরম রসে অথবা ভাজা মহুলকে সিদ্ধ করে তার সঙ্গে চাল মিশিয়ে তৈরি হয় মহুয়া খিচুড়ি , এমন খিচুড়ি আর কোন অন্য উপাদানে তৈরি হয় বলে অন্তত আমার জানা নেই । মহুল ফুল শুধু মানুষের উপাদেয় খাবার নয় , গাই গরু বাছুরেরও বলিষ্ঠ আহার । বর্ষায় চাষবাসের শেষে ক্লান্ত বলদদের উঠোনের জোলে অর্থাৎ বড় চুলায় বড় লোহার কড়াইয়ে দু'-তিন দিন ধরে হালকা হালকা জ্বালে সেদ্ধ করা মহুল সিজা খেতে দেওয়া হয় । দুধেল গাইকে মহুল সেদ্ধ খাওয়ালে রোজ দুধের পরিমাণ বেড়ে যায় । এখানে মানুষ আজও ভক্তি ভরে গাই-গরুকে মহুল সিদ্ধ খাওয়ায় , বলে মহুল ভগবতীর পবিত্র আহার ; তাদের খাওয়ালে গৃহস্থের পুন্যি হয় ।
মহুয়া মানভূমের লোকজীবনে, সমাজজীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বারো মাস । আদিবাসী অনাদিবাসী সমাজের বিবাহ উৎসবের ছাদনা তলায় বেশ কয়েকটি গাছের ডাল পুঁতে নানাবিধ সংস্কার পালনের বিষয় রয়েছে , সে ক্ষেত্রে মহুল ডালের স্থানটি মধ্যমণি রূপে । বাদ্য-বাজনা সহকারে সুসজ্জিত মহিলারা বিবাহের গান গাইতে গাইতে মহুল তলায় যায় এবং সেখান থেকে একটি ডাল সংগ্রহ করে নিয়ে এসে ছাদনা তলার কেন্দ্রে স্থাপন করেন মূল স্তম্ভ হিসাবে । আদিবাসীদের বিবাহ উৎসবে "মাতকম বুটা" পাঠদান আজো মানবিকতা ও নৈতিক শিক্ষার পাঠশালা হিসেবেই চিহ্নিত । একটি বৃক্ষ ও ফুলকে ঘিরে এমন সামাজিক সংস্কার বোধ করি বিশ্বে ব্যতিক্রম । সাঁওতাল সমাজের মানুষজন আবার বাহা পরবেও ব্যবহার করেন মহুয়া ফুল । তাঁরা দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন এবং নিজেদের নির্বাচিত পুরোহিতের হাতে ফুল অর্পণ করেন তারপর শুরু করেন নববর্ষের মহুল ফুল ও অন্যান্য মহুল জাত দ্রব্যের ব্যবহার ।
মহুল যে আবহমানকাল ধরেই মানভূমের মানুষের জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত তার অন্যতম প্রমাণ এখানে যে সকল "ভাঙানি" বা "ধাঁধা"র প্রচলন আছে , সেই ভান্ডারে মহুলকে ঘিরেও অনেক ধাঁধা রয়েছে । সর্বাধিক প্রচলিত ধাঁধাটি হল ---
"গাছটির নাম হীরা,
তায় ধ'রেচ্যা গুড়, বাগ'ন জিরা ।"
--- যার উত্তর হবে -"মহুল" বৃক্ষ । গুড় হলো মহুল ফুল, বাগ'ন অর্থাৎ বেগুন বলতে কচড়াকে বোঝাচ্ছে আর জিরা বলতে মহুল ফুলের পরাগ ।
তেমনি আর একটি ধাঁধা --"মা বিটির একেই নাম, ডুমকা ছঁড়ার ভিনু নাম"। মা বিটি বলতে গাছ এবং ফুলকে বোঝানো হচ্ছে , একটাই নাম --মহুল আর 'ডুমকা ছঁড়া' হচ্ছে মায়ের ছেলেটি অর্থাৎ কচড়া । অন্য একটি ধাঁধা "উপরে বাঁসা, তলে ডিম" তারও ভাঙানি সেই মহুল বা মহুয়া । এছাড়া "ঢাক-ঢোল ভিতর খোল, নিংড়ালে পড়ে ঝোল" --এই ধাঁধারও উত্তর -"মহুল"।
আবার একটি দাঁ'ড় নাচের গান পাওয়া যাচ্ছে --
"সব সব খাওয়ালি বঁধু,
না খাওয়ালি কচড়া ।
ইবার বঁধু হয়ে যাব
সঙতি ছাড়া ।"
--- গানটিতে বলতে চাওয়া হয়েছে, দুই বান্ধবীর মধ্যে দারুণ সখীত্ব । তারা একে অপরকে উৎসব অনুষ্ঠানে অনেক কিছুই ভালো মন্দ খাইয়েছে । আজ তাদের মধ্যে একজনের বিয়ে হয়ে যাবে । যার বিয়ে হয়ে যাবে, সে তার বান্ধবীটিকে বলছে, তুই তো অনেক উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমাকে অনেক কিছুই খাইয়েছিস, কিন্তু আমার খুব ভালো লাগা খাবার কচড়া পাকা আর কচড়ার তরকারি । তুই কিন্তু কোনদিন তা আমাকে খাওয়ালি না । আমার মনে এই বেদনা থেকেই গেল । হয়তো এই বাসনা এ জীবনে আর মিটবে না । এবার তো আমরা সঙ্গ ছাড়া হয়ে যাবো । আমি চলে যাব শশুর বাড়ি । খুব সহজ কথায় জীবনের এক অসাধারণ চমৎকারিত্ব ও প্রকৃতি প্রীতি ফুটে উঠেছে গানে । ফুটে উঠেছে সবজি অথবা বুনো ফল হিসাবে কচড়ার আকর্ষণ ও গুরুত্ব ।
অন্য একটি লোকগানে দেখছি প্রেমিক -প্রেমিকা মহুলবনে গেছে ; মহুলতলায় দাঁড়িয়ে থোকা থোকা কচড়া পাকা দেখে প্রেমিকার প্রেমিককে কচড়া পাকা খাওয়াতে ইচ্ছে হয়েছে । মেয়েটি নিজেই আঁকশি বেঁধে আঁকশিতে করে কচড়া পাড়তে চাইছে । তাই সে তার প্রেমিক এবং ওই ফলটির উদ্দেশ্যে আপন মনে গান গেয়ে উঠেছে ---
"কঁচড়া পাকা বেড়ে মিঠা
খাঁইয়্যা ল্যারে, লম্প'টা
কঁচড়া পাকা আঁকশি টা'নে
ডালে'ই হিলাব রে,
ডালেই হিলাব..."।
আবার সেইরকম সামাজিক সম্পর্কে বিজড়িত কোন নারী প্রিয় পুরুষকে হয়তো বা মহুলজাত মদ খাইয়ে আতিথেয়তা করেছেন কোন শূন্য প্রান্তরে কিংবা মেলা প্রাঙ্গণে । তারপর তিনি সেখান থেকে বিদায় নিতে চাইছেন । তখন প্রেম ও কাম উদ্রেককারী মহুয়ার রসে মাতাল পুরুষটি দক্ষিণ ডান হাত আর উত্তরে বামহাত প্রসারিত করে গান গেয়ে উঠছেন ---
"মহুল ক্যানে খাওয়লি
দেহে-মনে মাতলি ,
আর কুথা যাবি লো সই
দাঁড়াবো পথ আগলি ।"
মহুলকে ঘিরে প্রবাদপ্রতিম শব্দবন্ধেরও প্রচলন আছে এতদঞ্চলে । এমন একটি শব্দবন্ধ "মহু'লা বাসাত"। ব্যাকরণের বিশেষ নিয়মে বাতাস হয়ে গেছে বাসাত । যে বসন্ত বাতাসে মহুল পড়ে টুপ টুপ, সেই বাতাসে প্রেমিক মন হয়ে ওঠে উন্মন । আবার এই শব্দবন্ধটি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বাসন্তী বাতাসে বসন্ত রোগের আবির্ভাব-পরিবেশকেও বোঝানো হয় ।
তবে যে কারণে এই দেশ মহুয়ার দেশ যে কারণে দেশ-বিদেশের বাবু-ভায়াদের আকর্ষণ এই মহুয়ার প্রতি, তা হ'ল "মোহু'লা মদ" । হায় ! এই মদের ভুবনে যে আরো কত মাদকতা সে কথার খবর নিয়ে সময় নষ্ট করার সময় কোথায় ! কিন্তু বড়ো সময় সাপেক্ষ এই মদ তৈরির প্রক্রিয়াটি । একটি মাটির হাঁড়িতে মহুল ফুল এবং প্রয়োজন মতো জল নিয়ে তার উপর সম আকৃতির আরেকটি মাটির হাঁড়ি উপুড় ক'রে তাদের সংযোগস্থলটি ভেজা মাটি দিয়ে লেপে বায়ুরুদ্ধ করা হয় । এই অবস্থায় কাঠের জ্বাল দেওয়া মাটির উনুনে চাপিয়ে নিচের হাড়িতে জ্বাল দেওয়া হয় । আর উপরের হাঁড়িতে সামান্য একটি ছোট ছিদ্র ক'রে বাঁশের নল লাগিয়ে বাষ্প ঠান্ডা করে বিশেষ পদ্ধতিতে তরল আকারটি সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকে । মানভূমের লোকসমাজের আধুনিক বিজ্ঞানের সমতুল্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি সবিশেষ প্রশংসার যোগ্য । ইদানিং অবশ্য এই মদ তৈরির প্রক্রিয়ায় অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতির, প্রযুক্তির ব্যবহার এসে গেছে । যতো দিন যাচ্ছে সারা দেশ বিদেশ জুড়ে মহুয়া মদের কদর বাড়ছে , আদর-যত্ন বাড়ছে না এই মহুয়া বৃক্ষের প্রতি ।
________________________________________________
ঔপন্যাসিক দীপংকর রায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস---
"জলশ্যাওলার বিরহকথা" --- এবার সপ্তদশতম পর্ব তথা শেষ পর্ব
________________________________
জলশ্যাওলার বিরহকথা
দীপংকর রায়
বাড়ির দরজায় পা ফেলতে না ফেলতে বাড়িশুদ্ধ লোকের যেন এক সঙ্গে নানা অভিযোগের মাঝখানে পড়ে সে শুধু বললো, ইদ্রীশ কাকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাই কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল ।
চেতন ফকিরের কথাটা সে বেমালুম চেপে গেল। কারণ সামনে, একটু দূরে সাথীর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি ওই মানুষটিকে আবার খুব একটা ভালো চোখে দেখতে পারেন না। এর আগে তার এই বহেমিয়ানা নিয়ে, তার ঘরসংসারের প্রতি দায়দায়িত্বের কথা নিয়ে যে সব আলোচনা সামান্য একটু হয়েছিল, তাতে তেনার নানা অভিযোগ আছে তার প্রতি । তাই সে ভাবলো তার কথাটা বলা যাবে না একেবারেই। এরপরে আরো যদি শোনে এরা ----সে তার ওখানে আতিথ্য গ্রহণ করতে চেয়েছে, তাহলে তো তার প্রতিক্রিয়া সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এবং তার বিবাহ সংক্রান্ত আরো বিষয় উঠে এসে সে এমন এক ঝামেলা বাধিয়ে দেবে যে, তখন তার আর কোনোদিকেই সমর্থনের জায়গা থাকবে না। তাই ঘরে এসে সে তার এই মুহূর্তের প্রাপ্ত অস্থায়ী টেবিলের সামনে বসে পড়লো। অনেকটাই স্থির হতে চাইলো। এবং একেবারেই একা। ভাবছে, এতক্ষণ শুনে আসা কথাগুলি নিয়ে। ভাবছে, ইদ্রীশ আলী যতভাবে দেশের বর্তমান অবস্থা, চালের দর, কৃষকেরা ফসলের দাম পেলে তবেই তো একটু সচ্ছলতার মুখ দেখবে, তারা ভালো থাকতে পারবে। এইসব প্রসঙ্গ নিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু সমাধানের সূত্র বা আরো কিছু সুদূরপ্রসারী কথাবার্তা নিয়ে ভাবে; চেতন ফকিরের সাধন মার্গ আর ইদ্রীশ আলীর যাত্রার ঢঙে কথা বলার ভেতরেও প্রচন্ড আবেগ থাকা সত্ত্বেও সে যতটা জীবনমুখিন বা রাজনীতি সচেতন, তার থেকে চেতন ফকিরের জগত কত আলাদা! কিন্তু এতটা সময় এই দুই পিঠের দুটি মানুষকে নিয়ে কাটাতে এতটুকুও ক্লান্তি এল না তো তার!
বারবারই ভাবছে সে সেসব। ভাবতে ভাবতে এক সময় দুটি মানুষেরই সমান গুরুত্ব উপলব্ধি করে চেতন ফকিরের সঙ্গে আরো একবার দেখা হওয়া দরকার বলে মনে করে। আরও পড়ুন
আমাদের বই আমাদের অনুষ্ঠান
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণের ছবি : ব্লু পিরিয়ড, পাবলো পিকাসো (আন্তর্জাল)
মহুলের ছবি, অভিজিৎ মাজী
যোগাযোগ হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
খুব খুব সুন্দর।
উত্তরমুছুন