পঞ্চম বর্ষ ।। দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ ।। ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ২৭ মে ২০২৪
বীজ বোনার কাজ শুরু হলে ব্যস্ততা বাড়ে চাষির। ব্যস্ততা বাড়ে মেঘের। আকাশ মাটির এই ব্যস্ততাই পরিপক্ক ফসলের দিকে নিয়ে যায় আমাদের।
গ্রীষ্মের দাবদাহ শেষে এই যে ঘাম ঝরা ব্যস্ততা, এই ব্যস্ততাই ধীর পায়ে দীর্ঘায়িত হতে হতে নিয়ে আসে হেমন্তের শীতল ছোঁয়া। নিয়ে আসে এক অপরূপ আনন্দ মুখর পরিবেশ। যে পরিবেশের স্পর্শ পাওয়ার লোভে সারা বছর অপেক্ষায় থাকে মানুষ।
চারপাশে সোনালী ধান। রুনুঝুনু আওয়াজ মিশে যায় পাখিদের গানে। বাতাসের তানে। পাল্টে যায় জীবনের মানে আমাদের। আরও লক্ষ বছর অতিক্রান্ত করার সাধ জাগে। সাধ জাগে একটা সুবিশাল পরিবারের সদস্য হয়ে থাকতে জন্ম জন্মান্তর। মানুষের সাথে সাথে হাঁস, মুরগি, বকনা বাছুর, কেন্নো, গোবরে পোকা এবং মাঝে মাঝে বিড়ালেরাও ঘুরে বেড়ায় যে আঙিনায়। যে আঙিনায় বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে নির্ভয়ে বাসা বাঁধে টুনটুনি পাখি।
সেই আঙিনা ছাড়া সুখের এই মৌলিকতা আর কোথায়?
উত্তম মাহাত, সম্পাদক
______________________________________________
যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হলো এই সংস্করণ
______________________________________________
দুর্গা দত্ত / শুভজিৎ চন্দ / লালন চাঁদ / তীর্থঙ্কর সুমিত / সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় / বেণু মাহাত / সুশান্ত সেন / সুজন পণ্ডা / তপন পাত্র
_____________________________________________
গরমের চিঠি
দুর্গা দত্ত
এই চণ্ড গরমে আমার কাছে আসতে
তোমার অসুবিধে হবে জানি।
ধু ধু মাঠ প্রান্তর , ডাঙা ডহর, শুকনো টাঁড়,
ন্যাড়া বনভূমি,কাঁটা ঝোপ মাড়িয়ে মাড়িয়ে
এখান আসতে যে তোমার অসুবিধে হবে
তা মুখে না বললেও আমি জানি ।
এখানে এলে,
যদি কখনো আসো কোনো দিন
ভোর রাতে শুকনো নদীর বুক খুঁড়ে নিয়ে আসা
কলস ভর্তি ঠাণ্ডা জলে
কাঁসার থালায় ধুইয়ে দেবো
ধূলায় লাঞ্ছিত তোমার পা--
তেল মাখিয়ে দেবো পায়ের পাতায়।
একঘটি শীতল জলে
জুড়িয়ে নেবে তোমার শুকনো ঠোঁট গলা ও বুক।
হাওয়া করবো তালপাখা দিয়ে।
অনন্তমূল বেঁটে মাখিয়ে দেবো বিক্ষত পায়ের পাতায়।
আমাদের শীতলপাটি নেই।
বাড়ির মেয়েদের হাতে বোনা
খেজুর পাতার তালাই বিছিয়ে দেবো
গোবর নিকোনো মাটির মেঝেতে।
শালপাতার ডংলা-য়,--
পেট ভরে ইলি খাওয়াবো কিম্বা তালতাড়ি
যত খুশি, যা তোমার মন চাইবে...
বাবুই ঘাসের দড়িতে ছাওয়া খাটুলিতে
গাছের ছায়ায় বসে ঈষৎ নমিত চোখে
দূরের শাল গাছের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তুমি
গুনগুন করে গেয়ে উঠবে কোনো খররৌদ্রের গান ...
যে গানে কেবল তুমিই ,
আমি নিশ্চিত জানি
দারুণ দহনকালে 'ঝলা-পেটা' আমার ভেতরে
বসন্তের বীজ বুনে দিতে পারো অনায়াসে...
যদি কখনও কোনোদিন আসো এখানে
তবেই ...
বৃষ্টি
শুভজিৎ চন্দ
তুমি বৃষ্টি ভালোবাসতে
আমি ঝোড়ো হাওয়া
অবাক হয়ে দেখেছি প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা।
দিনে দিনে বৃষ্টির ফোঁটা আমার প্রিয় হয়ে উঠলো
তুমিও আর ঝোড়ো হাওয়াকে ভয় পেতে না।
তুমি বলেছিলে,
একসঙ্গে দুজনে বৃষ্টিতে ভিজবো
একসঙ্গে লাফাবো খোলা রাস্তায়
ঘরে ফিরব ভেজা শরীরে
উষ্ণতায়।
লালন চাঁদের গুচ্ছ কবিতা
১.
লাশ হবো
বিষাক্ত থেকে বিষাক্ততর হচ্ছি রোজ
বাটি উল্টে বিষ ছুঁয়ে দেখছি
পৃথিবী ভরে উঠেছে জরা ব্যাধি আর মৃত্যুতে
ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ বেঁচে আছে তবু
সেটাকে বাঁচা বলে না। জীবন এখানে মৃত্যুরই সামিল
আদিকাল থেকে জীবন মৃত্যু এক আসনে বসে আছে
আমরা নখ চিনেছি ওদের
দুটোই সংহারক
মরবো তবে রয়ে সয়ে মরতে চাই
মরবো তবে দেখে শুনে মরতে চাই। মরবো অবশ্যই
মৃত্যু আসবে
আত্মসমর্পন নয়। একেবারেই চলে যাবো
ইতিহাস হবো না লাশ হবো
২.
পুড়ে যাই নিমেষেই
এই যে এতোগুলো কথা ছুড়ে দিচ্ছি তীরের মতো
তবু বৃষ্টি নেই
গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ। কাতরাচ্ছে সবাই
সূর্য নিজেও পুড়ছে
পুড়তে পুড়তে ক্রোধ ঢেলে দিচ্ছে আগুনের মতো
পুড়ে যাচ্ছে পৃথিবী। ঈশ্বর
বেজার মুখে তাকিয়ে আছি সূর্যের দিকে
মা ডাকছেন
আগুনে পুড়তে পুড়তে স্কুলে যাচ্ছি
রমা আজ স্কুলে নেই
বুকের ভেতর দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে
পুড়ে যাই নিমেষেই
৩.
দুঃখ
কথা শেষ হলে দুপুর ডাকে
রোদ ডাকে
হেঁসেল থেকে মা'র ডাক শুনি
আমার খাঁচাবন্দি মন আজও আকাশ ছোঁয়
অভিমানে সরে থাকে মহুয়া সিমলাই
কাছে গেলে দূরে ঠেলে দেয়
দূরে থাকলে মন টাটায়
রোজ স্বপ্নগুলো ভেঙে যায়
পৌরুষের ছায়ায় বেড়ে ওঠে মায়াগাছ
শুকনো টব। মরে যায় গাছ
প্রতিদিন দুঃখ পাই
বাবার হাতে এক ব্যাগ রোদ
বাবা কবি
কিন্তু কেউ পড়ে না তাঁর কবিতা
দুঃখগুলো বুকের ভেতর ঝলসে যায় দিনরাত
বর্ণমালা
তীর্থঙ্কর সুমিত
শূন্য হতে হতে বুকের বাতাস একদিন...
নিভে যাবে হাওয়ার সঙ্গে
তার থেকে বরং
দুরন্ত নদীর বুকে একটা সকাল লিখি
দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত হয়েছে ইচ্ছেরা
ভালোবাসার গভীরে এখন দিনলিপির ছাপ
বৃষ্টির ধারা কখনও কখনও
তোমার শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে
আমার একতারা জুড়ে এখন লালনের বর্ণমালা।
অবিবর্তন
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
আমাদের মূর্ধার নিচে জিভ নেই আর।
মূর্ধার উপরের নাসাযন্ত্র, মস্তিষ্ক বিকল।
চোখ সাদা, কন্ঠনালি রজ্জু পাকিয়ে গেছে।
হাড় হিম ইস্পাত, আঙুলের চে' নখ বড়।
হৃদপিণ্ডে কয়েক হাজার পাথরের খটাখট।
শ্বেত রক্তকণিকার রং ঘনঘোর খয়েরি।
পাকমন্থনে যে বিষ, তারও বাজারদর উঁচু।
শিরদাঁড়ার নিম্নভাগে লেজ জন্ম নিচ্ছে। আর
এ-ওর পিঠ চুলকোতে চুলকোতে, মুখ ভেংচাতে
ভেংচাতে, অপরের উকুন বাছতে বাছতে,
নিজের করোটিকে নারকেলের মত ভাঙতে
ভাঙতে, আমরা ক্রমশঃ বিবর্তন-বিরোধী
চোখ পিটপিট দেশভক্ত বানর হয়ে যাচ্ছি।
বিবর্তন
বেণু মাহাত
কচি চোখ থেকেই দেখে আসা
শালপাতায় বোনা সংসার ।
প্রতিটা সেলাইয়ের মাঝে মাঝে
ফুটে ওঠে অসংখ্য বুনো কাহিনী ।
ভাগ্য পড়তে পড়তে
সপ্তর্ষিমণ্ডল হেলে পড়ে পশ্চিমে।
সারা রাত নুন মাখা ভাতের স্বপ্ন
দেখতে দেখতে ভোর হয়।
শেকড় ছিঁড়ে...
শেকড় ছিড়লে গাছ ঝিমোয়, নুইয়ে পড়ে।
আর মানুষ শক্তপোক্ত হয়।
সুশান্ত সেনের কবিতা
১.
চেষ্টা
অনেকবার চেষ্টা করেও যখন কিছু লাভ হলনা
তখন বেড়া ভেঙে ফেলার অনুমতি পাওয়া গেল।
এদিকে কাটারি নেই শাবল নেই
ঘা মারবার কোনো কিছুই হাতের কাছে না পেয়ে
বাড়ি বাড়ি ধর্না দেব
না বাজারে চলে যাব ভাবছি,
তখন দেখি কুঞ্জবিহারী বাড়ি ফিরে এসেছে
আর ভাঙা বেড়ার সামনে দাড়িয়ে।
বেড়া কি নিজের থেকে ভাঙলো না
তা কুঞ্জবিহারীর কীর্তি কিনা তাই ভাবছি।
২.
মন
তোমার মন নাই কেন ?
এ আবার কি প্রশ্ন
অঙ্ক কষার খাতা ত সামনে খোলা নেই ।
অঙ্ক মন খাতা
সব মিলে মিশে এই শীতের আকাশে
নীল পাখিটা খুঁজে চলেছে।
একটু আগেই নীল পাখিটা
বাগান হাতড়ে
পাতার ভেতর ঢুকে গেল
আর তাকে দেখতে পাচ্ছি না।
৩.
বৃষ্টি
তখন বৃষ্টি পড়ছিল
অজানা পাহাড়ে যখন উঠছিলাম
তুমি আর আমি
তখন বৃষ্টি পড়ছিল, গুড়ি গুড়ি
ধোঁয়া ধোঁয়া
পেঁজা পেঁজা মেঘও আমাদের সাথে
হাঁটছিল আর বৃষ্টিও পড়ছিল।
সেই প্রথম অজানা পাহাড়ে
সেই প্রথম অজানা পাহাড়ে হাতে হাত
মেঘ ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি স্নাত করছিল
আমাদের।
সেই প্রথম।
সিমলায় প্রথম ভ্রমণ
শুনলাম সেই পাহাড়ের নাম জাকো পাহাড়
জাকো পাহাড়ে আমরা উঠছিলাম।
আমাদের সাথে সাথে উঠছিল মেঘ আর
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি।
পাহাড় আর অজানা থাকছিল না।
সেই প্রথম।
অজানা রহস্য তখন প্রেমাহত।
সেই প্রথম।
সূর্যমুখী
সুজন পণ্ডা
সকাল তখনও ফোটেনি ঠিকঠাক। সূর্যমুখী তার জানালা থেকে তাকিয়ে আছে দুরের দিগন্তের দিকে। ওইখানে কোথায় যেন একটা নদী আছে সে শুনেছে... কি যেন নাম সেই নদীর?
বেশ কিছুটা রাত থাকতেই এই জানালায় এসে বসে সূর্যমুখী। রোজ। প্রতিদিন। অন্ধকারে ঠিক দেখাও যায় না ওকে। কিন্তু বাইরের আলো আঁধার সে বেশ দেখতে পায়। অজস্র নক্ষত্রের আলোয় ঝিলমিল করে বাইরে টা।
এই বাড়িটি এলাকার শেষতম বাড়ি.. বলা যায় এই দিকের একমাত্র বাড়ি। তাই জানালার বাইরে রাত্রির অজস্র বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই নেই। খুব ভালো লাগে সূর্যমুখীর।
বাবা কি আদর করেই না সূর্যমুখী নাম দিয়েছেন... অথচ মেয়ের অভ্যেস সেই নামের এক্কেবারে বিপরীত। সূর্য তার ভালো লাগে না। এই তারায় তারায় ভারী হয়ে থাকা মহাকাশ, এই চাঁদের আবছা জ্যোৎস্নায় ডুবে থাকা প্রকৃতি.. এদের কাছে দিনের কর্কশ সত্যি কোথায় দাঁড়ায়? এই আড়াল টুকু ভীষন রকম আপনার মনে হয় মেয়েটির। এই অন্ধকার তার চুলের অংশ, তার চোখের মণি মনে হয় সূর্যমুখীর।
পাশের ঘরে ঘুমিয়ে তার মা বাবা... ঘুমিয়ে কি? মা-এর আওয়াজ আসে... বাবা বোধ করি পাশ ফিরে শোয়। মা কি টের পায় তার এই উঠে পড়া... পায় হয়তো... না হলে ভোর হওয়ার ঠিক আগে সে কেমন করে মায়ের গায়ের গন্ধ পায়? দরজার দিকে ফিরে চাইলে দেখা যায় না কাউকেই... মা-ও কি দেখতে পায় ওকে? তাহলে কিছু বলে না কেন? জানালা দিয়ে শেষ রাতের যে হাওয়া টুকু তার ঘরে আসে সেই হাওয়া যেন তার বুকের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়... হু হু করে ওঠে বুক। মনে হয় ছুটে গিয়ে ধাক্কা দেয় মায়ের ঘরের দরজায়। জড়িয়ে ধরে মাকে, বাবাকে।
তাহলে নিশ্চয়ই মনের ভুল, মা জানেই না তার এই জেগে থাকা... এই রাত্রি.. এই হীরকখচিত আকাশ এ একান্তই তার।
কোলের কাছে একটা বালিশ টেনে নেয় মেয়েটি। দুরের আকাশে পাখিদের দেখা যায়। ভোর আসতে দেরি নেই আর... পূর্ব আকাশ রাঙা হয়ে আসছে....
****************************
শহরের এই এক প্রান্তে একটা বিরাট বাড়ি নজরে ছিল অনেকদিন। একটি বিরাট ঝিল, হাতের নাগালে ছোট্ট টিলা আর শাল মহুলের জঙ্গল। একটি রিসর্ট বানানোর জন্য আদর্শ পরিবেশ। অনুমতি পাওয়ার ঝামেলা নেই কিছু... পাওয়া যাচ্ছিল না বাড়ির মালিকের খোঁজ। অবশেষে তাও মিলল।
আজ এই বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেলো কলকাতার এক ব্যবসায়ীর কাছে।
একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ আর তার স্ত্রী শেষবার ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন বাড়িটা।
এখানে বহুদিন ছিলেন তারা। স্বামী স্ত্রী ও এক মেয়ে... সূর্যমুখী। অনেকদিন আগে... সেই মেয়েকে এখানেই হারিয়েছেন তারা... জন্মাবধি অসুস্থ সেই মেয়ে মাত্র আট বছর বয়সে মারা যায়... সেই স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ঘরের আনাচে কানাচে। এখনো তার ফেলে যাওয়া হাসির শব্দ এই ঘরে ঘুরে বেড়ায়... এখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তাদের... তাই আগেই ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছিলেন বাইরে।
বাড়িটি বিক্রির ইচ্ছে ছিল না যদিও... কিন্তু অবশেষে তাতেও রাজি হলেন।
ঘুরতে ঘুরতে তারা তার মেয়ের ঘরে এলেন... খোলা জানালা দিয়ে হাওয়া নাকি অন্য কিছু ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো দুজনকেই। দুজনের চোখেই জল... দুজন নাকি তিনজন? নাকি বাড়িটিও কেঁদে উঠল ওই দিগন্তের দিকে তাকিয়ে?
রোহিনী :পশ্চিম সীমান্ত বাংলার কৃষি উৎসব
তপন পাত্র
আজ ১৩ জ্যৈষ্ঠ। রোহিনী উৎসব ।রোহিন পরব ,বীজপুহ্ণাহ্ , বিচপুহ্ণা।
রোহিন পরব কী ? পুরুলিয়া তথা মানভূম তথা পশ্চিম সীমান্ত বাংলার এক কৃষি মহোৎসব ।
"রোহিনী" থেকে "রোহিন" । কে রোহিনী ? সহজ উত্তর --দক্ষ প্রজাপতির কন্যা , সোমদেবের স্ত্রী , বলভদ্রের জননী ।
বলভদ্র মানে হলধর,বলরাম । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বড়ো ভাই ।
ভারতীয় লোকবিশ্বাস হলধর কৃষির দেবতা । হল ধারণ করেন যিনি , তিনিই তো হলধর । এই হলধরের জননী , নক্ষত্ররাণী রোহিনী আজ পৃথিবীর সবথেকে সন্নিকটে বিরাজ করেন । তাই এই শুভ দিনে বীজ ব্যপন করলে আমনের ফসল হবে ভালো , সীমান্ত বঙ্গবাসী এই ধারণা মনেপ্রাণে লালন করে আজও ।
এমনিতেই তো পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় প্রবাদ আছে "চাষ নাই বাস টুরুই ব্যাঙের আশ" । একটানা কয়েকদিন বৃষ্টি ঝরতে থাকে যদি , তবে 'টুরুই' ডাকে । তবে এখানে চাষ । মেঘের প্রসন্ন দাক্ষিণ্যই আজও এখানে কৃষিকাজে অগতির গতি । কত কিছু এল গেল , কত নব নব ইতিহাস রচিত হলো , কিন্তু এই এলাকার কৃষির উত্তরণের স্বার্থে ছিটেফোঁটাও বন্দোবস্ত হল না আজও । অগত্যা প্রকৃতির প্রফুল্ল দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে , বহু আশায় বুক বেঁধে কৃষক ও কৃষি শ্রমিক আজ নির্দিষ্ট কোনো ক্ষেতের কোনে পূর্ব-প্রস্তুত মাটিতে প্রতীকী বীজ বোনে । আঞ্চলিক ভাষায় এর নাম "বিচপুহ্ণা" ।
তবে এই বিচপুহ্ণার দিন সেই সমস্ত কৃষকেরা আর প্রতীকী বীজ ব্যপন করেন না , যাঁরা রোহিনীর কয়েক দিন আগেই "অক্ষয় তৃতীয়া" তিথিতে এই কর্ম সম্পাদন করে থাকেন । অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিও এই অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের জীবনে একটি পবিত্র দিন । এদিন অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে আমন ধান চাষের শুভ সূচনা করেন "বিচপুহ্ণা"র মধ্য দিয়ে । মানভূমবাসীর ধারণা বা লৌকিক বিশ্বাস , এই শুভদিনে কৃষিকর্ম আরম্ভ করলে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হবে না , ফসল অক্ষত থাকবে । "অক্ষয়" শব্দটির আভিধানিক অর্থ "যার ক্ষয় নাই" । বৈদিক বিশ্বাস অনুসারেও এই তিথিতে কোন শুভ কাজ আরম্ভ করলে তা অক্ষয় হয় , অক্ষত থাকে । ধরিত্রী মাতা কে ঊর্বরা , বসুন্ধরাকে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা করার জন্য ভগীরথ এই দিনে স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন বলেই ধারণা ।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য মানভূম তথা সমগ্র পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় একদা কৃষি নববর্ষের শুরু হতো পয়লা মাঘ । এই অঞ্চলের আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে মাঘ মাস এখনো নববর্ষের প্রথম মাস । অসাঁওতাল কৃষিনির্ভর সভ্যতায় সময়ের সাথে সাথে নববর্ষের প্রথম মাস মাঘ মাস থেকে বৈশাখে পরিবর্তিত হয়েছে । কিন্তু এখনও এখানে কৃষি জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম কানুন পয়লা মাঘকেই কৃষি নববর্ষের সূচনা মাস ব'লে ইঙ্গিত করে । যেমন এই দিন চাষী তার কোনো নির্দিষ্ট জমিতে "আড়াই পাক" লাঙ্গল চালিয়ে বৎসরের প্রথম হালচালন অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করে । তুলনামূলকভাবে সম্ভ্রান্ত কৃষকের কৃষিকাজের সহযোগী মানব সম্পদ কামিন , মুনিষ , বাগাল ভে"তার বাৎসরিক স্থায়ী কর্ম সম্পাদনের শেষদিন পৌষ সংক্রান্তি আর পুনর্বহালের সূচনা দিন পয়লা মাঘ । কাজেই শুধুমাত্র রোহিণীর দিন নয় , অক্ষয় তৃতীয়া এবং পয়লা মাঘ অর্থাৎ "আখিয়ান যাত্রা" বা "আ'খান যাত্রা"র দিনটিও কৃষি কর্মের সূচনা সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত ।
যাইহোক রোহিনীর আগের দিন বারোই জ্যৈষ্ঠ-ই পরবের সূচনা হয়ে যায় । কথায় আছে ,"বার দিনে বারনি , আর তের দিনে রোহিনী ।" বারনি অর্থাৎ বার ।
যে কোনো মাঙ্গলিক ব্রত, উপবাসের আগের দিনকে বার বলা হয় । এই দিনটি নিজেকে বা নিজেদের শুচি করে তোলার দিন । নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নেবার দিন । বারই জ্যৈষ্ঠর পর তেরই জ্যৈষ্ঠ পবিত্র রোহিনীর দিন । এ দিন ঘর-সংসারের মহিলারা সকাল সকাল নিজেদের উঠোনে গোবরের ছঁচ দেয় , খড়িমাটির আলপনা আঁকে । অংকন করে মা লক্ষ্মীর কাল্পনিক পদচিহ্ন । একটু বেলার দিকে , কোনো কোনো এলাকায় বিকেলের দিকে একটি নির্দিষ্ট চাষজমি থেকে কৃষাণী নিজে অথবা বাড়ির "কামিন বউ" ন'বার বাঁশের ঠে'কাঝুড়িতে করে মাটি এনে রাখে গৃহের তুলসী মঞ্চের পাশে কিংবা গোয়াল ঘরে গরুর দনের কাছে । এর নাম "রোহিন মাটি" । যখন মাটি আনতে যায় তখন বাঁশের ঝুড়িটিতে তেল-সিঁদুরের তিনটি, পাঁচটি অথবা নয়টি তিলক রেখা টেনে দেওয়া হয় আর একখন্ড লৌহ রাখা হয় । প্রাচীন বুড়ো বুড়িদের মতো আজও এলাকাবাসীর বিশ্বাস তাহলে ঝুড়িতে কেউ কুনজর দিতে পারবে না । মাটি আনার সময় গ্রামের বা পাড়ার বালক-বালিকারা সারা মুখে কালি-ঝুলি রং মেখে সং সেজে ছড়া কেটে, গান গেয়ে মাটি বাহিকাদের হাসানোর ও কথা বলার চেষ্টা করে । কিম্ভুতকিমাকার আকৃতির বাঁদর, ভালুক সেজে নাচ করে । রীতি আছে, এ সময় তাদের হাসতে নেই, তাই হাসানোর জন্য এই প্রয়াস । এই প্রয়াস আনন্দ-স্ফুর্তি-বিনোদন ছাড়া কিছু নয় । যারা মাটি আনে তাদের স্নানের জন্য থাকে ঝাঁঝালো সর্ষের তেল, সুগন্ধি সাবান আর কেশ প্রসাধনের জন্য ফুলাম তেল ; আয়েশ ক'রে খাবার জন্য মহুল ফুলের পাগ আর আতপ চালের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি সরু চকলি পিঠে ও মিঠে পায়েশের ব্যবস্থা ।
এদিন যে সমস্ত গানগুলো গাওয়া হয় , সেগুলো এখন প্রায় লুপ্ত । এখনো দু-চারটি গান শোনা যায় , তবে সেগুলোর টুসু গান ও বাঁদর নাচের গানের সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে । সময়ের স্রোতে সেগুলো এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে , যে বোঝাই যায়না এগুলো রোহিনীর গান না অন্য কোন লোকগান । কারণ এই গানগুলি চিরকাল মুখে মুখে ফিরেছে, এগুলোর কোনো নির্দিষ্ট লেখক লেখিকা নেই আর লিখিত, মুদ্রিত রূপও নেই ।
যেমন --
১. মসি দড় দড় দড় গো কাওয়াই জুনহার খা'ছে ।
আগু ধারে ক্ষেদতে গেলে পেছু বাটে যা'ছে।।
২. ই ডাঙ্গায় উ ডাঙ্গায় পিয়াল পা'কে'ছে ।
যা'সনা বুড়ি পিয়াল খা'তে শিয়াল খে'পেছে।।
৩. সাগ রাঁ'ধতে ব'লেছিলি কোচু রাঁ'দেছে ।
সুয়াদে সুয়াদে বহু খাঁইয়ে ফেলেছে।।
৪.আম ধরে থপা থপা তেঁতুল ধরে বাঁকা ।
নামল দেশে দে'খে আলি রাঁঢ়ির হাতে শাঁকা।।
৫. আঢ়ে আঢ়ে যায় ভালুক ভুকু কুঢ়ে খায় ।
কাল শ্যামকে দেখে ভালুক লঢ়াই লা'গে যায়।।
উল্লিখিত তৃতীয় গানটি বাঁদর নাচের গান বলেই অধিক পরিচিত । এদিন বালক-বালিকারা বাঁদর সেজেও নাচানাচি করে , সেই সূত্রে গানটি এসে রোহিনী গানের সম্ভারে প্রবেশ করেছে বলে মনে হয় ।
রোহিনীর গানের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত গানটি হল ---
"ছেল্ বাঁদরি ছেল্ ছেল্ ছেল্ ,
আৎনা পাতের দশনা, তোর হিলো কানের সোনা ।
দনায় দনায় মেল খাঁইয়েছে ,
লিবো কানের সোনা ।
ছেল্ ছেল্ ছেল্ ।"
ঠিকমতো বৃষ্টি হলে রোহিনীর পরই , রোহিন বতরে আমনের চারা ফেলার কাজ চলতে থাকে । ধানের ঝুড়িতে বা বস্তায় অল্প রোহিন মাটি সহ বীজ যায় মাঠে। বিশ্বাস তাহলে রোগপোকার তাণ্ডব আসবে না ।
এ দিন প্রত্যুষে ঘরের চারদিকে গোবরের রেখা টানে মেয়েরা । রাবণ আড়ালের লক্ষণ রেখার মতো সরীসৃপ ঠেকানোর রোহিণীরেখা । নিয়ম করে খাওয়া হয় "রোহিনী ফল" । অন্য নাম "আষা'ঢ়া ফল" বা "কে'লাকটরা" । সবুজবর্ণা অতীব তেঁতো স্বাদের ফল । মানুষের বিশ্বাস এটি সাপে কাটা রোগীর এবং চর্ম রোগের প্রতিরোধক আয়ুর্বেদ । এমনকি হঠাৎ কাটাছেঁড়া হলে মানুষ রোহিন মাটি গুঁড়ো করেই ক্ষতস্থানে লাগাতো একদিন , এখনো দিব্যি লাগিয়ে থাকে কেউ কেউ । তাইতো মহর্ষি সুশ্রুত এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় 'রোহিণী ' মানে 'নিরাময় কারী', 'রোহিণী ' মানে 'ত্বকীয় উপসর্গের নিরাময়'।
আবার "রোহিণীদান" বলেও একটি শব্দবন্ধ আছে। আছে "গৌরীদান" । "কন্যাদান" । "অষ্টম বর্ষ ভবেৎ গৌরী, নববর্ষাতু রোহিণী "। আট বছরের মেয়েকে পাত্রস্থ করার রীতি "গৌরীদান" । নয় বছরে বালিকার বিবাহ দান "রোহিনীদান" । আর দশ থেকে বারো হলে "কন্যাদান" । গৌরীদানে পিতা-মাতার স্বর্গলোক বাস । রোহিনী দানে বৈকুণ্ঠ লাভ । আর কন্যাদান উৎকৃষ্টতম । এতে ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি ।
আমাদের যাবতীয় কৃষি সংস্কারের সাথে উৎপাদন
ধারণার নিবিড় সংযোগ । এদেশে কুমারীরা ৮ - ৯ থেকে ১২ বছরের মধ্যে রজস্বলা হয় । ধীরে ধীরে রতিসুখাকাঙ্ক্ষা জাগে । যার পবিত্র দিকটি হল সৃজন , সৃষ্টি । মেয়েরা বারো মাসে তেরো বার ঋতুমতী হয় । সম্ভবত সেখান থেকেই উঠে এসেছে "বারো মাসে তেরো পরব "-এর মত জীবন্ত প্রবাদ । উৎপাদন জীবনের শ্রেষ্ঠ মহোৎসব ।
এই রোহিনী মহোৎসবের দিন গ্রামীণ ছেলেছোকরারা রং মেখে সং সাজে । ঢাক ঢোল মাদল কাড়া-নাকড়া বাজিয়ে ছড়া কেটে গান গেয়ে নেচে বেড়ায় গ্রামে গঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় । অনেকেই ব্যাখ্যা করে থাকেন এটাই নাকি পুরুলিয়ার ছো নাচের আদি উৎস । সে যাই হোক, এই গানগুলির সাথে কোথা থেকে যেন ভেসে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় কৃষিপ্রেমিক রবি ঠাকুরের সৃজন সংগীত --"আমরা চাষ করি আনন্দে..."
(জুন মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে "লোকসংস্কৃতি লোকযান"গ্রন্থখানি। এতে রয়েছে মানভূম-পুরুলিয়ার প্রায় সারা বছরের লোক উৎসব-অনুষ্ঠানের কাহিনী। প্রকাশিতব্য গ্রন্থটি থেকে একটি প্রবন্ধ এখানে তুলে ধরা হলো।)
______________________________________________
আমাদের বই
সম্পাদক : উত্তম মাহাত
সহায়তা : অনিকেতের বন্ধুরা
অলঙ্করণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পেন্টিং, আন্তর্জাল
যোগাযোগ : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৯৩২৫০৫৭৮০
ইমেইল - uttamklp@gmail.com
পড়লাম, বেশ কিছু কবিতা ভাল লাগল, দূর্গা দত্তের কবিতা মনে পড়ছে, সুজন পান্ডার গদ্য...ভাল থাকবেন, এগিয়ে চলুক অরন্ধন।
উত্তরমুছুন