ডরোথী দাশ বিশ্বাসের এক গুচ্ছ কবিতা
১.
অতীত...
শান্ত দীঘির জলের মতো স্বচ্ছ মন নিয়ে বসে থাকি আজকাল,
যেখানে স্মৃতিরা উত্তাল হয় না আর,
আবেগ তৈরী করেনা কোন রঙীন বুদ্বুদ,
সে জলে শুধু দেখি এক রুক্ষ শুষ্ক বিষাদময়ীর প্রতিবিম্ব।
আঁজলা ভরা জল তুলে নিই চট্ করে,
ধুয়ে ফেলি মুখ,
কেঁপে ওঠে সে মুখচ্ছবি,
ভেজা হাতের তালুর দিকে চোখ পড়ে যায়,
রেখায় রেখায় লুকোনো কষ্টরা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যতোই বলো,এ যে পিছু ছাড়ে না।
কষ্টগুলো যে আমার ভীষণ চেনা।
নাহ্!আর ভাববো না।
২.
বসন্তলিপি...
ভীষণ ইচ্ছে,পলাশের রঙ নিই,
বনেতে আগুন,নবপল্লব ডাকে,
দিগন্ত নীল,সেও ডাকছে আয়,
ঠোঁটের খেয়ায়,তনুমনের বাঁকে।
অঞ্জলি ভরে কাজলা নদীর জলে
ভিজিয়ে দিলাম নুড়িমালাপ্রান্তর,
ছাপোষা এই জীবনযাপন ভাবে,
জ্যোৎস্না কিভাবে ভরে দেয় অন্তর!
শিকড় ছড়ায় বন্ধুবৎসলতা,
মোহন বাঁশি বাজায় প্রাণে প্রাণে,
ছেড়ো না কখনো হাত বিশ্বস্ততার,
ভুলে যেও না,নদী সব কথা জানে।
বসন্তে ফুল ছড়িয়ে হলুদ পরাগ
কপালে আঁকে প্রেমের তিলকখানি।
অতীত যেন কখনো হয় না ধূসর,
সোনার জলে লেখা থাক সে বানী।
৩.
কিছু অনুভবে...
(১)
অযাচিত কোন প্রশ্ন নয়,
নয় প্রেক্ষিত উত্তরের আশা,
পর্বতের মতই মহিমময় হতে পারি আমি,
কোন দুঃখবোধ পাবে না আর ভাষা।
(২)
তুমিও বুঝে গেলে শেষে
তোমাদের মতো নই আমি,
আমি যে সহমর্মী অরণ্যের মতো,
এ কথা শুধু জানে অন্তর্যামী।
(৩)
মেঘেরও ঝরার বেলা এলে
কার্ণিশ ছুঁয়ে নামে ভালোবাসা,
এ যেন অহঙ্কারের সাঁকো ভেঙে
সহজের কাছাকাছি আসা।
(৪)
বহুদিন আগেই নিয়েছি
হৃদয়হীনতা থেকে বিদায়,
খুলে দেখাও হৃদয়ের ধন
যারা সদ্য চিনেছে তোমায়।
৪.
হে পরমেশ্বর...
হে পরমেশ্বর,অর্ধচন্দ্রশোভিত জটাজুটধারী,পরমসত্ত্বা তুমি হে,
তুমি জন্মরহিত,শাশ্বতরূপ-স্ব স্বরূপে বিরাজিত তুমি হে।
তুমি জ্যোতির জ্যোতি,তুরীয়,অন্ধকারের অতীত,আদি ও অন্তহীন জানি।
হে ত্রিশূলধারী,দক্ষিণকর পরশুশোভিত,পাশুপতাস্ত্র তোমারি হে,হে পিনাকপাণি।
জটাবদ্ধ সুরধুনী,গলদেশে বাসুকীনাগ,ব্যাঘ্রচর্মাবৃত উরু,
বসনভূষণহীন,নীলকন্ঠ তুমি হে,সদানন্দে বাজাও ডমরু।
সৃষ্টি-স্থিতি-লয়,যার ইচ্ছেতে হয়,মর্তে নামে অমর্ত্য গোধুলি,
ছেড়ে করাল রুদ্র রূপ,শান্তসমাহিত রূপ সৃষ্টি করে শিল্পীর তুলি।
৫.
ফুরিয়ে যাইনি ভীষণ অপচয়ে...
সময় সাঁকো পার হয়ে আসে দিন
গ্রহের গতিপথও বদলে যায়
গহন অরণ্য পেরিয়ে যাই আমি
উৎস থেকে নদীর মোহনায়।
চড়াইপথে সুসজ্জিত বাড়ি
স্বপ্নে ওড়ে পক্ষীরাজ ঘোড়া
নিশাকাশে দোল পূর্ণিমা চাঁদ
আগাগোড়া সোনার পাতে মোড়া।
জ্যোৎস্না মেখে করেছি শুচিস্নান
চোখ মুখ ধুয়েছি সোনার আলোয়
পায়ের নীচে তিস্তার জলনুপূর
শব্দ তোলে নুড়িপাথরমালায়।
এমন আলোয় খুব এড়ানো যায়
ঈর্ষা অবহেলা ও সংঘাত
পায়ের নীচে দূর্বা কোমল ঘাস
অবহেলা সয় কতো দিন রাত।
ভাবনারা তো ইচ্ছে মতো ঘোরে
চিনে নিয়ে মনের অলিগলি
কখনো কিন্তু ক্লান্তি ধরেনা ঘিরে
চেনাফুলে গুঞ্জন তোলে অলি।
লতার দোলায় দোদুল দোলার স্মৃতি
তাড়া করে এখনো দিবানিশি
বন্দীদশায় মনটা হয়নি শক্ত
এখনো সরল তেমনই বিশ্বাসী।
কত অমানিশা কত পূর্ণিমা গেলো
মেঘে মেঘে মিশে যাইনি কখনও ভয়ে
মাটির কন্যা মাটিতে রেখেছি পা
ফুরিয়ে যাইনি ভীষণ অপচয়ে।
৬.
জগৎ সংসার...
আলো ফোটে, আসে এক সোনাঝরা দিন
পাখি জাগে,প্রাণ জাগে,ধরনী রঙীন।
ছায়া কালো দিগন্তে রঙের বিস্ফোরণ,
পক্ষীকুলেও দেখা যায় সম্পর্কের সমীকরণ।
সংসার যার খড়কুটো, তারও অপত্যস্নেহ অগাধ
বান ডেকে যায় মায়াবী আলোয় স্বজাতিপ্রীতি অবাধ।
মনুষ্যেতর পক্ষীকুলও পারেনা এড়াতে দায়,
আপন সন্তানেরে করে না হেলা চরম উদাসীনতায়।
গাছে পাতায় শাখায় শাখায় রোদ-বৃষ্টি-জলে
এভাবেই না কি তারা ভালোবাসার কথা বলে।
উত্তোলিত ডানায় কূজনে কূজনে প্রতিদিন আনে ভোর,
কখনো চমক জ্যোৎস্নাভেজা রাতের প্রথম প্রহর।
নগরআকাশ মেঘমালা আর নিঃসঙ্গতা নীল,
বয়ে যাওয়া হাওয়া পারে না আঁটতে ছোট্ট হৃদয়ে খিল।
যা রে যা ... ছোট্ট প্রাণ ... আলোয় ধুয়ে গা,
যা তুই ... আকাশের ... দিকে ভেসে যা ...।
৭.
দোল...
আয়রে সখী আনরে বীণা
প্রাণ খুলে গান গাইবি আয়,
আয়রে সখী মেলরে আঁখি
উড়িয়ে আঁচল বসন্ত বায়।
আয় যেখানে বাউল গানে
মাটির টানে উদাস সুর,
আয়রে সেথায় পলাশছায়ায়
মন ভেসে যায় স্বপ্নপুর।
আয় সখীগণ ঘুচিয়ে কাঁদন
বাজিয়ে কাঁকন রিনিঝিন,
আয় উড়িয়ে বিজয়কেতন
জাগিয়ে চেতন বাজিয়ে বীণ।
মাতছে আকাশ ফুটছে পলাশ
রাঙছে ভুবন রঙেতে,
দোলের খেলায় মিলনমেলায়
আয় এবেলায় সঙ্গেতে।
৮.
যা গিয়েছে হারিয়ে...
পায়ের তলা থেকে যদি মাটিই খসে যায়,
কি আর হবে ভেবে ভেবে,
কেনই বা হায় হায়।
ধান তোলা শীতের মাঠ সূর্য যদি চুমে,
ভাবনাদের পাঠিয়ে দিও
বেমালুম শীতঘুমে।
দিকে দিকে দেখো চেয়ে ঘাসেদের আলপনা,
কোরো না তার অনুসন্ধান,
আর তারে খুঁজো না।
হৃদয় তোমার নিষ্ক্রিয় হোক বেদনা কর্ষণে।
দুঃখবিলাস পায় না শোভা
যাপিত জীবনে।
অবলীলায় ভাঙতে পারি শতদুঃখ সোপান,
মৃত্যু এলেও ধরবো আমি
অমৃতেরই গান।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন